
লেখকঃ মাসুদ হাসান
১.
‘আজ ধরছি, অনেক দিন থেইক্যা তোদের উপ্রে নজর রাখছিলাম; আইজ তোদেরকে হাতেনাতে পাইছি।’ হঠাৎ এমন জোরে চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেল আদিম খেলার পরম আবেশে নিমজ্জিত দুই যুবক। কোন কিছু না ভেবে তাড়াহুড়া করে নিজেদের শরীর ঢেকে জানালায় তাকিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। জানালায় দেখা যাচ্ছে আকবর আলী’র মুখ, সে বার বার জোরে জোরে চিৎকার করেই ওসব কথা বলে যাচ্ছে। তার লক্ষ্য হলো মানুষজন জড়ো করা, মানুষজন জড়ো হলেই সে সবকিছু বলবে। অনবরত চিল্লিয়েই যাচ্ছে আর তার নজর জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর।
ঘরের ভেতর বিছানায় জড়সড় হয়ে দু’টো প্রাণী বসা! তাদের চোখ বিছানার দিকে, মনে অনেক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, ভয়ে একেবারে গুটিসুটি মেরে গেছে! না জানি আকবর আলী চাচায় মানুষজন ডেকে কি কেলেঙ্কারীই না বাঁধান।
একে একে অনেকেই এসে জানালার পাশে জড়ো হয়েছে। ভেতরে উকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে। কিন্তু আকবর আলী কাউকে ঠিক একেবারে কাছে ঘেষতে দিচ্ছে না। আবার অন্যরা জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলছে না। তার কথা এখন যারা বাড়ীতে বা আশেপাশে আছে সবাই এসে নিক, আমিই যা বলার সবাইকে বলল।
কিছুক্ষণ পরেই বাড়ীর সবার মুরুব্বি কাশেম চাচা এসে হাঁক দিলেন, ‘কি রে আকবর, এত হাঁকডাক, চেঁচামেচি করস ক্যান?’ আকবর আলী একটু চুপসে গিয়ে বলল, ‘ভাইজান, আপনে জানেন না, বাড়ীডা কত নষ্ট হয়ে গেসে, কলেজ-ভার্সিটি পইড়্যা পোলাপান কত খারাপ হয়ে গেসে, ছি: ছি: ছি: কেমুন সব কামকাজ দেখলাম, আমি অনেকদিন আগেই অনুমান করসিলাম, এই দুইডা শয়তান মিইল্যা খারাপ কাম করে।’
সবাই চুপচাপ, কোন কথা বলছে না। বাড়ীর যেসব মহিলা উৎসুক হয়ে এসেছিল, আকবর মিয়া’র বয়ান শুনে সবাই মুখে কাপড় চাপা দিয়ে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, সত্তোরোর্ধ বুড়ি ময়নার মা ‘ইয়া আল্লাহ, আমারে তুইল্যা নেও, বাইচ্যা থাকতে আর কি কি দেখাইবা? ছি: ছি: ছি: এমন কারবারও দেখা লাগল, দুইটা মরদ পোলায়….. ছি: ছি: ছি:, কলি কাল, ঘোর কলি কাল’ বলতে বলতে সরে গেল।
কাশেম চাচার গম্ভীর কন্ঠস্বর, ‘আকবর, আজিমের ঘরে ওইঠা কেডা? ওইটার বাড়ী কই?’ আকবর মিয়া যেন খুব খুশি হয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘ভাইজান, ওইঠা অইল সাধনডাঙ্গা পশ্চিম পাড়ার মুন্সী বাড়ীর কালিমউল্লাহ মুন্সীর ছোডপুত নাসির।’ কাশেম চাচা যেন হঠাৎ মনে হয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘ওরে তো আমি মাঝে মধ্যেই এইদিকে আসতে দেখি, কালও তো দেখা হইছে, কত ভদ্র একটা ছেলে, আমারে দেখলেই সালাম দেয়, ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করে, আমি তো ওরে কোনদিন কোন খারাপ কাজে দেখি নাই!’ আকবর একটু রাগত স্বরেই বলল, ‘ভাইজান কি যে কন, সারাজীবন মাস্টারি করছেন, কেউ একটু ভালমুখে কথা কইলেই হেরে আপনের ভাল মানুষ মনে অয়, ভালডাই যে কত্ত খারাপ এইবার দেখসেন তো? আস্ত একটা শয়তান, এই শয়তানগুলারে কুত্তা দিয়া…………!’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ‘চুপ যা, বেয়াদব’ কাশেম চাচার ধমকে আকবর মিয়া চুপ হয়ে গেল।
কাশেম চাচার গম্ভীর কন্ঠস্বর, ‘আকবর, আজিমের মা’রে ডাক।’ আজিমের মা মুখে আচঁল চাপা দিয়ে গুনগুন স্বরে কেঁদেই চলেছে। আকবর মিয়ার চেঁচামেচির শুরুতেই উনি বুঝে গেছিলেন যে, আজকে অবস্থা খারাপ; যদিও ছেলের এই কর্মকান্ডের কথা মা আগে থেকেই কিছু কিছু জানতেন। ভেবেছিলেন, জোয়ান ছেলে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে আসলে আর বাড়ীর ত্রিসীমানায় কেউ আসতে পারবে না। এসব ভাবছিলেন এমন সময় আকবর মিয়ার হাঁক শুনে বাস্তবে এলেন, ‘ভাবী, কাশেম ভাই আপনেরে ডাকে।’ আকবর মিয়ার ডাক শুনে চোখ মুছতে মুছতে কাশেম চাচার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
কাশেম চাচা বরাবরের মতই গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘শোন আজিমের মা, আগামীকাল এই ঘটনার বিচার হবে। আইজ যদি একটা মেয়েরে তোমার ছেলের ঘরে পাইতাম, তো কাজী ডাইক্যা বিয়া পড়াইয়্যা দিলেই ঝামেলা শেষ হইত! পরে দুইচার জন মেয়ের বাপেরে বুঝাইয়া আত্নীয় করে ফালাইতাম। কিন্তু তোমার ছেলে যে কাজ করছে এইডার বিচার তো শরীয়া মতে হবে! ওরে কইয়্যা দিও কাল যেন অফিসে না যায়।’ ‘জ্বি, আচ্ছা’ বলে আজিমের মা ঘরের দিকে হাঁটা ধরল। একবার আকবর মিয়ার দিকে ফিরে কাশেম চাচার নির্দেশ, ‘ওই উজবুকটা নাম যেন কি?’ আকবর আলী জবাব দেয়, ‘ভাইজান, নাসির।’ কাশেম চাচা বলেন, ‘হ্যাঁ, নাসির; ওরে বলে দে যেন কাল সকালে ইসকুলের মাঠে চইল্যা আসে, আর ওর বাবা-চাচা সহ ওই পাড়ার কয়েকজনকে বলে আসবি কালকে চলে আসতে।’ ‘ঠিক আছে ভাইজান, সব হইব!’ বলে আকবর আলী মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজের বাড়ীর পথে হাঁটা শুরু করে।
২.
কথায় আছে না, খারাপ খবর বাতাসের আগে ছড়ায়। আজিম আর নাসিরের এই স্ক্যান্ডাল গ্রামময় রাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগল না। পুরো গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবার মুখেই একই আলোচনা। কেউ কেউ তো পুরো অবাক, এসবও আবার হয় নাকি? কিছু দুষ্টু টাইপ কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে তো নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে, আরে আমাদের কে কি তোমরা দেখ না? নিজেরা নিজেরা কি সব করে বেড়াও, ছি: ছি: ছি:!
দুষ্টু ছেলেরাও কম যায় না, ওরাও নানা রং ছড়িয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয়ে গেছে। ছেলে-বুড়ো সবার নজর আগামীকালের বিচারের দিকে। বিচারে কি ফায়সালা হবে কে জানে! বৃদ্ধ রজব আলী অন্য একজনের সাথে বলছেন, ‘আচ্ছা কেনু দোর্রা কি জিনিস রে?’ কেনু মিয়া দাত কিলিয়ে বলছেন, ‘ভাইসাব কালকাই দেইখেন! আজিম-নাসিররে শুনসি দোর্রা মারব, তখন দেইখেন!’ বিভিন্ন কথার ডালপালা এভাবেই ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রামময়।
এক টগবগে যুবক আজিম। জেলা সদরের কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে কিছুদিন হলো চাকুরী শুরু করেছে। উপজেলা সদরে অফিস, নিজ বাড়ী থেকেই যাতায়াত করে। শিক্ষিত, ভদ্র হিসাবে গ্রাম-পাড়ায় সবাই মোটামুটি সমীহের চোখেই দেখে। ছোটবেলায় বাবাকে হারায়, বড়-ছোট মিলে তার আরো ৩ বোন, সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সংসারে বলতে গেলে দু’টি মাত্র প্রাণী, মা আর ছেলে। বলা যায়, ছোট্ট সুখের সংসার যেখানে অভাবের লেশ মাত্র নাই।
পাশের গ্রাম সাধনডাঙ্গা’র ছেলে নাসির। জেলা সদরের কলেজে স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র। সেই স্কুল লাইফের শেষ থেকেই আজিম ছিল তার প্রাইভেট টিউটর। আজিম অনার্সে ভর্তির পর থেকেই নিজের বাড়ীতে ব্যাচে ছাত্র পড়ানো শুরু করে। ক্লাসে তেমন একটা যেত না, হয়তো বা কোন কোন সপ্তাহে দু’এক দিন যেত। বাকী সময়টুকু বাড়ীতে থেকেই ছাত্র পড়িয়ে আর আড্ডাবাজি করে কাটাত। নাসিরের সাথে এভাবেই পরিচয়। দীর্ঘ চার-পাঁচটি বছর একটানা নাসির আজিমের কাছে পড়েছে। একেবারে আজিমের বাড়ী এসে, যখন পরীক্ষা আসত তখন দেখা যেত দিনের বেশিরভাগ সময় আজিমদের বাড়ীতেই থাকত নাসির। কত সময় যে একসাথে কাটিয়েছে তার শেষ নেই। অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরও তাদের সেই সম্পর্কে ভাটা পড়েনি।
কত বিকাল একসাথে দু’জন ঘুরেছে উদ্দেশ্যবিহীন; কখনো মেঠো পথ ধরে, কখনো আলপথ ধরে শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে। কখনো ঘন কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকালে, কখনো ঘুটঘুটে অন্ধকারে অমাবস্যার রাতে। কত চাঁদনি রাত যে দু’জনে কাটিয়েছে সবুজ ঘাসের চাদর ঢাকা খোলা প্রান্তরে দু’জন দু’জনার কোলে শুয়ে! এভাবেই ধীরে ধীরে ভালবাসা বাসা বেঁধেছে তাদের মনে। এ বাসা যেমন তেমন বাসা নয়, খড়কুটায় গড়া বাবুই পাখির বাসা নয়, ঝড়ে ভেঙ্গে যাবে এমন শালিক দোয়েলের বাসা নয়, এ বাসার অবস্থানই যে মনের গহীনে। যেখানে ঢেউভাঙ্গা কোন ঝড় কখনো আঘাত হানতে পারবে না, আচমকা ঝড়ে সে বাসা ভাঙ্গা তো দূর স্বপ্ন!
দু’জন দু’জনকে ভালবাসে প্রাণের চেয়েও বেশি। দু’জন দু’জনের পরিবারে প্রবেশ করেছে সন্তানতূল্য ভালবাসার দাবী নিয়ে এবং তা তারা পেয়েও আসছে। এভাবেই হেসে খেলে তাদের সুখের দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। সুখ কি আর সবসময় কপালে সয়? তাইতো এই হঠাৎ ঝড় এসে তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে! কেউই ভাবতে পারে নাই এমন কোন ঝড়ের মুখোমুখি কোনদিন হতে হবে!
আজিম ভাবতেও পারছে না তার শ্রদ্ধাভাজন আকবর চাচা তার এমন সর্বনাশ কেন করল? চল্লিশোর্ধ বয়সী এই মানুষটি আজিমের সম্পর্কে চাচা হয়। বেশ ক’বছর আগে সেই আজিমের কলেজে পড়াকালীন, তিনি তখন সবেমাত্র লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়েছেন; পূর্ণ যৌবনদীপ্ত একজন যুবক, যে শত নারীর স্বপ্নের রাজকুমার হতে পারে, সেই আকবর চাচা আজিমকে আপন করে পেতে চেয়েছিলেন! আজিম তখন ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। আজ হঠাৎ সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেল, আজিম ভাবতে লাগল, চাচা কি তাহলে অনেক দিন আগের সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার অপেক্ষায় ছিল? আর আর সুযোগ সেই কাজটাই করল? আর কিছুই ভাবতে পারছে না, চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
সারাদিন দু’জনের কেউই ঘর থেকে বের হয়নি। অন্যদিন হলে মা এই সময়ের মধ্যে অন্তত দু’বার খাবারের ব্যবস্থা করতেন, আজ তাও করেননি। সন্ধ্যার পর নাসির আজিমের হাত ধরে বলল, ‘আমাকে যেতে দাও, কাল সময়মত চলে এসো, আমিও আসব; জানি না সমাজ আমাদের কি বিচার করবে, কিন্তু আমি যদি তোমার ভালবাসার বিনিময়ে নিজের জীবনটাও হারাই আমার এতটুকু দুঃখ থাকবে না, তুমি শুধু সবার সম্মুখে আমার ভালবাসাটার স্বীকৃতিটা দিও।’ আজিমকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই এ দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল নাসির। আজিম তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকল। মুহুর্তেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল নাসির।
৩.
বেলা গড়াতেই স্কুলের মাঠে লোকজন জড়ো হতে থাকে। দুই গ্রামের সাধারণ মানুষ তো আছেই, যাদের মধ্যে উঠতি বয়সীরাই বেশি; বয়স্করাও এসেছে মোটের উপর অনেকই। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় কলেজের প্রিন্সিপাল, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, হাইস্কুল-প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্য কয়েকজন শিক্ষক, স্থানীয় ইউ.পি চেয়ারম্যান ও কয়েকজন সদস্য, এলাকার বেশ কয়েকজন সাবেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, মসজিদের ইমাম সহ কয়েকজন আলেম-উলামা।
উপস্থিত বিশিষ্টজনদের মাঝেই তথাকথিত দুই আসামীও উপস্থিত, আশেপাশেই আছেন তাদের অভিভাবকেরা। কেউ কোন কথা বলছে না, সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতাকি করছে; সাহস করে কেউ কথা শুরু করছে না। অবশেষে কাশেম চাচাই মুখ খুললেন, ‘উপস্থিত মান্যগন্য, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ, আপনেদের একত্রিত করার উদ্দেশ্য তো জানেনই, এবার আপনেরা এই ঘটনার একটা বিহীত ব্যবস্থা করেন।’
কাশেম চাচার কথার পর প্রথমেই গ্রামের হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেন। উনার বক্তব্যের সারমর্ম হলো, এরা যে অপরাধ করেছে সেটা ঘৃণ্য ও গর্হিত কাজ। সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য এই কাজ বিপজ্জজনক। এদের দেখাদেখি ভবিষ্যতে আরও ছেলেরা এসবে জড়িয়ে পড়তে পারে, তাই এমন নৈতিক স্খলনের জন্য এখনই কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আসামী দু’জন উনার স্কুলের ছাত্র ছিল, সেই জন্য তিনি লজ্জিত; এমন ছাত্রদের তিনি পড়িয়েছেন এটা তিনি ভাবতেই পারছেন না। তিনি এর বিচারের দায়িত্ব মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সহ উপস্থিত আলেম উলামাদের উপর ছেড়ে দেন।
উনার বক্তৃতার পর কলেজের প্রিন্সিপাল নিচু কন্ঠেই বললেন, ‘আচ্ছা আজ যদি এরা দু’জন ছেলে না হয়ে একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে হতো, তাহলে কি সমাজ এমন প্রতিক্রিয়া দেখাত? কখনোই না, দেখা যেত যে গ্রামের দু’চার জন বসেই একটা সমাধান করে ফেলত; তো এদেরকে নিয়ে এমন করাটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’ এই কথা শুনার পর মসজিদের ইমাম সাহেব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন, ‘জানেন, এরা যে অপরাধ করেছে, এর শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। দোর্রা মেরে বা কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলাই এই অপরাধের শাস্তি।’ এবার প্রিন্সিপাল সাহেবও বলতে লাগলেন, ‘এই শাস্তি তো যিনাকারীদেরও, যারা যিনা করে তাদেরও তো এই শাস্তি! কিন্তু সমাজ কি যিনাকারীদের ব্যাপারে কখনো এমন বজ্রকঠিন হয়? আমি তো দেখি নাই, সবাই বলে বিয়ে পড়িয়ে দাও। কিন্তু বিয়ে পড়িয়ে দিলেই কি অপরাধের শাস্তি হয়? কখনোই না। তবে এদের ব্যাপারে সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি কেন?’
ইমাম সাহেব আবারও উনার কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন এবং বললেন যে, ‘এই শাস্তি ছাড়া এদের আর কোন শাস্তি হতে পারে না।’ চেয়ারম্যান সাহেব এতক্ষণে মুখ খুললেন, বললেন ওরা কি বলতে চায় আমরা আগে শুনে নেই। চেয়ারম্যানের এই কথা শুনে আকবর আলী কচমচ করে বলে উঠল, ‘এরা আবার কি বলবে? আমি নিজে দেখছি!’ চেয়ারম্যান একটু রুক্ষস্বরেই বললেন, ‘আকবর মিয়া তুমি চুপ কর, সব জায়গায় মাতব্বরি দেখাতে এসো না।’
অবশেষে চেয়ারম্যানের প্রস্তাবে তাদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হল। আজিম খুব দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘আমরা একজন আরেকজনকে ভালবাসি। দু’টো ছেলেমেয়ের মধ্যে যেমন ভালবাসা হয়, তেমনি আমাদের মধ্যেও ভালবাসা। আমরাও তো অন্য সবার মত রক্ত-মাংসের মানুষ, তাই নয় কি? আমাদেরও তো মন আছে, কাউকে ভাললাগার, ভালবাসার অধিকার আছে। ভালবাসায় তো কোন অন্যায় দেখি না, প্রেম-ভালবাসা পবিত্র বিষয়…….’ এই পযন্ত বলতেই স্কুলের প্রধানশিক্ষক ধমকে উঠলেন, ‘বেশি জ্ঞান হয়ে গেছে তোমার? আমাদেরকে জ্ঞান দিচ্ছ? প্রেম-ভালবাসা, হুহ…’ এবার প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, ‘মাষ্টারসাব আমরাও তো আছি, একটু শুনতে দেন না, কি বলে।’ মাতব্বর গোছের অন্য একজন এই কথায় সায় দিল।
আজিম আবার বলতে শুরু করল, ‘মানুষ হিসাবে আমাদের যেমন সমাজে বাঁচার অধিকার আছে, তেমনি আমাদের প্রেম ভালবাসারও অধিকার আছে। প্রেম ভালবাসা মনের বিষয়, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মধ্যে একটি পবিত্রতম বিষয়। কার মনে কখন কাকে ভাললাগে তা কে বলতে পারে? প্রেম-ভালবাসা কখনো জাত, ধর্ম, লিঙ্গ মানে না। কোন সমাজ কি প্রেম-ভালবাসা অস্বীকার করতে পারে? আজকে দু’টো ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা হলে সেটা তো সমাজ এতটা রুঢ়ভাবে বিচার করে না? তাহলে আমাদের ব্যাপারে সমাজ এত বজ্রকঠিন কেন? আমি আমার ভাললাগা প্রতিষ্ঠার অধিকার চাই, আমি আমার ভালবাসার অধিকার চাই। সমাজ আমার এই অধিকার চিনিয়ে নিতে পারে না। কারো রক্তচক্ষু ভালবাসার অধিকার চিনিয়ে নিতে পারে না।’ এ পর্যায়ে একজন আলেম আবারো থামিয়ে দেয়ার জন্য উদ্যত হলে প্রিন্সিপাল সাহেব ইশারায় ঐ আলেম-কে চুপ করিয়ে দিলেন।
আজিম কম্পিত কন্ঠে বলতে লাগল, ‘ভালবাসা যে কোন সমাজ, যে কোন ধর্মেই পবিত্র ও গ্রহণযোগ্য বিষয়। প্রেম-ভালবাসার বিষয়ে কোথাও কোন দ্বিমত আছে বলে আমি জানি না। আমি ওকে ভালবাসি, আবারো বলছি আমি ওকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি। আমরা একজন আরেকজনকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকতে চাই। এই ভালবাসায় যদি কোন অপরাধ হয়ে থাকে, সমাজ যদি আমাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি নাও দেয়, তাহলেও আমরা ভালবেসেই যাব, এর জন্য সমাজ কোন শাস্তির ব্যবস্থা করলে সেটাও মাথা পেতে গ্রহণ করতে রাজি আছি; কিন্তু আমার ভালবাসার সাথে কোন আপস করতে আমি রাজি নই।’ এইটুকু বলে আর কিছুই বলতে পারল না, তার কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়ল। এবার নাসিরকে কে কিছু বলার জন্য বলা হলে সে কিছুই বলল না, শুধু বলল যে, ‘আজিম ভাইয়ের কথাই আমার কথা।’
বেলা গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর পার হতে চলল। বিতর্ক এখনো সমান তালে চলে যাচ্ছে। উপস্থিত সকল মানুষ ঔৎসুক হয়ে আছে, কি বিচার হয় সেটা দেখার জন্য। সবার ধারণা যে কঠিন একটা শাস্তি হতে যাচ্ছে ওদের। শেষ পর্যন্ত সকলের যুক্তিতর্কে এবং আজিমের মর্মস্পর্শী বাক্যগুলো শোনার পর অনেকের মনে কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল পরিস্থিতি তৈরী হওয়াতে ওদের কে কঠিন শরীয়া শাস্তি হতে অব্যাহতি দিল। কিন্তু সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল ওদের এমন একটা সামাজিক শাস্তি দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে এই এলাকায় আর কেউ এই ধরণের গর্হিত কাজ (লাওয়াতাত) করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে!
সকলের সিদ্ধান্তে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সাহেব শাস্তি ঘোষণা করলেন। তিনি কিছু কথাবার্তা বলার পর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন, ‘আজ থেকে ওদের সাথে কেউ কথা বলবে না, এমনকি ওরা দু’জন দু’জনের সাথেও কথা বলতে পারবে না, ওরা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না, কোন আত্নীয় বাড়ী যেতে পারবে না। এমনকি নিজেদের সব কাজও বাদ দিতে হবে। এটাই হবে এদের সামাজিক শাস্তি। পুরো এলাকায় ঢেঁড়া পিটিয়ে শাস্তির ব্যাপারটি অপরাধ সহ জানিয়ে দেয়া হবে।’
আস্তে আস্তে মানুষজন চলে যেতে থাকল। ওরা দু’জন বিমুঢ়ের মত দাড়িয়ে থাকল। আজিমের মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, এমন মানসিক শাস্তির চেয়ে যে শারীরিক শাস্তিটাই ভাল ছিল। একেবারে মরে যেতাম তবুও তো এই পোড়ামুখ কাউকে দেখাতে হত না, এখন কি হবে? না জানি কবে এই শাস্তির মেয়াদ শেষ হবে? আর শাস্তির মেয়াদ শেষ হলেও কি আবার সমাজে স্বাভাবিক অবস্থানটি ফিরে পাব? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করল। কিছু বুঝে উঠার আগেই চারপাশ ঘুরতে শুরু করল, কিছু একটা আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকানোর চেষ্টা করেও হাতের কাছে কিছুই পেল না। হঠাৎ সব কিছুই অন্ধকারে তলিয়ে গেল!
আজিমকে পড়ে যেতে দেখে দু’একজন ধরার চেষ্টা করতেই গ্রামের প্রবীণ মোড়ল ধমকে উঠল, ‘এই, একে ধরিস না! এদের শাস্তি শুরু হয়ে গেছে, সব দুরে সরে যা!’ মোড়লের ধমকে সবাই দূরে সরে গেল! আজিমের জ্ঞানহীন দেহটা পড়ে থাকল!
এই হল সমাজ ব্যবস্থা! এরাই হলো সমাজপতি!!!