গ্রাইন্ডার : যা কিছু খারাপ

লেখক :- অন্যস্বর

বর্তমানে ৬০ শতাংশের বেশি সমকামী পুরুষ তাদের সঙ্গী খোঁজার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আর সমকামীদের মধ্যে ইন্টারনেটে সঙ্গী খোঁজার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো গ্রাইন্ডার।

গ্রাইন্ডার একটি জিওসোশ্যাল মোবাইল এপ্লিকেশন যার কাজ হলো সমকামী ইউজারদের লোকেশন ট্রেস করে তাদের নিকটতম দূরত্বে সঙ্গী খুঁজে দিতে সাহায্য করা। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৪০ লক্ষ সমকামী এই এপটি ব্যবহার করে।

আমেরিকায় তৈরি হলেও এই এপটির মালিকানা ২০১৬ সালে একটি চাইনিজ গেমিং কোম্পানি কিনে নেয়। বর্তমানে এই চাইনিজ এপটি আমেরিকার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ক্রমবর্ধমান দুঃশ্চিন্তার কারণ। সেই আলোচনায় যথাসময়ে আসা যাবে।

ততক্ষণে একটু পরিসংখ্যান ঘাঁটা যাক।AIDS and behavior জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার দাবি নতুন এইচআইভি সংক্রমণের প্রায় ৬৫ ভাগ ঘটছে শুধুমাত্র সমকামী পুরুষদের মধ্যে। যদিও এই হার আমেরিকায় মাত্র ২ থেকে ৫ ভাগ।

বাংলাদেশে সমকামীদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণের হার কিরকম?

জাতিসংঘের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবমিলিয়ে ১৪০০০, নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৬০০ এবং এই এক বছরে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৫৮০ জন।
ঢাকা শহরে সমকামী পুরুষদের মধ্যে ০.৩ ভাগ এইডসে আক্রান্ত, ঢাকার বাইরে সামগ্রিকভাবে এই অনুপাত আরেকটু কম- ০.২ শতাংশ। এটা ২০১৫-১৬ সালের হিসাব। ২০১৩-১৪ সালে সারা দেশে এই অনুপাত ছিল ০.৭ শতাংশ।

একই রিপোর্ট অনুযায়ী ৪৬ শতাংশ গে তাদের সর্বশেষ এনাল সেক্স এ কনডম ব্যবহার করেছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে এই সংখ্যাটা অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশে মাত্র ২৬ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক সমকামীর এইচআইভি নিয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে। এই প্রসঙ্গে একজনের কথা মনে পড়ছে, যার কিনা এনাল সেক্স করার সময় কনডম ব্যবহার করা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। তার কারণ সে বটম এবং তার মতে “এইডস শরীরে প্রবেশ করে শুধুমাত্র পুরুষাঙ্গের মাধ্যমে”।

তবে সমকামীদের শারিরীক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির থেকেও গ্রেটার বিপদ সম্ভবত সমকামীদের মানসিক চ্যালেঞ্জগুলো। বাংলাদেশে সমকামীদের যেরকম প্রতিকূল হোমোফোবিক সমাজে বসবাস করতে হয় তাতে মানসিক ঝুঁকির মাত্রা অতিরিক্ত হওয়ার কথা।

২০০৬ সালের পর থেকে সমকামীদের মধ্যে এইডস এর চেয়ে আত্মহত্যায় মৃত্যু হার বেশি।

অথচ সমকামীদের যৌনবাহিত রোগ নিয়ে যত গবেষণা, প্রচারণা হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ততটা হয় না। এইডস প্রতিরোধে গ্রাইন্ডারের কিছু প্রচারণামূলক উদ্যোগ থাকলেও সমকামীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোন হেলদোল নেই। সমকামীদের মানসিক স্থিতির উপরে গ্রাইন্ডারের প্রভাব নিয়েও কোন গবেষণামূলক কাজ হয় না। অথচ আমরা দেখবো গ্রাইন্ডার অনেক সমকামী ইউজারদের মানসিক অস্থিরতার কারণ।

Time well spend নামে একটা অলাভজনক সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ৭৭ শতাংশ গ্রাইন্ডার ব্যবহারকারী এপটি ব্যবহার করার পর অনুতাপ বোধ করে। সব ধরনের মোবাইল এপ্লিকেশনের তুলনায় এই হার সর্বোচ্চ। প্রতিষ্ঠানটি এই গবেষণা চালিয়েছে ২ লক্ষ আইফোন ব্যবহারকারীর উপরে।

Time well spend

গ্রাইন্ডার অত্যন্ত এডিক্টিভ একটি এপ, তার কারণ সহজে অনুমান করা যায়। গ্রাইন্ডারের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ হলো এটি দ্রুততম সময়ে, অল্প আয়াসে ইউজারদের সেক্সের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। এই জন্য গ্রাইন্ডার একবার ব্যবহার করা শুরু করলে তার থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। এপটির স্ক্রিনভর্তি অর্ধনগ্ন ছবি ব্যবহারকারীদের উত্তেজিত করে। এই উত্তেজনা দ্রুত বেপরোয়া যৌন চাহিদায় পরিনত হয়। অবশ্য এমনটা সবার বেলাতে ঘটে তা বলা যায় না। তবু বেশিরভাগ ব্যবহারকারীর জন্য এটা মোটামুটি কমন একটা প্যাটার্ন।
নিউরোসাইন্টিস্টরা দেখিয়েছেন, অর্গাজম ফলে যখন ব্রেইনের প্লেজার এরিয়াগুলো একটিভ হয় তখন ব্রেইনের সেল্ফ কন্ট্রোল এরিয়াগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিএক্টিভ হয়ে যায়। এই রকম একটিভ এবং ডিএকটিভ হওয়ার আইডেন্টিক্যাল রুটিন দেখা গেছে যারা হিরোইন এবং কোকেইন নেয় তাদের ব্রেইনে।
তাই গ্রাইন্ডারে ক্লিক করলে সেটা প্লেজারের গ্যারান্টি দেয় বলে মানুষ অই কাজটা বারবার করে। ফলে আসক্তি দাঁড়িয়ে যায় এবং সেল্ফ কন্ট্রোল কমে যায়।

Variable ratio reinforcement নামে সাইকোলজিতে একটা টার্ম আছে, যেটা গ্রাইন্ডার তাদের এপের বেলায় কাজে লাগায় বলে মনে হয়। এই কনসেপ্ট অনুযায়ী ক্লিক করার রিওয়ার্ড(এক্ষেত্রে সেক্স) আসে অনিয়মিত বিরতিতে (আনপ্রেডিক্টেবল ইন্টারভ্যাল)। অর্থাৎ আপনি গ্রাইন্ডারে বসা মাত্রই সেক্স পার্টনার পেতে পারেন অথবা সারাদিনেও না পেতে পারেন।

জুয়াখেলায় ভ্যারিয়েবল রেশিও রেইনফোর্সমেন্ট এর ক্ল্যাসিক উদাহরণ।একজন জুয়াড়ি যেহেতু জানে না ঠিক কখন সে বাজি জিতবে তাই বাজি লাগবার ইচ্ছেটা সে কনট্রোল করতে পারে না। সর্বদা মনে হবে পরের দানেই সে বাজি জিতবে কিন্তু দেখা গেল সে সারাদিন দান হারছে। বারবার হারলে জেতার জন্য সে অধীর হয়ে যায় আবার একবার জিতলে আরেকবার জেতার লোভ সে সামলাতে পারে না।
জুয়াখেলায় জিতলে টাকার বদলে সেক্স পার্টনার পাবেন এরকম ভাবলে গ্রাইন্ডারের আসক্তির ব্যাপারটা বুঝা সহজ হয়। যৌনতা খুব দ্রুত আসক্তিতে পরিনত হয়, যেটা সমকামীদের গ্রাইন্ডার আসক্তিকে ব্যাখ্যা করে।

গ্রাইন্ডার অবশ্যই অনেক সময় ব্যবহারকারীদের হতাশা এবং একাকীত্ব কমায়,কিন্তু তার প্রভাব ক্ষণস্থায়ী।

বাংলাদেশের মত হোমোফোবিক সমাজে সমকামীদের চাহিদাগুলো কঠোরভাবে অস্বীকার করা হয়। এইসব অবদমনের বিপরীতে গ্রাইন্ডারের সমকামী বান্ধব পরিবেশ ব্যবহারকারীদের স্বস্তির খোঁজ দেয়। তাছাড়া সম্ভাব্য সেক্স পার্টনারদের এটেনশন এবং একটা ভালো হুকআপের সম্ভাবনা ব্যবহারকারীদের উত্তেজিত রাখে। ফলে ব্যক্তিগত হতাশাবোধ এবং একাকীত্ব অনেকটা দূর হয়। কিন্তু এপটির ব্যবহারকারীদের আন্তরিকতাশুন্য অগভীর কথাবার্তা, পুরুষাঙ্গ ইত্যাদির শ্রীহীন ছবির অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তিযোগ, সৌজন্যবিযুক্ত রিজেকশন এবং আরো সব কারণে অনেকে গ্লানি ও হতাশাবোধে ভোগে।

নিরাপত্তার ঝুঁকি

গ্রাইন্ডার অন্যান্য অনলাইন নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্মগুলোর মতো তার ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে।এই তথ্যগুলোর মধ্যে আছে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত মেসেজ, ছবি, ভিডিও এবং তাদের নির্ভুল লোকেশন। এইসব তথ্যগুলো সাথে যোগসুত্র থাকে একটি ইমেইল ঠিকানার। এই মেইল ঠিকানা থেকে যে কোন ব্যবহারকারীকে সনাক্ত করা সম্ভব। কিছুদিন আগে পত্রিকায় নিউজ বেরিয়েছিল যে গ্রাইন্ডার থার্ড পার্টির কাছে তাদের ইউজারদের এইচআইভি স্ট্যাটাস বিক্রি করেছে।
আর্মি অফিসার এবং ইন্টেলিজেন্সের অনেক কর্মী গ্রাইন্ডার ব্যবহার করে। আমেরিকার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দাবি চীন আর্মি অফিসারদের গ্রাইন্ডার লোকেশন বিশ্লেষণ করে আমেরিকার সেনাবাহিনীর অবস্থানগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানবার চেষ্ঠা করছে।

গ্রাইন্ডারে সমকামীরা প্রেম খুঁজতে আসে এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। লেখক Jack Turban তার একটি লেখায় গ্রাইন্ডারের কালচারকে হাইপারসেক্সুয়ালাইজড হিসেব বর্ণনা করেছেন। গ্রাইন্ডারে সাধারণত সেক্স বাদে অন্য আলাপ হালে পানি পায় না। তবে আমি দুএকজনকে চিনি যাদের গ্রায়ান্ডারের মাধ্যমে তাদের প্রেমিকের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল।

একবার একটা কাপলের সাথে আমার পরিচয় হয়, তাদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল গ্রাইন্ডারের মাধ্যমে। যখন গ্রাইন্ডারে তাদের সাথে আমার কথা হয়, ততদিনে তাদের প্রেমের সম্পর্ক এক বছর অতিক্রম করছে এবং তারা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গ্রাইন্ডারে তৃতীয় আরেকজন বিকল্পের খোঁজ করছিল। তাদের বয়স অল্প, দুজনের কেউই ২২ বছরের উপরে নয়। এত অল্প বয়সে ওপেন রিলেশনশীপে যাওয়ার মত চিন্তার পরিপক্কতায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।

গ্রাইন্ডার অন্যভাবেও সমকামীদের প্রেমের সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করছে যেগুলো বেশ দুঃশ্চিন্তা উদ্রেককারী। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে বাংলাদেশে এমনিতেই সমকামীদের প্রেমের সম্পর্ক টিকবার হার সন্তোষজনক নয়। এই পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে গ্রাইন্ডারের অজস্র অপরিচিত মানুষের সাথে তাৎক্ষণিক হুকআপের হাতছানি। সম্পর্কে ঝামেলা হলে, অনেক সমকামী সম্পর্ক ঠিক করতে মনযোগী না হয়ে ঝটপট গ্রাইন্ডারে একাউন্ট খুলে নতুন সঙ্গী খুঁজতে তৎপর হয়।

একসময় আমি নিজে নিয়মিত গ্রাইন্ডার ব্যবহার করতাম। তখন অনেক ‘গে কাপল’, যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলাম, তাদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার খবর গ্রাইন্ডারের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যেতো।

ডিপ্রেশন বা একাকীত্বে ভুগলে, রিলেশনে ঝামেলা হলে গ্রাইন্ডারে কমফোর্ট খোঁজা দীর্ঘমেয়াদে কোন স্বাস্থ্যকর সমাধান নয়। গ্রাইন্ডার সমকামীদের যৌনচাহিদা মেটাতে দারুণ ভূমিকা রাখছে তাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু একই সাথে এপটি তার ইউজারদের যে মানসিক ক্ষতের সৃষ্টি করছে তা হেলায় এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। কেননা মানুষ হিসেবে যাপিত জীবনে শারিরীক উত্তেজনার পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।


References:
https://www.theverge.com/interface/2019/3/28/18285274/grindr-national-security-cfius-china-kunlun-military
https://www.vox.com/science-and-health/2018/4/4/17177058/grindr-gay-men-mental-health-psychiatrist
https://www.aidsdatahub.org/Country-Profiles/Bangladesh?fbclid=IwAR0nehdxcD9Vg3xjkpV_Aw9_BEmwfsLIwXqrMC31sifHae1SDzgyQLBUTu4
https://humanetech.com/resources/app-ratings/

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.