
লেখক :- প্রলয় স্রোত
(১)
ধূলি ধুসরিত বসন্তে আমি হাঁটছি খালি পায়ে, হাতে টাকা আছে বেশ, কিন্তু পায়ে নেই জুতা। কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া কেতাদুরস্ত পোশাকে কোনো মানুষকে এভাবে উন্মুক্ত পায়ে হাটতে দেখে নি বোধহয় জনতা। অদ্ভূৎ চোখে আমার দিকে আর পায়ের দিকে বাঁকাচোখে বারবার দৃষ্টিপাত হচ্ছে তাদের। এই পা নিয়ে ব্র্যান্ডের জুতার দোকানে ঢুকা যাবে না। পাগল ভেবে হয়তো দরজা থেকে দূর করে দিবে। ফুটপাত থেকেই জুতা কিনতে হবে; এমন সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে রাস্তার এক জুতার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হাক দিলাম, “ভাই এই জোড়া জুতা দেখান তো”, দ্রুত দামদর না করে কিনে নিলাম, আর পায়ে চড়িয়ে দিলাম ৭০০ টাকার পোশাক।
এতটুকু পড়েই কী পাঠক বিরক্ত হলেন? ভাবছেন কেন এ সব বকবক করছি, তবে খুলেই বলি, আজকে সকালেও আমার জুতা ছিল বাসায়। আমার একলা বাসায় ছিল না কেওই, তবে ছিল একজন; যে গতকাল পর্যন্ত বর্তমান এবং আজকে প্রাক্তন এবং ভবিষ্যতে আমার জন্য অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমি, তাই কিছুটা হীনম্মন্যতায় ভুগলেও আশেপাশের বিশাল হৃদয়ের মানুষজন আমাকে আপন করে নিয়েছিল সম্পুর্ণ। এসব কিছু নিয়ে সুখীই ছিলাম। সেই সুখের আবছায়া আবেশে মুঠো মুঠো সুখ নিয়ে যে মানুষটা আমার একলা ঘর আরো ভরিয়ে দিয়েছিল, যে মানুষটাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম অনেকদূর যাওয়ার; সে মানুষটাকেই আমি আজ বললাম, “চিরবিদায়”। কেন বললাম? নাহ! মতের মিল ছিল আমাদের ভালোই। কিন্তু আমাদের মধ্যে মনের মিল হয়নি কখনোই। সে চাইত না, আমি তাকে ছাড়া অন্য কোনো সমপ্রেমী বন্ধুর সাথে কথা বলি। অথচ আমি চাইতাম নেটওয়ার্কিং। তার চাওয়ায় আমি কোনো ভুল দেখি না। যেখানে সবকিছুই শুরু হয় শরীর সর্বস্বতা দিয়ে, যেখানে অবিশ্বাস, মিথ্যাচার চলে নিয়মিত আর ধোকাবাজি চলে ভীষণ রকম; সেখানে বয়ফ্রেণ্ডকে অনেক বেশি নিজের করে পেতে কে না চায়। কোনো এক নাটকে উপদেষ্টার মত কেও একজন বলেছিল, ‘প্রেমিক বা প্রেমিকাকে খুব বেশি ছাড় দিতে নেই। বেশি ছাড় দিলে তারাই ছেড়ে চলে যায়।” তাই হয়তো সেও চেয়েছিল, আমাকে খুব করে কাছে পেতে। কিন্তু আমি চাই নি কখনোই। আমি চেয়েছিলাম, আমি তার প্রতি লয়াল থাকব সম্পুর্ণ, তবে তা থাকার পাশাপাশি আমি বাঁচব আমার মত করে, স্বাধীনমতো।
(২)
তাইতো বসন্তের এক বিকালে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই, যখন প্রকৃতি তার নতুন সকালকে নতুন রঙে কিভাবে সাজাবে; সে চিন্তায় বিভোর হচ্ছিল আমি আমার প্রেমিককে বললাম, আমাদের রঙিন স্বপ্নের, আমাদের শান্ত ভোরের অবসান ঘটানো দরকার। আমার হঠাৎ সমাপ্তিতে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল সে। ভীষণ রকম ছটফট করতে করতে ছুটে এসেছিল পরদিনই আমার ছোট্ট ঘরে। নানারকম শব্দবাণে জড়িয়ে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল সে, কিন্তু আমার কথায় প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছিল আমারই তৎকালীন বর্তমান প্রেমিক। আমি নিজেও জানতাম না, তার বিরুদ্ধে আমার মনের কোণে এত এত ক্ষোভ জমে ছিল। আমারই প্রত্যুত্তরে হঠাৎ সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল, ক্ষিপ্রতার সাথে আমার জুতা তুলে নিল এবং তারপর ঝড় যেমন হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়, সেভাবেই শান্ত হয়ে গেল। তারপর ব্যাখ্যাতীত দরাজ কন্ঠে বলল, “নাহ! তোমাকে আঘাত করা ঠিক হবে না, যাই দিয়ে করি না কেন, তারই তো অপমান হবে”। আমি মাটির সাথে মিশে গেলাম। হঠাৎ সে আমার চটিজোড়া বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম এবং মনে মনে বললাম, “ভালো থেকো অপ্রিয় হয়ে উঠা প্রিয় প্রাক্তন প্রেমিক।”
শরীরকে টেনে টেনে বাসায় ফিরে আসলাম, অনেক হেঁটে। কেন যেন পুরোটা বিকাল হেঁটেছি অনেক। হয়তো খুব করে চাচ্ছিলাম, তার গন্ধটা বাসা থেকে যেন সম্পুর্ণ দূর হয়ে যাক। আমার বাসায় এখন কেও থাকে না। কিভাবে কিভাবে করে যেন অনেকগুলো টিউশন করাই, একলা বাসা ভাড়ার খরচ উঠে যায়। তাই ২ রুমের একটা বাসায় থাকি, আর অনেককিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো করে রাখি। বাসায় ঢুকার সাথে সাথে রাজ্যের ক্লান্তি শরীরে ভর করলো। শুয়ে পরলাম উপুড় হয়ে। ঘুম এসে গেল ঝপাৎ করে, আর তারপরই ঘুম ভেঙে গেল, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, আদৌ ঘুমিয়েছি কিনা জানি না। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেই দেখি ঘর আর এলাকা একত্রে মিশে গেছে অন্ধকারে আর সমগ্র দেশ যেন উড়ছে বাতাসে। কী সেই বাতাস! রক্ত অবধি ঠাণ্ডা করে দেয়। কিন্তু আমার এজন্য ঘুম ভাঙে নি। তাহলে কেন ভেঙেছে… ভাবতেই বুঝতে পারলাম, ঘরে কেও একজন বা দুইতিনজন ফিসফাস করছে। আতঙ্কে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। দ্রুত বেডসুইচ টিপে দিলাম, লাইট জ্বলে নি, জ্বলবে কী করে? উন্নয়নের মহাসড়কের এ রাজ্যে বিদ্যুৎ তো যায় না, মাঝেমাঝে আসে।
(৩)
বলব না বলব না করেও, অস্ফুট ভাবে বলে উঠলাম, “কে? কে ওখানে?” শব্দ থেমে গেল। তারপর কেমন যেন যান্ত্রিক স্বরে কেও বলল, “আমরা”।
“কী চাও তোমরা?”
“তোমার মত মুর্খ মানবকে কিছু শিক্ষা দিতে চাই।”
সহসা এরকম বাক্যে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কী শিক্ষা দিবে?”
কে যেন খলখল করে হেসে উঠল। আমার শরীর জুড়ে আতঙ্কের শিহরণ বয়ে গেল, তারপরই জান্তব আর যান্ত্রিক স্বর একত্রে কবিতার মত করে শাব্দিক খই হিসেবে ফুটতে থাকলো।
“তোমরা মানুষেরা এত নিষ্ঠুর কেন? কী করে পারো, একজনকে ছেড়ে দিতে? দুইদিন পর তো অন্যের সাথে আবার জুড়ে যাবে। কিভাবে পারো এত অদল বদল? তোমাদের লজ্জ্বা করে না? নতুন কারো সাথে জড়াবার আগে, পূর্বের মানুষ, তার গন্ধ, তার স্মৃতি তার ভালো লাগা কী তোমাদের আচ্ছন্ন করবে না? আমাদের দেখো, আমরা জন্ম থেকে একসাথে। একসাথে তৈরী হয়েছি আমরা। একসাথেই শেষ হয়ে যাব।
আমাদের চলার পথে একজনও যদি ব্যথা পায়;
একজনও যদি আহত হয়;
একজনও যদি অচল হয়ে যায়;
অন্য জন সাথে সাথে সাথে চলা বন্ধ করে দিই, খাওয়া বন্ধ করে দেই, বেঁচে থাকা বন্ধ করে দেই। আমরা দুজন একসাথে অচল হয়ে যাই। আর যদি কোনো পরমাত্মা আমাদের সেই একজনকে কবর না দিয়ে সারিয়ে তুলে, আমরা দুজন আবার বেঁচে উঠি। একসাথে বাঁচি। আমরা কেওই একজনকে ছাড়া অন্যজন চলি না। আর তোমরা বা তোমার মত অপদার্থরা কিনা, টিস্যু পেপারের মত ছুড়ে ফেলে দাও নিজেদের একান্ত আপন সঙ্গীদের? কিভাবে পারো? কেন করো তোমরা? একটু আপোষ, একটু আত্মত্যাগ কী জন্ম দিতে পারে না, নতুন নতুন মহাকাব্যের। কিন্তু না, তোমরা শুধু ধ্বংস আর ছিন্ন করাই বুঝো। মানুষ বুঝো না।
(৪)
এভাবে একের পর এক শব্দঝড়ে আমি বিপর্যস্ত হয়ে পরছিলাম, আতঙ্কে আর ভয়ে আমার শরীরের রোম রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। টর্চ পাচ্ছিলাম না আলো জ্বালানোর জন্য, মোবাইল খুঁজে পাচ্ছি না ফ্ল্যাশলাইট অন করার জন্য, ম্যাচের কাঠি খুঁজে পাচ্ছি না বারুদে বিষ্ফোরণ ঘটানোর জন্য। খুঁজে পাচ্ছি না কিছুই, কিন্তু কেও একজন বা একাধিক জন আমাকে খুঁজে পেয়েছে। খুঁজে খুঁজে আমার ঘরে চলে এসেছে। সম্পর্ক বিষয়ে ভৎসর্না করছে। এখন আমার মনে হচ্ছে, শুধুমাত্র যান্ত্রিক স্বরের সেই জীবগুলো কথা বলছে না, পুরো ঘরে তাদের সমস্ত কথাগুলোই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আমার ঘরের দেয়াল, টেবিল, চেয়ার সবাই যেন আমাকে ধিক্কার দিচ্ছে, সবাই যেন একত্রে সেই কথামালা গুলো আবৃত্তি করছে, তাদের মিলিত চিৎকারে আমার ঘর গমগম করছে। এমনকি খোদ আমার আত্মা যাকে আমার মনে হত, একান্ত আপন, আমার মনে হচ্ছে, সেও বুঝি আমার ভিতর থেকে একই কথা অবিরাম বলে চলেছে। আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সেও বুঝি এক পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রচন্ড শব্দ আর ভয়ে কুকড়ে যাওয়া আমি চিৎকার করে বললাম, “থামো তোমরা”।
তারপর আবার খলখল করে সেই ভয়ংকর হাসির শব্দ বেজে উঠল। আর মুহুর্তে বিদ্যুৎ চলে আসায় উজ্বল আলোয় ঘর ভেসে গেল। আমি হতবাক হয়ে সেই হাসির ধ্বনিকে লক্ষ্য করে চেয়ে থাকলাম। সেই হাসি আর কথাগুলো আমার সদ্য কিনে আনা ৭০০ টাকার জুতাজোড়া যেখানে পরে আছে, সেখান থেকে উচ্চারিত হয়েছে।
আমি দ্বিতীয়বার মাটির সাথে মিশে গেলাম।
~~জুতোর চেয়েও নিকৃষ্ট~~