
লেখক :- অনির্বাণ আহমেদ
সমকামিতার প্রতি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা ধর্মীয়, আইনী ও চিকিৎসা ভিত্তিক। মধ্যযুগের আগে সমকামিতার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক এমনটা ছিলোনা এমনকি গির্জা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করাও হতোনা। কিন্তু বারো শতকের শুরুতে সমকামিতার প্রতি একধরনের বিদ্বেষমূলক আচরণ শুরু হয় যা অবশেষে ইউরোপের ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে নেয়। সমকামিতা কিভাবে নিষদ্ধ হলো তার হয়ত বিরাট ইতিহাস আছে তবে আলোচ্য বিষয়টা এটা নয়।
যা লিখতে চাইছি তা অনেকটা সমকামিতার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি, কিংবা গোহা মানবদের মাঝে হাজার বছর ধরে রেখে যাও চিহ্ন বা সংস্কৃতিই প্রমাণ করে সমকামিতা কতটা প্রাকৃতিক।প্রাচীন পৃথিবীর এমন কোন সভত্যা নেই যেখানে সমকামিতার প্রচলন ছিলোনা। আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে ভালোবাসা নিষিদ্ধ, একজন মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে ভালোবাসাটা অপরাধ। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি সুদূর অতীত কিংবা ভবিষ্যৎের কোন মানুষ সময় ভ্রমণ করে ঠিক এই সময়ের সমাজ ব্যাবস্থাকে দেখত তাহলে নিশ্চিত হয়ত আঁতকে উঠতো।
এখন প্রশ্ন হতে পারে ইতিহাস কপচাইয়া কি লাভ! হয়ত তেমন লাভ নেই। তবে এই ধর্মান্ধ এবং মডারেট শিক্ষিত এক শ্রেণী সবসময়ই একটা অভিযোগ থাকে সমকামিতা আধুনিক, পুজিবাদী ষড়যন্ত্র, অপ্রাকৃতিক। কিন্তু তারা জানেনা প্রাচীন পৃথিবীর এমন কোন সভত্যা নেই যেখানে সমকামিতার প্রচলন ছিলোনা। গুহাচিত্র, মানুষের শিল্পকলায়, সাহিত্যে, কবিতায় আছে সমপ্রেমের জয়জয়কার। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজ-রাজা, ধর্মীয় গুরুরাও সমকামিতায় লিপ্ত থাকতো। লেখাটার উদ্দেশ্যই হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌছানো যে সমকামিতা নতুন কিছু না, সমকামিতা সব যুগেই সবকালেই বিদ্যমান ছিলো। এর অস্তিত্ব সৃষ্টির আদি থেকে, মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝেই এর অস্তিত্ব আছে।
বর্তমানে আফ্রিকাতে সমাকামিতা বৈধ আছে ২২ টি দেশে বাকি গুলোতে এর বৈধতা নেই। আফ্রিকার বেশিরভাগ ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে সমকামিতার শ্বাস্তি মৃত্যুদন্ড। সম্প্রতি সময়ে আফ্রিকার বেশকিছু দেশের রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন সমকামিতা আফ্রিকার সংস্কৃতির সাথে সামনযস্য নয়। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে অন্য কথা। জিমবাবুয়ের একটি গোহায় সান-বুশম্যান মানুষদের দ্বারা চিত্রিত কিছু ছবি দেখা যায়, যা কমপক্ষে দুই হাজার বছর আগে আঁকা হয়েছে। কানাডার কুইন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ম্যাক্স এপপারচিট তার হুগানটি: দ্যা হিস্টোরি অব দ্যা ডিসিসডেন্ড সেক্সুয়ালিটি ইন দক্ষিণ আফ্রিকা বইয়ে সান-বুশম্যানদের একটি চিত্রকে সমকামিতার উদাহরণ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন যেখানে তিনজন পুরুষ পায়ু যৌনসঙ্গমে লিপ্ত ছিলো, আরো দুটি পুরুষ যেখানে একজন অন্য আরেকজন পুরুষের লিঙ্গ মুখে দিয়ে মুখমৈথুনে লিপ্ত আছে।
বর্তমানে যেমন সমকামিতাকে অস্বাভাবিক ভাবা হয়।সমকামিদের অনেকটা অবহেলা করা হয় স্বাভাবিক জিবন থেকে একঘরে করে রাখা হয় তেমনি ভাবে কেনিয়ার মোজাম্বি, ব্যুরো এবং নু্য়্যার সম্প্রদায়ের বিষমকামিতাকে অস্বাভাবিক ভাবে দেখা হয়। বিষমকামিতা সেখানে অনেকটা নিষিদ্ধ,বিষমকামিতায় লিপ্ত থাকলে তাদেরকে একঘোরে করে রাখায় হয়। সেখানে বিষমকামিতা শুধু সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রেই প্রোযজ্য তবে সেই সঙ্গমও আড়ালে লুকিয়ে করতে হয়।
নিডহামের বর্নণা অনুসারে, কেনিয়ার মেরু সমাজেও সমকামিতা প্রচলিত ছিলো। সেখানকার ধর্মীয় নেতা যারা হতেন, তাদেরকে মুগাওয়ে বলা হত। এই মুগাওয়ে বেশিরভাগ সময়ে সমকামী হতেন এবং কখনো কখনো পুরুষকে বিবাহ করতেন। এবং এই বিয়েকে অনেক সম্মানের সাথে দেখা হতো।
উত্তর কঙ্গোতে একধরনের প্রথা ছিলো যা এখনো প্রচলিত আছে। বিবাহযোগ্য পুরুষেরা কোন রমনিকে বিয়ে করার আগে অল্পবয়সী যুকব কিংবা কিশোরদের সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়, এবং পরবর্তীতে গিয়ে কোন মেয়েকে বিয়ে করার অনুমতি পায়।
সমকামিতার নিদর্শন আফ্রিকার অন্যতমদেশ প্রাচীন মিশরেও দেখা যায়। মিশরে সমকামিতা মিশরীয় ত্বাত্তিক ও ইতিহাসবেত্তাদের জন্য অনেকটা বিতর্কিত বিষয়। এটা এখনো সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় নি যে, কিভাবে প্রাচীন মিশরীয় সমাজে সমকামিতাকে দেখা হত। এই বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ জল্পনা কল্পনা এবং গুজব প্রচলিত।
তবে ব্যতিক্রম আছে প্রাচীন মিশরের রাজবংশের ২ জন সরকারী কর্মকর্তা নায়ানখ-খুনুম এবং খুনুম হটেপ এর ক্ষেত্রে। উভয় পুরুষই ফারাও নিউসেরের অধীনে ৫ম রাজত্বে (আনুমানিক ২৪৯৪–২৩৪৫ খ্রিষ্ঠপূর্ব) কাজ করতেন।নিয়ানখ খুনুম ও খুনুম হতেপের নিজেদের পরিবার ছিল, সে পরিবারে সন্তান ও স্ত্রীও ছিল। কিন্তু যখন তারা মারা যান, অনুমান করা যায়; তাদেরকে একত্রে এবং একই মাসাটাবা সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়। এই সমাধিতে বেশ কিছু চিত্র ছিল, যেখানে দেখা যায়, এই দুইজন পুরুষ একে অপরকে আলিঙ্গন করছে, মুখে মুখ ও নাকে নাক ঘষছে। এই চিত্রাঙ্কন অনেকটা সমকামিতার নিদর্শন বুঝায় কারণ প্রাচীন মিশরে নাকের সাথে নাক স্পর্শ করাকে চুম্বনকে বুঝানো হত।
উগান্ডার “নীলটিকো লাঙ্গো” সম্প্রদায়ের মধ্যে একধরনের লিঙ্গ ব্যাবস্থা প্রচলিত ছিলো। যারা পুরুষ এংব নারী কিছুইনা। অনেকটা আমাদের উপমহাদেশের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের মতো। এরা ‘মুকোডা ডাকো’ নামে পরিচিত ছিলো। এরা অনেকটা নারী বেশে থাকতো এবং পুরুষদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো।
গ্যাবন এবং ক্যামেরুনের বান্টুভাষী পাহহাইন কৃষকদের মাঝেও সমকামি যৌন প্রবনতা স্বাভাবিক ভবেই দেখা যায়।
ইথিওপিয়া বাইবারে সমকামিতার বিরোধিতা করা হয়। সেমিটিক হারারী মানুষদের কাছে সডোমী অপরিচিত ছিলোনা। কিন্তু সমকামিতার চর্চা গাল্লা এবং সোমালীতে করা হত। এই সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরের হস্তমৈথুন করত।(আমাদের দেশেও গ্রামঅঞ্চলের দিকে ছেলেরা খুব সাধারণ ভাবে একে অপরকে হস্তমৈথুন করে দেয়, কিন্তু এটা অসেচেতন ভাবে।) #গ্যামস্ট উল্লেখ করেন মধ্য ইথিওপিয়ার কুশিটিক ভাষী মেষপালক কেমেন্টদের মধ্যে সমকামী সম্পর্কের প্রবণতা ছিল। এমহারা রাজ্যে পুরুষদের মধ্যে বেশ্যান্তর করার প্রবণতা ছিল।(এই প্রবণতা আমাদের উপমাহাদেশেও আছে) তারা একে “ঈশ্বরের ভুল” হিসাবে দেখত। ডোনাল্ড ডনহামের মতে উত্তর ইথিওপিয়ার মালেদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষেরা নারী ভূমিকা পালন করত। তারা জৈবিকভাবে পুরুষ হলেও, নারীদের ন্যায় পোশাক পরিধান করত, নারীদের কাজ করত, নিজের ঘরের খেয়াল রাখত, এমনকি পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কেও জড়াত।
বলতে গেলে প্রাচীন আফ্রিকার জীবন ও সংস্কৃতির সাথে সমকামিতা ঘনিষ্টভাবেই জড়িত ছিলো।
চলবে……