
লেখকঃ অন্যস্বর
‘সমকামীরা খারাপ’ এরকম একটা প্রিডমিন্যান্ট ধারণা চালু আছে আমাদের হেটেরোসেক্সুয়াল সমাজে। বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান দেশের অধিকাংশ মানুষ সমকামিতা ফলত সমকামীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে যারা সমকামী তারাও সমকামী কমিউনিটির মানুষদের ভাল চোখে দেখেন না। সমকামীরা সেক্স ফ্রিক, তাদের মোরাল, ফ্যামিলি ইত্যাদি ভ্যালুজ কম বা অপরিণত, তারা স্বার্থপর, হীনচরিত্র, হিংসুটে, মিথ্যেবাদী ইত্যাদি নানা অভিযোগ সমকামীদের সম্পর্কে শুনতে পাই। কিন্তু এই দোষ বা ত্রুটিগুলো আলাদাভাবে সমকামীদের মধ্যেই বিদ্যমান এমনটা বলা যায় না। সমকামীদের বাইরে বিষমকামী সমাজেও অসৎ মানুষের সংখ্যা প্রচুর। এমনকি আমরা সবাই কমবেশি অসৎ, এমনটা দেখিয়েছেন ড্যান এরিইলি তার অনেস্ট ট্রুথ এবাউট ডিসঅনেস্টি বইতে।
বিষমকামীরা সেক্স ফ্রিক না- তারা সমকামীদের মত যথেচ্ছা যৌনাচারে লিপ্ত হয় না অর্থাৎ বহুগামী নন, তার কারণ অবাধ যৌনতার সুযোগ বিষমকামী সমাজে নাই।
কিন্তু সমকামীরা সবাই কি বহুগামী, সেক্স ফ্রিক?
এর উত্তর মিলতে পারে ভিলফ্রডো প্যারেটোর 80/20 প্রিন্সিপ্যালে। ভিলফ্রেডো প্যারেটো একজন ইটালীয়ান অর্থনীতিবিদ যিনি ১৯ শতকের দিকে আবিষ্কার করেন ইংল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পদ ২০ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত।
পরবর্তীতে আরো বিস্তৃত গবেষণায় তিনি আবিষ্কার করেন শুধু সম্পদ নয় আর্থ-সামাজিক নানা ক্ষেত্রেই এরকম সমীকরণ বিদ্যমান যেখানে মোটামুটি ২০ শতাংশ ইনপুট থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ আউটপুট বা ফলাফল আসে।

উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে- 80/20 প্রিন্সিপ্যাল অনুযায়ী কোন শহরের ৮০ ভাগ ট্রাফিক জ্যামের জন্য মোটামুটি ২০ ভাগ রাস্তা দায়ী। আপনার ওয়ারড্রবের মোটে ২০ ভাগ কাপড় আপনি প্রায় ৮০ ভাগ সময় পরেন। আপনার মোবাইলের ২০ ভাগ এপ্লিকেশন আপনি ৮০ ভাগ সময় ব্যবহার করেন। সেই কারণে দেখবেন মোবাইল ম্যানুফেকচার কোম্পানিগুলো তাদের মোবাইলের সব ফিচারের উপর সমান গুরুত্ব না দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট ফিচারে বেশি গুরুত্ব দেয়,যেমন ইন্টারন্যাল স্পেস, ক্যামেরা রেজুলেশন, ব্যাটারি ক্যাপাসিটি। প্যারেটে প্রিন্সিপ্যাল অনুযায়ী কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ ভাগ প্রফিট আসে মাত্র ২০ ভাগ প্রোডাক্ট থেকে।
রবীন্দ্রসংগীতের কথা চিন্তা করুন, গীতবিতানে সংগীত রয়েছে ২২৩৩ টি, কিন্তু তার মধ্যে জনপ্রিয় মাত্র কয়েকশত। শুধুমাত্র এই অল্প সংখ্যক গান অধিকাংশ সময় গাওয়া হয়।
যারা নতুন ভাষা শিখেন তারা খেয়াল করে থাকবেন, বিদেশী ভাষা শেখার জন্য ঐ ভাষার সব শব্দ জানার প্রয়োজন হয় না, কিছু অল্প সংখ্যক শব্দ অধিকাংশ সময় মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করে। ইংরেজি ভাষায় প্রায় ১০ লাখ শব্দ রয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ১০০০ শব্দ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয়। একজন নরওয়েজিয়ান ভাষাতাত্ত্বিকের মতে একজন কৃষক সারাজীবনে মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ শব্দ ব্যবহার করে। অর্থাৎ ভাষার বেলাতে প্যারেটো প্রিন্সিপ্যাল আরো বেশি নন লিনিয়ার।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে গ্রুপ এসাইনমেন্টগুলো দেওয়া হয়, তাতে সব স্টুডেন্টের সমান অংশগ্রহনের কথা থাকলেও, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এসাইনমেন্টের ৮০ ভাগ কাজ করে মূলত ওই গ্রুপের ২০ ভাগ শিক্ষার্থী। ক্লাস পার্টিসিপেশনের ৮০ শতাংশ আসে মাত্র ২০ ভাগ শিক্ষার্থী থেকে।
এইভাবে আর্থ সামাজিক নানা পরিস্থিতি, প্রবণতা এই প্যারেটো প্রিন্সিপ্যাল দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়।
তো, প্যারেটো প্রিন্সিপ্যাল অনুযায়ী ‘সমকামীরা খারাপ’ এই নোশন কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?
প্যারেটো প্রিন্সিপ্যাল অনুযায়ী, অনুমান করা যায়, (যদিও এটা প্রমাণ সাপেক্ষ,) যে সমকামী সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের প্রায় ৮০ বা অনুরূপ পরিমান শতাংশে অংশগ্রহণ করে মোট সমকামীর মাত্র ২০ শতাংশ। ফলে এই ২০ ভাগ সমকামীর জন্য পুরো সমকামী কমিউনিটিকে সেক্স ফ্রিক মনে হয়।
অন্যদিকে, সমকামীদের ভালবাসার সম্পর্ক টিকে না এরকম আরেকটা ধারণা চালু আছে সমকামী কমিউনিটির মধ্যে।
বিষমকামীদের তুলনায় সমকামীদের মধ্যে ব্রেক আপ হওয়ার প্রবণতা বেশি এবং তার কিছু বাস্তব সম্মত কারণ রয়েছে,সেটা ভিন্ন আলাপ। কিন্তু তাই বলে সমকামীদের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব নয় এরকম সিদ্ধান্তে আসা যায় কি? এ ব্যাপারে প্যারেটো প্রিন্সিপ্যালের প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে মনে হয়।
কিছু অল্প সংখ্যক সমকামী অধিকাংশ ব্রেক আপগুলো ঘটায়, কারণ ব্রেকআপের পর তারা পুনরায় সম্পর্কে জড়ায় এবং ইভেনচুয়ালি আবার ব্রেক আপ করে। এভাবে এই চক্রের আবর্তন ঘটে, এবং তার ফলে ‘সমকামীদের সম্পর্ক টিকে না’ এরকম একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। সমকামীদের একটা বড় অংশ এই চক্রের বাইরে থাকা সত্ত্বেও তারা ঐ অল্প সংখ্যক সমকামীদের প্রেম সম্পর্কিত ব্যর্থতার দায়ভোগী হয়।