
লেখকঃ চিন্ময়ের ইতিকথা
১।
পুঁউউউ…
হায় হায় ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে।ঝেড়ে দৌড় লাগালাম।সামনে ইমন দৌড়াচ্ছে।যে করেই হোক ট্রেনটা ধরতেই হবে।ইমন ট্রেনে উঠে পড়েছে।আমি ট্রেনের সাথে দৌড়ে নিজের দূরত্ব কমাতে লাগলাম।অবশেষে ট্রেনের হাতলে ধরে উঠে পড়লাম।মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।এতক্ষনে ট্রেনের কামারার লোকগুলোর দিকে তাকালাম।দেখি সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি ভিনগ্রহের প্রানীর থেকেও বেশি কিছু।অবশ্য তাকানোতে তাদেরকে দোষ দিতে পারি না।কারন আমি এমন একটা পাতলা জরজেটের শার্ট পড়েছি যাতে আমার ভিতরের প্রত্যেকটা ভাঁজ স্পষ্টভাবে দেখা যায়।আকাশী রঙের শার্ট আর বকশাদা প্যান্ট পড়েছি।আমাদের কলেজ ম্যাগাজিনের ফ্রন্ট পেজে আমার ছবি ছাপা হবে।তাই ফটোশূটে যাচ্ছি।আশা করছি বুঝতে পারছেন আমি দেখতে ততোটা খারাপ নই।তবে আমি কারো চাহনি তোয়াক্কা না করে চুপচাপ তাকিয়ে আছি ঐ দূরের দিগন্তে।
বাতাসে বসন্তের ঘ্রাণ।মৃদুলয়ে প্রজাপতি দোলাচ্ছে তার বর্নীল সাতরঙা পাখা।রেললাইনের ধারে ফুটে আছে অসংখ্য বুনোফুল।বুনোফুলের ঘ্রাণে প্রায় পাগল হয়ে যাবো।বেরসিক কাককন্ঠী ইমন বলল,
-তুই না হয় যাচ্ছিস কাজে।আমি কিসের জন্য যাবো?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
-বাল ফেলতে।
ইমন এই কথাটা একশো বার জিগ্যেস করেছে।আমিও উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। ইমনের খুব ইচ্ছে তাকে ফটোশুটে নেয়া হোক।কিন্তু ইমন বলে,
-“কি আমার চেমেরা
কুত্তা ধরে ক্যামেরা”
সে জন্যই আবেদ ভাই(ক্যামেরাম্যান) কে বলি না তার ছবি তুলে দিতে।কারন ইমনের ধারনা তার দিকে ক্যামেরা কুত্তা ছাড়া কেউ ধরবে না।বসন্তের কোকিলের কন্ঠে রাগের আহ্বান।আর সে কারনে হিংসা করে দূরের কোন এক গাছে বসা বউ কথা কউ ও শুরু করেছে তার কথামালা।রেললাইন ধরে দুরন্ত গতিতে চলছে ট্রেন।পিছনে ফেলে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ,পুকুর ,ধানক্ষেত ও জঙ্গল।আমার শার্টের হাতের কাছে দুটো লম্বা লম্বা ফিতার মতো কাপড় ঝুলানো। বাতাসে সেগুলো উড়ছে।একটা কলাগাছের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা কলাপাতার কিছু অংশ ছিড়ে নিলাম।তারপর আস্তে করে উড়িয়ে দিলাম।হঠাৎ একটা ছেলের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম।ছেলেটা একটা ডিএসএলআর নিয়ে ছবি তুলছিলো।ছেলেটা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল।দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেলো দূরে।হারিয়ে গেলো প্রকৃতির সাথে।আমিও অসহায়ের মতো তার দিকে ছিলাম। আর কিছু করার ছিলো না।কারন সে ছিল ট্রেনের বাইরে।হঠাৎ ইমন বলল,
-কিরে, মুখটাকে লোডার মতো করে রেখেছিস কেন?
-কেন?বদনার মতো করে রাখলে বুঝি ভালো লাগতো?
-সে তুই যার মতোই করে রাখ।আসল কথাটা বল না।কি হয়েছে?
আমি তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম,
-কিছুই না।
ইমন আর বেশী কিছু বলে নি।ট্রেন এসে থামলো আমাদের গন্ত্যবে।আমি ও ইমন স্টুডিওর দিকে রওনা দিলাম।
২।
ফটোশুট শেষ করলাম।এবার আর কিছুই করার নেই।তাই বসে বসে মুড়ি খাওয়ার থেকে বাড়ির দিকে রওনা দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে হলো।সারাটা পথ তার কথা চিন্তা করতে করতে এলাম।বাসায় এসে তো দেখি চক্ষু চড়কগাছ।আমার বড়দি এসেছে।আর সাথে নিয়ে এসেছে মূর্তিমান দুটো শয়তান।তার ছেলেমেয়ে।তার মেয়েটা আমাকে দেখেই ছড়া কাটতে লাগল,
“এই ছেরা বেরবেরা
কাডলের কুষ
তোর মা পাদ মারছে
আমার কি দোষ।”
সত্যিই আমি তার কোন দোষ ধরতে পারছি না।এমন সময় ছেলেটা এসে বলল,
-“মামা,বল তো আলমারি।”
আমি বললাম_আলমারি।
সে বললো,
-তোর বউয়ের উপরে ফাল মারি।
আমি মনে মনে বললাম’আমার বউয়ের উপর শুধু আমিই ফাল দিব,তোরা কেউ না।
মোটামুটি এই হল আমার ভাগ্নে ও ভাগ্নি। এমন সময় আমার ছোট বোন এসে বলল,
-একটা খবর আছে দাদা।
-দুঃসংবাদ টা দে (আমার এই বোনটা দুঃসংবাদ ছাড়া আর কিছুই দেয় না)।
-বাবা ট্রান্সফার হয়ে পাশের জেলায় যাচ্ছে।
আমার বুকটা ধক করে উঠল।মনে মনে চিন্তা করলাম,
-আমি কি তাহলে তার থেকে আরো দূরে চলে যাচ্ছি?একগুচ্ছ অনিশ্চয়তা নিয়ে চুপচাপ বসে আছি ছাদে।
হঠাৎ করেই যেন চলে যেতে হলো।এটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়।তবুও বন্ধুদের মিস করি।রুমে বসে বসে ফেসবুকে “বকুল আহমেদ” এর “অরিত্র” গল্পটা পড়ছি। এমন সময় ইমনের ফোন
-কই তুই?
-বাসায়,কেন?
-কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশ হইছে।আর তোর ছবি তো… দাড়া আমি তোদের বাসায় আসছি।
ইমন অর্ধেক কথা পেটে রেখে দেয়।সে কারনে খুব খারাপ লাগে।যদিও আমরা বর্তমানে দুই জেলায় থাকি,কিন্তু আমাদের বাসায় আসতে ২০ মিনিট লাগে।
২৫ মিনিটের সময় বাসার কলিং বেল বাজল।দরজা খুলে দেখি ইমন দাড়িয়ে।সে আমার দিকে ম্যাগাজিন টা বাড়িয়ে দিল।আমি ফ্রন্ট পেজটার দিকে তাকিয়ে তো থতমত খেলাম।দেখি যে ‘একটা ছেলে ট্রেনের দরজায় দাড়িয়ে একটু করো কলাপাতা উড়িয়ে দিচ্ছে।তার চুল ও নীল শার্টের লম্বা ফিতা বাতাসে উড়ছে!’আমি ইমনকে বললাম,
-আরে এ ছবি তো সেই ছেলেটা তুলেছিল!
-কোন ছেলে?
আমি ইমনকে সেদিনের ঘটনাটা বললাম।আরো বললাম,
-এই ছবি আবেদ ভাইয়ের কাছে কিভাবে গেলো?আর আবেদ ভাই তো ম্যাগাজিনে ফটোশুটের ছবি দিবে!
আমি আবেদ ভাইকে ফোন করলাম।আবেদ ভাই বলল,
-কে যেন এই ছবিটা অজ্ঞাতনামা এক ব্যাক্তির আইডি থেকে শেয়ার করেছে। আমি ছবিটা ডাউনলোড করেছি এবং বুঝতে পেরেছি এই ছবিটাই বেস্ট।কিন্তু পরে সেই আইডিটা আর পাই নি।
৩।
রাস্তায় হাটছি।উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে।আমি কিভাবে খুঁজে পাব?ইতিমধ্য আমার আইডিতে স্ট্যাটাসের বন্যা বইয়ে দিয়েছি।কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারছে না।এমন কি আবেদ ভাইও চেষ্টা করেছে আমার জন্য।কিন্তু ফলাফল শূন্য।ট্রেন এলে মাঝে মাঝে স্টেশনে যাই।অসহায়ের মতো চেয়ে থাকি।প্রথম এক দুই দিন আমার ছবিটা দেখিয়ে মানুষকে বলেছিলাম,
-আচ্ছা এটা কি আপনি তুলেছেন?
তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছে, তাতে আমারি মনে হচ্ছে আমি পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছি তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর টা জানার জন্য।তারপর আর জিগ্যেস করি না।প্রায় একমাস কেটে গেল।সেই অজানা লোকটিকে আজ ভুলতে বসেছি।একদিন আমি আর ইমন ট্রেনে করে পাশের শহরে যাচ্ছিলাম।ট্রেন শম্ভুগঞ্জ থামলো।আমি পানি কিনতে নামলাম।এমন সময় দেখি একটা ছেলে আমার দিকে দৌড়ে আসছে।এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল,
-“আমিই তোমার ছবিটা তুলেছিলাম।”
আমি বিষ্ময়ে কিছুক্ষন কথা বলতে পারলাম না।ট্রেনের হুঁইসেল শোনা যাচ্ছে।ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে।সে তাড়াতাড়ি বলল,
-“ময়ময়সিংহ যাবে?
আমি মাথা নাড়ালাম।
সে বলল,”ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে দৌড় দাও।”
আমরা দুজনেই দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম।
তারপর সে বলতে লাগল,
-আমি জামাল।শখের ফটোগ্রাপার।তুমি মনে হয় সেদিন ময়মনসিংহ যাচ্ছিলে। আমি ক্যামেরা নিয়ে ঘাসফড়িং এর ছবি তুলতে গিয়েছিলাম।তখন ট্রেন দেখে ভাবলাম কিছু ছবি তুলি।তারপরেই তোমার ছবিটা তুললাম।আর আমি অফার পাই ফ্যান্সি ফটো গ্যালারিতে। সেখানে তোমাকে ফটো পেপারের রোল মডেল বানাতে চায়।তাই তোমাকে খুঁজছলাম।প্লীজ তুমি আমার সাথে চলো।
আমি আর না করি নি।
৪।
বিশাল গ্যালারিতে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।এই গ্যালারি ফুজি ফিল্মের সাথে সম্পৃক্ত।জামাল আমাকে ম্যানেজারের রুমে নিয়ে গেল।ম্যানেজারকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম।ম্যানেজারের নাম শ্যামল দাস।বয়স ৩৫-৩৬ হবে। ম্যানেজার আমার দিকে মুচকি হেসে বলল,
-বসো নীল।
আজকে আমি শুধু অবাক ই হচ্ছি।সে আমার নাম জানল কি করে?তখন জামাল বলল,
-নীল,আমি তোমাকে একটা মিথ্যা বলেছি।আসলে সেদিন আমি ছবি তুলতে গিয়েছিলাম না।গিয়েছিলেন স্যার।বাকিটা স্যারের মুখ থেকে শোন। তখন শ্যামল বললেন,
-শখের বশে সেদিন প্রজাপতির ছবি তুলতে গিয়েছিলাম।তারপর তোমার ছবি তোলা ও ফেসবুকে দেয়া।আবেদ তোমাকে চিনতে পারে।আমি আবেদকে না করেছিলাম আমার পরিচয় জানানোর জন্য।তারপর তোমার বাসার সামনে একদিন গিয়েছিলাম।তুমি আমাকে খোঁজছো।
আমি কথার মাঝখান থেকে বলে উঠলাম,
-“আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি আপনাকে খুঁজছি?”
শ্যামল মুচকি হেসে বলল,
-সেদিন স্টেশনে ছবিটার সম্পর্কে তুমি আমাকেই জিগ্যেস করেছিলে।
যাই হোক।তারপর কাজের ব্যাস্ততায় কিছুদিন ডুবে যাই।আর আজকে এভাবে দেখা।এইবার আমি তোমাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কথাটা বলি।আর তা হল আমি তোমার উপর দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম সেদিন থেকেই।
আমি বললাম,
-আমি গে না।
-তাহলে সোহলের সাথে কি হয়েছিল?
ফিরে গেলাম অতীতে।সোহেল আমার ক্লাসমেট ছিল।তার উপর দূর্বল ছিলাম। আর সে আমাকে করেছে ব্যবহার।একদিন সব বুঝতে পেরে আমি পিছিয়ে গেলাম।কেউ কখনো আমায় বলেনি ভালোবাসার কথা।কেমন যেন চাপা একটা অভিমান হতে লাগল।খুব কান্না পাচ্ছে।দু চোখ উপচানো জল থামাতে পারছি না।সে বলল,
-ভালোবাসবে আমায়?
নিচের দিকে আমি তাকিয়ে আছি।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।শ্যামল আমার কাছে এসে দাড়ালো।এসে দু হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।তার বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে আমার মাথা।তাকে আমিও জড়িয়ে ধরলাম গভীরভাবে।
শ্যামল আমার সাথে যাচ্ছে আমার শহরে।সেখানে সে থাকবে কিছুদিন।ভৈরবের ট্রেনে উঠলাম।এ ট্রেনে যাত্রী থাকে না বলেই চলে।আমরা দুজন ট্রেনের দরজায় দাড়ালাম।বসন্তের শেষ বিকেলের মিষ্টি রৌদ্র আমাদের শরীরে আছড়ে পড়ছে।আমি তার দিকে সরে দাড়ালাম।সে মুচকি হেসে বলল,
-কিছু বলবে?
আমি বললাম,
“তুমি তখন ছিলে কোথায় কিসের অন্বেষনে,
চলো আজ ভেসে যাই নীলের নিমন্ত্রনে”।