
লেখক:- শওকত আদনান
চায়ের কাপ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে অনিমা তন্দ্রাচ্ছন্ন।জানালার দিকে মুখ করে পুবআকাশের সদ্য ওঠা সূর্যটার দিকে তাকিয়ে দাদা গাইছে “আজি যে রজনী যায়,ফিরাইবো তায় কেমনে?”অনেকদিন পর দাদার গলার আওয়াজ শুনে অনিমার ভেতরটা কেমন ছটফট করে উঠলো।এই মায়া মায়া কন্ঠটায় ” অনিম” বলে ডাকটা কতদিন শোনা হয়না।এইতো দাদা গান গাইছে,এমনতো না যে কথা বলতে পারেনা।কিন্তু কেন যে দাদা একদিন হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেল!কারো সাথে কথা বলেনা।মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে পাগলপ্রায়,এমন কোনো ডাক্তার কবিরাজ নেই যার কাছে ধর্না দেয়নি।কিন্তু দাদা কারো সাথে কথা বলেনা,কেউ কিছু বললে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে একটু কথা বলার চেষ্টা করলো অনিমা,”চা টা অনেক্ষন করেছি,ঠান্ডা হয়ে যাবে।”সেই বাইরের দিকেই তাকিয়ে,কোনো সাড়া নেই।এই অবহেলা আর সহ্য হলোনা অনিমার।তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দেয়ালে মাথা রেখে বুকের সব অবহেলা,অভিমান চোখের জলে ঢেলে দিল।এজন্মই যেন অবহেলা পাওয়ার জন্য।শ্বশুরবাড়ির লোকজন কথা বলেনা তিনমাস যাবৎ।অন্যায়? বিয়ের পাঁচবছর হতে চললো এখনো কেন বাচ্চা হচ্ছেনা।সারাদিন ঘরে বসে থাকে,ডাইনিং এ বসে খেতেও ইচ্ছা করেনা।বিউটি মাসি এসে খাবার দিয়ে যায় ঘরে।বাড়ির একটা কেউ সে আছে কি নেই খোঁজ করেনা,কোথাও গেলে ডাকেনা।সন্ধ্যার পর অংকন ফিরলে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারে একটু।দমবন্ধকরা ঘরটায় প্রাণ ফিরে আসে।অনিমার সাথে এমন আচরণ অংকন মেনে নিতে পারেনা বলে অংকনকেও ওর বাড়ির লোক দেখতে পারেনা এখন।সেদিন ননদ রিংকিকে দেখতে এসেছে অথচ অনিমা কিছু জানেই না।বিউটি মাসি এসে বলে গেছে আজ তোমার ঘরের বাইরে যাওয়া বারন।ফিরে এসে অংকন যখন জানতে পারলো,অনিমা সারাদিন ঘরে বন্দী ছিল,সহ্য করতে পারেনি।কথা কাটাকাটি হয়েছে বেশ।ঘরে এসে শুধু বলেছে আগামীমাসে আমি আর তুমি নতুন বাড়িতে উঠবো।কিন্তু অংকন কেন তার পরিবার ছেড়ে যাবে?আসলেতো ও ই অংকনের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে।ওর কি ইচ্ছা করেনা বাবা ডাক শুনতে?কিংবা সারাদিন পর এসে নিজের বাবা মায়ের মুখটা দেখতে?তাই সকাল হতেই এককাপড়ে অনিমা বেরিয়ে এসেছে,কাউকে কিছু না বলে।অংকন অনেক কষ্ট পাবে,কিন্তু একসময় ভালোই হবে।এসব চিন্তা করতে করতে কোনসময় থেকে ল্যান্ডফোনটা বেজে যাচ্ছে খেয়ালই নেই।তড়িঘড়ি করে চোখটা মুছে ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে অংকন,”নিমা…তুমি ঠিক আছো?”ধাপ করে ফোনটা রেখে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।সবকিছু কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেছে।দাদার জীবনটার মতো।কতো হাসিখুশি ছিল।আজ দাদা ঠিক থাকলে নিশ্চয়ই এমন কিছু একটা করতো যাতে এই পরিস্থিতিই তৈরি হতোনা। এইতো অনিমার বিয়ের সময়ও সজীব ভাই দাদা মিলে কতো মজা করলো। এই দুটি মানুষ একসাথে মানেই সব সমস্যার সমাধান।বাড়ির কোনো কাজ কাউকে করতে হতোনা।সব দাদা আর সজীব ভাইয়া সামলে নিতো,আর সবাইকে এক জায়গায় গল্প করতে বসিয়ে দিত।মা বলতো এই দুটি বিয়ের পরও দেখা যাবে বউ রেখে দুইবন্ধু মিলে একসাথে ঘুরছে।সজীব ভাই বলতো,”সে সুযোগ নেই আন্টি,যারা আমাদের আলাদা করতে চাইবে আমাদের জীবনে তাদের অস্তিত্বই রাখবোনা।”অনিমার বিয়ের দিন রাতে,সবাই যখন বাসর জাগছে,কোত্থেকে মণিপিসির ছেলেটা এসে বললো সজীব ভাই নাকি দাদাকে সিঁদূর পরিয়ে দিয়েছে।আসরের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।দাদারা যখন এলো ঘরে,দাদার সিঁথির দিকে সবার নজর।হ্যাঁ সিঁদূর শুধু মাথায় না,পুরো মুখেই লেপ্টে ছিল।বিসর্জনের সিঁদুরখেলায় যেমনটা হয়।অনিমা যখন বিদায় নিচ্ছিল,গাড়ির জানলা গলে দেখছিল সজীব ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে দাদা কেঁদেই চলেছে।আচ্ছা অনিমার যখন খুব কষ্ট হয়,অংকনের বুকে যেমন আশ্রয় খুঁজে পায়,দাদাও বুঝি সজীব ভাইয়ার বুকটাকে সেরকম ভরসা করতো।নইলে যেদিন সজীবদা কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল সেদিন থেকে দাদার এই অবস্থা কেন?মা ডাকছে রান্নাঘর থেকে।দাদাকে জল দিয়ে আসা হয়নি।কিন্তু আজ একটা প্রশ্ন সত্যি খুব নাড়া দিচ্ছে,সজীবদার চলে যাওয়ায় দাদা সবকিছু থেকে এতো ছিন্ন হয়ে গেল কেন?মা কে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে,কিন্তু কিকরে জিজ্ঞেস করবে ভেবে পাচ্ছেনা।চুপ করে আছে দেখে মা জিজ্ঞেস করলো,”কিছু বলবি?”অনিমা কথা গুছাতে পারছিলনা,বললো,”মা,দাদা হঠাৎ চুপ হয়ে গেল কেন?”চুলোর তরকারিটা নাড়তেই নাড়তেই না শোনার মতো একটা ভান করতে মনে হলো এখন সব বলা দরকার।মা অনিমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলনা,”সজীবের কথা মনে আছে?”
অনিমা-হ্যাঁ থাকবেনা কেন।
মা-তোর দাদা আর ও বন্ধু ছিল জানতিতো?
অনিমা-সে আর বলতে।
মা-শুধু বন্ধু না।হয়তো আরও বেশি কিছু।কতো কবিরাজ ডাক্তার কতজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম,আমার ছেলেটার এমন কেন হলো।কবিরাজ বলেছিল তাবিজ বেঁধে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।সজীবের মাথার চুলও দিয়ে এসেছিলাম যাতে বাবাইয়ের থেকে দূরে সরে যায়।ডাক্তার বলেছিল,এরকম মানুষের মধ্যে থাকে।তারপর যখন তোর বিয়ে,সেদিন বাবাইয়ের কপালে সিঁদূর পরিয়ে দিয়েছিল সজীব।তুই চলে যাওয়ার পর এ নিয়ে বেশ দেন-দরবার হয়েছে।তোর বাবা সজীবের বাবাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিল।সজীবের আব্বা ধর্মভীরু মানুষ।সহ্য করতে না পেরে এতো বড় ছেলের গালে চড় মেরে হন হন করে চলে গেছিল।যাওয়ার আগে সজীবকে বলেছিল,এখন থেকে জানবো আমার ছোটছেলে বলে কেউ নেই।এ নিয়ে তোর বাবার সাথে বাবাইয়ের খুব কথা কাটাকাটি হয়েছিল জানিস,বাবাইয়ের কথাগুলোও ফেলার মতো না।সত্যিইতো রে,ভালোবাসা কেন শুধু একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে হবে?দুটি হৃদয় যেখানে আছে সেখানেইতো থাকার কথা ভালোবাসা।যদি কোনো মেয়েকেও বিয়ে করে তবু তো সে বন্ধুই হবে,যার সাথে সবকিছু বলা যায়,সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে বাঁচা যায় তাহলে সেটা সজীব কেন হতে পারেনা?তোর বাবা তখন বলেছিল,তার বংশবৃদ্ধি চাই,দিতে পারবে সন্তান?বাবাই বলেছিল,”আচ্ছা বাবা আমার স্ত্রীর যদি সন্তান না হয়?”সজীব বলেছিল বাবাইকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে।বাবাই বারবার বাঁধা দিয়েছিল,বাবাই চেয়েছিল সজীব তার পরিবার থেকে আলাদা না হোক।হয়তো এটাই ভুল ছিল।সজীবকে না মেনে নিচ্ছিল পরিবার,না ও এ বাড়িতে আসতে পারছিল।বাবাই কিছুতেই অন্যকোথাও যেতেও রাজি না।ও চাচ্ছিল সমাজের আর মানুষগুলোর মতো বাঁচতে।একদিন খবর এলো সজীবকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।কোথাও না।
সাতদিন,পনেরোদিন,একমাস,বছর পেরিয়ে গেল।এদিকে বাবাইটাও একা থাকতে থাকতে কখন যে শূন্য হয়ে গেল,শুধু গান ছাড়া আর কিছুই রইলোনা।সজীব বলতো,ও মরে গেলেও নাকি ভূত হয়ে বাবাইয়ের গান শুনতে চলে আসবে,আর ঘুমের মধ্যে আমার পাকাচুল বেছে দিয়ে যাবে।আমার কপালটাই খারাপ জানিস।কোন জন্মে যে কতবড় পাপ করেছিলাম।ছেলেদুটোর জীবন এভাবে তছনছ হয়ে গেল চোখের সামনে,কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অনিমা কখনো বুঝতেও পারেনি দাদার জীবনে এতোবড় ঝড় বয়ে গেছে।অংকন?ও কি করবে এখন?যার জন্য ও পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস পায়,নিজের মতো করে ঘর গড়বার স্বপ্ন দেখে…সেই যখন চলে এলো….অংকন আবার কোথাও হারিয়ে যাবে নাতো?হঠাৎই অনিমার ভেতরটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে,ফোনটা হাতে নিয়েই অংকনের নাম্বার ডায়াল করলো।ফোনটা বাজছেই,ধরছেনা কেন কে জানে।একবার দুবার তিনবার…নাহ।দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অনিম।
দাদা ওঘর থেকে গাইছে,”যেতে দাও,যেতে দাও গেল যারা…তুমি যেওনা তুমি যেওনা আমার বাদলের গান হয়নি সারা”
হঠাৎই ফোন বেজে উঠলো,অংকন।রিসিভ করেই,”তুমি ঠিক আছতো?”