
অনির্বাণ আহমেদ
ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশনের মূল বক্তব্যই হলো জীব জগতের যে প্রাণী যত বেশি প্রজননসক্ষম সন্তানের জন্ম দিতে পারবে তার ফিটনেস তত বেশি বা সেই প্রাণী টিকে থাকার জন্য প্রকৃতিতে বেশি সুবিধা পাবে অর্থাৎ ন্যাচারাল সিলেকশনে প্রজননের ভূমিকাই মুখ্য।কোন প্রাণী প্রজননক্ষম সন্তানের জন্ম দিতে পারলেই সেই প্রজাতির বাবা মায়ের ফিটনেস এক করে বেড়ে যায় । যতবেশি প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম দিতে পারবে তত বেশি ফিটনেস যোগ হবে ঐ প্রজাতির বাবা মায়ের ।একে বলে ডারউনীয় ফিটনেস। কিন্তু প্রকৃতিতে এমন অনেক প্রণী আছে যাদের বেশির ভাগ সদস্যই প্রজননে কোন ভূমিকাই পালন করেনা। যেহেতু প্রজননে কোন ভূমিকাই পালন করেনা সেহেতু প্রজননের এই ফিটনেস তারা পাচ্ছেনা,তাহলে কিভাবে তারা প্রকৃতিতে টিকে থাকছে? তাহলে কী ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন ত্রুটি যুক্ত?
প্রকৃতিতে বেশির ভাগ প্রাণীই দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। এদের মধ্যে নিজের ক্ষতি করে অন্যের উপকার করার প্রবণতা অনেক প্রাণীর ভিতরেই রয়েছে। যেমন মৌমাছি নিজের বাসস্থানকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য হুল ফুটিয়ে আত্নবলিদান করে(যেহেতু মৌমাছি হুল ফোটানোর কিছু সময় পরে মারা যায়) শুধু নিজের বংশধর এবং নিজের জ্ঞাতি গোষ্ঠিকে সুরক্ষার জন্য। আবার ‘গ্রউন্ড স্কুইরেল’ নামের একধরনের কাঠবিড়ালি আছে যারা শিকারি ইগল,নেকড়ে দেখলেই ‘অ্যালার্ম কল’ দিয়ে নিজের গোষ্ঠির বাকি সদস্যদের সতর্ক করে দেয় ।গবেষণায় দেখা গেছে এরা তখনই এই ‘অ্যালার্ম কল’ দেয় যখন এদের আশেপাশেই নিজের প্রজাতিরা থাকে।বেশির ভাগ সময়ই অ্যালার্ম কল দিতে গিয়েই নিজেই শিকাড়ি ইগলের হাতেই মারা পরে। তাহলে জীবের এই সহজাত আত্নত্যাগের কারণ কী হতে পারে?
কিংবা রক্ত খাওয়া বাদুরদের মধ্যে যখন একটা বাদূর ক্ষুধার ফলে অসুস্থ হয়ে পরে (রক্ত খাওয়া বাদুরেরা ৩৫ ঘন্টার বেশি খাবার না খেতে পারলে অসুস্থ হয়ে পরে) তখন ঐ দলের সব বাদুরেরা মিলে অসুস্থ বাদুরকে তাদের খাবার ভাগ করে অসুস্থ বাদুরকে খাওয়ায় এবং সুস্থ করে তোলে। তাহলে বাদুরের এই নিস্বর্থ কাজের পিছনে কি কারণ থাকতে পারে? কোন কোন প্রণী একান্তজিবী হয়ে থাকে অর্থাৎ খাবার সংগ্রহ, দলব্ধভাবে সামাজিক ভাবে চলাফেরা করেনা,বাচ্চা লালন পালনের জন্য প্রজাতির অন্য সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হয় না যেমনঃ- কুকুর,গরু,বাঘ ইত্যাদি। এরা বাচ্চা জন্মদানের একটা সময়ের পর বাচ্চাদের প্রতি অযত্নশীল হয়ে পরে এবং খাবার নিয়ে দ্বন্দে লিপ্ত হয়।মায়ের এই স্বার্থপরতারই বা কারণ কি?
উপরের সব আচরণগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারে জীব বিজ্ঞানের এক বিখ্যাত থিউরি যার নাম হলো ‘কিন সিলেকশন’। ‘কিন’ শব্দের অর্থ হলো আত্নীয়।ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন হলো প্রজননের মাধ্যমে ফিটনেস বাড়ানো আর এই ফিটনেস বাড়ানোই হলো প্রজাতিতে জিনের সুরক্ষা। ডারউইনের সময় জিন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কোন ধরণা ছিলো না,পরবর্তিতে বিজ্ঞানীরা জিন সম্পর্কে অবহিত হলে ডারউইনের তত্ত্ব নতুন রুপ পায়। যার নাম হলো নব্য ডারউইনবাদ অর্থাৎ জেনেটিক্স ও পরিসংখ্যাণ ব্যাবহার করে ডারউনের তত্ত্বকে বোঝার চেষ্টা। উপরের উদারণ গুলো দেখলে মনে হতে পারে ন্যাচারাল সিলেকশন থিউরি ত্রুটি যুক্ত কিন্তু জেনেটিক্সের জ্ঞান আসার পর ন্যাচারাল সিলেকশন থিউরিকে আরো ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। তখন দেখা যাচ্ছে যে ‘কিন সিলেকশন’ থিউরি হলো ন্যাচা্রাল সিলেকশনের একটি অংশ।আর এই ‘কিন সিলেকশনই ব্যাখ্যা দেয় জেনেটিক আত্নীয়তার বন্ধন কিভাবে কাজ করে।
নব্য ডারউইনবাদের জেনেটিক এবং পরিসংখ্যান ব্যাবহার করে ১৯৫৫ সালে বিজ্ঞাণী হেলডন দেখান প্রানীর প্রতিটা বৈশিষ্ট্য বা আচরনের পিছনে আলাদা আলাদা জিন দায়ী থাকে। কোন বৈশিষ্ট্য প্রকৃতিতে টিকে থাকার মানে হলো সেই বৈশিষ্ট্যের জিনের টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।প্রতিটা প্রাণীর বাবা মায়ের জিনের প্রতিরুপ তাদের সন্তানের ভিতর থাকে। বাবা মা থেকে পাওয়া ২৩ জোড়া অটোজম এবং এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম।এখন কোন জিন কোন জিন প্রকৃতিতে টিকে যাওয়ার মানে হলো বংশ পরম্পরায় সেই জিনের সংখ্যা বাড়ানো অর্থাৎ প্রজননের মাধ্যমে প্রকৃতিতে নিজের সম্প্রদায়কে টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়ানো।এখন নিজের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার এই প্রবণতাকে অ্যাল্ট্রুইজম বলে।
পরবর্তীতে হ্যালডনের গবেষণার সূত্র ধরে বৃটিশ বিজ্ঞাণী ডি হ্যামিলটন ১৯৬৪ সালে দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। সেখানে তিনি একটা নতুন থিউরির আবির্ভাব ঘটান। হ্যামিলটনের থিউরি অনুযায়ী প্রজাতির জিনের সংখ্যা শুধুমাত্র প্রজনন করলেই বাড়বে এমনটা না। প্রজাতির অন্য সদস্যরা একে অন্যের সাথে জেনেটিক আত্নীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ সুতরাং প্রত্যেক সদস্যদের মাঝেই জিনের প্রতিরুপ আছে।তাই গোষ্ঠির কোন সদস্য কে বেঁচে থাকতে সাহায্য করলে, প্রজাতিতে জিনের সংখ্যা বাড়বে এবং সেই গোষ্ঠির সদস্যদের টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়বে। এমকি গোষ্ঠির কোন সদস্য যদি প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়ও তবুও সে এই ফিটনেস পেয়ে যাবে তার সদস্যদের মাধ্যমে। আর এই থিউরির নাম কিন সিলেকশন।