
লেখক :- জিমুট
ঢাকা শহরে বুয়াদের ওপর প্রায় পরিবারই ক্ষিপ্ত। আমিও ক্ষিপ্ত। আমার স্ত্রী রেণুকা আরো বেশী ক্ষিপ্ত। নতুন বিয়ে হয়েছে আমাদের। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিলো। এখনকার ছেলেমেয়েরা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে খুশি হয় না। তবে রেণুকা আমাকে বিয়ে করে ভীষণ খুশি। কে জানে, কি কারনে এতো সন্তুষ্ট সে আমাকে নিয়ে! আমি দেখতে মোটামুটি, এমবিবিএস শেষ করেছি বেশ ক’বছর হলো, দু একটি ফার্মেসিতে প্র্যাক্টিস করা ছাড়া ডাক্তারি বিদ্যার তেমন প্রয়োগ ঘঠাচ্ছি না। অপরদিকে, রেণুকা বড় ভালো মেয়ে। দেখতেও সুশ্রী। পড়ালেখাতেও বেশ। আজ সে চটেছে কলির ওপর। কলি আমাদের বাসার কাজের বুয়ার মেয়ে। যাকে বলা হয়, “ঝি এর ঘরের ঝি”। ওর মা অনেক আগে থেকে কাজ করত আমাদের বাসায়। এখন ওর মা তেমন আসে না; মেয়েকেই পাঠিয়ে দেয়। তার আগে মেয়েকে কাজ শেখানোর জন্য নিজের সাথে নিয়ে আসতেন। কলির পড়াশোনা তেমন হয়নি। দেখতেও তেমন ভালো না। এই কিছুদিন যাবৎ কলি কাজে ভীষণ অমনোযোগী। সেজন্যই রেণুকা আজ ঝারছে কলিকে। প্লেট-গ্লাসে ডিসওয়াশ লাগিয়ে,পানি দিয়ে না ধুয়েই টেবিলে রেখে এসেছে। বয়সে রেণুকা আর কলি খুব বেশি ছোট বড় হবেনা। রেণুকা বকা দিচ্ছে, আর কলি অঝোরে কাঁদছে। ছোটবেলায় মা যখন আমাকে বকা দিতো, তখন আমি এভাবেই কাঁদতাম। আমার মা-বাবা খুবই কঠোর প্রকৃতির মানুষ। একমাত্র সন্তান হওয়া স্বত্ত্বেও আমার আর তাঁদের মাঝে দূরত্ব ছিলো বিশাল। কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি নি, চাইতে পারিনি। দুজনেই প্রচন্ড ধার্মিক। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা দুজনই শিক্ষিত হওয়া সত্বেও সকল কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আমার বাবা-মার মতো, জগতের অনেক মানুষ অকাতরে সকল সংস্কার মেনে চলে; হোক তা কু অথবা সু। বলছিলাম কলির কথা। কলির সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ছোটবেলাতেই। ওর মায়ের সাথে আসতো আমাদের বাসায়। তখন আমার বেশ ইচ্ছে ছিলো, বড় হয়ে শিক্ষক হবো। নামকরা শিক্ষক। কলি বাসায় আসলে ছোট চক-স্লেটে তাকে অ আ ক খ শিখাতাম। চরম অনাগ্রহ নিয়ে সে সেগুলো শিখতো। ক’দিন যাবত তার মা কাজে আসতে পারছে না। সে একাই আসছে কজ করতে। এসেই কোন না কোন কাজে বিরাট বিরাট ভুল করছে, আর বকুনি খাচ্ছে। আর দেদারসে কেঁদে যাচ্ছে। তার কান্নার কারণ টা রেণুকা জানে না, মা ও জানেনা। জানি শুধু আমি। মূলত কারনটা আমি নিজেই। তাকে আমি আমার ভালোলাগার কথা কখনো বলিনি। সেও আমাকে বলেনি তার ভালোলাগার কথা। তবুও ভালোবাসা হয়েছিলো। প্রচন্ড ভালোবাসা। মরুভূমির গরম বালি আর সূর্যের ভালোবাসার মতো। আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে কিনে আনা কমদামি কাঁচের চুড়ি যখন তার হাতে দিতাম, তখন তার লাজুক হাসি আমাকে ভালোবাসার সালাম দিতো। বাড়িতে মানুষ গুনে গুনে ফুলকপির চপ বানানো হলে আমার জন্য যখন ও কিছু বেশী ফুলকপির চপ নিয়ে আসতো, তখন আমার হাসি দিয়ে আমি আমার ভালোবাসার জানান দিতাম। বলতে পারিনি আমি বাবা মা কে। কলির মা বুঝতে পেরেছিলো। কলিকে মারও খেতে হয়েছিল।দমে নি কলি, দমে গিয়েছিলাম আমি। রেণুকাকে পছন্দ করলো বাবা মা। আমিও মত দিয়ে দিলাম। বাবা মার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য আমার ছিলো না। কলি সব আয়োজনই চোখের সামনে থেকে দেখেছে। ওকে তো থাকতেই হবে;আমাদের বুয়ার মেয়ে। গায়েহলুদের দিন একবার এসে বলেছিল, ” কাল আপনার বিয়ে,ভাইজান? আমি কোন উত্তর দেইনি। বলেছিলাম,” যা এখান থেকে, বাড়ির কাজ কর”। তারপর আরকি! বিয়ে হয়ে গেলো আমার। এখন আমার বউয়ের কাজও করে কলি। আমাদের ঘর ঝার দেয়, দিনের বেলা রাতের বাসি বিছানা পরিষ্কার করে। প্রতিদিন আসে কাজ করতে। রেণুকার বকাবকি শেষ হয়েছে। শেষ হয়নি কলির কান্নার অঝোর ধারা। কলিকে আমার একটি কথাই বলার আছে, বলতে ইচ্ছে হয়- ” আর এসো না আমার বাড়ি, এসো না আমার দ্বারে।”