
লেখকঃ শাহরিয়ার সুমন
[উৎসর্গঃ আহসান আহমেদ, আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের মধ্যে একজন ]
অর্ক আজ আসবে, ও বলেনি, তবে আমার মন বলছে সে আসবে। মাঝে মাঝে আমার মন যা বলে, অদ্ভুতভাবে সেটা মিলে যায়। এই তো বছরখানেক আগের কথা, অর্ক সেদিন দুপুরবেলায় আমাদের বাসায় এসেছিল। বাহিরে প্রচন্ড রোদ, ঘর থেকে বের হলে গা পুড়ে যায় এমন অবস্থা। কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর আমি অর্ককে বললাম, এই ভাবে ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছে না।
– এই দুপুরবেলা রোদের মধ্যে কোথায় যাবি?
-চল, ছাদে যাই।
– তোর মাথা ঠিক আছে? এই রোদের মধ্যে কেউ ছাদে উঠে নাকি?
-কিছুক্ষন পরেই বৃষ্টি শুরু হবে, অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়না, গরমের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোই লাগবে।
-আকাশে তো মেঘের ছিটে ফোটাও নেই, তোকে কে বললো যে বৃষ্টি হবে?
– আমি জানি, কিছুক্ষন পরেই বৃষ্টি শুরু হবে।
– আকাশের মেঘেরা কি ট্যালিপ্যাথির মাধ্যমে তোকে খবর দিয়েছে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, হ্যা দিয়েছে, এখন চল। আকাশের মেঘেরা আমাদের প্রতীক্ষা করছে।
অর্ক আমার সব পাগলামী মুখ বুঝে সহ্য করে, তাই অনিচ্ছাসত্বেও সে আমার সাথে প্রখর রোদের মাঝে ছাদে উঠলো। আমরা ছাদে উঠার কিছুক্ষণ পরেই আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি শুরু হল। সে কি বৃষ্টি! যাকে বলে একেবারে তুমুল বর্ষণ। অর্ক রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। এমন কাকতালীয় ঘটনা হয়তো আমাদের সবার জীবনেই কম বেশি ঘটে। আমাদের সবারই কিছু ভবিষ্যতবাণী মাঝে মাঝে সত্যি হয়ে যায়। তবে আমি জানি, আজ সত্যি অর্ক আসবে, কারণ আজ একটি বিশেষ দিন।
আজ ভোরে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। ঘুমের মাঝেই মনে হল, কে যেন খুব আদুরে গলায় আমায় ডাকছে, ডাকটা আমি শুনতে পারছি, কিন্তু জবাব দিতে পারছি না। তারপর মানুষটা কাছে এসে আমার হাত ধরলো, সাথে সাথে আমি বুঝতে পারলাম, মানুষটি আর কেউ নয়, আমার ভালোবাসার অর্ক, যার প্রতিটি স্পর্শ আমার চেনা। হাজার মানুষের ভীড়েও যাকে আমি শুধু স্পর্শ করেই চিনে নিতে পারব। এই তো সেই পরিচিত গন্ধ। অর্ক যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমি সবসমই ওর গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাই। না, কোন পারফিউমের গন্ধ নয়, ভালোবাসার অনুভুতিময় মিষ্টি সুবাস। সব ভালবাসার মানুষের শরীরেই কি এমন মিষ্টি গন্ধ থাকে? নাকি আমি একাই শুধু পাই!
অর্ক আমার চুলে হাত দিয়ে আদর করছে, এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে আমার শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ অর্ক আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ভালোবাসি, ভালোবাসি। এমন মধুর শব্দ আমি যেন কোনদিন শুনিনি। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে যেন ভালবাসার অদ্ভুত শিহরণ, শরীরের প্রতিটি বিন্দুকণা যেন চিৎকার করে আমরাও অর্ককে ভালোবাসি, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি!
তারপরই হঠাৎ করে চারপাশের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেল, আমরা কিভাবে যেন আমরা একটা জঙ্গলে চলে এলাম। আমি অর্কের হাত ধরে দৌড়াচ্ছি। দুপাশে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে সরু পথ, তার ভেতর দিয়েই আমরা ছুটছি, ভয়ঙ্কর কিছু একটা যেন আমাদের তাড়া করছে। কিন্তু তবুও আমার কেন জানি কোন ভয় লাগছে না। মনে হচ্ছে অর্ক পাশে থাকতে আমার কোন বিপদ হবে না। হঠাৎ আমি হোচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম, অর্ক তার হাত বাড়িয়ে দিল আমাকে সাহায্য করার জন্য। ঠিক এসময় একদল লোক আমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলল। তাদের সবার হাতেই লাঠি, বর্শা। আমি অর্ককে জড়িয়ে ধরে আছি, লোকগুলো ভয়ঙ্কর চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, সেই চোখে খুনের নেশা।
স্বপ্নের এই পর্যায়ে এসে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, আম্মু ডাকছে ঘুম থেকে উঠার জন্য। বিছানা থেকে উঠে দেখি ঘামে আমার পুরো শরীর ভিজে গেছে। তারপরই মনে পরল আজ ১২ই নভেম্বর। বেছে বেছে আজকের দিনেই এমন দুঃস্বপ্ন দেখতে হল !
না, আজকে আমি একদম মন খারাপ করব না, কারণ আজ অর্ক আসবে। আজ আমাদের দুজনের জন্যই অনেক বিশেষ একটি দিন, আজকের দিনে অর্ক কিছুতেই আমার কাছে না এসে থাকতে পারবে না।
আজ দুপুরে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, অর্কর জন্য। অর্কটা খিচুড়ি খেতে ভীষণ ভালোবাসে। সাথে গরুর কালো ভুনা, আর ইলিশ মাছ ভাজা। নাস্তা খেয়েই আম্মুকে বললাম, আজ আমার খিচুড়ি খেতে খুব ইচ্ছে করছে। আম্মু অবশ্য প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। বলেছে আজ এসব ঝামেলা করতে পারবে না। আমিও রাগ করে বলেছি, আজ আমি খিচুড়ি ছাড়া কিছুই খাব না। মায়েরা মুখে যাই বলুক, সন্তানের সব আবদার তারা সাধ্যমত মেটানোর চেষ্টা করেন। আমি কিছু খেতে চাইব, আর আম্মু সেটা করবে না, এমনটা কখনোই হবে না। আচ্ছা, সব মায়েরাই কি আমার মায়ের মত ভালো?
আজ আমি গোসল করেই অর্কর দেয়া পাঞ্জাবীটা পরলাম। অর্ক বলে, এই পাঞ্জাবীটা পরলে নাকি আমাকে নীল রাজপুত্রের মত লাগে। আমি তখন হেসে বলি, রাজপুত্র আবার নীল হয় কিভাবে? অর্ক বলে, ‘আমার স্বপ্নের রাজপুত্র লাল, নীল অনেক রকম হয়। আমি নীল রাজপুত্র হয়ে মামার দেয়া বিদেশি পারফিউম গায়ে মেখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি আমার স্বপ্নের রাজপুত্রের জন্য। আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে দেখি, সব ঠিক আছে তো? কলিঙবেলের আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলি, আর বারবার নিরাশ হয়ে ফিরে আসি। কখনো ফকির, দুধওয়ালা কখনো বা আমাদের ভাড়াটিয়া। মনে হয়, এরা যেন আমার চির জনমের শত্রু, পৃথিবীর সবাই যেন আজ আমার সাথে উপহাস করছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, আমি তবুও বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্কর জন্য অপেক্ষা করি। আমাদের বারান্দা থেকে বাসার সামনের রাস্তার অনেকখানি দেখা যায়। বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে তাকিয়ে থাকি অনেক দূরে, যতদূর চোখ যায়।
এখন অনেক রাত, চাঁদমামা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে, তার সাথে ঘুমিয়ে গেছে পুরো পৃথিবী। শুধু জেগে আছি আমি, একা, নিঃসঙ্গ। নিকষ কালো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো চিন্তার জাল বুনছি। ভাবছি ভালোবাসা সুখের নাকি কষ্টের? মানুষ কি শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্যই ভালোবাসে? নাকি ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার মাঝেও এক অন্যরকম সুখ থাকে? অর্ক আজ আসেনি, আর কখনো আসবেও না।
অর্ক আমায় কথা দিয়েছিল, আসছে শীতেই সে আমার সাথে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম আসবে। শীত যায়, বসন্ত আসে। বসন্ত শেষে বছর ঘুরে আবার শীত আসে। কিন্তু অর্ক কখনো আসে না।
অর্করা কখনো আসে না, তবুও আমরা অপেক্ষা করি অর্কের জন্য, একসময় হয়তো সে আসবে। ভালোবেসে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরবে, আবেগ জড়ানো গলায় বলবে, তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?
আমাদের সেই প্রতীক্ষার কখনো শেষ হয়না, ক্লান্তিহীন নিরন্তর সেই প্রতীক্ষা।
(সমাপ্ত)