
লেখক :- অনির্বাণ আহমেদ
১
দীর্ঘ নিস্তবদ্ধতা ভেঙে হাঠৎই ডুকরে কোন একজন কেদে উঠলো আর বলতে লাগলো ‘আমার আব্বা জানলে আমাকে মেরে ফেলবে’। তখনই হুশ ফিরলো আমার, হাটু গেড়ে প্রিজন ভ্যানের দেয়ালে মুখ নিচু করে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। প্রিজন ভ্যানের সরু জানলা দিয়ে আসা হালকা আলোতে সকলের মুখ দেখতে পাচ্ছি। খেয়াল করলাম সবাই ডুকরে না কাদলেও সবার মুখ, নাক ফুলে লাল হয়ে আছে।প্রথম যখন প্রিজন ভ্যানে ঢুকি অন্ধকারে কেও কাওকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।কিছুক্ষণ থাকার পরে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
প্রিজন ভ্যানে আমরা ছিলাম ১৫ জন কেও কারো সাথে কথা বলছিলাম না। ঐ ছেলেটার কান্নার পর সবাই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বিড় বিড় করতে লাগলো।আমি উঠে দাড়িয়ে বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখছি। যেমনটা দেখতো হিমু। হিমু বলতে হূমায়ুন আহমেদের হিমু যে প্রিজন ভ্যান থেকে বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখতো, যার কাছে প্রিজন ভ্যান থেকে ঢাকা শহর দেখার মজাই নাকি অন্যরকম ছিলো। ছোট বেলা থেকেই আমি হূমায়ুন আহমেদের বড় ভক্ত, বিশেষ করে হিমু চরিত্রটা আমাকে বেশি টানতো।নিজেকে রুপার জায়গায় ভাবতাম আমি যদি রুপা হাতাম তাহলে হিমুকে এতো উচ্ছন্নে যেতে দিতাম না,যতই ডুব দিয়ে থাকুক না কেন ঠিকই খুজে বের করাতম রুপার মতো অপেক্ষায় থাকতাম না।
বাইরে কিছুক্ষণ আগেই ঝড়সহ বৃষ্টি হয়ে গেছে বৈশাখের এই শেষ সময়টাতে কৃষ্ণচূড়া ফোটে। রাস্তা জুড়ে কৃষ্ণচূড়া বেছানো, দেখে মনে হচ্ছে ঝড়ের পরে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য আরো ভয়বহ আকার ধারণ করেছে। প্রিজন ভ্যান চলছে কৃষ্ণচূড়ার সারি রেখে কাদা মাটির কনক্রিটের রাস্তার উপরদিয়ে হালকা ঝাকুনি খেতে খেতে মাঝে মাঝে বড় ঝাকুনিও হচ্ছে চারিদিকে মানুষ গিজ গিজ কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। কিছুক্ষণ মুখ উঁচু করে দাড়িয়ে থেকে আবার বসে পরলাম।আমরা কোথায় যাচ্ছি জানিনা, হয়ত জেলখানার দিকে। শুনেছি জেলখানা নাকি অন্যরকম আরেক পৃথিবী, তার শুরু হয়ত আলো ছায়ার এই প্রিজন ভ্যান।
২
মোঘল আমলের পুরনো মহল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, কারাগারের দেয়াল জুড়ে নীতি বাক্যের সমাহার। পুরনো মহল, সেল, ফাঁসির মঞ্চ মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি অপরাধী।মনে হচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে ইতিহাসের কয়েদী ভূতগুলো চিৎকার করে সাক্ষী দিচ্ছে তুমিও অপরাধী ঘৃণতম অপরাধী।
হাজারো বিচিত্র মানুষের সমাহার এই জেলখানা। মাত্র একদিনেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। জেলখানার এই পরিবেশের সাথে মানানোটা একেবারেই অসম্ভব। পানি, খাবার আর থাকার জায়গার অভাব। খুনী,নেশাখোর,যৌন অবদমিত ব্যাক্তির সাথেই আমাদের উঠা বসা শোয়া।
আমরা যে সেলটাতে থাকি সেখানকার ধারণ ক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি লোক একসাথে থাকতে হয়। একজনের গায়ের সাথে একজনকে লেপটে থাকি। এত সংকীর্ণতার মাঝে থেকেও আমরা যেন সকলের চোখের বিষ হয়ে উঠলাম। এর কারণ বোধ করি আমাদের কারো মাঝে মেয়েলী স্বভাবটা। অনেককে বলতেও শুনেছি হিজরাগুলা ক্যান আমাদের সাথে থাকে। এছাড়াও আরো অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়েছে।
অনেক দিন আগে কোন এক রাজনৈতিক বন্দীর জেলখানার অনুভূতি পড়েছিলাম তার কবিতায় লিখেছিলো :-
নীচের নর্দমা বন্ধ পচা গন্ধ বুনো অন্ধকার
সে-সবের মুখেমুখি চাঁদিমার জমাট পসার।
চাঁদের আয়না দিয়ে তবু এই জানালার পাশে
বাইরের পৃথিবীর মুখ আমাদের বুকে চলে আসে।
নর্দমার পচা গন্ধ আর বুনো অন্ধকারেও কারাগারের জানালা দিয়ে চাঁদের আলোয় কিছুটা হলেও গারদের অন্ধকার মৃয়মাণ হয়। কিন্তু আমার এখানে চাঁদের আলো নেই৷ আর সব আছে। আমিও পৃথিবীর মুখ বুকে ধারণ করে বসে আছি। যেদিন বের হবো সেদিন কি কোন মিরাক্কেল ঘটবে? বাইরে বের হয়ে দেখতে পাবো পৃথিবীর সকল ভালোবাসা সমান!?
৩
দুইদিন এভাবেই কেটে গেলো। তখনও বুঝতে পারিনি এর থেকেও ভয়াবহ সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ভোর বেলাতেই হন্তদন্ত হয়ে জেলের কর্মচারীরা আমাদের সবাইকে ঘুপচি একটা রুমে নিয়ে গেলো, সেখানে আটকে রাখা হলো। কিছুই বুঝতে পারছিনা কেন এভাবে আটকে রাখা হলো। এরপর খেয়াল করলাম আমাদের মাঝে দুইটা ছেলে নেই। পরে জানতে পারলাম ওদেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হইছে। যৌনহীনতায় ভুগতে থাকা যৌনঅবদমিত কয়েদীদের মাঝে এধরনের ঘটনা তেমন কিছুই না। কিন্তু এই গারদে আমাদের উপর নেমে আসছে আরো বিভীষিকাময় দিন তা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি।
আদেও কি আমরা কোন অপরাধ করেছি! খুব জানার ইচ্ছা ছেলে হয়ে অন্য ছেলেকে ভালোবাসাটা এত ঘৃণার কেন!