
লেখকঃ শিশির রায়হান
ট্রেন ধীরে ধীরে চলা শুরু করেছে।
ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ার একটা ইচ্ছে হল। এই ইচ্ছেটা প্রতিবারই হয়। কোথায় যাচ্ছি বা কোথা থেকে আসছি সেটা ব্যাপার না। একটা জায়গায় কিছুদিন থাকলেই আমার একটা আসক্তি জন্মায়। অনেকটা বেড়ালের মত স্বভাব। বেড়াল কুকুরের মত প্রভুভক্ত হয় না, স্থানভক্ত হয়।
তবে ইচ্ছেটা প্রগাঢ় না, হাল্কা। আজকাল হাল্কা ইচ্ছেয় কিছু হয় না। জোরালো ইচ্ছে লাগে, যে ইচ্ছের তোড়ে দমবন্ধ হয়ে আসে। আমার দমবন্ধ হয়েও এলো না, অতএব ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়াও হলো না। কোনদিনই হয় না অবশ্য। সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে তাই পাশের যাত্রীর দিকে নজর দিলাম। পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এক আঙ্কেল। ধুত্তুরি! সবার ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে কোন সুন্দর ছেলে বা সুন্দরী মেয়ে জোটে আর রসিয়ে রসিয়ে সেই কাহিনী শোনায়। আর আমার কপালে জোটে দিন মাটি করা সব চরিত্র। আজ অবশ্য রাত মাটি হবে। রাতের রেলভ্রমণ করছি।
আঙ্কেল এরই মাঝে নাক ডাকা শুরু করেছেন। এমনিতেই জার্নিতে ঘুম আসে না, তার উপর এই কুম্ভকর্ণ মার্কা নাক ডাকার শব্দেতো কোন মতেই আসবে না। তাই স্মৃতিচারণ শুরু করলাম।
***
‘তোমাকে আমি খুন করবো, এখন বলো কিভাবে খুন হতে চাও।’
তোমার শিশুসুলভ কথায় হাসতাম। এমন কথায় না হেসে পারা যায়? বলতাম, ‘তুমিই বলো কিভাবে খুন করতে পারলে তুমি খুশি হবে।’ তোমার প্রতি ভালোবাসা তখনো তৈরি হয়নি। কেবল একটা চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল আর হয়তো খানিকটা ভালোলাগা। আমার এহেন উত্তরে তুমি ভাবতে বসতে। নিত্যনতুন উপায় বের করতে আমায় খুন করবার। সৌভাগ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টের পায়নি, তবে হাতকড়া তোমায় পড়তেই হতো। তবে একটা কাহিনী আমার অনেক পছন্দ ছিল। সেটাই বারবার শুনে চাইতাম তোমার কাছে।
তুমি বলতে, প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন আমার পরনে থাকবে নীল শার্ট আর তোমার পরনে থাকবে সাদা পাঞ্জাবী। নীল তোমার প্রিয় রঙ। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, আমি তবে সারা শরীরে নীল রঙ মাখিয়ে আসবো। যদিও তোমার মুখ দেখতে পেতাম না, স্পষ্ট বুঝতাম আমার ঠাট্টায় বিরক্ত হতে। রোমান্টিক কথার মাঝখানে ঠাট্টা তোমার একদম অপছন্দ। কি করবো বল? আমি বান্দা নিরুপায়, ঠাট্টাই যে আমার সহায়। বিরক্ত ভাবটা কাটলে বলতে, দেখা হলে প্রথমে আমরা দুজন দুজনার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবো। তাতো থাকবোই, যার মুখখানি এত সুন্দর তার দিকে তাকিয়েতো থাকতেই হবে। আমার ঠাট্টায় বিরক্ত হতে তুমি আবার। বলতে, চেহারার দিকে না, শুধু আমার দুটি চোখের দিকে তোমার দুটি চোখ।
হুম! চোখ বলে মনের কথা। তারপর?
তারপর তুমি কিছুখনের জন্যে আমার হাতটা ধরবে আর আমার ডান গালে আলতো করে চুমু খাবে। আমরা বাঙ্গালীরা লাজুক কিনা। তাই গালেই চুমু সই। হলিউড ফিল্ম হলে লজ্জা বিসর্জন দিয়ে আমিই তোমার ঠোঁটে চুমু খেতাম। চুমু খাবার পরে হাল্কা স্বরে বলবে, তুমি আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছো। এরপর আমার বুকে বসিয়ে দেবে ছ’ইঞ্চি ফলার এক ছুরি। আমার জীবনাবসান হলে গুনে গুনে ঠিক তিন ফোঁটা চোখের জল ফেলবে। তারপর ছুরিটা বসিয়ে দেবে নিজের বুকে।
***
‘বিস্কুট খাবা?’
আঙ্কেলের ডাক শুনে স্মৃতিচারণে বাধা পড়লো। আঙ্কেলের নাক ডাকা বন্ধ হয়েছে। তিনি আপাতত উদরপূর্তিতে ব্যস্ত। আমি একটা সৌজন্যের হাসি দিয়ে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। এরপর আবার স্মৃতিচারণে ফিরে গেলাম।
***
আমাদের পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেম হয় নাকি আবার? হয়, তবে তাতে খাদটা একটু বেশীই থাকে আরকি। আজকাল খাঁটি কিইবা আছে? আমাদের ভালোবাসা হয়তো খাঁটি ছিল, কিন্তু পরিনতি তো সেই খাদপূর্ণ প্রেমের মতই হলো।
প্রথমে দীর্ঘ সময় চ্যাটিং করা, এরপর তার চাইতেও দীর্ঘ সময় ধরে ফোনে কথা বলা, এই দিয়ে শুরু। নাহ, শুরুতে ভালোবাসা, ভালোলাগা কোনটাই ছিল না। সময় লেগেছে অনেক। অন্তত আমার পক্ষ থেকে। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতাম না, তোমার ভালোলাগা প্রথম থেকেই ছিল কিনা। কিংবা বোঝার চেষ্টা করতাম না। আমি বরাবরই অসাড় প্রকৃতির। তবে যে আমি ফোনে কথা বলতেই বিরক্ত বোধ করি, সে আমিই যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা ফোনে কথা বলে গেছি তখন বলা যেতে পারে আকর্ষণ কিছুটা হলেও ছিল।
ভালোলাগার কথাটা জানালে প্রথমে তুমিই। সাড়া দেবো কি দেবো না প্রথম প্রথম ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। অসাড় প্রকৃতির হলেও আমারো একটা মন আছে। একসময় তাই সাড়া দিতে শুরু করলাম। তবে সাড়া দিলেও ভাবতাম অনেক। কারণ বাস্তব চিন্তায় এ সম্পর্ক হবার নয়। আমরা দুজনে দু’শহরে থাকি। ফেসবুকে ছবিতে একে অন্যকে অনেক দেখা হয়েছে কিন্ত সামনা সামনি দেখা হয়নি কখনো। তাছাড়া তুমি অনেক ধনী পরিবারের সন্তান আর আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাপোষা ছেলে। এসব বোঝাবার চেষ্টা কম করিনি। কিন্তু বুঝতে চাওনি। দোষ দেব না, বয়সতো বেশি নয়, বাস্তব চিন্তার ব্যাপারটা তোমার থেকে আশা করা যায় না। আমিই বা কিসের বুদ্ধিমান? ভালোতো বাসলামই শেষ পর্যন্ত। তবে এটাও ঠিক যে এই সবের কোনটাই আমাদের সম্পর্কের বাধা হয়নি।
দেখা হয়েছিল আমাদের। আমিই ছুটে গিয়েছিলাম আমার শহর থেকে তোমার শহরে। সেই ১০ ঘণ্টার পীড়াদায়ক বাসজার্নির কথা ভোলা সম্ভব না। পা দুটো ব্যথায় টনটন করছিল। তবে তোমার সাথে দেখা হবে সেই চিন্তাটা কষ্টটাকে টের পেতে দেয়নি। মজার ব্যাপার হল, তোমার বলা কাহিনির মত কিছুই করা হলো না। আমাদের পরনে সাদা নীল তো ছিলই না, বরং সেদিন আকাশটা জুড়ে ছিল কালো থমথমে ভাব। হয়তো আসন্ন দুর্যোগের সম্ভাবনায় তার মনটাও ভারী হয়ে ছিল। দুর্যোগের আভাস টের পেলাম তোমার সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই। তোমার মুখে হাসি ছিল ঠিকই কিন্তু দুচোখে ছলছল ভাব। বললে, তুমি না আসলেই ভালো হতো। বুকে শেল বিঁধল বটে, তবে এর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম। অসম্ভবকে সম্ভব ভেবেছিলাম ঠিকই কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনাটাও মাথা থেকে একেবারে দূর করে দেইনি কখনো। তাই প্রস্তুত ছিলাম প্রত্যাখ্যাত হবার জন্যে। তবে প্রত্যাখ্যাত হয়নি তখনি, অন্তত সেদিনই নয়।
দিন সাতেক ছিলাম তোমার শহরে। এই সাতটা দিন কোন পাগলা হাওয়ায় মাতাল হয়ে ছিলাম যেন। কত কিছুই না করলাম! এসময়টুকুতে তোমার চোখে দুঃখের এতোটুকুন আভাসও দেখতে পাইনি। কিন্তু শেষ দিনটায় সব হাওয়া একত্র হয়ে তুফান তুললো।
তোমাদের বিল্ডিঙের ছাদে বসে সময় কাটাচ্ছিলাম দুজনে। সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে হবে। পরদিন সকালের ট্রেনেই আমি ফিরে যাবো। আচমকা বলে বসলে, তোমার সাথে আর দেখা হবে না। বুকটা কেপে উঠলো আমার। তোমার বাবা মা ঠিক করেছেন তোমাকে ইউ এস এ পাঠিয়ে দেবেন। অতএব এ সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব নয়।
প্রথমে অনেক যুক্তিতর্কে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে দূরত্ব এখন ব্যাপার নয়, আমাদের ভালবাসাটাই আসল। প্রেমে পড়ে অবশ্য আমি নিজেই বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলেছি। শুরুতে তুমি অবাস্তব কল্পনা করলেও বাস্তবতাকে এখন ঠিকই আঁকড়ে ধরলে তুমি। আমাদের ভালবাসাটা হয়তো আগের মতই রইল কিন্তু সম্পর্কটা ছিটকে গেল। অনেকদিন পর কাদলাম আমি সেদিন। বাচ্চা ছেলের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে সন্ধ্যাটা পার করলাম।
***
আঙ্কেল আবার নাক ডাকা শুরু করেছেন।
করুক! আমার তো এমনিতেই ঘুম আসবে না। তোমায় নিয়ে চিন্তা শুরু করলেই এখনো অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘোরাফেরা করে।
***
তুমি ইউএসএ চলে যাবে তাই কি আমাদের সম্পর্কটা টিকলো না শেষ অবধি? কারণটা যে তা নয়, তা আমি জানি। জানতে পেরেছি সেই সন্ধ্যার পরে। তোমার ক্যান্সার আছে, ধরা পড়েছে দু’বছর আগেই। সময় বোধহয় বেশী দিন নেই তোমার। চিকিৎসার সুবাদেই স্থায়ীভাবে তোমাকে ইউএসএ পাঠানো হচ্ছে। সেদিন সম্পর্ক শেষ না হলেও হয়তো বেশী দিন দীর্ঘস্থায়ী হতো না।
তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন? তুমি বেশিদিন বাচবে না জানলে কি তোমায় ভালবাসতাম না? সে জানবার উপায় তো এখন নেই। শুধু কি আমার ভালো চেয়েই সব শেষ করলে? নাকি নিজের কষ্টটাই এড়াতে চেয়েছিলে? সবই যখন জানতে, তখন কেন মিছে মায়ায় বাধিয়েছিলে? আবার চলেও গেলে কেন?
ভালো যখন বেসেছি তখন চেয়েছিলাম দূরত্ব, সময় কিছুই যেন আমাদের মাঝে না আসে বাধা হয়ে। সেটাই বা মানলে না কেন?
সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভেবেছি অনেক কিন্তু কিছুই মেলাতে পারি নি। সব উত্তরই ঘোলাটে। তবে আজকে কিসের আশায় এই রেলভ্রমণ করছি? যা হওয়ার নয় তার প্রত্যাশায়? এর উত্তর আমার কাছেও নেই। তবে তোমায় শেষ একবার দেখতে ইচ্ছে করে। দেখা পাবো কি না তাও তো জানি না।
তবু শেষ চেষ্টা একবার।
সেই চেষ্টা সফল করতেই বোধকরি ট্রেনটা ছুটে চলে সামনে। অনেক শহর, গ্রাম পেছনে ফেলে তোমার শহরে।
প্রথম প্রকাশঃ বাংলা গে গল্প। ১৩ই আগস্ট, ২০১৩।