
লেখকঃ জিকো
এটা আমার চতুর্থ বয়ফ্রেন্ডের গল্প।
প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় ততদিনে জীবনের যাঁতাকলে নানান দিকে ফেঁসে গেছে। কেউবা চলে গেছে নতুন নরমাংসের সন্ধানে। এরা বলে একই খাবার বারবার মুখে রুচে না। ততদিনে আমিও নিজেকে খাবার অথবা একখানা কনজিউমার প্রোডাক্ট ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। ততদিনে লোকে ফ্রিতে ব্যবহার করে যাচ্ছে। লোক বলতে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির লোক। যদিও তাদের ক্রোমোজোম প্যাটার্ন এক্সএক্সওয়াই অথবা এক্সওয়াইওয়াই নয়, তবু তারা আলাদা এক মানসিক প্যাটার্ন নিয়ে জন্মছিল। কারও মতে ওদের মেনিয়া আছে, কারও মতে ওরা সয়তানের অনুসারী, কারও মতে ওরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের একটা সংখ্যালঘু অংশ। আর হ্যাঁ, আমি নিজেও এই সম্প্রদায়ভূক্ত।
আর ততদিনে আমি ফেইসবুকে ফেইকবুক, ম্যানজামে গ্যাঞ্জাম আর প্লানেট রোমিওতে রোমিওগিরি করাও শিখে গেছি। প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বয়ফ্রেন্ডের বিচ্ছেদ আমাকে স্যাডিস্ট বানাতে পারে নি ঠিক, কিন্তু ওদের অনুপস্থিতি আমার বায়োলজিক্যাল নিডস তো পূরণ করার পথে বাঁধা ছিল। নিজের যৌবনকে তাই বানিয়ে দিলাম ফ্রি কনজিউমার গুডস।
বলেছিলাম এটা আমার চতুর্থ বয়ফ্রেন্ডের গল্প। ওর সাথে কোথায় ফার্স্ট দেখা হয় বলব? যদি বলি রমনাতে, তবে অবাক হবে? তবে লোল হল- আমাদের প্রথম দেখা রমনাতেই। তবে প্রথম পরিচয় অন্য কোথাও। হয়তো ম্যানজাম অথবা ফেইকবুকে। আমার ফেইকবুক থেকে সুন্দর সুন্দর পুরুষ মানুষের ফেইসবুকে টেক্সট পাঠান ছিল আমার হবি। ম্যাক্সিমাম টাইমই ব্লক খেতাম। কিন্তু কেউ কেউ রেসপন্স করত। সৈকত করেছিল।
***************************************************
: হাই, নাইস পোস্টস অন টাইমলাইন!
– হুম, থ্যাংকস; সো সুইট অফ ইউ।
: ইউ’আর ওয়েলকাম…
– বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে তো চিনলাম না?
: চেনাটা জরুরি নয়। মনে হচ্ছে আপনার সাথে আমার আইডিওলজি শেয়ার করা উচিত।
– কেন এমনটা মনে হল?
: টাইমলাইনে আপনার পোস্ট পড়ে। আপনার মতো আমিও ফিলজফিতে আগ্রহী।
– ইন্টারেস্টিং, লেটস সি হাউ লং উই ক্যান মোভ…
: শ্যুয়োর। আপনি দেখতে কিন্তু অনেক হ্যান্ডসাম।
– তাই না কি? আপনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। ছবি নেই, নামটা অদ্ভুত- ‘মাতাল হাওয়া’, পোস্টগুলো ইন্টারেস্টিং।
এভাবেই কথোপকথন শুরু আমার আর সৈকতের। তার পর চলত ঘন্টার পর ঘন্টা সক্রেটিস, প্লেটো কিংবা মার্কস আর ক্যালভিনকে নিয়ে আলোচনা। এভাবে অনেক কাছে চলে আসা, কিন্তু সৈকত একবারও আমার কাছে নাম জানতে চায়নি। আমার ছবিও দেখতে চায় নি। একদিন তাকে বললাম, আচ্ছা আমি যদি গে হই, তুমি দুঃখ পাবে?
সে বলল, তুমি যে গে আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আমার কাছে তোমার অন্য একটি পরিচয় আছে। তুমি অনেক পড়, আর অনেক জান। তোমার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারি।
সেদিন সৈকত আমার অন্তরে এক আলাদা আসন দখল করে নিল। আমার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন জানার পরও সে আগের মতই বিহ্যাভ করতে থাকল। একদিনের জন্যেও পালটে গেল না। তবু সে আমার নাম জানতে চাইল না, ছবি দেখতে চাইল না। এই কারণে তার প্রতি আমার একটা গোপন অভিমান কাজ করত। আমি জানতাম, কিন্তু তাকে বলতাম না। এভাবেই কেটে গেল বছর খানেক।
একদিন জুকারবার্গের আমার ফেইকবুক নিয়ে সন্দেহ জাগল। ধুম করে আইডি ব্যান করে দিল। যেহেতু আমি ওই আইডি থেকে সৈকত ছাড়া আর কারও সাথে চ্যাট করতাম না, তাই সৈকতের প্রতি একটা অভিমান থেকে নতুন আইডি আর ওপেন করলাম না।
***************************************************
এভাবেই চলছিল। ভার্সিটি, বন্ধু, আড্ডা, গান।
পুরনো সেক্স পার্টনারদের সাথে নিয়মিত দেখাও হত। তবু একাকী যখন কোথাও বসতাম- মনে পড়ত সৈকতের কথা। মাঝে মাঝে রিয়্যাল ফেইসবুক থেকে সার্চ দিয়ে দেখতাম। কখনো টেক্সট দিতাম না। একটা অভিমান ছিল- সে তো কোনোদিন আমায় দেখতে চায় নি।
একদিন মোবাইলে বসে বসে তার প্রোফাইলখানা দেখছিলাম। টাচ স্ক্রিন ফোন, আঙুলের ছোঁয়ায় কখন তাকে পোক করে ফেলেছি টেরও পাই নি। ফোনের ডাটা কানেকশন অফ করে বেমালুম ভুলেও গেছি। রাতে যখন আবার ফেইসবুক ওপেন করলাম। দেখলাম ইনবক্সে একটা টেক্সট আসছে।
খোলে দেখি সৈকত লিখেছে- তুমি কি মাতাল হাওয়া?
হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা খচ করে উঠলো। কাঁপা হাতে রিপ্লাই দিলাম- কীভাবে বুঝলে?
: এখন কিছুই বলব না। আমি কাল তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। তবু রাজি হয়ে গেলাম।
*********************************************
রমনা পার্কের একটা বেঞ্চিতে আমার পাশে যে বসে আছে সে সৈকত। ছবিতে যেমন দেখেছি তার চেয়ে কিছুটা আলাদা। আমি কিছু বলছি না, শুধু তাকিয়ে আছি- মানুষ এতো সুন্দর হয় কী করে।
: জিকো, কিছু বলছ না যে?
– কী বলব? খোঁজে পাচ্ছি না কিছু।
: তুমি এতোদিন আমার সাথে যোগাযোগ কর নি কেন? তুমি জান তোমায় মনে মনে কত খোঁজেছি। প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম তোমার টেক্সটের জন্য।
– আমি বুঝতে পারি নি। তবে আমিও তোমায় অনেক মিস করতাম, তাই তোমার প্রোফাইল দেখতাম প্রায়ই।
: জিকো…
– বল?
: আমি হোমোসেক্সুয়াল কি না বলতে পারব না, কিন্তু এটা বুঝি যে আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি।
– আচ্ছা, তুমি ফেইসবুকে আমাকে চিনলে কীভাবে? আমার নাম জানতে না, ছবিও দেখ নি।
: আমি যে তোমার ভেতরের তোমাকে চিনেছিলাম। তাই নাম না জানলেও, ছবি না দেখলেও তোমাকে ঠিক চিনেছি। আমি তোমার ভাবনাগুলোকে পড়তে পারি।
– আমি তোমাকে ভালবাসি।
আমার চোখে পানি ধরতে পারি না।
বোকা ছেলে কাঁদছ কেন? সৈকত আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। ভালবাসা শরীরে শরীরে নয়, মনে মনে হয়। আমিও তোমাকে ভালবাসি জিকো।
আমি তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। আমি পাঁচ নাম্বার কাউকে চাই না এ জীবনে আর।
(সমাপ্ত)