
লেখকঃ চিন্ময়ের ইতিকথা
আজ বসন্ত। কবির মতো আমার মনেও আজ কোনো আনন্দ নেই। আছে শুধু শূন্যতার হাহাকার অার একটা অস্পৃহ্য বুকচেরা নিশ্চুপ অার্তনাদ। ফিরে দেখি আগের বসন্তটাকে। তন্ময় হয়ে ভাবতে থাকি গত বসন্তের সুখসময় গুলোকে। ভাবতেই ভালো লাগে। যেন এক অদৃশ্য আল্পনায় নিজের অাবেগের প্রতিটি নক্সা জলরং দিয়ে এঁকেছিলাম সেসময়। পুরনো দিনের ফ্ল্যাশব্যাক করতে হারিয়ে যাই স্মৃতির অতলে ।মনে পড়ে যায় সেইসব দিনগুলি…………
ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পা দিয়েছিলাম । আমি অমিও। দেবাশীষ রায় অমিও। আমার পড়তে খুব ভাল লাগে।না না… পড়ার বই মানে পাঠ্যবই নয়।
গল্পের।
আমি প্রতিদিন বাসার তিনতালার ছাদে বসে বসে গল্পের বই পড়ি। মনটাতে প্রশান্তি যেন দোলা দেয়। তখন বসন্ত ছিলো। একদিন দেখি পাশের ছাদে একটা ছেলে ডাম্বেল মারছে। দুটো ছাদের দূরত্ব ছিল এক হাত। চোরাচোরা চেহারায় তাকে পিছন দিক থেকে দেখতে লাগলাম।হঠাৎ করেই সে আমার দিকে ঘুরল। আমি তাড়াতাড়িই বইয়ের দিকে নজর দিলাম। আরও পাঁচ মিনিট পর সে দৃষ্টি আকর্ষনের একটা কাশি দিল। আমি মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম
লৌহকঠিন এক চেহারা তবে চোখে অাছে নমনীয়তা। ভনিতা না করে প্রথমেই সে বললো
-আমি রাজেশ। রাজেশ চন্দ্র পাল।তুমি?
-আমার নাম শিমুল। তবে সার্টিফিকেটে আছে দেবাশীষ রায় অমিও। তা কি করেন?
রাজেশঃ এইতো ছোটখাট একটা চাকরি। তুমি?
-” স্টুডেন্ট।”
এভাবেই পরিচয় অামাদের। তা ভাবতেই কেমন লাগে! অার তারপর? তারপর ভালোলাগা গুলো লিলুয়া বাতাসের মতো করে হুঁ হুঁ করে জানান দেয় মনের জানালায়। প্রতিদিন সে একই সময়ে গেঞ্জি খুলে প্রেকটিস করতো, আর আমি রাক্ষসেরর মত তাকে গিলতাম। মন বলত এটা ঠিক না। আর আবেগ বলত এটাই ঠিক! আর যখন ঠিক এই টানাপোড়ন সম্পর্কের মাঝে চলছে মন তেমনি একদিন মার অাদেশ অাসলে -“যাতো মরিচগুলো ভাঙিয়ে আন!”
আমি অগ্যতা মার প্রতি মনে মনে যথেষ্ট বিরক্তি ও কপালে বিরক্তির ভাঁজ নিয়ে রাস্তায় বেরুলাম।তখন দেখি রাজেশ দা। তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললাম
– মরিচ ভাঙ্গানো মেশিনটার কাছে একটু লিফট দিবে? রাজেশ বলল” চল”!
কিন্তু হোন্ডায় বসার পর বুঝছি সমস্যা টা আসলে ব্যাগের। তাই ঠিকমতো বসতে পারছি না। কিন্তু কি করা! মানিয়ে নিয়ে পেছনের সিটটা দখল করলাম। অল্পক্ষনেই পৌছে গেলাম গন্তব্যস্থলে। তারপর সে আমায় বললঃ
-“তুমি ভাঙাও আমি এদিকেই আছি।” কাজ প্রায় শেষের পথে। চোখ পড়লো বাইরে, সে বাইক নিয়ে দাড়িয়ে অাছে। অামি ততার পেছনে অাবারো ববসলাম।একদলছুট ইচ্ছেরা মনের অলি গলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর তারপরেও আমি যথাসম্ভব শান্ত রইলাম।এভাবে তার সাথে কাটানো কিছুটা সময় কেন জানিনা খুব ভাল লাগত।
১৪ ই ফ্রেব্রুয়ারি। সকাল থেকে কেমন একটা গুমোট ভাব। আজ সবাই ঘুরতে বেরুবে। তাই আমিও বেরুলাম। বেরিয়েই দেখি রাজেশ দা। তার হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। তাকে দেখে বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছিলো । সে বলল
-” চল তোমায় নিয়ে আজ ঘুরি।অনেক দূর যাই।”
সাধারন কথা তবে আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত তার পিছনে বসে থাকলাম। চারদিকে অসংখ্য গাছপালা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যেন অনন্ত সবুজের ধার ধরে চলছি অমরা। বসন্তের বাতাস ভাঙে অামাদের কানে। প্রায় ১৪ কিমি যাওয়ার পর তার বাইক নষ্ট হয়ে গেল। আর কি করা । পাশে অাছে হিজল বন। ঘন সবুজ পাতা ও বন থেকে ভেসে অাসে মিস্টি ঘ্রান। হাটছি ঘোরলাগা মানুষের মতো।হঠাৎ পিছন থেকে একটা ডাক!
শিমুল!
দেখি সে একতোড়া ফুল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে সে আমার কাছে আসল।
বললঃ -“এই ফুলগুলো তোমার জন্য।”
আমি নির্বাক হয়ে ফুলগুলো নিয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। বসন্ত বাতাসটা এই মুর্হুর্তে মনকে বেশ আন্দোলিত করেছে। কানে কানে কি কেউ বলে গেলো? ভালোবাসি?
সে কিছু বলবে ভেবেছিলাম কিন্তু না, বলেনি। সে হয়তো জানে না যে আমি এটাকে কিভাবে নিব কেউ বলেনি তবে বুঝতে পেরেছিল। একটা বাস দিয়ে এসে পড়লাম আর মোটর সাইকেল ট্রাকে করে পাঠিয়ে দিয়েছে।
তখন সন্ধ্যা! সারাদিনের কথা মনে করছি। কোমড়ে আলতো হাতের ছোঁয়া , ভালোবাসার সনদপত্র স্বরূপ গোলাপ, বসে থাকা পাশাপাশি সারাটা সময়, নির্বাক ভাবে।
আমি অার ভাবতে পারলাম না। ভাগ্যের উপর জোড় দিয়ে বললাম
-“যা হয় হবে, বলে দিবো, প্রতিদিন মরার থেকে একবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো।”
সেদিন বিকেলে ছাদে বসে থাকি! সে আসেনি! তারপর আরও দুদিন অপেক্ষার পর তাদের বাসায় গিয়ে শুনলামঃ
“সে কানাডা থেকে কিছুদিনের অতিথী হয়ে এসেছিল। নিরীহ ও প্রচন্ড লাজুক। সে ২২ তারিখেই চলে গেছে। আমি আর কিছু বলিনি। সেই ছিলো তার সাথে অামার শেষ দেখা। তারপর কতগুলো বসন্ত চলে গেলো। শরীরে যৌবনের ছাপ সুস্পষ্ট কিন্তু মনটা যে সে বসন্তে ভেয়ে গেছে তা অার জোড়া নেয় নি। প্রতিদিন ছাদে বসে থাকি এক উদাসী চিত্তে। প্রতীক্ষায় থাকি কবে আসবে। অার অাদৌ কি অাসবে….? দিন শেষে একটা কথাই মনে পড়ে,
“তাহারেই পরে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে।”