
লেখক :- আ হাসান
যখন চাকরি টা পাই আমাকে জিজ্ঞেস করা হল কোথায় পোস্টিং হলে ভাল হয়। আমি বললাম ঢাকার বাইরে কোথাও। শুনে তো কান্ট্রি ডিরেক্টর হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, বলল, “ইউ আর নট কিডিং, রাইট? তোমরা তো ঢাকা শহর ছাড়তেই চাও না।” আমি বললাম, “আমি আসলে কিছুদিন একা থাকতে চাই, সব কিছু কিভাবে একা সামলাতে হয় তা শেখা দরকার, এখানে থাকলে তা হবে না।” আসলে যে শহরে চুটিয়ে প্রেম করেছি, প্রতিটা অলগলি তে অসংখ্য সুখ-স্মৃতি, ব্রেকাপের পর সেই শহরে থাকা খুব একটা সহজ কাজ না। বস কে তো এত কথা বলে লাভ নেই, তাই অন্য কারণটাই বললাম।
হয়েও গেল পোস্টিং! একটু কাছে কোথাও দিল না, দিল এক্কেবারে সেই দিনাজপুর! আমি কিনা যমুনা সেতুর ওপাড়েই যাইনি, এখন গিয়ে থাকতে হবে দেশের অন্য মাথায়। তবুও রাজি হলাম, আপাতত ঢাকা থেকে যতটা দূরে থাকা যায়।
বাসায় এসে অবশ্য বললাম দিনাজপুরে পোস্টিং না নিলে জব তা হতই না। আব্বু আম্মু কিছু বলল না। ছোট বোন দেখলাম একদম চুপ হয়ে গেছে। ভাবলাম কিছুদিন থেকে আসি, পরে না হয় চাকরি ছেড়ে দেব।
নিজের রুমে ঢুকলাম। একটা সময় ছিল যখন নিজের বাসায় নিজেই অতিথি হয়ে আসতাম, আবার সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি। নিজের ঘরে, নিজের শহরে আবার নাহয় অতিথি হয়েই ফিরব। খারাপ কি!
বইয়ের তাক টা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল, এতোগুলো বই তো টেনে নিতে পারব না। তবুও কিছু নিয়েই নিলাম, বাকিগুলো নিজেই ঝেড়েমুছে রাখলাম। ছোটবোন কে বললাম সপ্তাহে একবার যেন একটু পরিষ্কার করে। করবে বলে মনে হয় না, টাকার লোভ দেখাতে হবে।
কি নেব, আর কি রেখে যাব এই নিয়ে যখন বিস্তর গবেষণা চলছে হটাৎ একটা ব্যাগ পড়ল চোখের সামনে। প্রিয় মানুষটার দেয়া সব চিঠি, কার্ড, গিফট ছবি এইসব হাবিজাবি। কিছুদিন আগেও চোখে পড়লে হয়ত একেবারে পুড়িয়ে ফেলতাম, এখন আর রাগ হয় না। থাকুক সে তার মত, আমার কি!
প্লেনের টিকেট ক্যান্সেল করে বাসের টিকেট নিলাম। যমুনা সেতুটা দেখা হয়ে যাক, আর ঢাকার চিরচেনা রাস্তা ধরেই না হয় বের হয়ে যাই এ শহর থেকে।
বাসার মানুষজন কে টেনে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আর আনিনি, কি দরকার! গাবতলী এসেই সিগারেট ধরালাম, আব্বু আম্মু আসলে তো আর তা পারতাম না। বাস আসতেই বাসে ব্যাগ রাখলাম, নিজেও উঠে বসলাম। অভ্যেস মত কানে হেডফোন।
শেষ বাস যাত্রা তার সাথেই ছিল। প্রেমের এই এক জ্বালা এত এত স্মৃতি হয় যে কিছু করতে গেলেই ওগুলো মনে পড়ে। তাও ভালো যে পাশে আর কোন সিট নেই। থাকলে নির্ঘাত সেই সহযাত্রীর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতাম, কতদিনের অভ্যেস বলে কথা!
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি, কেমন আজব লাগছে। ঢাকা আমার জন্মভূমি না, আমার বাড়িও ঢাকাতে না, কিন্তু বেড়ে ওঠা এই শহরেই। একবার মনে আছে মতিঝিলের জ্যামে বসে অর্ণবের ‘এই শহর আমার’ গানটা নিয়ে কথা বলছিলাম। এক বন্ধু তো ক্ষেপে একাকার। “বালের এক শহর! জ্যামের জন্য ১০ মিনিটের রাস্তা ১ ঘন্টা লাগে! মানুষের ভিড়! কি ভালো টা আছে এখানে!” আমি আর অন্য বন্ধু ঢাকায় কি কি ভালো তা নিয়ে চেঁচাতে লাগলাম।
আচ্ছা পাশের ছাদে কি পিচ্চিগুলো আজো ক্রিকেট খেলছে, ওই ছাদের আন্টিরা কি আজো ছাদে উঠে হাসাহাসি করছে? আচ্ছা বৃষ্টি হলে কি আমার জানালায় আজো অদ্ভুত সেই শব্দ হবে? ভার্সিটির ডাবল ডেকার কি রঙ সাইডে যাওয়ার জন্য হম্বিতম্বি করবে? জ্যামে বসে কি আজো কেউ না কেউ ঢাকা কে গাল দিয়ে যাচ্ছে? ওই ওভার ব্রিজের উপর কি আজো মানুষের ভীড় ঠেলে কেউ আমার মত দৌড়ে যাচ্ছে প্রিয় কারো কাছে? বিল্ডিং এর ফাঁকে কি আজ রাতেও চাঁদ উঠেছে?
আজ বাসে বসে ঢাকার কি ভাল বা কি খারাপ তা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না, প্রিয় মানুষের কোন স্মৃতিও আর কষ্ট দিচ্ছে না, মনে পড়ছে না কিছুই! শুধু মনে হচ্ছে কবে আবার ফিরব এই শহরে? আমার শহরে!…