
লেখক :- কমলিকা
আমার জন্ম গ্রামে। গ্রামের একটি যৌথ পরিবারে। গ্রামের যৌথ পরিবার গুলো হয় ভালোবাসার ভান্ডার। জেঠু- বড় মা,মা-বাবা,কাকা-কাকী,দাদী,ভাইবোন। সবমিলিয়ে ৪০/৫০ জন মানুষ। মাঝেমধ্যে বা, ছুটিতে ফুপুরা আসতেন সাথে ভাইবোন গুলাও। মজা আর আনন্দের শেষ থাকত না।
অনেক বড় হাড়িতে প্রতি বেলা ২ চড়ান করে ভাত রান্না। ১০ নম্বর কড়াইতে করে তরকারি। সেই ভোরবেলা ফজরের নামায পড়ে। মা আর কাকি রা কুপি ধরিয়ে পুকুর ঘাটে থালাবাসন মাজতেন। জন প্রতি একটা করে কাসার গ্লাস,কাসার থালা, আর ৩ টা কাসার বাটি। তারপর শুরু হতো সকালের রান্নার প্রস্তুতি। আমরাও পোলাপান গুলোও ভোরবেলা উঠতাম। জেঠু টেনে উঠায় বসায় রাখত। দিদিরা গিয়ে দাদীর কাছে বসত। দাদী নামাজ পড়া শেষ করে জলচৌকির ওপর বসেই ওদের চুল বাঁধত।
৩ বেলায়ই রান্না শেষ করে। রান্নাঘরের বিশাল বারান্দায় পাটি পেরে বসতাম সবাই। মেজোকাকী ঘর থেকে খাবার তুলে দিত।মা খাবার বেরে দিত সবার পাতে। ঝোল থেকে মাছ তুলে আলাদা করে রাখা হতো। সবথেকে বড় মাছটা জেঠুর,তারপরের টা মেজ কাকার,তারপরের টা বাবার,তারপর সোনাকাকা,তারপর কুটি কাকা। তারপর যা থাকত বাকিদের। কম পরলে ভেঙেই দিতো কোনদিন। ডিম হলে হলে অর্ধেক। সেটি অর্ধেক ডিমের কুসুম নিয়ে কতই না কিপটে পনা করতাম। বাড়ির ভালোমন্দ খাওয়া বলতে ছিল দেশী মুরগী,চিতুই পিঠা,রুটি পিঠা।
আমার জীবনেও প্রেম আসল জীবনের ১ম প্রেম….
জীবনের ১ম ভালোবাসা শুভ্র। জীবনে ভালোবাসা কি ১ম সেই বুঝিয়েছে। শুভ্র বাইরের কেউ না। আমার ছোট ফুপুর বড় ছেলে। দেখতে কালো ভোমরের মত কালো। উঁচু লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী। যাকে বলা চলে হাজারো রমণীর স্বপ্নের মাধব। কালো কিন্তু এতো মায়াময়,অসাধারণ হাসির অধিকারী,ঘন কালো চুল। শুভ্র ভাউয়াকে খুব ভাল লাগত।তখন এই জীবন সম্পর্ক অজানা ছিলাম। তখন বুঝতাম জীবন মানেই একটা ছেলে আরেকটা মেয়ের বিয়ে হবে বাচ্চা হবে। কিন্তু আমার তো মেয়ে নয় পুরুষের গন্ধ ভালো লাগে। শুভ্র দাদা সামনে আসলে সব উল্টো পাল্টে যেত। দাদা শুধু আমাকে দেখে হাসতেন আর বলতেন “তুই কি জানিস? তুই একটা ভালোবাসা! তোর নটাংকি গুলো ভারি মিষ্টি রে।” আমিও এক গাল হেসে ছাদ থেকে নেমে আসতাম। ১৪ বছর বয়স। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে কৈশোর সবকিছুই নতুন নতুন। বুকের ধুকপুকানি টাও বেরে যেত। শুভ্র দাদা আমাদের বাড়ি আসলে সবার সাথে পুকুরে গোসল করত। আমি অবাক চোখে তার শরীর দেখতাম। কতবার যে কোলে করে পুকুর ঘাট থেকে পানিতে লাফ দিয়েছে। আমি তো নাকানিচুবানি খেয়ে পানি খেয়ে কেশে কেঁদে মরতাম। সকালে অথবা, বিকেলে বড় দাদার চাইনা ফনিক্স সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরতাম ২ জনে। শুভ্র দাদা সবসময় সামনের রডে বসাতেন আর পিছনের কেরিয়ার খালি রাখতেন। আর গান গাইতেন,”তোরে রডে বসিয়ে বেল বাজাবো।” শুভ্র দাদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। দাদার শরীরে যখন ছোয়া লাগত তখন বিদ্যুৎ চমকে যেত। ভাবতাম “আমি তো ছেলে তাহলে এমন কেন হয়? দাদাও তো ছেলে।”
এভাবেই কেটে গেল ৩ টা বছর।
সেদিন ছিল রূপন্তি আপুর বিয়ের হলুদ। সবাই আসছে বাড়িতে। শুভ্র দাদাও আসলেন । পুরো বাড়ি আলোকসজ্জা হৈ-হুল্লোর। দাদাভাই, মিয়া দাদা, দাদাবাবু, দাদা,শুভ্র দাদা সবাই প্রায় সমবয়সী।সবাই বাজার থেকে এসে জামাইবাবুদের পুকুর পারের চালতা গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে তাশ খেলছে। বাড়ির ভেতরে গীত গাইছে দাদী আর তার সখীরা।
রাত তখন ১২ টা সবাই খাওয়াদাওয়া শেষে ঢালাই বিছানা। সচারাচর গ্রামের বিয়েতে যেটা হয়। আমি আদরের তাই দাদাভাইয়ের কাছে ঘুমাই। তো সেদিন দাদাভাই আর শুভ্র দাদার মধ্যে গিয়ে পরলাম। লজ্জায় শিহরণে বুক ধুকপুকানি তে আমি শেষ। ঠেলতে ঠেলতে দাদাভাইয়ের কোলের ভেতর। হঠাৎ রাতে শুভ্র দাদা রাতে টান মেরে টেনে নিয়ে বলল,”অপূর্ব শুধু দাদা? আমরা কি কিছুই না৷ আমাদের দিকে মুখ দিয়ে ঘুমানো যায় না।” বলেই জড়ায় ধরে কপালে চুমু দিয়ে ঘুমাইল।সেদিন আর ঘুম হলো না আমার রোবট হয়ে গেলাম।
পরদিন আপুর বিয়ে। সকালবেলা থেকে সাজ সাজ রব।গোসল করানো, হলুদ মাখানো,রং খেলা। আমি সারাদিন শুভ্র দাদার সাথে কথা বললাম না। সামনে পরলেও এড়িয়ে গেলাম। ১ম বার বলল ” পাঞ্জাবি তে বেশ লাগছে।” আমি শুধু হাসলাম। ২য় বার যখন জুতা চুরি করলাম!”সাব্বাস মেরি ভাই!” ৩য় বার যখন জামাইবাবুর কোলে উঠে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিলাম ” টাকা গুলা আমারে দে ভাই।”
বিয়ে শেষ। রূপা আপু চলে গেল। একলা হয়ে গেলাম। দুই ভাইবোন ছোট থেকে একসাথে ঘুমানো আর শোয়া নিয়ে মারামারি। যাওয়ার সময় আপু আমি একজন আরেকজনকে জরিয়ে ধরি সেকি কান্নাকাটি। মনটা এখনো খারাপ তাই সবাই যখন ঘুমে আমি উঠে ছাদে চলে আসলাম। হঠাৎ পিছন থেকে কাউকে টের পেলাম।
শুভ্র দাদা – কিরে ছোটু? এতো রাতে ছাদে কি তোর?
আমি- তুমি এখানে?
– ঘুমের ভেতর তোকে হাতিয়ে পেলাম না।খুজতে খুজতে ছাদে চলে আসলাম। মন খারাপ আপুর জন্য?
– হুম! 😔😔
– আমাকে দেখেও মন ভালো হয়নি?
– 🙄🙄🙄🙄
– আমি সব বুঝি খোকা তোমার চোখ ঠোঁট কি বলে।
– আমি যাই দাদাভাই না দেখলে রাগ করবে।
– আহ্! কই যাস? তোকে তো আজ ছাড়ছি না ভাই। এই তোর বয়স কত রে?
-১৪। আমি যাই দাদাভাই জেগে যাবে।
– জাগুক! তুই তো আমার বুকে ঘুমাবি আজ থেকে।
– 🙄🙄
– কাছে আয় বুঝিয়ে দিই….
-😶😶😶😶( হাত ধরে টান মেরে।)
– 😘😘😘 (চুমু দিয়ে) বুঝলি।
শুরু হল আমার জীবনের ভালোবাসা। সবকিছুই ছিল যেন সে। শুভ্র ছুটিতে বাড়ি আসলে আমাদের বাড়িতে আসত বেরাতো মা-বাবা কে আবদার করত,”মামা আর মামী ২ জনকে বলছি ছোটুকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি কয়টা দিন থেকে আসুক।পোলাপান মানুষ সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে থাকে।” মা-বাবাও সম্মতি দিতো। যেতাম ফুপুর বাড়ি। কাম ভালোবাসা আশা ভরসা সবছিল শুভ্র দাদা। বুকের ওপর করেই রাখত সবসময়। এভাবে চলতে লাগল আমাদআমাদের ভালোবাসা।
দাদা পড়াশোনা শেষ করলেন। খুব ভালো চাকরি পেলেন। সবাই কত খুশি আমি আরও বেশি খুশি। কিন্তু ফেকাসে হলাম তখনই যখন বাবা,কাকা,ফুপু,জেঠা দাদার জন্য পাত্রী দেখার কথা বলল। বুকের ভালোবাসার ধুকপুকুনি গুলো মনে হল বজ্রপাতে পরিণত হলো। ভালোবাসার থেকে হারানোর ভয় ঢুকে গেল। হারিয়েই তো ফেলব। সমাজে তো এসবের কোন জায়গা নাই।কি করব আমি? শুভ্র কে আমার সামনে অন্য কারও হবে। এটা কেমনে মেনে নিব? এসব ভাবতাম সারাদিন কাঁদতাম আড়ালে। খেলতে যেতাম না,পড়ায় মন বসত না। এদিকে শুভ্র দাদা চাকরির ১ম বেতন দিয়ে ঘড়ি কিনে দিলেন “সামনে তোর এস.এস.সি পরীক্ষা এটা হাতে পরীক্ষার হলে যাবি।মনে করবি আমি তোর সাথে।” একটু খুশি লাগল। সন্ধ্যাবেলা খবর আসল শুভ্রর জন্য মেয়ে পছন্দ করেছে আবার বাগদানটাও সেরে ফেলেছে। পাথর হয়ে গেলাম শুনে।তছনছ হয়ে গেলাম ভেতরে।
কাকী বলল,”শুনেছিস শুভ্রর বিয়ে ঠিক হয়েছে? ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে!”
মনি মা,-এই নে মিষ্টি খা। মেয়ের বাড়ির থেকে মিষ্টি পাঠিয়েছে! তোর ফুপু পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ি।নে নে খা! (বলেই ২/৩ টা মিষ্টি গুঁজে দিলো মুখে।) আমি শুধু ২ টা কথা জিজ্ঞেস করলাম,”বিয়ের তারিখ টা কবে? শুভ্র দাদার কি মেয়ে পছন্দ হয়েছে? “
মনি মা বলল, “হ্যাঁ খুব পছন্দ করেছে। বিয়ের তারিখ তোদের পরীক্ষার পর।”
শুভ্র দাদা কে ফোন করলাম। কল ওয়েটিং। হয়তো তার প্রিয়তমার সাথে কথা বলছে। পরে ব্যাক করবে হয় তো কিন্তু করল না। কয়েকদিন কল করলাম আর ফিরতি কিছু আসল না। এদিকে পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষা দিচ্ছি ভালো মত। ঘড়িটা নিই না সাথে। যাওয়ার সময় একবার ছুঁয়ে যাই চোখে পানি আসে।মুছতে মুছতে বের হই ঘর থেকে। মা বড়মা দাদী ভাবে পরীক্ষার ভয়ে চোখে পানি। পানি টা ছিল কষ্টের মানুষ টা একবার পরীক্ষার আগে ফোন করল না। একটা ফোন করলে কি হত?
পরীক্ষা শেষ হলো।এবার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসল। ইচ্ছে ছিল না তবুও গেল। কারণ না যাওয়ার জন্য যে হাজার প্রশ্ন হবে সেটার উত্তর আমার জানা নেই। তাই নিরুপায় হয়ে গেলাম শুভ্রর বিয়ে তে। কি খুশি তিনি একদম ভেতর থেকে। আমার যে ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। সেদিন বুঝেছিলাম ভেতরে কষ্ট চেপে রেখে সবার সাথে অট্টহাসি, রং মাখা,হলুদ খেলা, সেজেগুজে হাসতে নিজের ভালোবাসার মানুষ টা অন্যের হয়ে যাওয়াটা দেখা কত কষ্টে র।
সন্ধ্যাবেলা বউ নিয়ে বাড়ি আসল। সবাই আমাকে ডাকছে,
-কিরে চল! এখানে বসে আছিস যে? বাসরের দরজা আটকাতে হবে। তুই ছাড়া সম্ভব না। কিরে চল না।
আমি- আমার শরীর ভাল ঠেকছে না তোরা কর যা৷ শুভ্র দাদা এমনিতেই দীল দরিয়া মোটা অংক দিবে।
আমি উঠে গিয়ে বাবা’র হাত ধরে বললাম, আমি- বাবা আমাকে বাড়ি দিয়ে আসো না!
বাবা- কেন?
আমি- আমার এতো হৈ হুল্লোড় ভাল্লাগছে না।
বাবা- সে কিরে? তুই এটা বলছিস?
আমি – হুম্! তুমি যাওয়ার সময় আমায় নিয়ে চল। মা কাকীরা এখানে থাক।
আমি কেমনে থাকব এই বাড়ি। একই ছাদের নিচে আমি থাকব সেই ছাদের নিচে ভালোবাসার মানুষ টা অন্য কারও সাথে তার ফুলশয্যা। এটা আমি কেন! কেউ মানতে পারবে না। আসার সময় চোখে পরল। আজ কি সুন্দর লাগছে শুভ্র দাদা কে।
শুভ্র দাদা – কি হলো মামা? কোথায় যাচ্ছেন?
বাবা- বাবুর! ভাল্লাগছে না বলে এখানে তাই বাড়ি যাচ্ছি। সকালে চলে আসব রে বাবা।
শুভ্র দাদা – ওহ আচ্ছা!
হায় রে! হায় রে মানুষ। কেমনে পাল্টালে তুমি। কি ছিলে কি হলে? ভয়তে চোখের পানি পরতেও দিচ্ছি না।একফোঁটা পানি হাজারটা প্রশ্ন। চলে এলাম বেরিয়ে কয়েকবার ফিরে তাকালাম হয়তো আড়ালে থেকে দেখবে। এই পথ দিয়ে কত স্মৃতি। কিন্তু ভুল ছিলাম আমি কেউ তাকিয়ে নেই।
বাড়ি চলে আসলাম । এসেই ঘরে চলে গেলাম। কাপড় পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে খীল লাগিয়ে শুয়ে পরলাম। রাত গভীর হচ্ছে আমার যন্ত্রণা বারছে।একলা বিছানায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি আমি। হায়! কিছুদিন আগে ওর বুকে তো আমি ছিলাম। আজ আমি কোথায়? সেই ঘর,সেই পালঙ্কে, সেই মানুষ টা, সেই ঘর,কত স্মৃতি আজ সেই মানুষটার বুকে অন্য কেউ। কি করছে এখন ওরা? শুভ্র মনে হয় ঐ মেয়েটারে চুমু খাচ্ছে কপালে, বুকে জরিয়ে নিয়েছে। ভাবতেই বুক দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট টা যে বলে কয়ে বুঝাবার নয়। হায় রে মানুষ। শেষ করে দিলি আমাকে।পরদিন সকালে বৌভাতে না গিয়ে মামা বাড়ি চলে গেলাম।
২ মাস পর আমার রেজাল্ট হলো এ+ আসল। সবাই কত খুশি আমিও খুশি খুব।কাটিয়ে উঠেছি অনেকটা। হঠাৎ তার একটা মেসেজ,” শুভেচ্ছা নিস। জীবনের খারাপ অধ্যায় ভুলে সামনে এগিয়ে যা।” আমি হাসলাম। ওদের বিয়ের ৬ মাস পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। শুনলাম শুধু কিছু জানতে চাইলাম না। আবার ধুমধাম করে বিয়ে করল। সেই ঘরে ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে #সায়ন্তী। বেশ মিষ্টি সে। ওর ১ম বিয়ের দিনের পর থেকে আর দেখা হয়নি। শুনেছিলাম বাবা মারা যাওয়ার দিন আসছিল।কিন্তু আমার হুঁশ ছিল না। আমিও তো ভুলে গিয়েছি ওরে । এখন আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ফুপুরা ঢাকা শহরে বাড়ি করছে।যেতে বলে আমি যাই না।
এখনো মাঝেমধ্যে স্স্মৃতি গুলো মনে পরলে আঁতকে উঠি। হায়! এজন্যই বলে জীবনের ১ম ভালোবাসা ভুলবার নয়।