
লেখক :- ই আহমেদ
সবকিছু ঠিকঠাক যাচ্ছিল। ভার্সিটিতে আহামরি রেজাল্ট না হলেও মোটামুটি মাঝারি মানের ছাত্র হিসেবে এসব নিয়ে টেনশন ছিলনা কখনো। হলে থাকতাম, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ক্লাস, আড্ডা, ঘোরাঘুরি সবই চলছিল নিয়ম করে। এর মধ্যেই পরিচয় হয়েছিল নাঈমের সাথে। ফেসবুকে একটা গ্রুপ থেকে পরিচয়। পরিচয় হওয়ার পরপরই ওকে বেশ ভাল লেগে যায়। এরপর দেখা করা,নিয়মিত আড্ডা দেওয়া, ফোনে দীর্ঘসময় কথা বলা- ঠিকঠাক ফর্মুলা মেনে একটা সুন্দর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম দুজনে। ও ছিল আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র, অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ছাত্র। একারণে ওর সাথে সবকিছু নিয়েই কথা হত, পড়াশোনা, বই, মুভি, সিরিজ- সব। প্রতি শুক্রবার বিকেলে আমরা ঘুরতে যেতাম, চট্টগ্রাম শহর চষে ফেলেছিলাম দুজনে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে। বাটালি হিলের চূড়ায় বসে কত বিকেল কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। ও মাঝে মাঝেই আমার হলে চলে আসতো। বন্ধুদের সাথে কাজিন বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম,তাই আমাদের অবাধ ঘোরাফেরায় কারো সন্দেহ করার কিছু ছিলনা। সবকিছু সত্যিকার অর্থেই ঠিকঠাক যাচ্ছিল।
সমস্যার শুরু একেবারে হঠাৎ করেই। অপ্রত্যাশিতভাবে। তখন আমি ফাইনাল ইয়ারের শুরুর দিকে৷ নাঈম ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট,একটা প্রাইভেট ফার্মে মাত্রই চাকরি শুরু করেছে। ঘটনার সারমর্ম ছিল এই, নাঈমের বড় বোন একদিন ওর ল্যাপটপে আমার আর নাঈমের চ্যাট দেখে ফেলে। বলে রাখা ভাল, নাঈমের পরিবারের সবাই ছিল খুব ধার্মিক৷ কাজেই ঘটনার ফলাফল যতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো, ঠিক ততটুকুই গড়ালো। ওর বাবা জানলো, মা জানলো। তারা কেউ কখনো তাদের ভয়াবহ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাদের ছেলে এমন কিছু করবে। এত বড় ‘অসুখ’ তাদের একমাত্র ছেলের- এটা তারা বিশ্বাস করতে পারছিলনা। তাই ছেলেকে সুস্থ করার উপায় এক দিনেই খুঁজে বের করে ফেললেন তারা। নাঈম তখনও কিছু জানেনা। ও সকাল থেকে বাইরে ছিল। বিকেলে বাসায় এসে দেখে ওর মা,বাবা,বোন, বড় চাচা আর ছোট চাচা সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ওর জন্য একটা পাত্রী ঠিক করা হচ্ছে। বড় চাচার শ্যালকের মেয়ে৷ ওর চেয়ে দুবছরের ছোট। ওকে কোন প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়ে জানানো হল আগামী মাসেই তার বিয়ের দিন ঠিক করা হচ্ছে, মুরুব্বীরা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সে অনুযায়ী সবকিছু হবে৷ সে যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে৷
কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেল। দুই বছরের সম্পর্ক দুইদিনের মধ্যেই শেষ! আমি কিংবা নাঈম, আমরা কেউই অতি রোমান্টিক বা আবেগপ্রবন কখনো ছিলাম না। নাঈম খুব প্র্যাক্টিক্যাল ছেলে ছিল। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কখনো ভেবে দেখিনি, ভাবা হয়নি গ্র্যাজুয়েশনের পর কে কোথায় থাকবো, বা আমাদের সম্পর্কের কি হবে। দুএকবার যে কথা হয়নি এ ব্যাপারে- তা নয়। কিন্ত আমরা ভেবেছিলাম যখন সমস্যা আসবে, সমাধান করে নেব আমরা যেকোনভাবে। কখনো মনে হয়নি এভাবে দুদিনের মধ্যেই সব শেষ করে চলে যেতে পারবে ও।
ওর বিয়ের ছবি দেখার আগ পর্যন্ত আমি বোধহয় একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মন খারাপ ছিল, ওর অভাব বোধ করছিলাম খুব। কিন্ত কোথাও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা। একমাস পার হতেই যেদিন ও ‘আলহামদুলিল্লাহ’ লিখে নববধূর হাত ধরে একটা ছবি ফেসবুকে প্রোফাইল ছবি হিসেবে সেট করলো, সেদিন প্রথমবারের মত বুঝতে পারলাম ওর কাছে আমি কতটা মূল্যহীন ছিলাম। যে সম্পর্ককে আমি ম্যাচিওরিটি ভাবতাম, সেটা যে ওর কাছে অদরকারী সময়ক্ষেপনের একটা উপলক্ষ ছাড়া আর কিছু ছিলনা- তা বুঝতে আমার ব্রেকাপের পরেও একমাস সময় লেগে গেল!
এর পরের ঘটনা দেবদাসের কাহিনীর মতই। ফাইনাল ইয়ারে ৩ সাব্জেক্টে অকৃতকার্য হলাম। পাবলিক ভার্সিটিতে একটা ব্যাপার খুব সহজ, বখে যাওয়া। ক্যাম্পাসে বোতল খুব সহজেই পাওয়া যেত। প্রতিদিন রাত ১২ টার পর ভার্সিটির মাঠের পেছনটায় বোতল হাতে বসে থাকা তখন আমার প্রতিদিনের রুটিন। নাঈমের সাথে যোগাযোগ আর ছিলনা। খুব ভদ্রভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল আমাকে,যেন আমি এসব নিয়ে আর না ভাবি কখনো। সমকামীতা যে ওর ধর্মে কত জঘন্য অপরাধ এটা নাঈম নতুন করে বুঝতে পারলো। আমাদের মধ্যকার ‘হারাম’ সম্পর্ক ভুলে ও নতুনভাবে বাঁচতে চায়, আমার কাছে অনুরোধ করলো আমি যেন ওকে এটুকু সাহায্য করি। প্রথমদিকে খুব সমস্যা হত, না চাইতেও প্রায়সময়ই হঠাৎ মেসেজ দিয়ে বসতাম,আমাকে মিস করে কিনা জিগেস করতাম। শেষমেশ ও ব্লক করে দেওয়ার পর থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
||
ওর বিয়ের প্রায় আট বছর পার হয়ে গেছে। আমি একাই রয়ে গেছি এখনো। আমার জীবনে যে কেউ আসেনি এই আট বছরে,তা নয়। আমি সবার মধ্যে নাঈমকে পেতে চাইতাম, কিন্ত কেউ নাঈম হতে পারেনি।
ওর আর আমার ব্যাপারটা খুব কাছের দুএকজন বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ জানতো না। ওই দুএকজনের মধ্যে একজন ছিলেন রাফি ভাই। রাফি ভাই থেকে আজ সকালেই জানতে পারলাম ওর মৃত্যুর খবরটা। ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করে মারা যায় আমার নাঈম। পাশে ছিল ওর পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা, আর স্ত্রী। ওর জীবনটা সুন্দর সাজানো ছিল, আমার মত এলোমেলো ছিলনা।
দাফনের শিডিউল আছরের নামাজের পর। রাফি ভাই থেকে ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন দুপুর একটা বাজে। স্থানীয় বাজারে নেমে জিগেস করতেই ওর বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিল। ওর বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ভীড়, কান্নার শব্দে বাতাস এত ভারী মনে হচ্ছিল যেন নিশ্বাস নিতেও প্রচুর পরিশ্রম হচ্ছে৷ এত আত্মীয়ের মাঝে আমাকে আলাদা করে কেউ খেয়াল করেনি, যারা দেখেছে তারা ভেবে নিয়েছে নাঈমের কোন বন্ধু হয়তো। লাশের ঘরটায় যখন ঢুকলাম, সাদা কাপড়ে ঢাকা শরীরটার পাশে যখন বসলাম তখনও কেউ বাধা দেয়নি। কয়েকজন মুরুব্বি গোছের লোক একটু দূরে বসে কুরআন পাঠ করছিল, আতরের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। ওকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল না একটুও৷ আট বছর পরেও আমার নাঈম আমার কাছে একইরকম রয়ে গেছে। ওর কপালের বামপাশে ভ্রুর উপরের ছোট্ট তিলটা আগের মতই আছে। আমার না, ওর বাদামী চোখ খুব পছন্দ ছিল। ওকে কখনো বলা হয়নি যদিও। এসব আদিক্ষেতা আমাদের মানাতো না। ও যখন আমার পাশে ঘুমাতো, আমি আলতো করে ওর কপালে চুমু দিয়ে দিতাম, এই তিলটার ঠিক ওপরে। নীলচে প্রাণহীন এই কপালে হয়তো আজো আমার সেই চুমুর চিহ্ন রয়ে গেছে। ওর চেহারাটা শুধু দেখা যাচ্ছিল। হাত ছিল কাফনের ভেতরে। কাফনের ওপর থেকেই ওর হাতটা ধরলাম। ঠান্ডা শক্ত এই হাত আমাকে মনে করিয়ে দিল ওর খসখসে চামড়ার সেই উষ্ণ হাতের কথা, যে হাত অজস্রবার আমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরেছিল ওর শরীরের সাথে, যে হাতের ছোঁয়া কল্পনা করে করেই হাজারো রাত আমি বিছানায় জেগে কাটিয়ে দিয়েছি। পাশের একজন মুরুব্বি আমাকে ডেকে হাত দিতে নিষেধ করলো। ওযু ছাড়া আমার নাঈমকে স্পর্শ করলে নাকি ওর আত্মার ক্ষতি হতে পারে।
হাতটা সরিয়ে নিলাম। আমার চোখ শুষ্ক। অন্য সবার মত আমি কাঁদছিনা। কেন কাঁদছিনা তা জানিনা।
নাঈমের আত্মা কি আছে এখানে? আশেপাশে কোথাও? সে কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে? আমি যখন ওর হাতটা ধরছিলাম, তার কি একটু কষ্ট হচ্ছিল আমার কথা ভেবে?
খুব ইচ্ছে করছে ওর প্রাণহীন ঠোঁটে শেষবারের মত একবার চুমু দিতে। কি হবে যদি একবার, শুধু একটাবার চুমু দেই? আমার নিষিদ্ধ ঠোঁটের স্পর্শ কি ওর মৃতদেহকে অপবিত্র করে দেবে? দশ বছরের পুরনো পৃথিবীর বিশুদ্ধতম প্রেম বুকে লালন করেও আমি নিষিদ্ধই থেকে গেলাম নাঈমের কাছে। ওর কাছে আমৃত্যু আমার এই তীব্র ভালবাসা কেন শুধু ‘হারাম’ হয়েই থেকে গেলো?