পরিবার

লেখকঃ অরণ্য রাত্রি


রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই রোদে চোখ বন্ধ হয়ে এলো।রোদ ঢাকতে আমি সানগ্লাস পরলাম। বহুদিন পর দেশে এসেছি। সেই যে ৩ বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম আর আসা হয় নাই। কেউ আসে নাই আমাকে নিতে? মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। আরে না এসেছে। এখলাস ভাই কে চোখে পড়লো। এখলাস ভাই আমাদের বাড়ির ড্রাইভার। সেই ছোট বেলা থেকে তিনি আছেন। যখন আমাদের নীল রঙের ছোট গাড়ি টা ছিল তখন তাকে প্রথম আমার দাদাভাই নিয়োগ করেন। সেই থেকেই তিনি এখানে। এখন তিনি আমাদের পরিবারের একজন সদস্যই বলা যায়।
এখলাস ভাই কে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলাম।
কেমন আছ এখলাস ভাই?
ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ?
খুব ভাল। দেশে আসলাম। সবাই ভাল আছে তো ?
এই প্রশ্ন শুনে এখলাসভাই চুপ হয়ে গেলো ।
নীল দাদাজান ইন্তেকাল করার পর থেকে কিছুই আর ঠিক নেই। সব ওলট পালট হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই চাকুরী ছেড়ে। কিন্তু তোমাদের পরিবারটার উপর এমন মায়া জন্মাইছে পারি না যেতে।
আমি কিছু কিছু শুনেছি। কিন্তু কেউ আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলে নাই। ভাবলাম এখলাস ভাইয়ের কাছ থেকেই সব শুনতে হবে।
গাড়ি তে উঠলাম। এয়ারপোর্ট রোড ধরে চলছে গাড়ি। ঢাকা শহরের অনেক পরিবর্তন দেখছি। বড় বড় ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে। এই তো আমার দেশ।
আচ্ছা এখলাসভাই দাদাভাই মারা যাওয়ার পর কি হয়েছে যে আমাদের পরিবারটা এমন ভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি আম্মু কে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি ফোনে কিন্তু আম্মু কিছুই বলতে চায় না। শুধু কাঁদে। আর আব্বু কে জিজ্ঞেস করার তো সাহস নাই। আকাশ কিছু কিছু বলেছে। তাও তোমার মুখে শুনি।
এখলাস ভাই কেমন জানি আমতা আমতা করছে
আমরা গরীব মানুষ। আর তোমরা রাজা বাদশা। তোমাদের অন্দরমহলের গল্প করা কি আমার উচিত।
উফ এখলাস ভাই ন্যাকামি বন্ধ করে বল সব। আমার জানা দরকার।
এখলাস ভাই আমাকে সব বলল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।আমি চলে গেলাম সেই ছোট বেলায়।

আমি বড় হয়েছি যৌথ পরিবারে। আমার দাদা আশরাফ আলি ছিলেন বিশাল ব্যবসায়ী। ঢাকার মহাম্মাদপুরের ইকবাল রোডে প্লট কিনে বিশাল বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। তার সারা জীবনের শখ তার দুই ছেলে আখতার আর আকরাম একই সাথে থাকবে। সব কিছু ঠিক ঠাক মতই চলছিল। আখতার আর আকরাম কে বিয়ে দিলেন।দুই বউ এলি আর মুক্তা। ২ জনেরই ছেলে হল। আশরাফ সাহেব নাতির মুখ দেখলেন। তার খুশির সীমা নেই। তিনি যা চেয়েছিলেন আজীবন তাই হয়েছে। তিনি বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী , দুই পুত্র , পুত্রবধূ , নাতি দের নিয়ে সুখে আছেন।
দুই নাতি বড় হচ্ছে। তাদের মাঝে একজন আমি নীল । আরেকজন আমার ছোট আকাশ। আমার আব্বু বড়। আখতার। আর আমার চাচুর নাম মানে আকাশের আব্বু হল আকরাম। আমার আম্মুর নাম মুক্তা আর আকাশের আম্মু এলি। এই হল আমাদের পরিবার।
আকাশ আমার থেকে ৪ বছরের ছোট । আমি যখন অষ্টম শ্রেণী তে পড়ি তখন আকাশ চতুর্থ শ্রেণী তে। সেই সময় থেকেই আমরা এক ঘরে থাকি। একই বিছানায় ঘুমাই।সময়ের সাথে সাথে আমরা ২ জনই অনুভব করলাম আমরা সমকামী আর একে অপরকে ভালবাসি। ছোটবেলা থেকেই আমরা ২ জন যা করি একসাথে করি। কেউ কারো কাছে কোন কিছু গোপন করি না। আমাদের মাঝে বোঝাপড়া চমৎকার। মান অভিমান হয় না তা ঠিক না। কিন্তু তা মিটে যায় সহজেই।
সমস্যা হল যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে স্কলারশিপ পেয়ে বাইরে চলে গেলাম। আমার সবসময় স্বপ্ন দেশের বাইরে আকাশকে নিয়ে থাকবো। দেশে থাকলে বিয়ের চাপ দেয়া হবে। আকাশও আমার সাথে এক মত। সেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে এবং সময় মত বিদেশে পালাবে।
আমার দাদু বরাবর সুস্থ। এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রতিদিন সকালে নিয়ম মত ৪০ মিনিট হাঁটেন।তার স্বাস্থ্য নিয়ে কারো কক্ষনো চিন্তা করতে হয় নাই। বরং আমার দাদিয়া নানান অসুখে জর্জরিত। অথচ বলা নেই কওয়া নেই আমার দাদাভাই হার্ট এটাক করলেন। ২ দিন আইসিইউ তে জমে মানুষে টানাটানি হল। শেষ পর্যন্ত দাদাভাই হার স্বীকার করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রেখে গেলেন তার সোনার সংসার। নিজের গড়া বাসা আর অসংখ্য সম্পত্তি।
বাড়িতে মানুষের মিলনমেলা বসলো। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসলো দাদাভাই কে এক পলক দেখার জন্য। দাদিয়া বৃদ্ধ বয়সে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবেন নাই তার আগেই দাদাভাই চলে যাবেন। দীর্ঘ ৪৯ বছরের বিবাহিত জীবনে কক্ষনোই তো দাদাভাই কে ছাড়া থাকেন নাই। অনেক শোক প্রকাশ করা হল। মিলাদ পড়ানো হল। ১ সপ্তাহের মাঝে শোক সভা ভেঙ্গে গেলো। আমার আব্বু এবং চাচু যথেষ্ট স্বার্থপর। নিজেদের বাবার মৃত্যু তাদের মনে খুব একটা দাগ কাটলো না। আমাকে খবর পর্যন্ত দেয়া হল না। কারন খবর পেলে আমি যদি পড়াশোনা রেখে দেশে চলে আসি। কারন আমি তো দাদাভাই কে অনেক ভালবাসি। আমার আব্বু আর চাচুর কথা আসি। তারা ২ জন বসে পরলেন বাড়ি ভাগাভাগি তে।
অনেক আলোচনা হল বাড়ি ভাগাভাগি নিয়ে। কিন্তু কেউ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না ।প্রচণ্ড রকম ঝগড়া হল ২ ভাই এর মাঝে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেলো। চাচু চলে এলেন পাকাপাকি ভাবে দোতালায় আর আব্বু এক তলায়। দাদিয়া অনেক চেষ্টা করলেন ঝগড়া মিটানোর। কিন্তু কে শুনে কার কথা। দুইজনেই নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল। দাদিয়া খুব কষ্ট পেলেন ছেলেদের এই অবস্থায় দেখে। জীবনে যা কক্ষনোই ভাবেন নাই তাই দেখতে হচ্ছে। চলে যাবেন তিনি গ্রামে। আর আসবেন না। যা ভাবা তাই। দাদিয়া পরের দিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন রসুলপুরে আমাদের ভিটায়। সাথে গেলেন আমাদের কেয়ারটেকার রহমত ভাই আর কাজের মেয়ে বেলি। আমার দাদিয়া স্বাবলম্বী । কারন এই বাড়িটা ছাড়া আর সমস্ত সম্পত্তি দাদিয়ার নামে।

সব শুনলাম এখলাস ভাইয়ের কাছে। ভয় লাগছে বাড়ি যেয়ে কি দেখবো। আমি কি তাহলে আকাশের সাথে সামনাসামনি কথা বলতে পারবো না। অবশ্য আকাশের সাথে প্রতিদিন ই আমার কথা হয়। স্কাইপি তে, ভাইবারে। সে ধারণা দিয়েছে বাসাতে সামনাসামনি আসলেই কথা বলা যাবে না। বাসার গেটে এসে গাড়ি থামলো। পুরো বাড়ি রঙ চটে গিয়েছে। রঙ করা হয় না বহুদিন। গেটে বাদল। আমাদের দারোয়ান। বহুদিন পর দেখলাম। কোলাকুলি করলাম তার সাথে। আব্বু আর আম্মু বের হয়ে আসলো ঘর থেকে। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তারা। আমাকে এসে আম্মু জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।
আরে আম্মু থামো তো । কি শুরু করলা? আমি কি মারা গিয়েছিলাম নাকি
আম্মু ধমক দিলো
ছিঃ। এসব কি বলিস। মরার নাম মুখেও আনবি না।
আমি আম্মুর চোখ মুছে দিলাম।
আব্বু খুব খুশি। আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আব্বু অনেক গম্ভীর রাশ ভারী প্রকৃতির মানুষ। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরবে ভাবতেই পারি নাই। খুব আশা করেছিলাম আকাশ থাকবে কিন্তু নেই। একপলকের জন্য উপরে তাকালাম । দেখলাম আকাশ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। মনটা একটু শান্ত হল।
নিজের ঘরে ঢুকে দেখি সব বদলে গিয়েছে। আগে একটা ডাবল খাট ছিল। এখন সিঙ্গেল খাট। বিশাল আলমারি ছিল যেখানে আমি আর আকাশ এক সাথে কাপড় রাখতাম। এখন ছোট একটা ওয়ারড্রব। মন খারাপ হয়ে গেলো। আম্মু ঘরে ঢুকলো। আমার মুখ দেখেই বুঝলো আমি কি বলতে চাইছি। আম্মুর মন টাও খারাপ হয়ে গেলো।
আকাশের সাথে দেখা হয় নাই বলে তোর খারাপ লাগছে? কিন্তু কি করবো বল? তোর আব্বু আর তোর চাচুর মাঝে এতো বড় ঝগড়া হয়েছে যে কেউ এখন কারো মুখ দেখে না। আমাদেরও একে অপরের মুখ দেখা নিষেধ। তোর দাদিয়া তো রাগ করে চলেই গেলেন। আকাশ এই ঘরে থাকতো তাকে পর্যন্ত দোতালায় শিফট করা হল। কতদিন এলির সাথে ঠিক মত কথা হয় না।
এসব বলে আম্মু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ।
চল তোর জন্য রান্না করেছি অনেক কিছু। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
টেবিল ভর্তি খাবার। আমার সব প্রিয় আইটেম গুলো রান্না করা হয়েছে। এর মাঝে ২ টা আইটেম আকাশেরও খুব প্রিয়। আব্বু এখন নামাজ পড়ছে। আমি আম্মু কে ফিস ফিস করে বললাম
আম্মু চিংড়ির মালাইকারি আর ইলিশ ভাজা তো আকাশেরও খুব প্রিয়। ওর বাসায় পাঠিয়েছ?
আম্মু বলল
ও নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আমি গোপনে পাঠাবো
এই কথা শোনার পর আমি শান্তি পেলাম। আকাশ খেতে না পারলে আমি ওই চিংড়ি গলা দিয়ে নামাতে পারতাম না।
সন্ধ্যায় আব্বু কে দেখলাম কোট গায়ে দিয়ে বের হচ্ছে। আম্মু কে জিজ্ঞেস করলাম আব্বু কই গেলো
একটা বন্ধুর ছেলের বিয়ের দাওয়াতে গেলো
তুমি গেলা না কেন?
সে বুঝতে পারবি একটু পরে
আম্মুর এই কথার কোন মাথামুণ্ডু খুঁজে পেলাম না। দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি। মন মরা। বাংলাদেশে আসলাম অথচ আকাশ কে কাছে পাচ্ছি না। একটু পরে আম্মু দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। জেট ল্যাগ কাটে নাই। শুইলাম একটু। এখন আবার দরজা ধাক্কানি।
দরজা খুললাম দেখি আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ভর্তি হাসি। পিছনে এলি চাচি। চাচি আমাকে জড়িয়ে ধরে মুখে সন্দেশ গুঁজে দিলেন। চাচির হাতের সন্দেশ আমার খুব প্রিয়।
বাবা কতদিন পর দেখলাম
আমি পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।
বেঁচে থাকো বাবা। দেখো তোমার চাচু বের হল এই সুযোগে দেখতে এলাম। স্বাধীন ভাবে দেখতে পাবো সেই সুযোগ পর্যন্ত নেই। আকাশ তো তোমার নাম বলতে পাগল। যাই হোক তোমরা যা গল্প করার করে নাও। তোমার চাচু আবার এক ঘণ্টার মাঝে চলে আসবে। যদি জানে আমরা আসছি মহা কেলেঙ্কারি হবে।
এক ঘণ্টায় কি সাধ মিটে। হাত ধরেই বসে রইলাম এক ঘণ্টা। আলতু ফালতু গল্প হল। আমার মাথা তখন প্ল্যান ঘুরছে। আমি বললাম
আকাশ শোন কালকে আমরা বাইরে দেখা করবো
আকাশ কিছুক্ষণ চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থেকে বলল
আসল প্রেমিক দের মত?
কেন আমরা নকল প্রেমিক নাকি?
না কক্ষনো এইভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করি নাই তো। তাই। কেমন থ্রিল লাগছে।
ঠিক হল আমরা বসুন্ধরা সিটিতে দেখা করবো কালকে।যাওয়ার আগে আকাশ ঠোঁটে একটা কিস দিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্ট এ ২ জন বসে আছি বিমর্ষ হয়ে। এইভাবে প্রতিদিন বাইরে যেয়ে দেখা করা সম্ভব না। কিছু একটা করতে হবে। মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য এসেছি। আর এই তিন সপ্তাহে আকাশ কে কাছে পাবো না তা কি করে হয়? হটাত মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো।
– চল রসুলপুরে দাদিয়ার ওখানে চলে যাই। তোর তো ভার্সিটি বন্ধ।তোর ও পড়ার ক্ষতি হবে না। আর ওখানে আমাদের কে কেউ কথা বলাতে বাধা দিবে না।দাদিয়া কেও দেখে আসা হবে।
আকাশ লাফ দিয়ে উঠলো
– নীল ভাইয়া তুমি গ্রেট । আজকে রাতেই ভাগবো।
এরপর বাকি টা সময় কি কি সাথে নিবো , কিভাবে পালাবো সেই আলোচনায় কাটলো। ঠিক হল আজকে রাতেই বাড়ি থেকে পালাবো। এরপর ২ জন আলাদা আলাদা ২ টা রিকশা নিয়ে বাড়ি গেলাম যাতে কেউ না বুঝে আমরা দেখা করেছি।
সন্ধ্যা হলেই বের হব। একটা ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। আমি সরাসরি কমলাপুর স্টেশনে চলে যাবো । সেখানেই মিলিত হব আমি আর আকাশ। সময় যেন আর কাটে না। কখন ৭ টা বাজবে আর বাসা থেকে বের হব। আমি জানি আকাশেরও একই অবস্থা। নিজেকে শান্ত রাখার জন্য গান ছাড়লাম । কিন্তু উত্তেজনা কিছুতেই প্রশমিত হচ্ছে না। সূর্যি মামারও অস্ত যাবারা কোন লক্ষণ দেখছি না। বহাল তবিয়তে আকাশে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হল। ঘড়ির কাটায় ৭ টা বাজলো। আমি পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে দেয়াল টপকিয়ে একদম রাস্তায়।
কমলাপুর রেলস্টেশন। আমি ট্রেনের বগি খুঁজে নিজের সিটে বসে আছি। খুব বিরক্ত লাগছে। এখনো আকাশের আসতে আরও ১০ মিনিট লাগবে। অবশ্য ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরি আছে। অবশ্য সব ধরণের অপেক্ষাই বিরক্তিকর। সময় যেন আর কাটেই না। আমি ঝাল মুড়ি খেলাম। কোল্ড ড্রিঙ্কস খেলাম। কিন্তু তার দেখা নাই। অবশেষে বাবু আসলেন টানা ২০ মিনিট পর। ট্রেন ছাড়তে আর ৫ মিনিট বাকি। এসেই কান ধরলও আকাশ
– সরি দেরি হয়ে গেলো
– কেন হল সেটা আগে বল ।
– আম্মু জেনে গিয়েছে।
– সেকি কিভাবে?
– বের হওয়ার সময় দেখে ফেলেছে।
– সর্বনাশ।
– আরে আগে হোক পরে হোক জানতোই তো । মাঝখান থেকে আম্মু সুন্দর করে তোমার আর আমার জন্য ডিনার প্যাক করে দিলো
– আর কিছু বলে নাই চাচি?
– বলল সুযোগ থাকলে সেও পালাতো। বাড়ি নাকি অসহ্য লাগে তার কাছে।
– তাহলে চাচি আমাদের পক্ষে।
– হম
– আম্মুও আমাদের পক্ষে থাকবে।ওরা আব্বু আর চাচু কে ম্যানেজ করে নিবে ঠিক
ট্রেন চলতে শুরু করলো । আমার নিজেকে একটা রোম্যান্টিক সমপ্রেমী গল্পের নায়ক মনে হচ্ছে।রাতে ট্রেন জার্নির মজাই আলাদা। তার উপর যদি প্রিয় মানুষ টা সাথেই থাকে তাহলে তো কথাই নাই।পুরো বগি খালি। আমরা ২ জন মাত্র। রসুলপুর যেতে ৪ ঘণ্টা লাগবে। ততক্ষণে যদি আর কেউ না উঠে ট্রেনে তাহলে খুব ভাল হবে। আমি আমার হেঁড়ে গলায় গান ধরলাম।
– কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা
আমার গান শুনে আকাশ হেসে দিল। আমি গান থামিয়ে বললাম।
– আর গাইবো না।
– আরে রাগ কর কেন? গাও গাও। কতদিন পর তোমার গান শুনছি
– এক শর্তে
– কি?
– আমি গাওয়ার পর তুই গাবি
– অকে
আকাশ খুব ভাল গান গায়। কিন্তু একশ বার বললেও গাইবে না। আসলে সেও খুব এঞ্জয় করছে আজকের জার্নি। তাই একবারেই রাজি হয়ে গেলো।
ঝিক ঝিক শব্দ করে ট্রেন চলছে। আমরা মাঝখানে ডিনার করে নিয়েছি চাচির দেয়া খাবার দিয়ে। মাঝখানে কত স্টেশনে থেমেছে গাড়ি । কত অজানা জায়গা। আমাদের ২ জনের ইচ্ছে করছিল অজানা কোন একটা স্টেশনে নেমে যাই।
রসুলপুর যখন পৌঁছে গেলাম তখন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মফঃস্বলের স্টেশন। মধ্যরাত। নামলাম আমরা দুইজন। এই স্টেশনে আর একটা মানুষও নামলো না। ভয় পেলাম না। কারন স্টেশনের পাশেই দাদা বাড়ি। হেঁটেই যাওয়া যায়। কত্ত এসেছি। বৃষ্টি থামার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম স্টেশনে। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমলো। টিপ টিপ করে পরছে। ওর মাঝেই যাওয়া যাবে। রাত রাস্তায় কেউ নাই। আমি আর আকাশ রেললাইনের পাশের রাস্তা দিয়ে হাত ধরে হাঁটছি। নির্জন নীরব চারিদিক। খালি ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যায়। আমি আকাশের হাত শক্ত করে ধরেছি। ওর হাতের স্পর্শ আমি গভীর ভাবে অনুভব করছি। সেও কি করছে ? জানি না।বৃষ্টি এই রোমান্সে বাঁধ সাধলো । আমি দৌড়ে পাশে একটা ভাঙ্গা বাড়িতে গিয়ে দাঁড়ালাম । আকাশ বৃষ্টি তে ভিজেছে। আমাকেও ডাকছে ভেজার জন্য। আমার অল্প তে ঠাণ্ডা লেগে যায়। কিন্তু এই মুহূর্ত তো আর পাবো না। যা হবে হবে। আমিও দৌড়ে যেয়ে আকাশের হাত ধরলাম। ২ জন মিলে বৃষ্টি তে ভিজছি। একটু পরেই আমি কাশতে লাগলাম। সাথে হাঁচি।
– হইসে তোমার আর ভিজতে হবে না।
আমাকে নিয়ে আকাশ ভাঙ্গা বাড়ি টার নিচে দাঁড়ালো। আমি প্রায় কাঁপছি। তার সাথে হাঁচি , কাশি ।আকাশ ব্যাগ খুলে একটা শার্ট বের করলো ।
– ভেজা কাপড় ছেড়ে এটা পরে নাও।
আমি কাপড় বদলে নিলাম। আকাশ রুমাল বের করে সেটা দিয়ে আমার মাথা মুছার চেষ্টা করছে। ওর এই অভিভাবকের মত আচরণ আমার খুব ভাল লাগছে। আসলে এটাই তো ভালবাসা । অধিকার-বোধ।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেল। কাপড় বদলানোর পর আমারও হাঁচি কাশি কমেছে। আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম। বাড়ির একদম কাছে গিয়ে দেখলাম মনা কাকুর চায়ের দোকান খোলা। খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে। বসলাম দোকানে যেয়ে। মনা কাকু নেই। তার ছেলে সোহেল বসে আছে। আমাদের দেখে চিনতে পারলো সে। হেসে দিলো ।
– ভাইয়ারা ভাল আছেন?চাচা চাচি আসেন নই। বসেন চা খান।
কড়া লিকারের দুই কাপ চা খেলাম। টাকা দিতে গেলাম । নিলো না।
– ভাইয়া রা এত দিন পর আসছেন আর আমি টেকা নিমু? বাপ জান জানলে মাইর দিবে।
গ্রামের মানুষের এই একটা ব্যাপার খুব ভাল লাগে। কত অল্পতেই আপন করে নেয় মানুষ কে। এই সোহেলের সাথে আমার কি সম্পর্ক? ২-৩ বছরে একবার গ্রামে আসলে রাস্তা ঘাটে দেখা হয়। তাতেও সে আপন করে নিয়েছে। আমরা শহরের মানুষ রা তা করি কখনো ? বরং বিরক্ত হই কেউ বেরাতে আসলে।
বাড়িতে ঢুকলাম। পাকা বাড়ি কিন্তু টিনের ছাদ। কতদিন পর এলাম। দাদিয়া নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে। দরজায় ধাক্কালাম। সাথে সাথে দরজা খুললো দাদিয়া। আমরা ভাবি নাই দাদিয়া এতো রাতে জেগে আছে। আমরা ২ জনই দাদিয়া বলে একটা চিৎকার দিয়ে দাদিয়া কে জড়িয়ে ধরলাম।
– আরে ছাড় ছাড়। আমার তো দম বন্ধ হয়ে গেলো
আমাদের চিৎকার শুনে বেলি আর রহমত ছুটে আসলো । তারা ঘুমিয়ে ছিল। আমাদের দেখে দাদিয়া খুশি তে কেঁদেই দিলো।
– কত দিন পর তোদের দেখলাম রে দাদু ভাই। তোদের কথা সব সময় মনে পড়ে । কিন্তু আমার ঢাকায় যাওয়ার উপায় নেই যতদিন না ওই ছাগল ২ টা ঝগড়া না মিটায়।
দাদিয়া যে অভিমান করে বসে আছে তা স্পষ্ট বুঝা যায় দাদিয়ার কথার টোনে। ভিতরে ঢুকলাম। দাদিয়া বসে বসে সুয়েটার বুনছে। প্রতি শীতে দাদিয়ার বানানো সুয়েটার আমরা পরি।
– তুমি রাত জেগে সুয়েটার বানাও? তোমার অসুখ করবে না?
– কি করবো ? ঘুম আসে না তো ? ২ টা অমানুষ পেটে ধরেছি না? ওই ২ টার কথা মনে পরে ।
– দাদিয়া এসব কথা বাদ দাও। ওদের এইসব দেখেই তো আমরা রাগ করে তোমার এখানে চলে আসলাম।
– ভাল করেছিস। কিন্তু এত রাতে তোদের কি খেতে দেই?
– আমরা ট্রেনে খেয়েছি দাদিয়া। আর চা খেয়েছি মনা কাকুর দোকানে
– এই বেলি মোয়া আর নাড়ুর বয়াম টা নিয়ে আয় তো
দাদিয়ার হাতের মোয়া আর নাড়ু সে তো অমৃত। আমি আর আকাশ ঝাঁপিয়ে পড়লাম। খেতে খেতে গল্প হচ্ছে দাদিয়ার সাথে। দাদিয়ার বিয়ের গল্প, ভুতের গল্প, আমার বিদেশের গল্প। কত কি!ফজরের আযান শুনে গল্পের আসর ভাঙলো। আমরা ঘুমাতে গেলাম।
ঘুম থেকে উঠলাম ১১ টায়। ঘুম ভাঙ্গার পর বুঝতে পারছিলাম না কই আছি। একটু পরে দেখলাম পাশে আকাশ। তখন মনে পড়লো আমরা রসুলপুরে। আকাশ কেও ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলাম। ঘর থেকে বের হয়ে দাদিয়া কে খুঁজছি। পেলাম রান্না ঘরে। বসে বসে তিনি পিঠা পায়েস বানাচ্ছেন।
– দাদিয়া তুমি ঘুমাও নাই রাতে? সারা রাত ধরে এসব বানিয়েছ নাকি?
– আরে নারে বোকা। কিছুক্ষণ আগে থেকে বানাতে বসছি।
একটু পর সবাই মিলে খেতে বসলাম। পিঠা পায়েস সেরকম মজা হয়েছে।আর পাটিসাপটা পিঠা তো আমার ফেভারিট।আর দাদিয়ার হাতের পিঠা যে একবার খেয়েছে সে কোনদিন ভুলবে না।
এদিকে একটা মজার ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। আমরা নেই সেটা জানতে চাচু আর আব্বুর বেশি সময় লাগে নাই। তারা তো পাগলের মত আমাদের খুঁজছে। সারা রাত বাসায় নেই। তার উপর মোবাইল বন্ধ। আমরা ২ জন ই মোবাইল অফ করে রেখেছি। চাচি আর আম্মু জানায় নাই কোথায় আছি। অবশেষে দাদিয়া কে ফোন করে আব্বু জেনেছে যে আমরা রসুলপুরে আছি।আমরা দাদিয়ার উপর একটু ক্ষেপে আছি। কি দরকার ছিল বলার? আরেকটু খুঁজতো । উচিৎ শিক্ষা হত। কিন্তু একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা হচ্ছে আমাদের কে কিরকম বকাবকি করা হয়? আর এখুনি কি আমাদের কে তারা ঢাকা নিয়ে যাবে কিনা?নিতে চাইলেও কোন ভাবেই যাবো না।
আমরা দুপুরে পুকুরে দাপাদাপি করছি ঠিক এই সময়ে বাবা , মা , চাচা , চাচি এসে উপস্থিত। চাচা আর বাবা একই গাড়িতে এসেছেন এটা ভাবতেই কেমন লাগছে। তারা তো কারো মুখই দেখতে চায় না।তাদের কেমন যেন ভাব হয়ে গিয়েছে এমন মনে হচ্ছে। আসলে বিপদে পরলে শত্রুও বন্ধু হয়ে যায়। দাদিয়া তো দুই ছেলে কে পেয়ে যেন স্বর্গ পেয়েছে। বিশাল খাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলো। আম্মু আর চাচিও রান্না ঘরে ঢুকতে চাইলো। কিন্তু দাদিয়া বকা দিয়ে বের করে দিলেন।আমরা আব্বু আর চাচুর থেকে একটু দূরে দূরে থাকলাম বকা খাওয়ার ভয়ে। কিন্তু দেখলাম আব্বু আর চাচু কেউ কিছুই বলছে না। বরং নিজেরা গল্প গুজব হাসাহাসি করছে। দুজনে মিলে গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন একটা পিকনিক হচ্ছে। এত দ্রুত তাদের এত ভাব হল কিভাবে। আমরা তো অবাক।
দুপুরে সবাই মিলে খেতে বসলাম। আব্বু হেসে হেসে বলতে লাগলো
আম্মা আসলে বুঝেছ সম্পত্তি তো সব ছেলে দের জন্যই। ভেবে দেখলাম নীল আর আকাশ যখন চায় না তখন শুধু শুধু ঝগড়া করে কি লাভ? আমি আর আকরাম ঝগড়া মিটিয়ে ফেলেছি। এখন আবার আগের মত এক সাথেই থাকবো। আম্মা তুমিও আর রাগ করে থেকো না। চল আমাদের সাথে।
চাচুও হেসে সম্মতি জানালো
আমি আর আকাশ ২ জনই ইয়াহু বলে চিৎকার দিলাম।

পরিশিষ্ট
দাদিয়া এখন আমাদের সাথে ঢাকাতে এসেছেন। আমার ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসছে। চলে যাবো। কিন্তু মন খুব খারাপ। আবার কবে দেখতে পাবো আমার এই আপন মানুষ গুলো কে। কিন্তু এখন সারা জীবনের জন্য দেশের বাইরে থাকবো ভাবতেই কষ্ট লাগে। নিজের শিকড় কে তো উপেক্ষা করা যায় না।আর পরিবারই তো সকল শান্তির উৎস। কিন্তু আমাদের মত সমকামী দের সেই সুখটাও নেই। এটাই আমাদের নিয়তি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.