
পহেলা বৈশাখ, ১৪২১।
প্রতিবারের মতো এবারো ঢাকা চারুকলার সামনে লোকসমাগম ভোর বেলা থেকেই। এখান থেকেই প্রতি বাংলা বছরের প্রথম দিনে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানান প্রতীকী উপকরণ, রঙিন মুখোশ, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি ইত্যাদি নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। এবারে তার সাথে আরও একটু ভিন্ন কিছু যোগ হয়েছিল। ঘড়িতে তখন বাজছিল সকাল সাড়ে নয়টা। শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে সবেমাত্র। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলছে শোভাযাত্রা। হঠাৎ ছবির হাট থেকে বেরিয়ে এলো ছয়রঙবিশিষ্ট এক রংধনু মিছিল। এক একটি সারি রঙধনুর এক একটি রঙে অর্থাৎ বেগুনী, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রঙে রঞ্জিত। প্রতিটি সারিতে ছয়টি রঙের কাপড় পরা পুরুষ, নারী ও হিজড়াদের উচ্ছ্বাস ছিল লক্ষণীয়। প্রত্যেকেই পরনের কাপড়ের রঙ অনুযায়ী হাতে বানানো কাগজের কিছু উপকরণ যা কিনা বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরে যেমন ইলিশ মাছ, আমপাতা, কলাপাতা, প্রজাপতি, ফুল ইত্যাদি হাতে বহন করছিলেন বা মাথায় পরেছিলেন। সবার হাতে আরও ছিল রঙ অনুযায়ী কয়েকটি করে বেলুন যা এই রঙের মিছিলকে আরও রাঙ্গা করে তুলেছিল। পাশের সারির মানুষের হাত ধরে এগিয়ে চলছিল সকলে শোভাযাত্রার ঠিক পিছন পিছিন।
আশেপাশের মানুষের জন্য পুরো বিষয়টি ছিল এক অপ্রত্যাশিত চমক, তারা অবাক এমন একটা রঙিন মিছিল, রঙের উৎসব দেখে। র্যালির রঙে অনেকেই আগ্রহ নিয়ে যোগ দিয়েছিল, হাত হাত রেখে উচ্ছ্বাস ও আনন্দের সাথে এগিয়ে চলেছিল। আশেপাশের পরিবেশ তখন একইসাথে উৎসবমুখর ও রহস্যময়। কেউ জানে না কারা করছে এই মিছিল কিংবা কেন করছে? আর র্যালির অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের পরিচয় নিয়ে ছিল না কোন দ্বিধা, তারা সমপ্রেমী নাকি বিষমপ্রেমী নাকি হিজড়া তা নিয়ে ছিল না কোন মতভেদ। সবকিছুর উপরে তারা মানুষ এই মূলমন্ত্রকে অকপটে স্বীকার করে মাথা উঁচু করে, গৌরবের সাথে এগিয়ে চলেছিল র্যালি। মূল শোভাযাত্রার পেছন পেছন র্যালিটি রূপসী বাংলা হোটেল মোড় ঘুরে শেষ হয় শাহবাগ মোড়ে, সবার বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিয়ে।
বেলা ১২টায় ‘রূপবান – The Fagazine’ এর অফিসিয়াল পেইজে ছয়রঙা এক ছবি পোস্ট করা হয়। ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘বাংলা বছরের প্রথম দিনটি উদযাপিত হয়ে গেল রঙধনুর রঙে। বন্ধুত্ব, বৈচিত্র্য আর ভালোবাসায় শুরু হলো ১৪২১। শুভ নববর্ষ’।
সঙ্গে সঙ্গেই নিরীহ বিষয়টি ভয়াবহ রূপ নিল। সবার মধ্যে একটি ভুল ধারণা জন্ম নিলো, সকালের সেই রঙিন র্যালি ছিল সমকামীদের র্যালি। পাশ্চাত্য দেশগুলোর অনুকরণে সমকামীরা ‘Rainbow Pride’ উদযাপন করেছে, শাহবাগে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খবরের কাগজ ‘কালেরকন্ঠ’ পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে খবরটি আসে এইভাবে :
‘রূপবান’ নামের একটি ফেসবুক পেইজে দাবি করা হয়েছে, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাজধানীতে প্রথম প্রকাশ্য শোভাযাত্রা করেছে সমকামীদের একটি দল।
আরও জানা অজানা, বিখ্যাত কুখ্যাত বিভিন্ন অনলাইন নিউজে খবরটি ঢালাও ভাবে প্রকাশ হয়। বিদেশি কিছু অনলাইন নিউজে ব্যাপারটাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করলেও দেশি অনলাইন নিউজগুলো নেতিবাচকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে সবার কাছে খবরটি উপস্থাপন করে। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ব্লগ এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে র্যালি নিয়ে আপত্তিকর কথা, নোংরা ভাষায় র্যালির বিরুদ্ধে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। প্রকৃত ঘটনা কি, র্যালির প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা সম্পর্কে একটি দেশীয় পত্রিকাও রূপবানের কাছে সঠিক তথ্য চায়নি। এতে র্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের সম্মুখীন হতে হয়েছে নানান বিব্রতকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির।
রূপবানের তত্ত্বাবধানে র্যালিটি সম্পন্ন হলেও এটি মোটেও সমকামীদের র্যালি কিংবা প্রাইড র্যালি ছিল না। র্যালির সারকথা ছিল ‘বন্ধুত্ব ও বৈচিত্র্য’। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশেরর ছয়টি ঋতুকে ছয় রঙে রাঙা র্যালির মাধ্যমে উপস্থাপন করা। র্যালির মাধ্যমে সকল শ্রেণির মানুষ হাত হাত রেখে সুন্দর – সাবলীলভাবে, সম্প্রীতি বজায় রেখে বাংলা সংস্কৃতি তুলে ধরাটাই এর মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ভুল ব্যাখ্যার কারনে মানুষ সঠিকভাবে ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি।
দৃঢ়ভাবে বলা যায়, পাশ্চাত্য কোনো রীতিকে তুলে ধরা হয় নি এই র্যালিতে। আমরা বন্ধুত্ব ও বৈচিত্র্য উদযাপন করেছি ছয়টি রঙের সমন্বয়ে।
‘রূপবান’ শুধুমাত্র সমপ্রেমকে সমর্থন করে তা নয়, রূপবান সর্বরকমের প্রেমকে সমর্থন করে। ‘রূপবান’ মানেই ‘সমকামী’ ম্যাগাজিন নয়, রূপবান সকলের কথা বলে।
রূপবান ভালোবাসার ফেরিওয়ালা।
বিশেষ টীকাঃ লেখক তৎকালীন রূপবান ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালে রূপবান ম্যাগাজিনের ৩য় সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। ‘মন্দ্র’ এর অনুমতি ছাড়া এই লেখাটা পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।