বিবর্তনের দৃষ্টিতে সমকামিতা

লেখক : অনির্বাণ আহমেদ

কিছু সমকাম বিরোধী প্রগতিশীল আছে যাদের যুক্তি সমকামিতাকে বিবর্তন সমর্থন করে না, তায় সমকামিতার কোন বিবর্তনীয় কারণ নেই এটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ মানসিক রোগ, রুচীর বিকৃতি। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মান্ধের দেশের শিক্ষিত মানুষরা তো বিবর্তনকেই মানেই না,সেখানে বিবর্তনের দৃষ্টিতে সমকামিতাকে দেখার প্রশ্নই আসে না। আমার এই লেখাটা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে যারা মনে করে ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন সমকামিতাকে সমর্থন করে না, বা ন্যাচারাল সিলেকশন সমকামকে ছুড়ে ফেলে দেয়।

আসলে বিষয়টা কী সেরকম! বিবর্তন কী সমকামিতাকে সমর্থন করে না? নাকি ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন সেভাবে সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না! তাহলে চলুন বিবর্তনের দৃষ্টিতে সমকামিতা দেখে আসি :-

সমকামিতা ও ন্যাচারাল সিলেকশন :-

আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে প্রচলিত বিবর্তন তত্ত্বের সাথে সমকামীয় আচরণ সামঞ্জস্য পূর্ণ না। অর্থাৎ প্রজনন নীতির পরিপন্থী! ব্যাপকহারে সমকাম যৌন আচরণ কী বিবর্তনের একটি ধাঁধা, নাকি প্রাকৃতিক নির্বাচনের চালিকা শক্তি যা বিবর্তনের পরিণতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। জীব বিজ্ঞানী ময়লিন জুক এবং নাথান বেইলী মনে করেন প্রাণী জগতে বিদ্যমাণ সমকাম আচরণ যে সমস্থ প্রজাতিতে বেশি, প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে যে তাদের বিবর্তনের ক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণ বিবর্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি। সমকামী আচরণে প্রজননের প্রশ্নই ওঠে না তবুও পরস্পরের মধ্যে প্রজননে অক্ষম দুটি প্রাণীর উপর প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কাজ করছে।
প্রকৃতিতে প্রধানত দুই ধরনের প্রজনন দেখা যায়; একটা যৌন প্রজনন এবং অন্যটা অযৌন প্রজনন। যৌন প্রজননে অধিক শক্তি ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতিতে যৌনপ্রজরাই বেশি টিকে আছে। কিন্তু একজন যৌনপ্রজ তার জীবনদশায় যতবার যৌন সম্পর্কে সে হিসাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম উৎপাদিত হয় খুবই কম, কিন্তু টিকে থাকার ক্ষমতা অযৌনপ্রজদের তুলনায় বেশি থাকে। বিজ্ঞানীরা মনে করে সেক্স; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জেনেটিক প্রকরণ ঘটায় যা বির্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি। জেনেটিক ভেরিয়েশনের ফলে হঠাৎ পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, খাদ্যাভাবে বেশ সহজেই নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে পারে যৌনপ্রজরা অর্থাৎ অভিযোজনীয় ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করছে।
সমকাম ভিত্তিক যৌন আচরণে অভিযোজনীয় ভূমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
সমলিঙ্গ যৌন আচরন সামাজিক বন্ধন হিসাবে কাজ করে যা সামাজিক সম্পর্ক তৈরী,তার রক্ষণাবেক্ষণ এবং বলিষ্ঠ করণে বিশেষ ভুমিকা রাখে। যেমন বটলনোজ ডলফিন পুরুষদের মধ্যে জোটবদ্ধতা।
সমলিঙ্গ যৌনআচরন যৌন আগ্রাসন বা দ্বন্দ্বর তীব্রতা বাড়ানো বা কমানোর একটা পথ। যেমন, ডাঙ্গ ফ্লাই এই প্রজাতির পুরুষদের অন্যপুরুষদের উপর সঙ্গমের জন্য মাউন্টিং। পুরুষ ডাং ফ্লাইগুলো অন্য পুরুষদের উপর মাউন্ট করে তাদেরকে প্রজননের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে, ফলে তাদের নিজেদের আরো বেশী প্রজননের সুযোগও বৃদ্ধি পায়।
সমলিঙ্গ যৌন আচরন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী প্রাণীদের প্রজনন সংক্রান্ত নানা আচরন যেমন, কোর্টশীপ, মাউন্টিং ইত্যাদির অনুশীলন হিসাবে কাজ করতে পারে, যা পরবর্তীতে বিষম লিঙ্গের সঙ্গীর সাথে তাদের প্রজননে সফল হতে সাহায্য করে। ড্রোসোফিলার উদাহরণ থেকে দেখা যায়, সমলিঙ্গ ভিত্তিক যৌন অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তরুণ পুরুষ মাছিদের বিসমলিঙ্গ সঙ্গমের ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য নিয়ে আসে। পিঙ্ক ফ্লেমিঙ্গোরাও সমলিঙ্গ ভিত্তিক যৌন আচরনের অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হয় পরবর্তীতের তাদের নিজস্ব এলাকা দখল করার দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে।
এভাবে টিকে থাকার জন্য সমকামের আচরণ বোশ গুরুত্বপূর্ণ।

সমকামিতা ও সেক্সুয়াল সিলেকশন

সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌন নির্বাচনকে ব্যাখ্যা করা যায় প্রজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতামুলক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দ্বারা ফলে প্রজাতিতে প্রজননের হার বৃদ্ধি হয় এবং বৈচিত্রতাও বৃদ্ধি পায়।
তেলাপোকাদের অনেক প্রজাতির মধ্যে দেখা যায় পুরুষ তেলাপোকারা অন্য পুরুষ তেলাপোকাকে তাদের উপর মাউন্টিং এর জন্য উত্তেজিত করে, পক্ষান্তরে অন্য পুরুষ তেলাপোকা, স্ত্রী তেলাপোকাদের মতই আচরন করে এবং কোর্ট করা পুরুষদের উপরে মাউন্ট করে। এধরনের ‘সিউডোফিমেল’ আচরন আপাত দৃষ্টিতে এমন আচরনকারী পুরুষদের প্রজনন ফিটনেস বাড়িয়ে দেয়, কারন স্থানচ্যুত হওয়া পুরুষদের জায়গায় তাদের কোর্ট করা স্ত্রী তেলাপোকাদের সাথে সঙ্গম করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।আবার এমনও হতে সমকামিতা বিবর্তনের উপজাত বা সাইড ইফেক্ট। যা যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে, উপজাত হিসাবে বংশপরম্পরায় প্রজাতিতে চলে আসছে যা প্রজাতির কোন ক্ষতি করছে না।কিন্তু সেক্সের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়ীত্ব পালন করছে।

বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সমকামিতার গুরুত্ব

২০০৮ সালের দিকে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের লিন্ডসে ইয়ং হাওয়াই দীপপুন্জ্ঞে একটা অ্যালবাট্রস কলোনীতে দেখতে পান, পাখিদের সব জুটির মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ জুটি বেধেছে সমকামী জুটি। ঘনিষ্ট পেয়ার বন্ডিং এর মাধ্যমে দুটি স্ত্রী-অ্যালবাট্রস সঙ্গম করছে, একে অন্যর পালক পরিষ্কার করে দিচ্ছে এবং একই সাথে একটি বাচ্চা বড়ও করছে।একটা সম্ভাবনা হচ্ছে স্ত্রী পাখিদের এই সমলিঙ্গ জুটি বাধা সম্ভাব্য ফিটনেস বেনিফিটের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং পুরুষ পাখিদের জুটির বাইরে সঙ্গমের মাধ্যমে প্রাকৃতিকি নির্বাচনের সুবিধাও পায়।এছাড়াও মানুষে সমকামিতার প্রভাবে নারীর উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়।২০০৪ সালে, ইটালির বিজ্ঞানীরা ৪,৬০০ মানুষের উপর একটি গবেষণা চালান। এরা ৯৮ জন সমকামি ও ১০০ জন বিসমকামী পুরুষের আত্মীয় ছিলেন। সমকামি পুরুষদের নারী আত্মীয়দের তুলনামূলক বেশি বাচ্চাকাচ্চা আছে বলে পরিলক্ষিত হয়। সমকামি পুরুষদের মায়ের দিকে দিয়ে নারী আত্মীয়রা বাবার দিকে দিয়ে নারী আত্মীয়দের চেয়ে বেশি বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। এতে করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, এক্স ক্রোমোজোমে করে যে জিনগত বৈশিষ্ট্য বাচ্চার মাঝে পরিবাহিত হত, তার নারীর মাঝে ঊর্বরতা এবং পুরুষের মাঝে সমকামি প্রবণতার সঞ্চার করে। যেসব গবেষণায় সমকামিতা ব্যাখ্যায় জিনগত বৈশিষ্ট্য এককভাবে না হলেও অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কারন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই সম্পর্ক অন্তত সেই সকল ২০% গবেষণাকে ব্যাখ্যা করে।

শেষ কথা :-

বর্তমানে জিন এডিটিং এর মাধ্যমে ভ্রুণ অবস্থাতে জেনেটিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলেছেন । এখন ধরুণ সুদূর ভবিষ্যতে দেখা গেলো সমকামিতার লক্ষণকে ভ্রুণ অবস্থাতেই শনাক্ত করা গেলো এবং তা জিনএডিটিং এর মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যাবে। তাহলেও কী মানুষের উচিৎ হবে জিন এডিটিং করে সমকাম প্রবৃদ্ধিকে রুখে দেওয়ার?

এমনটা হলে কী বিবর্তন তার স্বাভাবিক গতি থেকে বিচ্যুত হবে না?!

তাই প্রকৃতিকে তার মতো করে চলতে দেওয়ায় উচিত। সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয়। সকল জীবের জন্যই মঙ্গল জনক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.