
লেখকঃ অমিম জিফান
গল্পটি উৎসর্গ করছি হোসেন মাহমুদ, আকাশ রহমান ও আনন্দ ধারা ভাইয়াকে। এই তিনজনের প্রেরণায় এই অর্বাচীন এর গল্প লেখায় পদচারণা। তাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি.
১.
১৯১৮ সাল।
তখনকার দিনে সারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী তীব্র অসহযোগ আন্দোলন চলছে, কলকাতার ছাত্ররাও এর বাইরে নয়। নিত্য জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙতে তারা এগিয়ে আসছে প্রথমেই। ব্রিটিশরা যাদের সামনে পাচ্ছে গায়ে খাদি খদ্দর চাপানো, তাদেরকেই পুরে দিচ্ছে গারদে। সেদিন ছিল সোমবার। পার্ক স্ট্রিট এ দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছে একদল। এদের একজন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি। পারিবারিক ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের বাইরে এসে পায়ে কাঠের খড়ম আর গায়ে মোটা কাপড়
চাপিয়ে দেয়ালে ব্রিটিশবিরোধী শ্লোগান লিখে যাচ্ছে। অতর্কিত ভাবে পিছন থেকে রাজসৈনিকরা তাদের ঘেরাও করে ফেলে। নিরস্ত্র ছাত্রদের নির্মমভাবে অত্যাচার করে গাড়িতে তুলে নেয়। যখন অনিরুদ্ধের পালা চলছিল তখন, আচমকা সৈনিকদের উপর পাল্টা আঘাত হেনে বসে সে, এক আঘাতেই লালফৌজের একজনের মাথা ফাটিয়ে দু ভাগ করে দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। শুরু হয় অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরির জীবনের
ফেরার হয়ে যাওয়ার এক আশ্চর্য সুন্দর অধ্যায়।
২.
বিক্রমপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম, সুতানটি গ্রাম।গ্রামটি অনেক সুন্দর, পাশ থেকে বয়ে যাওয়া এক ছোট নদীতে তাঁদের সমস্ত জীবনের হাসিকান্না। কারণ এ নদী থেকেই তাদের পেটের খোরাকের উৎস। নদীর নাম আংড়াভাসা নদী। এখানে মানুষগুলো অনেক আমোদ ও শান্তিপ্রিয়, প্রতি চাঁদের রাতে এখানে চলে কবিগানের আসর।
দূরের গ্রামগুলো থেকে অনেক মানুষের আনাগোনা চলে এখানে প্রতি চাঁদের রাতে। তাঁদেরকে চিনেজোঁকের মত আকৃষ্ট করে এই কবিয়ালের কবিগানের আসর। সবার মুখে মুখে শুধু দুজনের নাম। তাঁদের একজন এ গ্রামের বাসিন্দা, নাম সরকার গৌরব বসাক। নদীর ধারে একটা ছনেঘেরা কুঁড়েঘর, এই কুঁড়েঘরের চারদিকে বেশ উঁচু উঁচু টিলা রয়েছে আর পাশে কুলকুল করে বয়ে চলছে আংড়াভাসা নদী। এই নদীর তীরের কাজলকালো কাদার উপরে এক জোড়া পায়ের ছাপ পড়ে গেছে। তীরে বাঁধা খেয়ানৌকার হাল ধরে আছে গৌরব বসাক। মধ্যবয়সী গায়ের শ্বেতপদ্মের এর মত শুভ্র রঙ, আর ব্যক্তিত্বের প্রখর ছাপ যেন তার সাতেপাঁচের ধারে কাছে না গিয়ে তার
চোখে ফুটে উঠেছে। এমন মায়াবী চোখ খুব কমই দেখা যায়। এই মায়াবী চোখের জ্বলজ্বল করা ভাষা যেন অন্ধকারে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দেয় তার জীবনসঙ্গীর কাছে। আজ শুক্লা পঞ্চমীর চাঁদ উঠেছে মেঘমুক্ত আকাশের পিঠে। চারদিকের সুনসান নীরবতাকে ফাঁকি দিয়ে নদীর কাঁদায় পড়ে যাওয়া পায়ের
ছাপে পা মিলিয়ে চলছে এক রাজযুবক, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি। ফেরার হয়ে এই
গ্রামে অজ্ঞাতবাসে আছে সাত বছর ধরে। এই সাত বছরেই তার জীবনের অনেক মোড় ঘুরেছে। কৈশোরের মনের ভাষা গত সাত বছর আগেই খুঁজে পেয়েছে গৌরবের মনের কাছে, তার গোরার কাছে। পালতোলা খেয়ানৌকা তরতর করে ছুটে চলছে ভাটির দিকে। নৌকার পাটাতনে শুয়ে আছে দুই আদিম পুরুষ। একজনের বুকের উপর আরেকজন শুয়ে আছে, একজনের হাতের তালুতে আরেকজনের আঙুল
খেলে বেড়াচ্ছে। আকাশের খোলা পথ বেয়ে বেয়ে আধভাঙা চাঁদ জ্যোৎস্না লুটাচ্ছে দুই মানবপ্রেমিকের ভালবাসাকে পরিপূর্ণ করার জন্য।
– গোরা!
– অনি!
– একটা গান বাধো না, আমি তার সাথে বাঁশির সুর তুলি।
– আজ থাকুক না, দেখ আকাশে নক্ষত্র আর তার সাথে উল্কোর লুকোচুরি খেলা দেখ।
– (উঠে বসে) না, আমার জন্য এখনই একটা গান বাঁধতে হবে।
অনির রাগ ভয়ংকর, আর তা যদি হয় অভিমান তাহলে ত কথাই নেই। অন্তত সাতদিনে মুখে রাটি কাটবে না। খালি গলায় গান ধরল অনির গোরা।
ও চরণসই, আকাশের পরাণ খোলা স্বপ্ন দেখো,
রাতের আধাঁর প্রাতের তারার রূপালি ঝিলিক দেখো, নদীর জলকেলিতে তোমার হাসি দেখো, সব দেখার মাঝে পাবে আমায়, চরণসই, তোমার সব দেখা যে আমায় দেখা, আমায় খোঁজা, সেই খোঁজায় পাবে আমায় চরণসই। তোমার ফিরা পাওয়া সত্য পিরিত, আমার রাধিকের প্রেমের ঝিলিক, সবই যে এক যইবনসুতায় বাধা পড়া আ আ আ, ও চরণসই!!!!
চারদিকের সুনসান নীরবতার বুক চিরে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অনির বাঁশির প্রাণভাঙা লীলা। গানের ছন্দে গান শেষ হতেই অনির স্বগতোক্তি
– আচ্ছা গোরা, এটাত পাঁচালি নয়।
– হুম এই গান হচ্ছে কৃষ্ণযাত্রা। এই গান আমি শুধু তোমাকে নিয়েই বাঁধি।
– আচ্ছা, গোরা ধর কোনদিন তোমায় যদি আমার জন্য কিছু উৎসর্গ করতে হয়,
তুমি কি দিবে?
– কি আর দিব! আমার যা সাধ্য, এক প্রাণভরা ভালবাসা আর তোমার বাঁশির সুরে নেচে বেড়ানো আমার কণ্ঠসুর।
– সত্যিই তুমি আমার জন্য এতবড় ত্যাগ করবে? যদি আমি হারিয়ে যাই?
– তাহলে আমিও হারিয়ে যাব, আমার জীবন থেকে, সমস্ত পুজোর থেকে, এ পুজো আমার জীবনপুজো, আমার সুর পুজো। ছলছল করা চারটি চোখের ভাষাই
বলে দেয়, এমনদিনটি যেন কোনদিন ও না আসে। রাত গড়াচ্ছে, রাতের নিয়মে, ভরা নদীর বুকে একটা নৌকার জল ঝাপটানোর শব্দ চলছে। যে শব্দের ভাষাই বলে দেয়
ভালোবাসার এক অপূর্ব মিলনের ভাষা।
৩.
সেদিন গায়ের হাটবার ছিল। অনিরুদ্ধ সেদিন ৯ ক্রোশ দূরের এক গ্রামে গিয়েছিল এক কাজে। সেখানেই তার যবনিকাপাত হল এক জীবনের এক আনন্দের অধ্যায়ের। ধরা পড়ল পুলিসের কাছে ফেরার আসামি হয়ে। এ ধরা পড়া যেন আইনের কাছে জয় নয়, ভালবাসাকে বিকিয়ে দিয়ে ফেরার করার পরাজয়।
৪.
৯ বছর পরের কথা…….
দিনাজপুরের রায়চৌধুরি পরিবারের কুঠিবাড়িতে এক জমকানো কবিয়াল
গানের আসর বসানো হয়েছে। মূলমঞ্চের পাশে জমিদারবাড়ির সম্ভ্রান্ত সদস্যরা লাল তোষকের গদিতে বসে উপভোগ করছেন শেষ কবিগানের লড়াই। আসরের মূল মধ্যমনি নতুন জমিদার অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি। তাঁর পাশে বসে এক পুত্রসন্তানকে নিয়ে উপভোগ করছেন রাজরানি। অনিরুদ্ধের চোখ বারবার দর্শক সারিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাউকে খুঁজে পাওয়ার তীব্র চেষ্টা। জেল থেকে বেড়িয়ে দুই বছর ধরে পাগলের মত খুঁজে বেড়িয়েছে তার গোরাকে। সবশেষে খুঁজে না পেয়ে আপন গৃহে ফিরতে বাধ্য হয় সে। পরের ইতিহাস তার পাশেই বসা। ভোর রাত হয়ে এল। পর্দা নেমে গেছে আসরের। সবার মুখে মুখে নতুন জমিদারবাবুর নাম। আহ! কি তার রোশনাই, কি তার মন, কি তার অতিথি আপ্যায়ন, কি তার সঙ্গীতপিয়াসু মন। সকল শ্রোতার মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে এক নাম। কিন্তু একজনের মুখে নয়।
৫.
সবে মাত্র খাসকামরায় ফিরছে অনিরুদ্ধ। এ ঘরে তার বিনে অনুমতিতে কেউ ঢুকতে পারে না। খাসকামরার সকল আলো নিভানো, প্রশস্ত বেলকনিতে সুর্যোদয়ের সোনার ঝিলিক পড়তে শুরু করছে। নীল আকাশের বুকে একটুকরো পাথর হয়ে চুপটি করে নিষ্প্রভ হয়ে জ্বলছে চাঁদটা। কামরাতে প্রবেশ করছে অনিরুদ্ধ। তার সেগুনকাঠের পালংকতে এক আধবুড়ো বসে আছে। কে এই বুড়ো!!! অনিরুদ্ধ একটু এগোতেই মুখ ফিরাল আধবুড়োটা। মুখটা দেখে হঠাৎ যেন আনন্দবান বিঁধল অনিরুদ্ধের বুকের পায়ে এগিয়ে গিয়ে চোখটা চেনার চেষ্টা করল অনি। কান্নার্ত চোখের ভাষায় বলে দিচ্ছে এ চোখ বহুদিনের চেনা, এ যে তার হারিয়ে যাওয়া অন্ধকার এর জ্বলজ্বল করা মায়াবী চোখ। চারদিক পরিস্কার হয়ে আসছে, চারটি চোখের ভাষায় এখনো কথা বলছে অনন্তকালের বিরহ গাঁথা। একগাল ভরা সাদা দাড়ির ফাঁক গলে বেয়ে পড়ছে অশ্রুকষ্ট। এ কষ্টের সব ছাপিয়ে দুটি প্রাণ বাঁধা পড়েছে এক সুতোয়। এই সুতো আবার নতুন করে জোড়া দেয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়েছে দুটি পাগলপ্রাণ নতুন পৃথিবীকে আহবান জানানোর জন্য। আপন ঘর সংসার, জমিদারি,সমাজের সকল বাঁধাকে পায়ের ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে চলছে দুটি প্রাণ অনন্ত সুখের পানে। শহরের মেঠো রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সকল সুখের বুনো হাওয়া গায়ে মাখিয়ে…।
প্রথম প্রকাশঃ বাংলা গে গল্প। ২৯ই জুলাই, ২০১৪।