
লেখকঃ চিন্ময়ের ইতিকথা
১.
এখন কয়টা বাজে? দূর্বল চোখ মেলে তাকিয়ে অাশপাটা দেখল। কিন্তু কোথাও কোন ঘড়ি নেই। শরীরটা ভয়াবহ রকমের দূর্বল। মনে হচ্ছে কেউ ৫ টন ট্রাক চালিয়ে নিয়ে গেছে শরীরের উপর দিয়ে। ক্ষীন কন্ঠে নিবেদিতা ডাকল
-“মা, ও মা। “
কিন্তু মা সাড়া দিচ্ছে না। অবাক লাগলো ব্যাপারটা। কেমন যেন ভয় করছে তার। সে গলায় অারো শক্তি জোগার করে ডাকল
-“ও মা, কই তুমি?”
দুপদাপ অাওয়াজ করে ঘরে এলো তার বাবা। এসেই শঙ্কিত মুখে বলে
-তুই ঠিক অাছিস তো?
-হা বাবা, কিন্তু মা কই।
-একটু বেড়াতে গেছে। এসে পড়বে। কয়েকদিনের মাঝেই।
ব্যাপারটা অবাক লাগল। এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট। অার মা সাথে নেই। সে অনেক কষ্টে বিছানা থেকে উঠলো। বাথরুমে ঢুকে সে ভালো করে স্নান করলো।
স্নান সেরে নাস্তার জন্য নিচে নেমে এলো ধীরে ধীরে। দ্যাখে বড়দিদিও বসা। চেয়ার টেনে বসলো নিবেদিতা। পাউরুটি চিবুতে চিবুতে সে বললো
-বাবা, অাজ অামি কলেজ যেতে চাই।
খাবার টেবিল হতে মাথা তুলে বাবার দিকে তাকালো নিবেদিতার বড় বোন। বাবা অাস্তে করে মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিলেন।
২.
গাড়ি নিয়ে বের হলো নিবেদিতা। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অানমনে।হঠাৎই তার কান্না পেয়ে গেলো। বাবা প্রতিদিন কাজে বাইরে যাওয়ার সময় তার কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে যায়। কিন্তু অাজ দিলো না। এক্সিডেন্টের পর সবাই কেমন যেন বদলে গেছে। হয়তোবা সে নিজেও…
স্কুলে যাওয়ার পর তার বান্ধবীরা প্রশ্নবাণ ছুঁড়ছে।
-কি রে, কেমন মেয়ে তুই?
-নিজের খেয়াল রাখতে পারিস না।
-তুই তো রাস্তাঘাটে বেরুতেই পারবি না।
-একটু সাবধান হয়ে চলা দরকার….
এসব প্রশ্নবাণে সে জর্জরিত। সে অার জড়াতে চাচ্ছে না। কেমন যেন ভয়াবহ অতীত মনে করিয়ে দেবার মতো….
এসব থেকে বাঁচার জন্য সে বাংলা ম্যামের কাছে চলে গেলো। ভাবলো সেখানে শান্তিতে কয়েকটা মুর্হর্ত কাটাতে পারবে। কিন্তু বাংলা ম্যামের প্রশ্নটা শোনে সে অবাক হয়ে গেলো। বাংলা ম্যাম বলেছে
-“ওরা কতজন ছিলো?”
৩.
কলেজ গেটে দাড়িয়ে থাকে নিবেদিতা। প্রতিদিনের মতো। গাড়ি করে নিয়ে যাবে। কিন্তু গাড়ি এখনো অাসছে না। সে ভাবলো কাছাকাছিই যেহেতু বাসা তাহলে অার গাড়ি কেন অাজ? হেটেই চলে যাই।
মোড় ঘুরতেই কোথা থেকে একটা সাদা ফোর্ড গাড়ি তার সামনে এসে দাড়ালো। হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে তার এক হাত ধরে টান দিলো। নিবেদিতা কিছু বুঝে উঠার অাগেই তাকে গাড়িতে তুলে নেয়া হয়। অার তারপর…
৭ জন পশু মিলে তার দেহ খুবলে খেয়েছে। প্রথমে একটা গুন্ডা টাইপ লোক গাড়ির ভেতরেই তার উপরে উঠলো। অসহ্য রকম চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো নিবেদিতা। রক্ত বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে অসহ্য যন্ত্রনা দিয়ে তিলে তিলে মারবে। তারপর অার কিছু মনে নেই। এর মাঝে দুবার জ্ঞান ফিরেছিলো। তখন সে দেখে তাকে ব্যাবহার করছে একদল নরপিশাচ। মাংশাসী লোভে উপহার দিচ্ছে এক অবর্ণনীয় ব্যাথা। অবশেষে মাংশাসীরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে তাকে ফেলে দিয়ে অাসে একটা ডাস্টবিনের পাশে। সাথেই একটা কুকুর হাড় নিয়ে ঝাঁকাচ্ছে। কাক উপচে পড়া নোংরা থেকে খুঁজে বের করছে নৈশভোজ। কে দ্যাখেছে, নিবেদিতার শরীরের ভেতরেও ছিলো এমনি ডাস্টবিনের মতো নোংরা….। যদিও তা কৃত্তিম, তবু নোংরা ত….
তাকে খোঁজে পায় ডি এম পি পুলিশ। তারপর তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করায়। ১৫ দিন পর সে ছাড়া পায়। এ ঘটনা জানার পর নিবেদিতার মা স্ট্রোক করেন। তাকে অার বাঁচানো যায় নি। তবে এ কথা নিবেদিতা জানে না। হয়তো অার জানবেও না….।
৪.
নিবেদিতা বসে বসে ডায়রি লিখছে। অনেকটা এরকমঃ
পৃথিবীটা হয়তো অনেক সুন্দর। কিন্তু প্রকৃতি সবাইকে সে সৌন্দর্য অবলোকন করতে দেয় না। অামার জন্ম নীল কুয়াশায়। অামি জানি প্রতিরাত্রে বাবা মদ খেয়ে মার উপর অত্যাচার করলে কেমন লাগে। অামি জানি মা থাকা সত্বেও অন্য মহিলাকে নিয়ে পাশের রুমে বাবা যখন শুয়ে থাকে, তখন মার কেমন লাগে। অনেক কষ্ট বুকে। না পারি বলতে, না অাসে কেউ ভাগ বসাতে। এলাকায় বেরুলে মানুষ অামার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন অামি নষ্টা বা পতিতার এক জ্বলজ্যান্ত উদাহারন। বন্ধুদের শান্তনা যে কতটা ছোট করে সে সময় তা বন্ধুরাও জানবে না। থাক পৃথিবীর সবাই ভালো থাক। বাবা ভাবছে অামি জানবো না যে মা চলে গেছে মহাজাগতিক মুক্তির পথে। মার পথে অামিও চললাম। সর্বশেষ এই কামনা করি, ভালো থাক প্রতিটি মানুষ, ভালো থাক প্রতিটি ধর্ষক শুধু পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে যাক এ নিবেদিতারা।
শেষবারের মতো
বিদায় পৃথিবী
বিদায়, “নিশ্চুপ নিবেদিতা”
পরিশিষ্টঃ নিবেদিতার বাবাকে প্রায় প্রতি শুক্রবারেই দেখা যায় মা মেয়ের কবর জিয়ারত করতে। সন্ধ্যাবেলা কখন যে তার বাবার চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পড়ে তার খবর রাখে রাত্রির প্রত্যেকটা প্রহর। অার কবরে শুয়ে থাকে” নিশ্চুপ নিবেদিতারা….”