
লেখকঃ কাব্য
এক.
মাঝে মাঝে কোত্থেকে যেন আসে এমন সুন্দর সকাল। শুধু থাকেনা দেখার মত চোখ আর চৈতন্য। যে ম্যাগাসিটি সময়ের ইটকাঠ আর সিমেন্টের রুক্ষতায় হারাচ্ছে তার ঝকঝকে সবুজ বরন।প্রতিদিনের বাড়ন্ত মান,কলকব্জার একঘেয়ে কোলাহলে;অন্তরীক্ষের যন্ত্র পক্ষীর শব্দে জটিল কঠিন,রাস্তাঘাটে গ্রাম থেকে ছুটে আসা নিত্যনতুন মানুষের আশাবাদী আনাগোনা। কারনে অকারনে মিছিল মিটিং। উত্তপ্ত শ্লোগান।আরো কতো কী! এক কথায় অবাঞ্চিত উতপাত। এমন মহানগরীর একটি ভোর যে এত নির্মল আর মিষ্টি হতে পারে,কঠিন জীবনসংগ্রামের নিরেট বাস্তবতায় তা অনেকদিন ধরা দেয়নি প্রানের ঘন গভীর অনুভবে! গোল টেবিলে ছড়ানো কিছু এডফার্মের কাগজপত্র। রায়হানের হাতে একটু আগেও সাইনিং পেন ছিল! কয়েকজন উঠতি পারফরমারের ছবি। অবনী রেখে গিয়েছে ধুমায়িত কড়া লিকারের পেয়ালা। রায়হান উঠে এসে দাঁড়ালো কুমড়ো ফালি প্যাটার্নের বারান্দার রেলিং এর কাছে।জায়গাটি শহরের হৃদপিন্ডে। চওড়া রাজপথে যানজট তেমন একটা হয়না।রায়হান উপভোগ করতে লাগল নাগলিঙ্গম,রাধাচূড়া,কৃষ্বচূড়া,বটল ব্রাসের সৌন্দর্য্য!যতদূর চোখ যায় কেবলি লাল,বেগুনী,ম্যাজেন্টা,হলদে ফুলের ঢেউ খেলান পুষ্পের বাহার!সব না হলেও কোনো কোনো গাছের নাম জানে সে। পথের ওপারটা সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পাড়া।নিষ্ঠুর বৃক্ষ নিধন পর্ব তাই কখনো হয়নি। প্রতি বছর ফোটে ওইসব ফুলেরা। সকাল বিকাল কিচির মিচির করে আশ্রিত পাখিরা।হঠাত করে ঘুম ভাঙ্গে কোকিলের ডাকে।জীবনের যান্ত্রিক চাপে অনেকদিন এইসব ভুলে আছে রায়হান।
-কী ব্যাপার?চা যে পানি হয়ে গেল!
অবনীর ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পায় রায়হান।
-যেতে দাও!
-আর এক কাপ নিয়ে আসব?
-নাহ। একদম না।
-কি আশ্চর্য!এসময় এককাপ চা না হলে-
অবনীর কথায় বাধা দিয়ে রায়হান বলে,
-পানীয় তো কত রকমের হয়।এই যে ফুল পাখি মিষ্টি রোদ হাওয়া প্রকৃতির নির্যাস ভরে দিয়েছে সব তৃষ্মা!
-এতকাল পর কি যৌবনের কাব্যিক ভূতে ধরেছে তোমায়?
-নাহ!কবি কখনো ছিলাম না।তবে ছোট পর্দার নায়ক ছিলাম!উঠতি অভিনেতা। তাইতো তোমার বাবা নিজের মেয়েকে তুলে দিতে চায়নি এমন চালচুলোহীন ভ্যাগাবন্ডের হাতে। তারপর ছিল আমাদের ধর্ম নিয়ে সমস্যা।মনে আছে তোমার?
-তুমি ভুলেছ?
-না,তোমার কাছে সেটা রোমান্টিক স্বপ্ন হলেও আমার জন্য ছিল তার আরেক চেহারা!
-তাই বলে আমি কখনোই তোমায় অভিনয় পর্বের টপফর্ম থেকে সরে আসতে বলিনি।
-তা বলনি,তবে আমার কাঁধে যে দায়িত্ব ছিল,তা তো এড়াতে পারিনা।নতুন সংসার,তারপর আমাদের সন্তান! তাইতো সব বিবেচনা করে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে চলে গেলাম কামালের ডাকে পারফর্মিং আর্টসের ব্যবসায়!তা না হলে হইত আজ এই অবস্থানে আসতে পারতাম না!
-তুমি কি অভিযোগ করছ?
-নাহ,ওটাতো আমার কর্তব্য ছিল। দেখো,আজ আমাদের সংসার,গাড়ি বাড়ি,আমাদের দুই মেয়ে।সব মিলিয়ে কি সুখের সংসার! তুমি খুশী তো?
-কিন্তু স্বপ্ন বিসর্জনে যে আমাকেই অপরাধী করে দিলে তুমি!
-এইভাবে বলনা।এতে তোমার কোন অপরাধ ছিলনা।নিজের স্বপ্ন আমি ভেঙ্গেছিলাম। তাইতো মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম নিজে অভিনয় না করি,ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে খুলে দেব তার উত্তরণ দরোজা।সেই হবে আমার সাফল্য।
ঘুরে দাঁড়িয়ে রায়হান কিং সাইজ সিগারেট ধরাল!এমন সময় টেবিলের এক দিকে রাখা মোবাইল বেজে উঠল। কেউ খেয়াল করলনা।
-কিন্তু সেই সঙ্গে এও সত্যি, আমার ফেলে আসা যৌবনের আকাঙ্গক্ষাকে কখনো আমি ভুলতে পারিনি।
এমন কথাবার্তায় ওদিকে সিগারেট শেষ হবার আগেই রুক্ষ আঙ্গুলের চাপে এসট্রেতে সেটার ঘাড় গুঁজে দিল। আর একটি সিগারেটের মুখে আগুন জ্বেলে বিচিত্র,বিদগ্ধ,দুর্বোধ্য হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে রায়হান বলল,
-বলি স্বর্গ।আজ আমার সব আছে। তুমি সুখী।জলি মলি সুখী।আর কি লাগে!এইতো স্বর্গ।আর সেই স্বর্গের প্রধান পাহারাদার আমি।
আবার চিৎকার করছে মোবাইল। সেটা তুলে সিগারেট ঠোঁটে কথা বলল রায়হান,
-ইয়েস স্পিকিং
ওদিকে শোনা গেল কামালের বিচলিত কন্ঠস্বর,
-তুমি কি আজ আসবে না?
-ইচ্ছে করছে না।
-প্লিজ এসো!এদিকের অবস্থা বেহাল। মডেলিং-এর ইন্টারভিউর জন্য এ দেশের ছেলেমেয়েরা এত আগ্রহী। যাদের ডাকা হয়েছিল,দুগুন বেশি এসেছে।বন্যার স্রোতের মতো আঙ্গিনা দখল করে নিয়েছে। মুশকিল তারা আবার বিপ্লবীদের মত জোকার দিচ্ছে,তাদেরও কল করে একটিবার চান্স দিতে হবে। বুঝতেই পারছ আজকালকার বেজাহানী পোলাপান পারেনা এমন কিছু নেই। দেরি হচ্ছে বলে অফিসের দরজা জানালা-
-যা হয় প্লিজ নিজেরা করো।
-বুঝেছি,নসটালজিয়ার রোগে ধরেছে। স্পোর্টসম্যান স্পিরিটে ঝেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পর। প্লিজ!
-ঠিক আছে।আসছি।
-প্লিজ!তাড়াতাড়ি এসো!
রায়হান যেন ঝাকুনি দিয়ে নিজেকে তুলে নিল চেয়ার থেকে।রাতের পোশাক খুলতে খুলতে বলল,
-অবনী একটু ঘুরে আসি।
-এইনা বললে আজ যাবে না। শরীর খারাপ লাগছে।
-তা কি আর চাইলেই পারি। কামাল বলে আমার নাকি লোহার শরীর।হবেও
বা।নইলে এই পঁয়তাল্লিশেও তারুণ্যের ছাপ চেহারায়।জীবনযাপনের ধরন যুবকদের মতো!
বলতে গিয়ে লক্ষ করল অবনীর মুখের আলো কেমন যেন নিভে এসেছে।
-এই কি হল?
স্বামীর কোট পরতে সাহায্য করে অবনী বলল-না কিছু না। তখন মৃদু হাসল রায়হান-আরে আমার ভাল থাকা মানেই তো তোমারও ভাল থাকা।
-তা ঠিক।তবে নায়ক যখন ছিলে আমাকেও সতর্কতার সাথে নায়িকাদের মতো স্মার্ট থাকার সাধনা করতে হত। হেসে দিয়ে বলল,
-এ বয়সে বাপু আর তেমন করতে পারব না।
-কে বলেছে পারতে?তুমি আমার জলি মলির মা-এর চেয়ে মজবুত পরিচয় আর কি আছে?
টাই-এর নট ঠিক করে ঘর থেকে বেরুল রায়হান।
দুই.
অফিসে এসে দেখল সত্যি এলাহি কারবার। কয়েক বছর আগেও
যে নেন্সা বা পোশাকে ভালো চোখে দেখা হতনা,প্রবীনদের সেই সামাজিক দৃষ্টির আমুল পরিবর্তনের জন্য দল বেঁধে পথে নেমেছে নবীনরা। শিক্ষিত আদব কায়দা দুরস্ত ভদ্রঘরের সন্তানরা। এও এক ধরনের জীবন দর্শন,এ পথের পুরোধা পুরুষ তাদের মতো কিছু স্বপ্নদ্রষ্টা।একসময় এ পথে পা বাড়াতে গিয়ে কম ব্যঙ্গ বিদ্রোপ সহ্য করতে হয়নি। নিজের টেবিলে বসে টাইয়ের নট সামান্য আলগা করে রিলাকস মুডে পিয়ন আফজালকে বলল কড়া করে এক কাপ কফি দিতে। কথার মাঝে দোতলার রক্ষীকে বলতে গেল,এমন সময় ঠেলে ভেতরে টেবিলের ওপাশে এসে দাঁড়ালো সদ্য তরুন এক ছেলে।আদাব না,সালাম না,সরাসরি অভিযোগ,
-দেখুন তো কি কান্ড! আপনাদের ঐ বুড়োটা বলে কিনা আপনার সাথে দেখা করতে বিশেষ পারমিশন চাই।আরে ভক্ত আসবে তার প্রিয় শিল্পী দর্পনে,সেখানে এত বাধা নিষেধ কিসের?
-তুমি কে?
-কেনো ঐ যে একটু আগে বললাম ভক্ত।
-তাদের নামধাম তো থাকে!
-সুযোগ পেলাম কোথায়?নাম ঋদ্ধ। ফারহান ইহসাস ঋদ্ধ। বাবাকে হয়তো দেখেছি।মনে নেই। পন্ডিতরা বলেন মানুষের স্মৃতি তিন বছর বয়স থেকে শুরু হয়।বাবা যখন সবকিছু ফেলে নিষ্ঠুরের মতো আকাশে চলে গেলেন তখন আমি চার-এ।কিন্তু ব্রেইন খুব সার্প ছিলনা বলেই বোধহয় কিছু মনে করতে পারিনা।। ছবি দেখে খুশি হতে পারিনা। আমার চাই রক্ত মাংসের মানুষ।যে আমায় আদর করবে। আমি যাকে ভালবাসব।
হঠাত কিছু খেয়াল করার ভঙ্গিতে ঋদ্ধ আবার বলল,
-কি আশ্চর্য! সেধে এসেছি বলেকি বসতেও বলবেন না?
নিজেকে তখন খুব আন্সমার্ট মনে হল রায়হানের।ক্ষিপ্রতায় বলল-বস!চেয়ার তো তোমার কাছেই আছে! বসতে বসতে ঋদ্ধ বলল,
-তবুও ভদ্রতা বলে তো একটা কথা আছে।
আফজাল কফি নিয়ে আসতে রায়হান ইঙ্গিতে বলল,ওকে আগে দাও।
ঋদ্ধ বাধা দিয়ে বলল,
-না না তা কী হয়!আপনি বরং আর এক কাপ নিয়ে আসেন।
কফি এলে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে ঋদ্ধ ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বোলাতে লাগল।সেই ফাঁকে ছেলেটিকে ভাল করে খেয়াল করল রায়হান।বিশ একুশ বছরের সদ্য তরুন। গলায় ‘R’ চিহ্নের হোয়াইট গোল্ডের লকেট।বা হাতে হলদে নীল বেল্ট ঘড়ি। ব্লু জিন্স আর হলুদ রঙ্গের টি-শার্ট পরেছে।পায়ে গ্রিন কনভার্স। দেখতে দেখতে সিগারেট ধরিয়ে রায়হান প্রশ্ন করল,
-তুমি কি ইন্টারভিও দিতে এসছিলে?
-এসেছিলাম এবং উতরেও গেছি কিন্তু রণর জন্য খুব ফিল করছি।বেচারা পুয়োর সোল আনফিট হয়ে-
-রণ কে?
-আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।ওইতো এখানকার সলুক সন্ধান দিয়েছিল।আমরা একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। ঘোরাফেরা করি একসঙ্গে।এখন আপনাদের এখানে এসে বেজোড় হয়ে গেলাম।
-ও,সে কোথায়?
-হবে রাস্তার কোন মোড়ে!আচ্ছা? আপনার তো শুনেছি অনেক ক্ষমতা। পারেন না ওর জন্য কিছু করতে?
-এই মুহূর্তে নয়। পরের সেশনে দেখা যেতে পারে। রায়হানের মুখ গম্ভীর হচ্ছিল।ঋদ্ধ চকিতভাবে বলল,
-কি? আবার ভেবে বসবেন না যেন ওর উমেদারিতেই এসেছি।
যে হাতটা রায়হানের টেবিলের উপর,ঝপ করে নিজের ডান হাতটি সেখানে ফেলে ঋদ্ধ আবার বলল, ছুঁয়ে বলছি।
এইবার না হেসে পারলনা রায়হান।
-আচ্ছা ঠিক আছে। একদিন ওকে নিয়ে এসো।
ঋদ্ধ সস্তি পেয়ে আবার বলে,
-জানেন?আমি না আপনার যেখানে যতো ইন্টারভিউ চোখে পড়েছে,কেচি কাটা করে ফাইল আপ করেছি।আপনার ছবি রয়েছে আমার টেবিলে। আমি বলি প্রেরনা মা বলেন খেয়ালের পাখি।রণ কিন্তু নাম্বার ওয়ান হিংসুক এ ব্যাপারে।ও যে রুমে জুলিয়া রবার্ট কেনো সেরহয়া বড় পোস্টার লাগিয়ে রেখেছে আমি কি তা নিয়ে কিছু বলি?
-তা তোমার পরিবারে কে কে আছেন?
-মা আর নানী।মা বুয়েটের টিচার্।আর আমি ভবঘুরে ডট কম।
-তবে তো তাদের দুই কন্যার সংসার!
-আসলেও তাই।আর আপনার তো ওই কন্যা নিয়েই কষ্ট।
-কে বলল তোমায়?
-আরে বিখ্যাত লোকের জীবন হল খোলা বই-এর পাতার মতো!আপনার
দুটি মেয়ে শুধু!আপনার কোন ছেলে নেই,আর আমার বাবা নেই।
এভারেস্ট জয়ের ছেলেমানুষীতে তখনি আবার কথা বলল ঋদ্ধ।কী ঠিক বলিনি? হেসে ঘাড় কাত করল রায়হান। তাড়া খাওয়া ছটফট ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল ঋদ্ধ,
-না: বড্ড বেশি সময় নিয়ে ফেললাম আপনার।ফেললাম না?
রায়হান সংক্ষেপে বলে-তা নিয়েছ।
-না হয় চলে গেলে গাল মন্দ করবেন। কিন্তু সামনা সামনি এমন করে বলা।
-মাইন্ড করেছ?
-করতাম।কিন্তু মাইন্ড করলে তো আমার চলবেনা।আমায়
তো মাঝে মাঝেই আপনার কাছে আসতে হবে।বারন করবেন না তো?
-তোমার কাজ কিন্তু আমার সঙ্গে নয়। তবু যদি আসতে চাও,মাঝে মধ্যে দু একবার এসো।তবে আজকের মত কিন্তু খুব বেশি সময় দিতে পারবনা।
-আচ্ছা নিলে নিয়েছি।আজ আসি। মাঝে মধ্যে আবার এসে জ্বালিয়ে যাবো।আপনি বিরক্ত হলেও আমার কিছু করার নেই।
এই বলেই ঝড়ের বেগে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল সদ্য তরুন ঋদ্ধ নামের যুবকটি।
ঋদ্ধ চলে যেতেই রায়হান শব্দ করে একা ঘরে হেসে উঠল।কামাল এল পরিশ্রান্ত ভঙ্গিতে। চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল,হাসির শব্দ শুনলাম।
এস্ট্রেতে সিগারেট ঠুকে রায়হান বলল,
-একটা ছোট্ট হলদে পাখি জানালা দিয়ে এসে ঢুকেছিল হঠাত!
-তার জন্য তোমার চোখে মুখেও যে গ্রিন সিগনাল দেখছি।
-তোমার ঘরে গেলে রেজাল্টটা আরো গভীরে যেত।এতক্ষনে ফাইনাল শুরু করে দিতে নিজের রুমে।খুদে ইনোলন্স ছেলে একটি।আর আমি কখনো ভুলিনা আমি হচ্ছি সেই পারফিউমের বোতল যার সুবাসটুকু তলানীতে এসে ঠেকেছে!
-আরে বন্ধু না!অতটা প্রাচীন তুমি এখনো হওনি।সুতরাং—- কামালের লাইনটা শেষ করেনি সেইদিন। ব্যাপারটা নিয়ে তলিয়ে দেখার বাড়তি সময়ই বা কোথায়?
তিন.
ঋদ্ধ ঝড়ের মত আসে যায়।হঠাত হঠাত এক একটা সূত্র আবিষ্কার করে-আমার বন্ধুরা বলেছে আপনার সঙ্গে আমার খুব বনিবনা হবে।দুজনের নামই ‘র’ দিয়ে।
-উহু হল না।আরো একজন যুক্ত রয়েছে।রণ।
-আরো একটা ব্যাপারে শুধু আমাদের দুজনেরই মিল।আমার বাবা নেই,আপনার ছেলে।
-তা বলতে পারো।
-তবু জানেন রণ খুব হিংসে করে আপনাকে।
-একদিন ওকে নিয়ে এসো।
-ও তো হাতে তাহলে মঙ্গলগ্রহ পাবে।
ঋদ্ধ রণকে হাজির করল পর দিনই।বছর বিশের সপ্রতিভ তরুন। কথায় কথায় বলল-
-ঋদ্ধকে আমি সত্যি হিংসে করি।ও আপনাকে বড্ড বেশি পাচ্ছে।
একটু মৌন হয়ে বলল,
-ওর অবশ্য এখানে আসার পাসপোর্ট জুটেছে।
-তোমার জোটেনি বলে দু:খ করোনা। বরং পড়াশোনায় বেশি সময় দিয়ে রেজাল্টে ওকে হারিয়ে দাও।
যতোক্ষন ছিল রণকে উজ্জ্বলই দেখাচ্ছিল।কিন্তু কোথায় যেন অমনযোগী।কেমন করে কিসে যেন আপন অজ্ঞাতে জড়িয়ে যাওয়া। কথাটা জিজ্ঞেস করার আগেই,অন্য অভিযোগ দাড়া করিয়ে দেয় ঋদ্ধ, চোখের ওপর-জানেন আমার মা আজকাল যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। বলে কিনা আমি অবাধ্য,বেশি বুঝি। তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারিনা যে বেশি তো আমি বুঝবই।আমার প্রজন্ম জন্মেই কমিকসের পাতা চিবিয়ে খায়।ভিডিও গেম খেলে।ইমেইলে চিঠি পাঠায়।কাল কি ঘটবে আন্দাজ করতে পারে আজ। যেমন আপনার আর আমার বেপারটা মাথায় আসলেই আমার মাথায় ঘুরতে থাকে-ড্যাডি কাম লাভার!
কাজের ভেতর কথার লেনদেন হচ্ছিল। রায়হানের হাতের কলম থেমে গেল। চোখ তুলে বলল,
-এটা তুমি কি বলছ?
-মিথ্যে কি বলেছি!দেখুন আমার মধ্যে ভন্ডামি নেই,যা বলি সরাসরি। বলতে পারেন আপনি আমায় মান্ধাতার আমলের রদ্দি সেন্টিমেন্ট,ছেলের মত দেখেন। আর আমি অন্ধ বোকা কাকের মত ড্যাডি ভাবি আপনাকে।
-ঋদ্ধ বাড়ি যাও তো আজ।
রায়হান সটান দাঁড়িয়ে গেল। যে পার্সোন্যালিটি তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে সেই তীক্ষ্ম অমোঘ ভঙ্গিতে বলল,যাও! ঋদ্ধ ঘাড় বাঁকিয়ে ছিল।সেই ভঙ্গিতেই বেরিয়ে যেতে যেতে দু:সাহসী স্বরে বলে গেল,মুখ দেখবেন নিজের আয়নায়। রায়হান নিজের আসনে ঠিক হয়ে বসতে চাইল।পারল না।দুহাত পেছনে ফেলে দুচার পা পায়চারি করল।সিগারেট ধরাল। কিন্তু স্থির হতে পারলনা। কী বলে গেল একফোটা ছেলেটা? সাহস পেল কোথায়?অন্তর্লীন দৃষ্টি বিদ্ধ করার অহংকার!শক্ত তীরের ফলা,ঝকঝকে দর্পন,দাম্ভিক কৌশলে সামনে দাড় করে দিয়ে গেল। সেখানে কার চেহারা ভাসছে?কার? কতগুলো ফটো কপি নিয়ে কামাল ঢুকে বলল,পুচকে ছেলেটা দেখাচ্ছে বটে।মডেলিং-এ এত অল্প সময়ে এতটা প্রগ্রেস সাধারণত দেখা যায়না।নাটকে ডাক এসেছে। সেখানেও নাকি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট।এরপর-
কামাল তাকাল।একটি হাত চোখের ওপর,অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট,কি নিয়ে যেন সমাধিস্থ রায়হান।একটু চমকে প্রশ্ন রাখল,
-কি?সেই মাথা ব্যাথাটা কি হঠাত আবার এল?
-নাহ,আমার তো লোহার শরীর।
-তবে অন্য কিছু?
-আচ্ছা কামাল আমরা তো দ্বৈত সত্তার মানুষ।
-দ্বৈত কি বলছ?যে জটিল কুটিল সময়ের স্রোত আমরা পার করছি,তাতে একই মানুষের মধ্যে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে ডজনখানেক সত্তা।
-এই অবাঞ্চিত সত্তার হাত থেকে রেহাই পেতে কী বলে তোমার সাইকোলজি?
-আমি তো সাধারন জ্ঞানের মানুষ। পন্ডিতদের ব্যাখ্যা,জাতক দৃঢ় চেতা আত্মস্থ,সুকেন্দ্রিক হলে এমনটি ঘটতে পারেনা।
-আচ্ছা আমরা কি মিড-লাইফ ক্রাইসিস পিরিয়ড পার হচ্ছি?এই সময়েই কি নিজের অজান্তে উঁকিঝুঁকি মারে যৌবনের কালারফুল লিভিং টাইম?
-হতে পারে।কিন্তু দোস্ত আমরা কেনো এসব জটিলতায় ঢুকছি? আমি এসেছিলাম ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কথা বলতে।
-আজ আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকবে না।
-ঠিক আছে। তুমি বরং বাড়ি গিয়ে রেস্ট কর। সেখানকার শান্তির আলোতেও
ছায়া পড়েছে।
কথাটা কামালকে শুনিয়ে নয়,মনে মনে উচ্চারন করল রায়হান।বাড়ির আবহাওয়া কবে থেকে যেন আগের মত নেই।স্ত্রীরা কি আগাম কিছু পড়তে পারে কিংবা বুঝে যায়? ঋদ্ধ চোখের ওপর আজ যে অদৃশ্য আয়না ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে, সেখানকার মানুষটির চেহারা কি অপরিচিত?এই মিডিয়া গুলোও যা করে!কাজের ফাঁকে নিজের দ্বিতীয় সত্তা আর শরীরের টানে হয়ত বেশ কিছু ছেলের সাথেই মিশেছিলাম।তরুন থাকা কালে নিজে কাজ করতে গিয়ে,তারপর এই উঠতি মডেলদের কাজ দিতে গিয়ে। উভকামী হওয়ার এই যা সুবিধা আর জটিলতা দুটোই বলা যায়। অবনীকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম।আড়ালে ছেলেদের সাথে দেহ ভাগাভাগি করলেও এমনটাতো হয়নি আগে কখনো। আমি কি তবে ওর——- নাহ,এই সময়ে এসে নিজেকে এইসব মানায় না।আফজালকে ডেকে হুকুম দিয়ে দিল ঋদ্ধকে যেন তার ঘরের ত্রিসীমানায় আর দেখা না যায়। পায়চারি করতে করতে জানালার ধারে দাঁড়াল।ফার্ম হাউজের উল্টো দিকে অভিজাত এক বেকারি শপ।আরো কয়েকদিনের মত আজো দেখল হাতে কোকের বোতল নিয়ে উদাস চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে রণ।এখন বেপারটা আরো পরিষ্কার রায়হানের কাছে।তবে কি,যা নয় তার চেয়ে বেশী শো করে ছেলেটিকে ভোগাচ্ছে ঋদ্ধ? ঋদ্ধ আসেনি তারপর বেশ কিছুদিন। কিন্তু রণকে দেখা গেছে ঠিক তার জায়গাটিতে।
চার.
সংযত সুভদ্র দারুন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রায়হান যেন রক্ত মাংসের মানুষ নয়,রোবট।নিজস্ব ক্ষমতা বলতে যার কিছু নেই,সবই যান্ত্রিক।কিন্তু গত কিছু দিন সে ভুগছে পোষ না মানা এক বুনো কষ্টে।আবিষ্কার হয়েছে এক নগ্ন সত্য।যে ঋদ্ধকে সে মুখে বলে ভাল লাগে,বুকে সে জায়গা নিয়েছে ভালবাসায়।অবুঝ অপক্ব ঋদ্ধ-এর টান যে দুর্বার।এমন টানে যে কোন মানুষ নিমেষে ভেঙ্গে দিতে পারে প্রথাসিদ্ধ বাধ।পরিনত মানসের এই উচ্ছাস ভাসিয়ে নেবে নির্দোষ অবনীকে,নিরপরাধ জলি মলিকে।না: আরো একজন আছে।বেকারিতে নিরলস প্রক্সি দেওয়া তরুণ। টেবিল ভর্তি কাজ।অসম্ভব মনযোগ দেওয়া।চেতনার জগতে অবিরল পাক খাচ্ছে একটি নিষ্পাপ মুখ।পাড় ভাঙ্গা মানসিক যন্ত্রনা। এর মধ্যে ফোন এল-তুমি কেমন আছো? নিজেকে চেনে না এমন গলায় রায়হান জবাব দিল,
-ভাল নেই।তুমি?
-আমার মিডিয়ার কাজ কর্ম নিয়ে বাড়িটা একটা অশান্তির আখড়া হয়ে গেছে।তারা এই কাজ মানতেই চাচ্ছে না।আমার এত ভালবাসার মাকে আমি আর চিনতে পারিনা।
-অবনীকেও আজকাল চিনতে অসুবিধা হয় আমার।কিন্তু তুমি তো আর এলেনা।
-কেন আসব?আমার ভালবাসার কি মান মর্যাদা নেই?
-রাইট তুমি একদম রাইট।
-বয়সের দিকে তোমার আমার জেনারেশন গ্যাপ যাই হোক,মনের দিক থেকে আমারা একই রকম।এখন তুমি যদি বলো সব মিথ্যে,হয় আমি মানসিক ভারসাম্য হারাব,নয়তো সুইসাই—
-থামো!তুমি এখন কোথায় ঋদ্ধ?
-আমার এক বন্ধুর বাড়িতে এসে লুকিয়ে থাকি।রণ ভাবে তোমার কাছে গেছি!মাও ভাবেন তাই।রাতে বাড়ি ফিরি।এমন করে কি বেশিদিন স্বাভাবিক থাকা যায়?
-না।কিন্তু রণর তো কোন অপরাধ ছিলনা।
-কে বলল?ও কেনো ওর পৌরুষ দিয়ে বেঁধে রাখতে পারেনি আমাকে ?যেমন পারেনা তোমার বউ! বলার অনেক কিছু ছিল।
রায়হান চুপ করে রইল।ওপাশ থেকে ঋদ্ধ আবার বলল,
-আমি তোমার কাছে একবার আসতে চাই।বাধা দিও না।আমায় আসতে দাও।
-এসো।কাল এমনি সময়।যা হোক একটা হয়ে যাবে।
-সেটা যেন আমার জন্যই হয়!
-তোমার জন্যই হবে।এই মানসিক যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছেনা।
রিসিভার রেখে টেবিলে দু কুনুই ভর করে মাথার দুপাশে চেপে ধরল রায়হান।অসহ্য দু:সহ কষ্ট। বুকে,মস্তিষ্কে,সারা দেহে। কামাল একবার এসে ফিরে গেল।আর একবার এসে পিঠে হাত রেখে বলল,
-বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও।
এসিতেও কপালে ঘাম নিয়ে রায়হান বলল,
-এখানেও পায়চারি করব।ওখানেও তাই,থাকি আর কিছুক্ষন।
কামাল ঘুরে দাঁড়াবার মুখে যেন তার পিঠে হঠাত ছুড়ে দিল এক প্রশ্ন,
-আচ্ছা কামাল তোদের সম্পর্কে,এই দুর্দান্ত ঢেউগুলো সম্পর্কে কি বলে সাইকোলজি?
-বলে তো অনেক কিছু।টিন এজ বয়সটাই তো সেন্টিমেন্টের।
-আর আমাদের?
-এমন এক অবস্থানে থাকা,যাদের রয়েছে সমাজ সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতার হিসেব নিকেশ। মানুষ যন্ত্র নয়।তাই সেখানেও মাঝে মধ্যে ঝড় উঠে।সুস্বপ্নের খোঁয়ারি বলব না।স্বাভাবিকভাবেই জেগে ওঠে সবুজ এক পৃথিবী।
-সেখানে আমার কি ভুমিকা হওয়া উচিত বলতে পারো?
-না।ওটা একান্তই তোমার নিজস্ব এলাকার ব্যাপার! কামাল চলে যাচ্ছে।রায়হানের মনে হল তেমাথার এক মোড়ে যেন নিষ্ঠুরের মত তাকে একাকী দাঁড় করিয়ে রেখে গেল নির্ভেজাল বন্ধুটি।
সন্ধার ঘরে বাতি জ্বালতে দিলনা রায়হান। অন্ধকার যত গাঢ় হল,চোখের দীপ্তি ততো তির্যক হয়ে খুঁজতে লাগল কিছু।সামনে কেবলি বন জংগল।পথ কোথায়?
জীবনে এই প্রথম বাড়ি ফিরলনা রায়হান।সুস্থির হয়ে বসতে পারলনা।গোটা একটা রাত কাটল প্রায় পায়চারিতে। সকালের দিকে টেবিলে দুপা তুলে দিয়ে বসে, সিগারেট ধরিয়ে তুলে নিল রিসিভার।বলল,
-কি করছ রণ?
ওপাশ থেকে জবাব এল,
-ঘুমানোর চেষ্টা করছি স্যার।
-তার মানে সারারাত জেগে আছো!
-ইচ্ছে করে নয় স্যার।
-জানি।
একটু থেমে রায়হান বলল,
-বিকেলের দিকে আমার অফিসে আসবে।কামাল আর ঋদ্ধ
থাকবে।
-তার মানে?
-আমার একটি চিঠিও থাকবে।কিন্তু আমি থাকব এ শহরের বাইরে।ঋদ্ধ
আমাকে প্রতারক ভাববে।সেই সুযোগটা তুমি কাজে লাগাবে ইয়াং ম্যান।
-কিন্তু আপনিতো ওকে ভালবাসেন!
-বাসি বলেই তো ঋদ্ধর মত অন্ধ অবুঝ হতে পারছিনা।এটাই আমার শেষ
ডিসিশন। কন্ঠার কাছে কি জলীয় পদার্থ কিছু জমতে চাইছে?রায়হান গা ঝাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বরে বলল,
-আসলে মানুষটা তো আমি শিল্পী। প্রকৃতিকে যে ভালবাসে।সমুদ্র যার সঙ্গে কথা বলে।নীল আকাশ যাকে দুহাতে হাতছানি দেয়। নিসর্গের এই ডাকগুলো বহুদিন ভুলে আছি।আর একবার কিছুদিনের জন্যে হলেও আমি তাদের কাছে ফিরে যেতে চাই। একটু থেমে গলা আরো পরিষ্কার করে বলল,এবং এসে শুনতে চাই সেখানে যা কিছু গরমিল হয়েছিল আবার তা ঠিক হয়ে গেছে!