
লেখকঃ আ জা হিমু
কী অদ্ভুত !
এটাকে সিক্সথ সেন্স বললেও কম বলা হবে। এটা নির্ঘাত সেভেনথ সেন্স।
আবার কাকতালীয় বললেও নিতান্তই কম হয়ে যাবে। এটা অবশ্যই ময়না,টিয়া,শালিক,কোকিলতালীয়। কেন? বলছি। প্লিজ একটু অপেক্ষা।
রাত বাজে আড়াই টা। শীতের রাতের এই সময়টাতে সবাই হয় অন্যের গায়ের সাথে লেপ্টে পড়তে চায়। অথবা নিঃসঙ্গ কম্বলের সাথে সহবাস করতে চায়।
ভিশন একটাই।
একটু উষ্ণতার জন্য…..।
আমি কেন ঘুমাইনি জানিনা। ইন্সমনিয়ার রোগী আমি নই।
গত তিন দিন ধরে এই সময় টাতে আমি জেগে থাকি। ঘুমিয়ে গেলেও জেগে যাই।
খুব ইচ্ছা করে ওই ছেলেটার সাথে একটু কথা বলতে। তুলুতুলে কম্বলের মাঝে ওর ভরাট বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে। ওর ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই। কিন্তু আমার টা তো ওর কাছে আছে। কেন যে নাম্বার নিয়েও ফোন দেয়না। অথচ নাম্বার নেয়াতেও তার সে কি নাটকীয়তা।
“এই হিমু, তোমার নাম্বার গুলো আমাকে একটা কাগজে সুন্দর করে লিখে দাও ভাই।”
“কেন ইমন ভাইয়া, আপনি তো ফোনে এখন সেভ করে রাখলেই পারেন।”
“উহু। আমি রাতে মানিব্যাগ থেকে কাগজ টা বের করে আগ্রহ নিয়ে খুলে একটা একটা করে নাম্বার তুলে তোমাকে ফোন দেব। অন্যরকম এক অনুভুতি !”
“আপনার বয়স কত ইমন ভাই?”
“বত্রিশ বছর।”
“এই বয়সে এত পাগলামী? আমার মত যখন তেইশ-চব্বিশ ছিলেন তখন?”
“নাম্বার লিখে দাও তো।”
দিলাম। অথচ আমি তার নাম্বার চাইতেই কি মেয়েমানুষী। বলল- “আমি তোমাকে ফোন করলেই নাম্বার পেয়ে যাবা।”
আমাদের কোন রকম সম্পর্ক নেই।
ভালবাসা,প্রেম,বন্ধুত্ব কিছুই না। অথচ কত জনমের অধিকার নিয়ে আমরা মাত্র একটি সন্ধ্যা কথা বলেছি, দুষ্টুমি করেছি। এত ভাললাগায় আমার সারা দেহ ভেতরে ভেতরে কেঁপেছে। ইশ! ইমনে ভাইয়ের মত সুপুরুষ একজন যদি কেউ আমাকে ভালবাসতো !
নাম্বার নেয়ার পর মাঝরাতের পরে কেন যেন ওনাকে আমার খুব বেশী মনে পড়ে। আজও তেমনি। রুটিন করে ঘুম ভেঙে গেলো। ফোন হাতে করে কম্বলের নিচে শুয়ে আছি। যদি ইমন ভাই একবার কল দিত।
আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে ফোনের রিং বেজে উঠল।
কোথা থেকে এত আত্মবিশ্বাস জন্মেছে কে জানে, আমি ফোন রিসিভ করেই বললাম-
“ইমন ভাইয়া আই মিস ইউ।”
কিছুক্ষন চুপ ওপাশে। হয়ত অন্য কেউ কল করেছে। মন টাই খারাপ হয়ে গেল। ওপাশ থেকে কেউ একজন খ্যাঁশখ্যাঁশে গলায় বলল-
“হিমু তোকে এত রাতে মনে পড়ছে কেন আমার এত?”
তিন-চার দিনের পরিচয়ে এত মায়া,আবেগ আর টান তৈরি হয়ে গেছে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। ইমন ভাই আমাকে তুই করে এত দরদ দিয়ে কথা বলছে।
অকারনে আমার চোখে জল চলে আসল। বললাম-
“আল্লাহর কসম, বিশ্বাস করেন আমি এখন আপনার কথাই ভাবছিলাম।”
“এটা কি ধরনের সিক্সথ সেন্স বলতো হিমু?”
আহ! কি এক ভাললাগায় আমি কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম সে রাতে। হতে কি পারে ইমন আমার সমচাহিদা জীবনের প্রথম প্রেম? এত সোজা!! কি অদ্ভুত !
আমি ঢাকাতে এসেছি একসপ্তাহ।
বেড়াতে আসলেও বেশীরভাগ সময় আমি ঘুমিয়ে কাটাই। সন্ধ্যা হলে শাহবাগে গিয়ে পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসে একা একা মানুষ দেখি। মোবাইল টিপি। কত জন নির্লজ্জের মত ঘুরঘুর করে চারপাশে। যেন আমি একটা পণ্য। আমার বিরক্ত লাগে।
হঠাৎ এক শুক্রবার আমার ঠিক পাশেই কোনার দিকে সিঁড়িতে অসম্ভব সুন্দর এক পুরুষ (ছেলে বললে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়) জুবুথুবু হয়ে হয়ে বসে থাকলো আমার মত একা একা।
এত সুন্দর দেখতে! নিষ্পাপ চাহনি। শীতের প্রকোপের তুলনায় গায়ে গরম কাপড় খুব অল্প উষ্ণতা দিচ্ছে, বোঝা যায়।
কতবার চোখে চোখ পড়ল। দুজনেই ভীতু। কেউ হ্যালো বলার সাহস টুকু পেলাম না।
মোবাইলের হালকা ভল্যুমে সে একটা গান বারবার শোনে “যদি ডেকে বলি এস হাত ধরো, চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে ….. এস গান করি মেঘ মল্লারে। করুন ধারা দৃষ্টিতে। চল ভিজি আজ বৃষ্টিতে। “
কী আশ্চর্য! আমার পছন্দের গান। যা শুনলে ভেতর টা আবেগে ভিজে যায় আমার।
এই ছেলে কে? আমার পাশে কেন থাকছে সে দু’তিন দিন?
প্রকৃতি কি কিছু ঠিক করে রেখেছে আগে থেকে?
ঢাকা থেকে চলে আসার আগের দিন আমি যথাস্থানে বসে আছি। আমার কেন যেন মনে হল উনি আমার জন্যই প্রতিদিন এখানে আসছে।
আমি চুপচাপ বসে সেই গানটি আমার ফোনে শুনছি। সে আসলো। তার যায়গায় বসে হঠাত চমকে আমার দিকে তাকালো। আমি তার গানটি শুনছি বলেই হয়ত।
এত বোকা মানুষ হয়। কোন কথা বলছে না।
অথচ আগামীকাল থেকে আমাদের আর দেখা হচ্ছে না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। এক পলকে আমার চলে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখে সে অবাক হল।
আমি কিছু না বলেই চলে এলাম। কি লাভ এক পাক্ষিক মায়া বাড়িয়ে।
পাবলিক লাইব্রেরীর গেটে এসে থমকে দাঁড়ালাম। আমার কেন জানি মনে হল সে আমার পেছনে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। এই বুঝি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলবে, “তোমার নাম কি? কেন আমাকে পাগল করলে তুমি?”
পেছনে তাকিয়ে শুধু তাকেই পেলাম না।
প্রেম, ভালবাসা বড় অদ্ভুত জিনিস। মানুষ কে নেশাগ্রস্ত করে দেয়।
আমি এত সহজে কেন তার জন্য মায়া বোধ করছি?
কেন এত ভালবাসা জন্ম নিচ্ছে একটা ছেলের প্রতি?
তার চেহারায় অকৃত্রিম এক মায়া আছে এজন্য?
কেবল মানুষের চেহারার এমন সম্মোহনী ক্ষমতা থাকতে পারে?
করে দিতে পারে আমার মত আবেগী এক ছেলেকে এত বেহায়া? এত নির্লজ্জ?
আমি মাতালের মত সিঁড়িতে আবার ছুটে এলাম। কোন রাখঢাক না রেখে তার সামনে গেলাম। তীব্র ভাবে অপমানিত হতে পারি, ভুল দরজায় কড়া নাড়তেই পারি। সে আমার মত নাও হতে পারে। এত সব সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে আমি সহজ স্বাভাবিক ভাবে নির্লজ্জের মত তাকে প্রথমেই বলে বসলাম-
“আপনি ভেবেছেন আমি কাল আবার আসব এখানে। আমি কাল সকালে বাড়ি চলে যাচ্ছি।”
আমার দিকে সে তাকালো। হয়ত এখনি সে আশপাশের লোকজনকে শুনিয়ে চিৎকার করে বলবে, “আপনি বাড়ি যাচ্ছেন তো আমার কি? গে গিরি করার আর যায়গা পাননা? পিটিয়ে ছাতু করে দেব।”
বলাটা আস্বাভাবিক কিছু না। অথচ সে কিছুই বলল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে সিনেমাটিক ভাবে বলল,
“আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না ছেলে। “
কি সুন্দর বাচনতা! আসলেই কিছু গে ছেলেরা অনেক রোমান্টিক আর আর্টিস্টিক হয়!
সেদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত আমরা একসাথে কাটালাম। বহুজনমের পরিচিতের মত একে অপরের হাত টা এক মুহুর্তের জন্য ছাড়লাম না।
টানা দুটি বছর আমাদের সম্পর্ক চলল। আমি ঢাকা যাই। সে ফরিদপুর আসে।
কি যে স্বর্গ আমি খুঁজে পেয়েছি।
একবার ঢাকা থেকে ফিরছি। সময়টা সম্ভবত জুন মাস। এত গরম!
আমি বরাবরের মত বিদায় নেয়ার সময় ওর বুকে পাঁচ মিনিট আশ্রয় নিয়েছি। আমার পিঠ চাপড়ে ইমন বলেছে, “পাগলা আমাকে ইমোশনাল করিস না। যা ভাল থাকিস।”
আমি যখন বাসে, ইমন ফোন করল।
“হিমু তোকে যে আমি একটা মিথ্যা বলেছি।”
“ভাল করেছো। চুপ থাকো।”
“তোকে শুনতে হবে।”
“উহুম। আমি শুনতে চাই না। তোমাকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছে। ফোন রাখছি।”
আবার ইমনের ফোন।
কন্ঠে কি এক বিষন্নতা! আমার পৃথিবী নড়ে উঠলো। কি এমন সত্যি ইমন বলতে চায় আমাকে?
খারাপ কিছু?
যা শুনে আমি কষ্ট পাবো!
বললাম, “বল ইমন, আমি স্বাভাবিক ভাবেই শুনছি।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে ইমন জড়ানো গলায় কিছু সত্য শুনিয়ে দিলো।
দু’দিন মনটা খুব খারাপ থাকলো।যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। তিন দিনের দিন আমি আর থাকতে পারলাম না।
ফোন করেই আনন্দিত হওয়ার ভান করে বললাম, “এই পঁচি ছেলে, এমন হাজার টা সত্য শোনালেও আমি তোমাকে কখনওই ভুলে যাবোনা। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো? তুমি মিথ্যা বলেছো ভয়ে। যদি আমাকে হারিয়ে ফেলো সত্যি বললে, এই ভয়ে।
আমাকে পাওয়ার জন্য, আমাকে হারানোর ভয়ে যে ছেলে মিথ্যা বলে, তার ভালবাসাই আমার দরকার।”
কি দিয়ে কি বলেছিলাম কে জানে। সে রাতে এতবড় একটা ছেলে মোবাইলে কত হাহাকার নিয়ে কাঁদলো। বারবার বলল, “হিমু ইউ আর দ্য গ্রেট!”
ইমন বিবাহিত। ওর বউ আছে, সন্তান আছে, সংসার আছে; এটা কে আমি সহজ ভাবেই মেনে নিয়েছি।
ভালবাসা মানুষকে স্যাক্রিফাইস করতে শেখায়।।
সমস্যা অন্য যায়গায়। আমার সাথে ইমনের সম্পর্ক ওর স্ত্রী জেনে ফেলেছে। কি ভয়ঙ্কর !
দুটি ছেলের মাঝে এমন সম্পর্ক ওর ওয়াইফ মেনে নিতে পারেনি। কথাও না মেনে নেয়ার। লোক জানাজানি হলে ইমনের অবস্থা কি হবে?
আমাদের সমাজ তো এটাকে অন্য চোখে দেখে।
কি দিয়ে কি হলো, আমার সাথে ইমনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে চাকরিতে ট্রান্সফার হয়ে ইমন চলে গেলো সিলেট। আমি অসহায় হয়ে গেলাম যেন।
আমাকে কোন কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করল না ইমন। নাম্বার অফ। চিরদিন অফ।
আমি দিশেহারা।
জীবনে ভাল খুব কম বেসেছি।
কষ্ট ও তাই কম পেয়েছি। ইমনের সাথে এইভাবে আমার সম্পর্ক হয়ে যাবে, এটা আমি কখনও ভাবিনি।
ঠিক ওর সাথে আমার সম্পর্ক এত সহজ-স্বাভাবিক ভাবে শেষ হয়ে যাবে এটাও ভাবিনি।
দিনগুলো আমার এত কষ্টে পার হলো যে আমি আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হতাম।
রিমন নামে আমার এক বন্ধু আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো। ইমনের এমন হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুনে আমাকে ও কোনপ্রকার সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না।
চেস্টাও করল না।
আমি বাকহীন হয়ে বসে থাকি, আর ও আমার নিরবতাকে দূর্বলতা ভেবে এক এক করে কথা বলেই যায়-
“হিমু, গে দের আবার সম্পর্ক কি রে? একটা ছেলের সাথে তোর সম্পর্ক হবে। একদিন বিছানায় গিয়ে তোরা সেক্স করবি। সব মিটে যাবে সাধ। আবার শুরু হবে প্রজন্মের খেলা। অন্য ছেলের সাথে। তার থেকে তুই জেরিন কে ভালবাস। মেয়েটা তোর জন্য এত পাগল। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? আমি জানি, ইমন সেক্স করার জন্যই তোর সাথে রিলেশন করেছিলো।”
আমি থাকতে পারিনা। লাল চোখে ওর দিকে তাকানোর সাহস পাইনা।
মাটিতে তাকিয়েই বলি- “শাট আপ রিমন। আমার আর ইমনের এখনো সেক্স হয়নি।”
বলতে এত লজ্জা লাগে আমার।
রিমন আবার বলে-
-“একজন বাই সেক্সুয়াল হয়ে কেন তবে একজন টপ ছেলেকে ভালবাসিস?”
শব্দগুলো শুনে আমার এত ঘেন্না ধরে যায়।
ওরা কেন বুঝতে চায়না ভালবাসায় এসবের কোন মূল্য নেই। মায়া,টান অন্য ব্যাপার। টপ,বটম অন্য ব্যাপার। আমি তো সেক্স কে কখনই সেক্স বলিনা। শারিরীক সম্পর্ক কে আমি বলি ভালবাসা।
আমি ইমনের দোষ দিতে পারলাম না।
নিশ্চই ওর কোন বিপদের কারনে আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
পৃথিবী বড় কঠিন জায়গা। পৃথিবীর কাঠিন্যতা ভালবাসা কে স্থান থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে।
মন থেকে পারে কি?
পেরেছে কি ইমন আমাকে ভুলে যেতে?
আমার মনে হয় না।
আমাকে বিদায় দেয়ার সময় যে শক্ত-সামর্থ পুরুষটি বাচ্চাদের মত শক্ত করে হাত জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেলে বলে, “না, তুই আরো কদিন থাক আমার সাথে”, সেই ছেলে আমাকে এত সহজে ভুলে আছে, আমার বিশ্বাস হয়না।
তারপরও কথা থেকে যায়। কোন শোকই দীর্ঘ হয়না।
আমি নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলাম।
ওকে ভোলা যদিও আমার পক্ষে সম্ভব না।
ভান করলাম ইমনকে আমি ভুলে গেছি।
আমার প্রচন্ড ইচ্ছা করত একবার যদি ওর বুকে আছড়ে পড়ে কাঁদতে পারতাম।
যদি পারতাম ওর বুকে মুখ গুজে ওর ভেতরের ঘ্রাণ টা নিতে। ওর গহীনের শব্দ গুলো শুনতে..।
গত জানুয়ারি মাসের কথা।
আমি আর থাকতে পারলাম না। আমার মনে হলো, ইমনহীন জীবনে আমি আর একটা মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারব না।
ওর সাথে আমার দেখা করতেই হবে।
আমি ঢাকাতে শাফকাত ভাই কে ফোন করলাম।
-“প্লিজ ভাই আর না করবেন না,আপনার পায়ে পড়ি। ইমন ভাইয়ের ফোন নাম্বার টা দিন প্লিজ। ঠিকানাটাও প্লিজ।”
আমার কন্ঠে কি আকুতি ছিলো, সেটা সম্ভবত শাফকাত ভাই বুঝতে পারলো। তা না হলে যে লোক আমাকে ইমনের নাম্বার দিতে এত খেলা করেছে, সে এত সহজে ইমনের নাম্বার দেয়ার লোক না।
জানুয়ারিতে খুব শীত পড়ে। আমি করলাম কি ওই শীতের মধ্যেই একদিন সিলেট চলে এলাম ইমন কে না জানিয়ে।
এর মাঝে একদিন ইমনকে ফোন দিলে খুব কড়া ভাষায় আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
তাই ভাবলাম সিলেট গেলে এতটুকু ছেলেকে ইমন ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ও এত খারাপ না।
রাত ৯ টার দিকে শীতে কাঁপতে কাঁপতে সিলেট উপশহরে ইমনের অফিসের পাশে হোটেল রোজ ভিউ এর সামনে থেকে ইমন কে কল দিলাম।
“আমি এসেছি। দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আসো। আমার সাথে একবার দেখা দিয়ে যাও।”
আমার সকল বিশ্বাসের বুকে ছুঁড়ি চালিয়ে ইমন আমাকে কুকুরের মত ফিরিয়ে দিল।
আমি সিলেট আসার পরেও ও আমাকে ফিরিয়ে দিবে, এটা আমার ভাবনার বাইরে ছিলো।
কেন এমন করছে ইমন? আমাকে ভুলে যাওয়ার কেন এত প্রাণান্ত চেস্টা ওর?
সমস্যা এত গুরুতর?
ও বাস্তবতা অথবা আবেগ, কোনটাকে গুরুত্ব দিবে খুঁজে পাচ্ছে না ! কি কষ্ট আমার।
আমি অনেক পায়ে ধরেও ইমনের দেখা পেলাম না।
ফিরে আসার জন্য নিকষ কষ্টে পা বাড়ালাম।
বাসস্টপেজে বসে আছি। রাত ১২ টার গাড়ি ধরব।
শুকনা,চোখ-মুখ।
শীতের তীব্রতা গায়ে লাগছে না আমার।
ইমনের ফোন আসলো।
ধরব না ধরব না করেও ধরে ফেললাম।
উদভ্রান্ত কণ্ঠ ইমনের-
“হিমু তুই কোথায়? যেখানেই থাকিস, প্লিজ থাম। আমি আসছি।”
আমাকে এক নজর দেখার আশা পূরণ করতে ইমন আসলো।
আমার সামনে উদভ্রান্ত,কষ্টে পোর খাওয়া, চোখের নিচে কালি পড়া এক ইমন দাঁড়িয়ে।
আমার চোখে জল আসবে না এটা দেখে, অসম্ভব!
আমাকে শক্ত করে বুকে টেনে নিলো ইমন।
আমার বুক কেঁপে উঠলো। থাকতে পারলাম না।
বাচ্চাদের মত কান্না চেপে গেলো আমার।
ইমন জড়ানো গলায় বলছে- “আমাকে মাফ করে দে। প্লিজ হিমু আমাকে মাফ করে দে। আমি খুব বিপদে আছি তোকে ভালবেসে। তাই দূরে আছি।”
আমি ইমনের মুখের দিকে একবার অসহায়ের মত তাকালাম।
এত কান্না আমার জমে ছিলো, আমি অবাক হলাম।
ইমন আবার বলল, “কাঁদিস না। আমি তোকে আমার জীবনের থেকেও বেশী ভালবাসি। তোকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার মেয়েটা না থাকলে তোর সাথে পালিয়ে যেতাম লক্ষী। “
আমি ইমনের চোখের জল মুছে দিলাম। এতবড় একটা ছেলে। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে আশ্বাস দিলো, আমাকে আর ভুলে যাবে না।
আমি অনেকদিন পর মানসিক প্রশান্তি পেলাম।
বাস্তবতা, সমাজ ভুলে গেলাম।
বললাম – “আমি এত কাঁপছি কেন ইমন? আমার শরীর খারাপ লাগছে ইমন। আমাকে একটু উষ্ণতা দাও। একটু আদর করো।”
আশপাশের দু’একটি উৎসুক দৃষ্টি কে উপেক্ষা করে ইমন আমার ঠোট ওর ঠোটে নিয়ে নিলো।
এমন আদর আমি অনেকদিন পাইনি।
এত প্রেম, এত ভালোবাসা পৃথিবীতে কেন দিয়েছে বিধাতা?
আজনের কুয়াশামাখা আকাশে তাকিয়ে একটা উত্তর শুধু পেলাম- “একটু উষ্ণতার জন্য….!”
প্রথম প্রকাশঃ বাংলা গে গল্প। ১০ই আগস্ট, ২০১৩।