
লেখক :- অনির্বাণ আহমেদ
- সমকামিতা কি শুধুই জন্মগত প্রাপ্ত যৌনঅভিমুখিতা?
“কৃষ্ণ একবার অর্জুনকে পবিত্র এক সরোবরে স্নান করতে বললে অর্জুন মহিলা হয়ে যান।তাঁর নাম হয় অর্জুনী। পদ্মাপুরাণে আছে, পুরুষ কৃষ্ণের সঙ্গে কামক্রীড়ায়য় মেতে উঠেন।পুনরায় তাকে,পূত সরোবরে স্নান করতে অনুরোধ করলে তিনি পুরুষত্ব ফিরে পান।কিন্তু কৃষ্ণের প্রতি ভাব গোপন করতে পারেন না। কৃষ্ণ তাঁকে তাঁর পৌরষ সম্পর্কে অভিহিত করেন। “মধ্যযুগে কোন লেখকেরা এধরেনের সাহিত্যের অবতারন ঘটিয়েছিলেন তা নিদৃষ্ট করে বলা যায় না। তবে তখনকার সময়ে বা সমাজে সমকামিতার দৃষ্টি ভঙ্গি কেমন ছিলো তা অনেকটা আন্দাজ করা যায় এই গল্পগুলোর মাধ্যমে।
এখানে যে বিষয়টা লক্ষনীয় তা হচ্ছে একটা পুরুষের প্রতি আরেকটা পুরুষের কামভাব জাগ্রত হওয়া। কোন ধরনের প্রেম বা প্রণয় সম্পর্ক ছাড়াই।
- ইদানীং সময়ে আমাদের একটা বদ্ধমুল ধারণা হয়েছে, সমকামিতা হলো :-
জন্মগত, একে বারে মায়ের পেট থেকে নির্ধারিত, (আমি বলছি না, যে সমকামিতা জন্মগত নয়, কিংবা মায়ের গর্ভে হরমোনাল কারণে সমকামী আচরণ হতে পারেনা), বিষমকামী আর সমকামীদের আচরণ একেবারেই ভিন্ন, কোন বিষমকামী কখনোই সমকামী আচরণ করতে পারেনা, কোন সমকামী আবার কখনোই বিষমকামী আচরণ করতে পারেনা, সমকামিতা জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সমকামি জিন কারো মাঝে থাকলে সে অবশ্যই সমকামি, তথাকথিত ময়েলী আচরণ মানেই সমকামী কিংবা এই আচরণে মুলে শুধুমাত্র হরমোন দায়ী।
(আমি বলছিনা যে সমকামি আচরনের জন্য জিন, হরমোন, এর প্রভাব নেই। কিন্তু শুধুমাত্র জিন, হরমোনই সমকামিতার জন্য দায়ী এটা ভাবাটা ভুল হবে।)এই ধারণা গুলো যে একেবারেই ভিত্তিহীন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেন এই ধারণা গুলো সাধারণ মানুষ কিংবা সমকামি কমিউনিটিতে গড়ে উঠেছে, তা হয়ত সমকামীদের প্রতি সমাজিক হেয় দৃষ্টি ভঙ্গির জন্য, এই টার্মগুলো অনেক শক্তভাবে সমাজে গেড়ে বসলে হয়ত সামাজিক সহানুভূতি পাওয়া যাবে।কিন্তু সাময়িক সহানুভূতি তৈরীর জন্য আমরা সত্যটাকে গুলিয়ে ফেলছি যা সমকামি কমিউনিটির জন্য ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আসতে পারে।আমাদের আগে এটা মেনে নিতে হবে যে সমকাম একটা সাধারণ যৌন ভাবনা বা যৌনক্রিয়া। মার্কিন মনঃরোগবিশেষজ্ঞ মার্টিন কাফকা বলেনঃ ‘সমকামিতা, যেটা একসময় যৌনতার একটি অস্বাভাবিক রূপ এবং যৌন বিকৃতি হিসেবে বিবেচিত হত, এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক যৌনতা বলে পরিগণিত হয়।আমরা এই ধারণাগুলোর জন্য জানতে পারিনা যে যৌন তারল্য, এপিজেনেটিক্স, পরিবেশ এবং কালচারের প্রভাবে যৌনঅমুখীতা পরিবর্তন ঘটাতে পারে।আমরা অনেকেই বলতে পছন্দ করি যে সমকামিতা পূর্ব নির্ধারিত। কোন বিষমকামী ব্যাক্তি সমকামি আচরণ করতে পারেনা। কিন্তু আমরা একেবারেই ভুলে যাই যে যৌন তারল্য নামে মনোবিজ্ঞানে একটা টার্ম আছে। যে কোন ব্যাক্তিই পরিবেশের প্রভাবে বিশেষ গুন বা পরিস্থিতির কারণে অন্য সমলিঙ্গ ব্যাক্তির উপর যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারেন। এই যে বিষমকামী থেকে সমকামী হবার যে প্রবণতা, এটাই যৌনতার তারল্য। পরবর্তিতে এই যৌন অবস্থা থাকতেও পারে,আবার নাও পারে।যৌন তারল্য নিয়ে অনেক সময়ই গবেষণা হয়েছে সম্প্রতি আমেরিকার কর্ণেল ইউনিভার্সটির অনেকদিন ধরে চলা একটা গবেষণায় উঠে এসেছে কোন ব্যাক্তিই ১০০% স্ট্রেইট এবং ১০০% গে না। মানুষের ভিতর যৌনঅভিমুখিতাও পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক।বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী “সিগমন্ড ফ্রয়ড” বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যেই সমকাম প্রবণতা একটু হলেও থাকে। সমকামিতা কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়। যদিও প্রথম দিকে তিনি মনে করতেন সমকামিতা একটি যৌনবিকৃতি। পরবর্তিতে তিনি এই মতবাদ থেকে সরে আসেন।
আধুনিক সেক্সলজির জনক আলফ্রেড কিনসে মানব যৌনতা সংক্রান্ত যে সমীক্ষাটি চালান, সেই সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে কোন ব্যক্তিই বিপরীতকামী বা সমকামী শ্রেণীবিভাজনের আওতাভুক্ত নন।তিনি যৌন আকর্ষণ এবং আচরণের স্কেলে দেখিয়েছ বিষমকামী এবং সমকামী তাদের যৌন অবস্থান এই দুই শ্রেণীর মাঝামাঝি কোথাও অবস্থিত। কিন্সে স্কেল অনুসারে যৌন আকর্ষণ ও আচরণ স্কেলটিতে ০ (একান্ত বিপরীতকামী) থেকে ৬ (একান্ত সমকামী) সাতটি দাগ বিদ্যমান। কিন্সের গবেষণা অনুযায়ী, অধিকাংশ মানুষই এই স্কেলে ১ থেকে ৫ (অর্থাৎ, বিপরীতকামী থেকে সমকামী) দাগের মধ্যে পড়েন।
এ থেকে বোঝা যায় সমকামিতা বিষমকামিতা দুটো যৌনঅভিমুখিতায় স্বাভাবিক এবং যৌনঅভিমুখিতা ঘাটাও স্বাভাবিক।এবার আসা যাক এপিজেনেটিক্সে।
এপিজেনেটিক্স হলো, এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টর বা বাহ্যিক কোনো কারণে ক্রোমোসোমের কেমিক্যাল চেঞ্জ ঘটে যার ফলে ডিএনএ’র কোনো পরিবর্তন হয়না কিন্তু জিনের ফাংশন চেঞ্জ হয়ে যায়। এটা জীবনের যেকোনো পর্যায়ে হতে পারে। এপিজেনেটিক্যাল চেঞ্জ প্রাত্যাহিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত অনেক কারণেও হতে পারে, এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টরস তার অন্যতম। একটি গবেষনায় দেখা যায়, মায়ের জিনগত গঠন ও সমকামিতার সাথে পুত্রের যৌন অভিমুখিতার সম্পর্ক রয়েছে। নারীদের দুইটা এক্স ক্রোমোজোম আছে। এর মাঝে একটি অকার্যকরী। ভ্রুণাবস্থায় এক্স ক্রোমোজোমের এই বৈশিষ্ট্য না দেখানোর প্রবণতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই র্যান্ডমলি ঘটে।পরিবেশ আরো অনেক উপায়ে সমকামি আচরণের কারণ হতে পারে। যেমন :- শৈশবে লৈঙ্গিক সঙ্গতিহীনতা, পারিবারিক প্রভাব, কালচারাল প্রভাব, শহরে অবস্থান ইত্যাদি।আমি সমকামি কমিউনিটির অনেককেই বলতে শুনেছি তারা কখনোই ছোট বেলা থেকে ছেলেদের প্রতি যৌনআকর্ষন বোধ করতো না, একটা বিশেষ সময়ের পরেই ছেলেদের প্রতি আকর্ষণটা বুঝতে পারে।আবার অনেকেই আছে একেবারেই ছোট বেলা থেকে একই লিঙ্গের মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষন বোধ করতো।সমাকামিতা জিনগত, হরমোনগত, মষ্তিষ্কের গঠনগত,পরিবেশগত,এপজেনেটিক্সের প্রভাব। এখানের সবগুলো কারণেই হতে পারে। তেমনি ভাবে বিষমকামিতাও এই একই কারণেই ঘটে। এখানে সমকামিতাকে বিষেশায়িত করার কোন কারণ আছে বলে মনে হয় না। আমি সমকামি এটা জন্মগত এটা বলার একধরনের সহায়ানুভূতি পাওয়ার মাঝে কোন গর্ব নেই। বরং কেও যদি সমকামিতাকে নিজের চয়েজ বলে সেটাই স্বাভাবিক। একজন ব্যাক্তির যৌনঅভিমুখীতা নির্ধারণ করার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কেও নিজেকে উভকামী বললে এটা তার চয়েজ হতেই পারে। কারে মাঝে সমকামি জিনের অস্তিত্ব থাকলেই সে সমকামী হয়ে যাবে না, প্রচলিত মেয়েলী আচরণ করলেও সে সমকামী হয়ে যাবে না। আবার কোন বিষমকামী মাঝজীবনে এসে যদি সমকামি হয়ে যায় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যদি যৌনঅভিমুখীতা নিজের চয়েজ বলতে না পারছি, নিজেরাই এই বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবোনা।