
লেখক: নাহিদ রাজ
উৎসর্গ: সায়ন
হারিয়ে ফেলবো কি তোকে? নাকি অদেখা সুখ সহ্য হচ্ছেনা আমার? আমার পোড়া কপালের জন্যই কি তুই চলে যাচ্ছিস না ফেরার দেশে?…
চরম উত্তেজনায় কাঁপছি, ঘামছি, ভাবছি অলুক্ষনে সব কথা। দুর্ভাগ্যকে ভুলেই গেছিলাম। কিছু মানুষ থাকে যাদের ভাগ্য বিধাতা সৃষ্টি করেছেন শুধু কষ্ট দিয়ে। বলা চলে, কষ্ট দিয়ে মোড়া এক যান্ত্রিক জীবন। চাইলেও যেন মোড় ঘোরানো যাবেনা সে জীবনের।
রাজশাহী মেডিকেল। বিশাল বারান্দা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে। সেই রাত ২ টা থেকে কতবার যে একমাথা থেকে আরেকমাথা চক্কর দিলাম কে জানে? ভেতরে হয়তো অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে সে! আমার আপন।
-দোস্ত, কি অবস্থা?
আরিফের গলা শুনে ফিরে তাকালাম করিডরের শেষ মাথায়, যেখান থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচ তলায়। আরিফ আমাদের ক্লাসমেট।
-কিরে, অমনভাবে তাকিয়ে আছিস? কি হইছে? ডাক্তার বের হইছে?
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুরু বোবার মত হুহু শব্দ করে অপারেশন থিয়েটারটার দিকে তর্জনি ইশারা করলাম।
-সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।
সহানুভূতি ভরা হাতটা আমার পিঠ চাপড়ে দিলো আলতো ভাবে। আর পারলাম না। সারারাতের অস্থির পায়চারি আর অসহ্য টেনশন সহ্য করতে না পেরে টলে উঠলাম। আরিফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধড়াম করে পড়ে গেলাম কংক্রিটের শক্ত মেঝেতে। চোখ বোজার আগ মুহুর্তে দেখলাম আরিফের আতঙ্কিত মুখ।
আমি ঐশ্বর্য্য। রাজশাহীর ছোট্ট এক গ্রামে আমার জন্ম। মা আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে প্রান হারায়। তাই, মা কি আমি জানিনা, বুঝিনা। মা বলতে আমার কাছে সন্তানদের মধ্যে ফারাক সৃষ্টিকারী। আমার বাবা তখন নাকি সবে কয়েকবছর হলো বিয়ে করেছে। মা মারা গেল। রেখে গেল আমাকে। বাবা নিজের জন্য হোক বা আমার জন্য, এক ধনাঢ্য বিপত্নীক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন দ্বিতীয়বার। সেই মহিলার ছিলো আগের পক্ষের এক ছেলে। সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা! সৎমা পারেনি আমার মা হয়ে উঠতে। আমি পাইনি মায়ের আদর, বাবার ভালোবাসা। বাবা বেচারা সৎ মার ভয়ে যতটা সম্ভব আমার থেকে দূরে থাকতেন। তিনি আমার অভাব রাখতেন না। স্কুলে কিছু খাবার নিয়ে আমার আগে গিয়ে বসে থাকতেন। আমি যেতেই আমার কি দরকার সুধাতেন। আর স্কুল জীবনেও পাইনি ভালো কোন বন্ধু!
সবে তখন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। ভাগ্য যেন চরম দুর্দিন নিয়ে এলো। মাথা থেকে সরে গেল ছাত স্বরুপ আমার বাবা। জানি তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আমার নামে কিছু জমিজমাও লিখে দিয়ে গেছিলেন।
আপন আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। আমার অর্ধাঙ্গ। যখন সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়, তখন আপনের দুয়ার খুলে যায় আমার জন্য। ছোটবেলা থেকে কিছুটা মেয়েলিপনা ছিলো আমার মধ্যে। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ক্লাসমেট, আমি ছিলাম তাদের একমাত্র হাসির জোগানদাতা। পাড়ার বড় ভায়েরা শরীরে হাত দিতেন, জোর করে জড়িয়ে ধরতেন। আমার পক্ষে বিচার করার কেউ ছিলোনা। তাই মায়ের কথিত কবরের পাশে বসে চোখের জল ফেলতাম।
বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠিনি তখনো। জোর করে সব দখল করে সৎমা বের করে দিলেন বাড়ী থেকে। নিরুপায় হয়ে যখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন নিজের বাড়ীতে জায়গা দিয়েছিলো আপন। তার মা বাবাও আমাকে
আপন করে নিয়েছিলেন। আমি তখন নব তরুন। এই বয়েসে ক্লাসের কিছু কিছু ছেলের একাধিক গার্লফ্রেন্ড। আমার কোন গার্লফ্রেন্ড ছিলোনা। থাকবে কেন? এদিকে আপন এতটাই সুন্দর, মেয়েরাই ওকে প্রোপোজ করতো। আমি দেখতাম, কোন মেয়ে ওকে প্রোপোজ করলে ও শুধু আমার দিকে একবার তাকিয়ে মেয়েটাকে অগ্রাহ্য করতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো, আমি অন্য কারো হয় গেলে তোর কি হবে? আমি চাইলেও তখন আর কিছু বলতে পারতাম না।
ভালোভাবেই ইন্টার পরীক্ষায় সফল হলাম।
মনে পড়ে, সে জোর করেই, নিজের খরচে আমাকে নিয়ে শহরে গেলো। কাকতালীয়ভাবে রুয়েটে চান্স পেলাম দুজনেই। আমার আর তার বলা চলে, ছোট্ট একটা সংসার হলো। দেখতে দেখতে একটা সেমিষ্টার শেষ করে ফেললাম। সত্যিই সুখের দিন খুব দ্রুত শেষ হয়। সপ্তাহে প্রায় চারটা রাত আমি ঘুমাতে পারতাম না। মা- বাবা আমার কেউ নেই। মনে হতো তাদের কথা। খুউব যখন কাঁদতাম, আপন বুকে জড়িয়ে রেখে বলতো, “আমি কি তোর কেউ না?” শুনে বাচ্চাদের মত শব্দ করে কেঁদে দিতাম।
সন্ধ্যায় পদ্মা গার্ডেনে হাত ধরে হেঁটে যেতাম। মুক্ত মঞ্চে বসে আকাশের তারা গুনতাম। যখন পদ্মার পানি উপচে উঠলো। টি বাঁধে গিয়ে পানির স্রোত দেখে আপনকে কিভাবে জড়িয়ে ধরেছিলাম ভাবলেও গাল লজ্জায় লাল হয় এখন। ছোট ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে আমার কাণ্ড দেখছিলো।
ভালোই ছিলাম। ক্যাম্পাসে কত মেয়েকে আপন রিজেক্ট করেছে হয়তো নিজেও জানে না। এসব দেখে যখন বলতাম, আমাকে কি ভালোবাসিস?
সে হেসে বলতো, বাসি।
আমি বলতাম। সিরিয়াস প্রেম??
ও বলতো, পাগল। ছেলে ছেলে আবার কিসের সিরিয়াস প্রেম?
আমি উত্তর দিতে পারতাম না। কারণ আমিও জানিনা ছেলে ছেলে আবার কিসের প্রেম?
সে জড়িয়ে নিতো, বলতো, ভালোবাসার থেকেও বেশি কিছু। তার বুকের উষ্ণ পরশ আমাকে পাগল করে দিতো। দিন যাচ্ছিলো। সে একসময় আমার ঠোঁটে চুম্মা দেয়া শুরু করেছিলো। আমি মানা করতাম না। হয়তো আমি চাইতাম। তবুও বলতাম, কেন ঠোঁট কামড়াস?
তার সোজাসাপ্টা জবাব, তুই কিউট তাই!
একবছরে কোন ঝগড়া হয়নি আমাদের। এইতো সেদিন, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আপনের সেকি কাণ্ড! রাতে জ্বর বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তারকে বাসা থেকে কিডন্যাপ করে এনেছিলো। সারারাত আমার শিওরে বসে থেকে যখন সকালে চোখ মেললাম, তার পরিশ্রান্ত লাল চোখ কিন্তু আবার ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসি আমার সব অসুখ যেন ভালো করে দিলো।
কয়েকদিন থেকেই তাকে অন্যমনষ্ক দেখে যখন জিজ্ঞেস করলাম। সে কিছুই বলল না। হাসি দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা চালালো। জানে মিথ্যা বলতে পারেনা তাও কেন এত অপচেষ্টা অবাক হয়েছিলাম। তার বাবা সেদিন বিকালে ফোন করে বললো, তারা আপনের বিয়ে দিতে চায়। ওর মায়ের ডায়াবেটিকস প্রচণ্ড বাড়তি। ছেলের বৌয়ের মুখ দেখে চোখ বুজতে চান। পড়াশোনা অনেক হয়েছে। বিয়ের পরেও তো মানুষ পড়ে। এমন তো না চাকরি না করলে ওর ভাত জুটবেনা। কিন্তু আপন নাকি বিয়েতে অমত করছে। আমি যেন তোকে বোঝাই। এ বিষয়ে অনেক অনুনয় করলেন। তারাও আমার জন্য অনেক করেছে। তাই আমি প্রত্যুপকারে বাধ্য।
আমার মাথায় থেকে থেকেই চক্কর দিচ্ছিল। সেদিন মনে হচ্ছিল, সত্যিই তো, আপন অন্য কারো হয়ে গেলে আমার কি হবে? তাকে আড়াল করে অনেক কেঁদেছিলাম। পরে ভেবেছিলাম, সত্যিই আপন আর তার মা বাবা অনেক করেছে, এবার তাদের জন্য আমার কিছু করা দরকার। মনস্থির করে আপনকে অনেকভাবে বোঝালাম। তার এক কথা, বিয়ে করবেনা।
শেষে না পেরে বললাম, বিয়ে না করলে আমার মরা মুখ দেখবি।
একথা শুনে চোখ লাল করে আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলো ব্যাগ গুছিয়ে। দরজা ভেজানোর আগে বললো, তুই যা চাস!
অস্ফুট কষ্ট যেন বুক ফেটে বের হচ্ছিল। আচ্ছা, আমার সাথেই কেন এরকম হয়? রাত করে বেশ কয়েকটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ গভীর রাতে
ফোন বাজলে আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে ফোন রিসিভ করতেই শরীরটা এতই হাল্কা অনুভূত হলো, যেন পৃথিবীর সমস্ত শূণ্যতা ভর করেছে আমার উপর। ঔষধের রিএ্যাকশন।
-হ্যালো..
-ঐশ্বর্য্য বলছিলেন?
-জ্বি..
তারপর যা শুনলাম শরীরে তীব্র কাঁপুনির জন্য অতটুকুই যথেষ্ট ছিলো। শরীরে কোনোরকম কাপড় জড়িয়ে ছিটকে বের হলাম বাসা থেকে।
বাসায় যেতে পারেনি আমার আপন! বাস অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে। তার
অবস্থা মারাত্মক! মাথায় আঘাত পেয়েছে। রক্ত বের হয়েছে অনেক! অনেক চেষ্টার পর ব্লিডিং বন্ধ করা গেছে। এইরাতে আমি সব ফেলে চলে এসেছি ওটির সামনে।
জ্ঞান যখন ফিরলো, আমিতো কেঁদেই কুল করতে পারছিনা। শুনলাম ওর জ্ঞানও
ফিরেছে। বাবা মা এসেছে। ওদের অবস্থা দেখে তো আমি বোবা বনে গেলাম। সকালে যখন ওটি থেকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হলো। আপন বলল, ঐশ্বর্য্যকে একা আসতে দাও!
-কিরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস যে?
ধীর পায়ে তার সামনে দাড়ালে আমার হাত ধরে বিছানার পাশে বসালো আপন। আমি মৃদু কাঁপছি। ভয়ে না শারীরিক অবসাদে ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না। শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছিল।
-দেখলি, তুই আমাকে ছেড়ে দিলে মৃত্যু আমাকে গ্রহন করবে?
সশব্দে কেঁদে জড়িয়ে ধরলাম আপনকে। মাথা পেচানো মমিটাকে খুব নিস্পাপ লাগছিল।
-আমি জানিনা ছেলে ছেলে প্রেম হয় কিনা, কিন্তু আমি তোকে ভালোবাসি ঐশ্বর্য্য।
-আমিও।
-কথা দে আর কখনো ছেড়ে যেতে বলবি না।
-বলবোনা।
সারাটা দিন আপনের পাশে বসে আছি। দিনটা পার হলো। আপনকে ঘুমানোর সুযোগ দিতে বলা হলো। আমিও আপনের আদেশে খেয়ে একটা ঘুম দিলাম।
পরদিন সন্ধা নামলো। বৃষ্টি নামলো। আপনকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। সারাটা রাত ঝুম বৃষ্টিতে গল্প করলাম। ঠিক করলাম আপন সুস্থ হলে নীলগিরিতে গিয়ে একসাথে মেঘ ছোঁবো।
রাত পেরিয়ে দিন হলো। বৃষ্টি শেষে প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিলো সাতরঙা রঙধনু। আশা করছি সাতরঙে ছেয়ে থাকবে আমাদের সাতরঙা ভালোবাসা। অমর প্রেমের বসবাস হবে সাতরঙের ঠিকানায়। আমার জীবন, আমার মরণ সবই আপন। জানি পরিপূর্ণ প্রেমের কাহিনীগুলো কখনই গল্প বা ইতিহাসের পাতায় জায়গা পায়না। তবু আনন্দ, যাকে চেয়েছি তাতে তো পেয়েছি। কয়টা ভালোবাসার এমন হ্যাপি এন্ডিং হয় বলুন?
সমপ্রেমের গল্প ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত