
লেখকঃ হোসেন মাহমুদ
উৎসর্গ: দেশের লাখো প্রবাসী ভাইদের, যাদের কষ্টে অর্জিত অর্থে দেশ বেঁচে আছে।
শেষ আশ্রয়স্থল বসত ভিটা কিংবা আবাদি চাষের জমিন বন্ধক না রাখলেও, মায়ের যজ্ঞের ধনের মত আগলে রাখা দুখানি সোনার বালা, এক গাছী চন্দ্র হার আর বাবার ব্রিটিশ আমলের এখানি জরাজীর্ণ টানজিস্টার ধুলে পাড়ার গৌরব সেটের পেটে পুরে দিয়ে সৌদি আরব আসে আরমান। সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয় প্রিয়তমা নূরনাহারের সযত্নে রাখা ভালোবাসা আর পরিচিত ধুলোয় মাখানো গাঁয়ের মেঠো পথ, দুরন্তপনার কৈশোর আর শৈশবের সকল স্মৃতি বিমান বন্দরের পরিষ্কারকর্মীর হাতে সোপর্দ করে দিয়েছে ডাস্টবিনে ফেলার জন্য। তার চোখে মুখে স্বাপ্নিক দ্যুতি প্রজ্বলিত হচ্ছিল, নূতন আশার আলো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ আলো তার জন্ম-স্বভাবের অভাব সরাবে সাথে গৌরব সেটের গিলে নেয়া পেট থেকে মায়ের গয়না বাঁচাবে।
নূতন দেশ, নূতন পরিবেশে আরমানের পিছনে ফেলে আসা সাদা কালো অতীতের অভাব অনটনের সীমাবদ্ধ জীবন, এইখানের চাকচিক্য দেখে বড়ই সেকেলের মনে হল। তার কর্মস্থল নির্ধারিত হল স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর আলিসান বাড়ীতে। আমাদের দেশের একান্নবর্তী পরিবারর গুলো যদিও দিন দিন বিলুপ্তির দিকে কিন্তু এইখানে তার উল্টো, এদের কাছে পরিবার মানে গাছের শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত সকল শাখা প্রশাখা, দাদা পরদাদার জ্ঞাতি গুষ্টি তো আছেই সাথে এক একজনের একের অধিক স্ত্রী, তাদের ছানাপোনা মিলে এখানকার একেকটি পরিবারকে আমাদের দেশের ছোট খাটো গ্রাম বলা চলে। এদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মরত থাকে আমাদের মত শিক্ষিত অশিক্ষিত চাকর বাকর। আরমানের বিদ্যার দৌড় কলেজ অবধি, সেই সুবাদে কিছুটা সম্মানের চাকুরী মিলেছে তার। বাড়ীতে কর্মরত মানুষগুলির দেখভালের দায় দায়িত্ব তার উপর। পাঁচটি বড় বড় বিল্ডিং মিলে এদের আবাস। চাকর বাকর থাকার জন্য আলাদা ঘর। আরমান ও পেয়ে যায় বাগানের দক্ষিণ দিকের ছোট একটা রুম তার পাশেই ইন্ডিয়ান এক মালী থাকে। আরমান দুই একটা ইংরেজি যদি ও জানে কিন্তু গুছিয়ে বলা শিখেনি এখন অবধি।
দিন সাতেক পর পরিবারের প্রধান আহম্মদ খুরাইমির সাথে দেখা করতে গেল আরমান। বাড়ির কেয়ার টেকার স্বদেশী মতি মিয়া তাকে আরবি তে পরিচয় করিয়ে দিলেন মালিকের সাথে। কাজের কাজ কিছুই করছিলে না তিনি, বসে বসে দুনিয়ার সিগারেট আর সিসার গুষ্টি উদ্ধার করছেন। তারপর ও আরমান কে দেখে চোখে মুখে ব্যস্ততার বলি ফুটিয়ে আরবিতে বললেন, পরে দেখা করতে এখন সে ব্যস্ত। মতি মিয়া আরমানকে নিয়ে বেরিয়ে আসতেই মালিক তাকে দাঁড়াতে বললেন। আরমান ঘুরে দাড়ায়, আহম্মদ খুরাইমি এমন ভাবে তাকে উপরে নিচে দেখছিলেন, মনে হচ্ছিল হয় লোকটার মাথা খারাপ অথবা মাতাল। আরমানকে এমন ভাবে দেখার কি হল? সে দেখতে আরবের খুরমা নয়, খুবই সাধারণ গুছের আট দশজন বাঙ্গালির মতই সে , মোটামুটি ধাঁচের শরীরী গডন, গায়ের রঙ ফর্সা না হলেও ফ্যাকাসে নয়, তাকে গরু খোঁজার মত করে দেখার কি আছে? এই বিরক্তির ছাপটা মুখে স্পষ্টই ফুটিয়ে তুলেছে আরমানের পাশে দাঁড়ানো মতি মিয়া। ঘড়ির কাঁটা থেকে আরও পাঁচ মিনিট বলি দিয়ে নিজের রুমে ফিরল আরমান। বেটা বোধহয় জীবনে প্রথমবার চর্ম চক্ষু দিয়ে কোন বাঙালী দেখল।
প্রবাসী জীবনটা ভালোই কাটছিল আরমানের। মাঝে সাঁজে নুরনাহার কে ফোন দিয়ে চোখের জল নাকের জোল মিশিয়ে আশা হতাশার স্বপ্নে ভবিষ্যৎ রচনা করে । কাজের ফাঁকে ফাঁকে আরমানের ডাক পড়ে উপরতলা থেকে। কে ডেকেছে সেইটা অনুমান করতে পারে না সে। তার কাছে এই বাড়িতে বসবাসরত সকল পরুষকে একই রকম মনে হয়। তবে একজন কে ছাড়া, তার নাম সাইদ খুরাইমি। আরমানের মালিকের ছোট বৌয়ের বড় ছেলে। বয়স সতের আঠারর এদিক ওদিক হবে। বাড়ীর প্রতিটা পরুষ যেন হিংস্র নেকড়ে শুধু মাত্র এই সাইদ ছাড়া। সাইদ অনেক সময় তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, বোধহয় আরমানকে কিছু বলতে চায় কিংবা অন্য ভাইদের মত ভিন দেশী বান্দর বলে খ্যাপানোর জন্যই কাছে আসতে চায়। আরমানের কাছে ব্যাপারটা মটেও সুবিধার মনে হল না। তাই সে নুরনাহার কে একদিন কথার ফাকে সাইদের কথা চালান করে দেয় বাংলাদেশে। নুরনাহার কড়া শাসনের সুরে বলে, এই সব ছোড়া গুলোন থেকে যত দূরে থাকন যায় ততই নিজের ভালো বুজচ্ছ, আপনা বলতে ওখানে তোমার কেউ নাই, পরে দেখবে কোন বিপদে পরবে।
সাইদ আরমানের সাথে কথা বলতে চাইলেই আরমান নুরনাহারের সতর্কবাণী মাথায় রেখে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ভুত দেখার মত প্রস্থান করে। নুরনাহারের ভাষায় এই ছোট খাটো বিপদ সংকেত মহা বিপদে পরিণত হল একরাতে।
আরমান সবে ঘুমানোর জন্য বন্দবস্ত করছিল হঠাৎ তার ঘরের দরজায় নক পড়ে। এসির আওয়াজে শব্দটা অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল আরমানের কানে। মিনিট দুই পরে আবারো দরজায় টোকা পড়ায় আরমান মোবাইলের আলোয় সময় দেখে, রাত ১ টা বেজে কুড়ি মিনিট। এত রাতে কার পদার্পণ তার চৌকাঠে? আরমান বিছানা ছেড়ে উঠে পরনের লুঙ্গী ঠিক করে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই দেখতে পায় তার মালিক আহম্মদ খুরাইমি তার দরজায় দাড়িয়ে। তার পরনে সাদা কন্দুরা, অন্যদিনের মত আজকে মাথায় পাগড়ী গোছের কিছু নেই। সাদা কালো চুল স্পষ্টই বলে দেয় তার বয়স ৫০ এর ধারে কাছে হবে। কিন্তু এখনো শরীর গঠন তরুণ যুবার মতই। আরমান ডরে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে সালাম দিল। লোকটা সালামের তোয়াক্কা না করে আরমানকে দরজার সামনে থেকে হটিয়ে দরজার ছিটকানিটা ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়। আরমান তাৎক্ষনিক কর্ম কাণ্ডে দিশেহারা। এই লোক এত রাতে তার ঘরে এসে খিল দিচ্ছে কেন? তার উদ্দেশ্য কি?
উদ্দেশ্য দুই মিনিট পরেই দেখতে পেল আরমান। তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বিছানায় ফেলে দেয় তার মালিক। আরমান তখনো বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হতে চলছে। খানিকক্ষণ বাদে লোকটা দাঁতের সব কটা পাটি মেলে দিয়ে তার কুন্দুরা উপরের দিকে তুলে নেয়। এরাবিকরা সাধারণত কন্দুরার নীচে সেলাইবিহীন লুঙ্গী পরে। কিন্তু আন্ডার ওয়্যারের সাথে তাদের জন্মগত শত্রুতা আছে। কন্দুরা উপরে তুলে লোকটা আরমানকে যা দেখালও সেইটা সারাজীবন তার মনে এঁটে সেঁটে গেঁথে থাকবে।
চারিদিকে গভীর রাত, আশে পাশের ঘর গুলোর এসির আওয়াজে ভয়ার্ত এক রজনীর পূর্বাভাসের গন্ধ পাচ্ছিল আরমান। কাচা পাকা চুল নিয়ে এই বুড়ো তার কন্দুরা খুলে যে দণ্ড খান দেখিয়েছে আরমানকে, পারলে সে তক্ষণই মূর্ছা যায়। কিন্তু অবশেষে মূর্ছা তাকে যেতেই হল।
ঘড়ীতে রাত পৌনে তিনটা, আরমানের নিস্তেজ শরীর পড়ে আছে বিছানায়। তার পরনে কোন কাপড় অবশিষ্ট নেই শুধু কোমরের দিকে এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় জমে উঠা আধখানি তাজা রক্তের লালা জামা ছাড়া। তারও ঘণ্টা দেড়েক পরে আরমানের জ্ঞান ফিরে। আরমান বুঝতে পারছে না সে কোথায় আছে। চারিকে এত ঠাণ্ডা কেন, সে তো গরমের দেশ সৌদিতে আছে ঠাণ্ডার সুইজারল্যান্ডে নয়। পাশে রাখা কম্বলটা আস্তে করে শরীরের উপরে টেনে আরমান ঐ ভাবেই পড়ে থাকে বেলা অবধি। সকাল ১১ টার দিকে সাইদ তার রুমে আসে। এত দিন সাইদ তার সাথে দূর থেকে কথা বলতে চাইলে ও এই প্রথম সে আরমানের ঘরে প্রবেশ করে। সাইদের হাতে কিছু ঔষধের কোটা আর ব্যথা বেদনার পেনাডল ট্যাবলেট। তার হাতে ঔষধ দেখে আরমান কাল রাতের অসমাপ্ত অংক মিলাতে লাগলো। সাইদ তাহলে জানে তার বাবার কুকীর্তি কথা, তাই হয়তো তাকে সতর্ক করার জন্য কিংবা বাবার আগমনী কর্মকাণ্ডের বিপদ সংকেত দেয়ার জন্য আরমানের কাছে ঘেঁষতে চেয়েছিল। আরমানের চোখের সামনে থেকে পর্দা সরতে লাগলো, ব্যাপারটা শুধু সাইদ নয় বাড়ীর অন্য সবাই ও জানে। তা না হলে কাল রাতে আরমানের চীৎকার শুনে পাশের রুমে থাকা ইন্ডিয়ান মালী বেটা কেইবা এগিয়ে আসল না?
আরমান সাইদকে দেখে খাঁটি বাংলা ভাষায় ছোট বেলা থেকে শেখে আসা গালি একটা দিতে ভুলল না বাপ বেটা কে। সাইদ হয়তো আরমানের কথা বুঝতে পারছে না, কিন্তু তার চেহারার রুক্ষতা আর রাগের তীব্রতা সাইদের নজর এড়ায় না। তাই সাইদ হাত থেকে ওষধ গুলো বিছানার এক কোনে রেখে তাড়াতাড়ি আরমানের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আরমান আস্তে আস্তে উঠে বসল, কোমরটা বিছানা থেকে সরাতে পারছে না জমাট রক্তে বিছানার সাথে শরীর বিঁধে আছে। অনেক কষ্টে বিছানা থেকে নিজেকে তুলে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। ঝর্ণার পানির সাথে আরমানের রক্ত মিশে লাল সমুদ্র মনে হচ্ছে বার্থ রুমটাকে। ঝর্নার পানি সাথে চোখের জল আর রক্ত মিশে লোহিত সাগরের কূল মনে হচ্ছে বাথরুমটাকে।
দুইদিন আরমান ঘর থেকে বের হতে পারেনি। মালী এসে খাবার দিয়ে গেছে রুমে। এ দিকে সাইদ সকাল বিকেল এসে আরমান কে দেখে যায়। আরমান তার দিকে না তাকিয়ে চুপ করে থাকে। সাইদ কোন ভাষা ব্যাবহার না করে খানিকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে চলে যায়। দুইদিন আরমান ঠিকমত হাঁটতে পারেনি। হপ্তা-খানিক আরমানের ব্যথায় বেদনায় কাটে। কিন্তু তার দুইদিন পরে আগের ব্যথা আবার এসে উপস্থিত হয় তার রুমে। এইবার অনেক বার নক করে ও আরমান দরজা খুলেনি। কিন্তু তার মালিকের কাছে বোধহয় ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। তাকে দেখে আরমানের চোখে মুখে ভয়ের ভয়াবহতা আবার ফুটে উঠলো। ঐ দিন ও তার মালিক তার উপরে হাল চড়িয়ে যায়। এই ভাবে চলতে থাকে আরমানের প্রবাসী জীবন।
সমকামী না হয়েও আরমান কে নিজের শরীর প্রায় দিন উৎসর্গ করতে হয় তার প্রভুর কাছে। আরমান ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। এদিকে নুরনাহারকে ও খুলে বলতে পারছে না লজ্জায়। আরমানের দুঃখ কষ্টের স্বাদ আরও গভীর করে বাড়ানোর জন্য তার মালিকের দুই ছেলে টাইম করে আরমানকে ব্যাবহার করে যায়। বিনিময়ে যাওয়ার আগে পকেটে যত টাকা থাকে তা আরমানের শরীরের উপরে ছুঁড়ে মেরে যায়। প্রথম প্রথম শরীর বেচার টাকা গুলো না ধরলে ও পরবর্তীতে পরিবার আর নুরনাহারের কথা চিন্তা করে টাকা গুলো হাতে তুলে নেয় আরমান।
সাইদের সাথে আরমান এখন আগের মত ব্যাবহার করে না। সে মেনে নিয়েছে এইটাই তার অভাব মোচনের দুর্ভাগ্য নিয়তি। শরীরের কাঁচা রক্ত ঝরিয়ে টাকা উপার্জন কতটা কষ্টের হতে পারে সেইটা ভুক্তভোগী না হলে বোঝা মুশকিল। আরমান এখন দুইএকটা এরাবিক বলতে পারে। তাই দিয়ে দুজনের বন্ধুত্ব। সাইদ যখনি আরমানের সাথে কথা বলে তার চোখ দুটো নিচের দিকে নুয়ে রাখে। বোধহয় তার বাবা ভাইয়ের অপকর্মের জন্য নিজের লজ্জাবোধ। সাইদ আরমানের সাথে বন্ধুত্ব নয় আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে সেইটা আরমান বুঝতে পারে না। সাইদ মাঝে মধ্যে আরমানের জন্য খাবার আর গিফট নিয়ে আসে এক দিন নিয়ে এলো একটা বড় টেড়ি বিয়ার। আরমান বিয়ার দেখে তাকে বাংলাতেই বলে, এই তোর তো পুরাপুরি মাথা খারাপ। এই জিনিষ দিয়ে আমি কি করবো আমার কি পুতলা দিয়ে খেলার বয়স আছে? তার কথা বুঝে না বুঝে সাইদ মুচকি হেসে গল্প পাতে তার সাথে।
আরমানের আগের পেটানো শরীর দিন দিন ভাঙ্গতে লাগলো, সে ইচ্ছে করলেই বাড়ীর ত্রিসীমানা পেরুতে পারে না। রাত তার কাছে ভীতিকর অধ্যায়, দিনের আলো ফুটতেই পরবর্তী আগমনী রাতের কথা চিন্তা করে প্রতিটিক্ষণই বিপদগস্থ থাকে আরমান। এই বন্দীশালা থেকে মুক্ত হবার উপায় তার জানা নেই। দেশে গিয়ে কি করবে? আবার সেই অভাব, এক আধ বেলা খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন। মা আর নুরনাহারের কথা চিন্তা করে ফীরে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে জেটে ফেলে শরীর অত্যাচার মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নেয় আরমান।
এই ভাবে কেটে যায় দেড়টি বছর। বাড়িতে তিন চারটে স্ত্রী থাকার পর ও বাপ বেটা মিলে আরমানের উপরে চড়াও হয় সকাল বিকেল। আরমান মাঝে মাঝে ভাবে তাকে বোধহয় রাখাই হয়েছে পশু গুলোর শরীর কামনা মেটানোর জন্য। একটা সময় আরমান জ্বরে ভুগতে থাকে বেশ কিছুদিন। সাইদ তাকে ওষধ দিয়ে যায় কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তার পেটে কোন খাবারই হজম হয় না। তাই না খেয়ে খেয়ে পেটে পিঠে লেগে একাকার। আরমান সাইদকে বলল, এই অবস্থায় যদি তোমার বাবা এসে উপস্থিত হয় তাহলে নির্ঘাত আমি মারা যাবো। সাইদ আরমানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কোন চিন্তা কর না। আমি বাবাকে আসতে দিবো না। এই প্রথম সাইদ আরমানের হাত বুকে নিয়ে তাকে সান্ত্বনার বানি শুনায়, আরমান জানে সে কোন সাহায্য করতে পারবে না তবে সান্ত্বনার বানী তাকে একটু হলে ও সাহসী করে। আরমান মাঝে মাঝে ভাবে এই ছেলে তার জন্য এত কিছু করছে কেন? কেনই বা সে তার এত কাছা কাছি আসে। আরমান বুঝতে পারে না সাইদের ভিতরকার জমানো কথা কিংবা অব্যক্ত ভালোবাসা।
আরমান তার ঘর থেকে বের হতে পারে না। ঠিক মত হাঁটতে পারে না। তার অবস্থা ভয়াবহ বেগতিক এমতাবস্থায় এক রাতে আরমানের মালিক তার রুমে হাজীর। আরমানের চোখ দুটো যদিও সচল কিন্তু শরীরটা নিস্তেজ। আরমানের চোখ থেকে অনবরত পারি ঝরছে লোকটার সেই দিকে খেয়াল নেই। সে তার কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তড়িঘড়ি করে। একটু পর দরজা জোরে আওয়াজে আহম্মদ খুরাইমি আরমানের শরীরের উপর থেকে মুখ তুলে ঐ অবস্থায় পিছন ফীরে তাকায়। সাইদ রাগান্বিত চোখে প্রতিবাদের ঝড় তুলে দাড়িয়ে আছে দরজায়। তার বাবা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়েই বিনা বস্ত্রে উঠে দাড়ায় আরমানের গায়ের উপর থেকে। সাইদের হাতে থাকা এটা রড দিয়ে সজোরে আঘাত করে তার বাবার মাথায়। কিছু বোঝে উঠার আগেই খুরাইমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মিনিট পাঁচেকের মাথায় তার শরীর থেকে শ্বাস প্রশ্বাস বের না হতে দেখে সাইদ বুঝতে পারে সে জন্মদাতার খুনি সেজে গেছে। হাতের রড টা মাটিতে ফেলে সে যায়গাতেই বসে পড়ে সাইদ। এ দিকে আরমান তাৎক্ষনিক ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করছে।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে আরমান বিছানায় উঠে বসে, বিছানার এক পাশে পড়ে আছে তার মালিকের মৃতদেহ, ঘরের অন্য প্রান্তে মেঝেতে বসে আছে রড হাতে তার খুনি। আরমানের এখন কি করা উচিত সে বুঝতে পারছে না। শুধু ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছে সাইদের দিকে। তার জন্য কেন সে খুনির খাতায় নাম লেখাল, আর এইখানে খুনের শাস্তি প্রকাশ্য মাথা কাটা।
আরমান এখন মুক্ত। তার মুক্তি দাতা এখন মরার প্রহর গুনছে অন্ধকারে বসে। গত দুই মাস তার জীবনের দিন গুলো ভয়ংকর কষ্টে কেটেছে। একটা অপরাধ বোধ বারবার তাকে দংশন করছে বিষাক্ত সাপের মত। একটা হিসাব সে মিলাতে পারছে না সাইদ কেন তাকে বাঁচানোর জন্য নিজের বাবাকে খুন করল। সে খুব ভাল করেই জানে খুনের বদলে সৌদিতে মাটা কাটা হয় প্রকাশ্যে। ওই রাতে পুলিশ এসে আরমান আর সাইদকে নিয়ে যায় থানায়। এক দিন পর সাইদের জবানবন্দীতে ছেড়ে দেয় আরমান কে। সেখান থেকে ১৫ দিন সে হসপিটালে ছিল, সুস্থ হয়ে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাসায় উঠে। তার ভিসা কেনসেল করে দিয়েছে পুলিশ, যে কোন মুহূর্তে সে দেশে ফিরত যেতে পারে অথবা অন্য কোন যায়গায় নূতন চাকরি খুঁজতে পারে। আরমানের কোথাও চাকরি করার ইচ্ছে নেই। দেশে ও ফিরে যেতে পারছে না এক মায়ার বাঁধনে। ঐ রাতে অনেকক্ষণ সাইদের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আরমানের মনে এক সফট কর্নার তৈরি হয়েছে কিন্তু এই সফট কর্নারকে কি বলে সেইটা তার জানা নেই।
অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ও একবারের জন্য সাইদকে থানায় গিয়ে দেখতে পারেনি আরমান। এই দেশের অনেক কড়া শাসন, খুনের আসামীর সাথে সাক্ষাৎ করা অনেক কষ্টের। শুধু আরমান থানার বড় অফিসারের বরাত দিয়ে এই টুকু জেনেছে আগামী ২৪ শে এপ্রিল তার বিচারের রায় দেয়া হবে।
গত কয়েকদিন ধরে দেশে ফোন করা হয় না আরমানের। নুরনাহারের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে সে। জীবন তাকে কষ্টের ছাঁচে ফেলে পরীক্ষা করছে প্রতিনিয়ত। নুরনাহারের যায়গায় সে এখন একজন পরুষকে কল্পনায় বসায়। যে তার জন্য জীবন বাজি রেখেছে। তার অনেক কাছে থেকে অনেক কিছু দিয়ে ও বেশি কিছু প্রত্যাশা করেনি কোন দিন। আরমান বুঝতে পারছে না ছেলে ছেলে কি ভালোবাসা হয়? নাকি এইটা দায়বদ্ধতার সর্বোচ্চ মোহ? সে যাই হোক আরমানের মনে এখন সাইদের স্থান বিশেষ কেউ হিসাবেই। সে জানে আরমান হয়তো পৃথিবীর আলোয় আর বেশী দিন নেই। তারপর তাকে কেন যেন কাছে পেতে ইচ্ছে করছে তার। খুব গোপনে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে তার ভালোলাগার কথা। কিন্তু বাস্তব বরাবরই তার বিমুখ।
আরমান কোর্টের বাহীরে দাড়িয়ে আছে। ভিতরে চলছে সাইদের বিচার। দুই ঘণ্টা ধরে আরমান উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে বিচার কক্ষের দিকে। একজন সরকারী আইনজীবী এসে বলল, বিচারকের রায়ে তার মাথা কাটা হবে আগামী ২৫ শে এপ্রিল শুক্রবার। কথাটা শুনার পর আরমানের কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে। সাইদের এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। সাইদ নিশ্চয় তাকে ভালোবাসতো, কিন্তু আফসোস কখনো প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করতে পারল না। শুক্রবারের আরও দুই তিন দিন বাকি আছে। আরমান নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তার বাধ্য মন আজ পুরটাই অবাধ্য। সারাক্ষণ একটা মানুষের চেহারা তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। আরমান শুধু শেষবারের জন্য সাইদের সাথে দেখা করতে চায়। একটা বার তাকে জড়িয়ে ধরে তার ভালোলাগার কথা জানাতে চায়। আর প্রশ্ন করতে চায় রাত বীরাতে কেন সে তার পাশে থাকত? কি কথা সে আরমান কে বলতে চাইত? কেন সে তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করল?
আজ শুক্রবার আরমান দাড়িয়ে আছে মাঠের পাশে। নামাজের পর জন সম্মুখে সাইদের মস্তকচ্ছেদ করা হবে। আরমানের হাতে সাইদের দেয়া টেড়ি বিয়ার টা ধরা আছে। আরমানের হাতে আরও আছে একটা কৌটা যেটাতে সে সাইদের রক্ত ভরে নিয়ে যাবে। রেখে দিবে সারা জীবন তার কাছে। জীবন্ত মানুষটাকে কোন দিন ভালোলাগার কথা বলতে পারেনি অন্তত মৃত মানুষটার রক্ত নিজের কাছে রেখে স্মরণ করবে সারাজীবন। নিজেকে অনন্ত বোঝাতে পারবে দুনিয়ার সকল মানুষ খারাপ নয়। ভালোবেসে টু শব্দ না করে মরার মত মানুষ এখনো পৃথিবীতে আছে। সব কিছু রেডি, সবার সামনে দিয়ে পিছনে হাত বাঁধা সাইদ কে মাঠে আনা হল, তার দিকে তাকিয়ে আছে আরমান। সাইদ এদিকে ও দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে শেষবারের মত দেখার জন্য। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে একজনকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। পুলিশ চার দিক ঘিরে রেখেছে। মাঠের মাঝখানে সাইদকে হাঁটু ভাঙার মত বসিয়ে রেখেছে। তাকে আরমান বার বার দেখছে মৃত্যু ভয়ের দানা পানি তার চোখে মুখে নেই। মনে হয় সে বেড়াতে যাচ্ছে। সান দেয়া তলোয়ার তৈরি একজন হুজুর গোচের লোক মুখ ঢেকে তলোয়ার হাতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আরমান এ দৃশ্য নিতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে একটা চীৎকার দিল।
আরমানের পাশে থাকা তার আত্মীয় তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। সে জিজ্ঞাস করল কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিল নাকি? আরমান তার কথার কোন উত্তর দিতে পারে না। চুপ করে ভাবতে থাকে স্বপ্নের ভয়াবহতা। না এই ভাবে থাকলে সে মানসিক রোগী হয়ে যাবে। তার কিছু একটা করা উচিৎ কিন্তু কি করবে সে জানে না। অবশেষে আরমান সিদ্ধান্ত নেয় সে ফেরত যাবে দেশে শুক্রবারের আগেই। তার জানতে ইচ্ছে করছে না সাইদের বিচারের রায়। তার ইচ্ছে করছে সাইদকে সে বাঁচিয়ে রাখতে তার মত করে। বিচারের রায় শুনার পরে সারা জীবন সে জানবে সাইদ মৃত কিন্তু রায় না শুনলে সে ভাবতে পারবে কোন কারণে তাকে হত্যা করা হয়নি। সে বেঁচে আছে। আরমান জানে এটা স্বার্থপরতা বৈ অন্যকিছু নয় কিন্তু সে নিরুপায়। যাকে সে পছন্দ করে হয়তোবা ভালোবাসে তাকে একটি বার প্রকাশ করে জানাতে না পারার কষ্ট সে সয়ে নিবে হয়তো, কিন্তু তার হত্যা নিজের চোখে দেখার মানসিকতা তার নাই।
বাংলাদেশ বিমানে করে আরমান দেশে ফিরছে, পিছনে রেখে যাচ্ছে কষ্টময় এক ইতিহাস। স্বপ্ন বুনতে এসে স্বপ্ন হারিয়ে নিজে দুখে থেকে অন্যকে দুঃখ উপহার দিয়ে এক রকম পালিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। আরমানের কষ্টের অধ্যায় অসমাপ্ত, আবার সেই অভাব অনটনের রাত্রি যাপন, খেয়ে না খেয়ে দিন পার।
প্রথম প্রকাশঃ বাংলা গে গল্প। ২০শে এপ্রিল, ২০১৪।