
লেখক ঃ- অরণ্য রাত্রি
এক
আজকে আমাদের বন্ধুত্বের ১ বছর পূর্তি হবে।অথচ আজই আমাদের বন্ধুত্বের শেষ দিন হতে যাচ্ছে। আর আরেকটা কাকতালীয় ব্যাপার আজকে আমার জন্য খুব বিশেষ একটা দিন। কারণ আজ পহেলা আষাঢ়। বর্ষার প্রথম দিন।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু নীল। অথচ তার সাথেই আজকে বন্ধুত্ব শেষ করে দিবো।কারণ আমি তাকে ভালোবাসি। শুধু ভালবাসি বললে ভুল হবে। তীব্র ভাবে ভালবাসি। ভালবাসি অথচ বন্ধুত্ব শেষ করে দিচ্ছি কেন?বরং আমার তো উচিত তীব্র ভালবাসা দিয়ে তার জীবনকে পরিপূর্ণ করে দেয়া।তাহলে আমি কেন এমন করছি? কারণ আমি কক্ষনোই তার ভালবাসার মানুষ হতে পারবো না। তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আজ তার গায়ে হলুদ। আমিও নিমন্ত্রিত।
দুই
বর্ষার প্রথম দিনে গত বছর আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা ।বর্ষার প্রথম দিন হলেই কি বৃষ্টি হতে হবে? এমন কোন নিয়ম আছে কি? সেদিন আকাশটা ঘন কালো হয়ে ছিল।আমার সাথে নীলের সেদিন প্রথম দেখা। আকাশের অবস্থা দেখে বের হব কিনা ভাবছিলাম।দেখা করবো শাহবাগে। আমার বাসা কাছেই কিন্তু নীল বেশ দূরে থাকে। বৃষ্টি পরলে তো আটকে যাবে এই কথা বলতেই নীল হেসে বলল
– বৃষ্টি পরলে তো ভালই। বেশ ভেজা যাবে।
– বৃষ্টি তে ভেজার এত শখ
– শখ মানে ? বৃষ্টি আমার অসম্ভব প্রিয়। কেন তোমার বৃষ্টি ভাল লাগে না?
– ভাল লাগে না মানে? রিকশায় হুড তুলে বৃষ্টি তে ভেজার মজা যে কি তা আমার থেকে আর কে ভাল জানে?
টিপ টিপ বৃষ্টি পরছে আমি বাস স্টপে দাঁড়িয়ে। কিন্তু নীলের দেখা নেই। আকাশের রঙ ধুসর থেকে কালো বর্ণ ধারণ করেছে।সকাল বেলা কে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।মেঘ ডাকছে।ব্যাঙ ও ডাকছে কোথায় জানি। যে কোন সময় জোরে বৃষ্টি শুরু হবে। কিন্তু নীলের দেখা নেই। বাস আসে, বাস যায়। কিন্তু নীল কোথায় ?হটাত একটা বাস এসে থামতেই পাঞ্জাবি পরা কিউট একটা ছেলে বাস থেকে নামলো। ভাল মত তাকিয়ে দেখলাম আরে এই তো নীল। ও আগেই আমাকে ছবি দিয়েছিল।তাই দেখেই চিনতে পারলাম। আর তক্ষুনি ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি।
বাস স্টপের ছাউনির নিচে দুইজন দাঁড়িয়ে আছি। ফোনে কত কথা হয়। অথচ এখন দুইজনের কেউই কথা বলছি না। ছাউনির নিচে প্রচুর মানুষ। তাই হয়তো কথা বলতে লজ্জা লাগছে। এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই। দুই জনেই বৃষ্টি এত ভালবাসি। কিন্তু কেউই বৃষ্টি তে ভিজছি না। আসলে এত মানুষের সামনে এই ঝুম বৃষ্টি তে ভেজা সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির তীব্রতা কমলো। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা এখন আর পরছে না। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরছে। প্রথম নীরবতা ভাঙলও নীল
– বৃষ্টি তো এখন থেমেছে। সামনে এগোই চল।
– চল
রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পরছে মাথার উপর। আস্তে আস্তে আমাদের জড়তা ভাংছে। নীল বকবক করছে। ফোনে যেমন করে। আর আমিও কম যাচ্ছি না।এই কথা সেই কথা ,নানা কথা বলছি। হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি তে চলে আসলাম। চা খাবো। আসে পাশে অনেক মানুষ ।মেয়ে রা বেশিরভাগ শাড়ি পরা। নীল শাড়ি।মাথায় ফুল। দুটো পিচ্চি মেয়ে কদম ফুল বিক্রি করছে। টিএসসির এক পাশে চা বানাচ্ছে। আমরা ২ জন রঙ চা নিলাম।বৃষ্টি হওয়ায় ঠাণ্ডা পরে গিয়েছে। চা খাওয়ার পর বেশ ভাল লাগছে। পাশেই একদল ছেলে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। সব বৃষ্টির গান।
মন মোর মেঘেরও সঙ্গী …………।
আকাশে মেঘ আবার গর্জন করা শুরু করেছে। আবার মুশলধারে বৃষ্টি নামবে হয়তো।ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। একটা পরিপূর্ণ বর্ষার প্রথমদিন।
একটা রিক্সা নিলাম। আজ বৃষ্টির মাঝে রিক্সা নিয়ে ঘুরবো। এটাই আমাদের পরিকল্পনা।রিক্সায় বসে ইচ্ছে করছিল নীল এর দিকে তাকাই।কিন্তু কেমন যেন লজ্জা লাগছে। আচ্ছা ওর কি এমন লাগছে? মনে হয় না। কেমন বক বক করছে। বোরিং রাজনীতির আলাপ শুরু করেছে।নিউমার্কেটের সামনে আসতেই আবার বৃষ্টি শুরু হল । সেই আগের মত।রিকশাওয়ালা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল
– মামা পর্দা দেই?
আসলে যেভাবে বৃষ্টি নামছে পর্দা না নিয়ে উপায় নেই। বৃষ্টি-বিলাস করতে চাই। কিন্তু এত বৃষ্টি তে না। কারন আমাদের কাছে বাড়তি পোশাক নাই। হয়তো আমরা বেরসিক তাই ভিজলাম না। অবশ্য কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি-বিলাসের সুযোগ পেলাম। বৃষ্টি তীব্রতা কমলো। পরদা রেখে আর হুড তুলতে বলল নীল
– মামা পর্দা নেন আর হুড তুলে দেন
রিকশাওয়ালা আমাদের দিকে এইভাবে তাকালও মনে হয় কোনদিন এত অদ্ভুত কথা সে শোনে নাই।
– মামা ভিজে যাইবেন তো।
– ভিজতেই তো চাই।
রিকশাওয়ালা আর কথা বাড়ালও না। পাগল ঠাউরেছে সম্ভবত। আমি আমার হেঁড়ে গলায় গান ধরলাম
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে………।
নীলও আমার সাথ গলা মেলালও। রাস্তায় রংবেরঙের ছাতা হাতে মানুষ ।আর ছাউনি গুলোর নিচেও অসংখ্য মানুষ। রিকশা গুলোতেও নানা রঙের পর্দা লাগিয়ে অনেকে যাতায়াত করছে। আর বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ তো রয়েছেই।
সামনেই রেস্টুরেন্ট পড়লো একটা। খুব ক্ষুধা লেগেছে। নীল বায়না ধরেছে ভুনা খিচুরি খাবে। এমন দিনে নাকি খিচুরি খেতে হয়। ওর কথা শুনে আমারও খেতে ইচ্ছে করছে। রিক্সা থেকে নামার পর আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো নীল।
– কি হল
– তুমি তো পুরো কাক ভেজা হয়ে গিয়েছ
– ও এই ব্যাপার? তুমি নিজেকে দেখেছো ?ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছ
আমরা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। আমাদের যা অবস্থা। এরকম ভেজা অবস্থায় বসতে দিবে তো রেস্টুরেন্টে? বসতে তো দিলই। উলটা একটা স্ট্যান্ড ফ্যান রেখে গেলো আমাদের শুকানোর জন্য। চিকেন খিচুরি অর্ডার দিলাম। খেয়ে বের হতেই দেখলাম কোথায় বৃষ্টি ?বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। এখন শুকনো খটখটে রোদ।বিকেলে গেলাম ছায়ানটে। ওখানে বর্ষা বরণ উৎসবে।বর্ষার গান আর ধ্রুপদী নাচ দিয়ে বর্ষা বরণ করা হল।বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো।এখন আবার মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। রাত্রে বৃষ্টি হবে। সারাদিন অসংখ্যবার তার হাত ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সুযোগ পেলাম একদম শেষ মুহূর্তে। হ্যান্ড সেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমার আর তার হাত ছারতে ইচ্ছা করছে না। নীল হেসে দিল। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম
– তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না
– কিন্তু যেতে হবে। এটাই জগতের নিয়ম। যেতে নাহি দিবো হায়। তবু চলে যেতে হয়। এনিওয়ে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা দিন উপহার দেয়ার জন্য।
আমি মৃদু হাসলাম।কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আমি যেভাবে ওকে অনুভব করছি সে সেইভাবে করছে না।বাড়ি ফিরলাম অসম্ভব সুন্দর স্মৃতি নিয়ে কিন্তু সাথে সাথে মন খারাপ।কেন যেন মনে হচ্ছে সে আমাকে আর দশটা বন্ধুর থেকে আলাদা কিছু ভাববে না। রাতে বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছি। মেঘ ডাকছে। আবার বৃষ্টি পরবে । কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শুরু হল।বৃষ্টির ছিটা এসে গায়ে লাগছে। আর আমার মাথায় আসতে লাগলো এলোমেলো সব চিন্তা।প্রতিটা চিন্তা নীল কে নিয়ে। আমি আসলে একদিনেই নীল কে অনেক পছন্দ করে ফেলেছি। কিন্তু নীল কি করেছে?মনে হয় না।
তিন
কিছুদিন অতিবাহিত হল।এখন আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছি।একেবারে তুইতোকারি সম্পর্ক ।আমি নীল কে কিন্তু ভালবেসে ফেলেছি।কিন্তু একটা ব্যাপার আন্দাজ করছি। তা হল নীলের ভালবাসা আমি পাবো না।অবশ্য আমি তাকে আমার ভালবাসার কথা বলিও নাই। তাতে যদি আমার সাথে তার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? না এই ঝুঁকি নেয়া যাবে। ভাল না বাসুক। অন্তত বন্ধু হিসেবে তো পাশে আছে। প্রতিদিন কথা হচ্ছে, চ্যাট হচ্ছে। প্রায়ই দেখা হয়। এইবা কম কি?
বহুদিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। আমি আর নীল ঠিক করলাম চট্টগ্রাম যাবো। উত্তাল সমুদ্রে পা ভেজাবো। আমাদের প্রথম একসাথে ঢাকার বাইরে ভ্রমণ। ঠিক করলাম ট্রেনে যাবো।শ্রাবণ মাস। সবাই অবাক। এই সময় তো চট্টগ্রামে বৃষ্টি থাকবে। এখন কেন যাচ্ছি? সবার একই প্রশ্ন। কিন্তু আমাদের যে বৃষ্টিই ভাল লাগে। সন্ধ্যায় ট্রেন। কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছতে না পৌঁছতে বৃষ্টি শুরু হল। দুজনেই ভাবছি ভুল করলাম নাকি এই সময় চট্টগ্রাম যাওয়ার পরিকল্পনা করে। যতই বৃষ্টি ভালবাসি একদম ঝুম বৃষ্টি তে কি ঘুরাঘুরি হবে? পর মুহূর্তেই মনে হল বৃষ্টি হলে ঘুরাঘুরি হোক বা না হোক আমার ভাল লাগবেই।
ট্রেনে উঠলাম বৃষ্টির মাঝেই। আমাদের কামরায় উঠলাম।কোন বাইরের মানুষ নেই। ভালই হল নিরিবিলি যাওয়া যাবে। নীল ট্রেনে উঠেই বই খুলে বসলো। বই দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কোথায় গল্প করতে করতে যাবো তা না বই খুলে বসলো।আঁতেল কোথাকার। আমি আর কি করবো আমিও ম্যাগাজিন খুললাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছি নীল কে নিয়ে। এই ধরনের স্বপ্ন এই প্রথম না। অনেকবার দেখেছি। নীলের পাতলা ঠোঁটে আমি চুমো দিচ্ছি। নীল আমাকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ করলো। আমি নীল কে জড়িয়ে ধরবো ঠিক সেই সময় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো ।
নীল ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে
– এই ওঠ।পরে পরে নাক ডেকে ঘুমচ্ছিস কেন?
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। একদম আসল মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
– ডিনার করবি না?আম্মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার দিয়ে দিয়েছে।
আমি ওয়াশ রুম থেকে ঘুরে আসলাম। এসে দেখি নীল সব সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়েছে।আসলে প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। আনটির হাতের রান্না যে কি চমৎকার তা বলার বাইরে। তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া শেষে দেখলাম নীল একটা ফ্লাক্স বের করলো। আমি তো অবাক। এতে আবার কি!
– কি আছে রে এতে?
– মদ। খাবি?
– রিয়েলি ?
– আরে না বাবা । কফি।
– বাহ! তুই তো দেখি অনেক গোছান ছেলে।
কফি খেতে খেতে গল্প শুরু করলাম।বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর ট্রেনের কু ঝিক ঝিক শব্দ।আমরা আর ঘুমালাম না।গান গাইলাম আমরা
আজি ঝর ঝর মুখরও বাদলও দিনে…
খুনসুটি আর গল্প করতে করতে, ভোরে পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রাম
এরপরের দিনটা গেলো স্বপ্নের মত। আমরা সমুদ্র স্নান করলাম একসাথে।ছুটাছুটি করলাম সৈকতে। তারপর একসাথে হাত ধরে বসে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখলাম।সৈকতের বালিতে লিখলাম দুইজনের নাম।আমি ভেবেছিলেম সমুদ্র-স্নানের সময় নীল হয়তো আমাকে ভালবাসার কথা বলবে। কারন আমরা দুইজনই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম। বলেছি একজন আরেকজনের জীবনের সব কথা। আসলে সাগরের কাছে আসলে মানুষের মনই এমন হয়ে যায়।আমার হাত নীল এমন ভাবে ধরেছিল মনে হচ্ছিল খুব আপন সে। খুব কাছের কেউ। কিন্তু কই নীল আমাকে ভালবাসার কথা বলল না।আমিও বলতে পারলাম না ওকে হারানোর ভয়ে।
চট্টগ্রামে আরও থাকা হল দুই দিন।পাহাড় ঘেরা ফয়েজলেকে সন্ধ্যা বেলা লেক ক্রুজ করলাম। গেলাম কর্ণফুলী নদীর তীরে অভয়-মিত্রের ঘাটে।এই কয়দিন চট্টগ্রামের আবহাওয়া ছিল এই হাসি তো এই কান্না। এই রৌদ্র এই মেঘ। বৃষ্টি তে ভিজতে হয়েছে আমাদের। আর আমরা খুশি মনেই ভিজেছি।
এই দুই দিন হোটেলে শুধু আমরা ২ জন থ্রি কোয়ার্টার পরে খালি গায়ে শুয়েছি। কিন্তু কেউ আমরা সীমানা অতিক্রম করি নাই।
তারপর থেকে আমার বদ্ধমূল ধারনা হয়ে গেলো নীল আমাকে শুধু বন্ধুই ভাবে। কিন্তু আমি তো দিনে দিনে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছি।কি করবো আমি? ভালবেসে এত অসহায় হয়ে গেলাম। বলে দিবো নীল কে আমার ভালবাসার কথা? কিন্তু তাতে যদি ভালবাসা না হয়? বন্ধুত্ব নষ্ট হয়?
চার
এভাবেই দিন গুলো অতিবাহিত হয়ে আজ এক বছর পূর্তি হল। বিয়ের কথাটা হটাত করে উঠলো। আমি ভাবার সময় পাই নাই।নীল গত পরশু আমাকে মহাখালী ক্যাপ্টেন্সে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল তার বিয়ের কথা।নীল তো খুব উত্তেজিত।
– বুঝলি হটাত করেই বিয়ে টা ঠিক হয়ে গেলো
– কিসের বিয়ে ? কার বিয়ে?
– কার আবার? আমার বিয়ে
আমি বুঝলাম ফাজলামো করছে নীল।
– ওই ফাজলামি সব সময় ভাল লাগে না। এটা কিন্তু বেশি বেশি
– দোস্ত তোর সাথে আমি মিথ্যা বলবো ? আমার মামা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।মেয়ে ঢাকা ভার্সিটি পড়ে। আমি তো রাজি ছিলাম না। কিন্তু মেয়ের ছবি দেখে এত ভাল লাগলো
– তুই না গে? তুই কেমনে মেয়ের ছবি দেখে পটে যাস?
– আমি বাই সেক্সুয়াল। আর এক সময় না এক সময় বিয়ে করতেই হবে সমাজে থাকতে হলে
এরপরে সমাজ নিয়ে আরও বক বক করতে লাগলো নীল। কিন্তু তার আর কোন কথা আমার কানে যাচ্ছে না। তাহলে নীল সত্যি বিয়ে করবে? তাহলে আমার কি হবে?
– এই আমার কিছু শপিং করতে হবে। তুই যাবি?তুই তো মেয়েদের জিনিস ভালই চিনিস। আম্মা এত অল্প সময় এত শপিং করতে পারছে না।
এখন তার বিয়ের শপিং আমার করে দিতে হবে?কিন্তু কি বলবো ? আমাকে নীল নিয়ে গেল বসুন্ধরায় সিটি শপিং মলে।ঢুকলাম আড়ঙে ।২ টা সুন্দর ছোট ছোট স্বর্ণের কানের দুল কিনলও নীল।ও নাকি বাসর রাতে বউ কে উপহার দিবে। এসব দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে। এত দিন গে সেজে এখন বাইসেক্সুয়াল সাজছে। কিন্তু কিছুই বললাম না আমি।এরপর আমাকে নিয়ে গেলো দেশি দশে। একটা পাঞ্জাবি কিনলও আমার জন্য নীল । আমাকে নাকি গায়ে হলুদে এই পাঞ্জাবি পরে আসতে হবে! আমি নিবো না ঠিক করলাম। পরে ভাবলাম থাক নেই ।নীলের কাছ থেকে পাওয়া শেষ উপহার। স্মৃতি হিসেবে থাকবে।আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। নীল তাহলে আসলেই আমাকে ভালবাসে না।
পাঁচ
আজ নীলের গায়ে হলুদ। বৃষ্টি পরছে অঝোর ধারায় একদম সকাল থেকেই।আজ কি যাবো নীলের হলুদে। কিন্তু গেলে তো মন আরও খারাপ হয়ে যাবে। না থাক যাই। শেষ দেখা দেখে আসি।এরপর তো আর বন্ধুত্বই রাখবো না। সারাদিন শুয়ে থাকলাম। বুকের উপরে যেন একটা পাথর চাপা দিয়েছে কেউ। কাঁদতেও পারছি না। কাউকে যে বলবো সেরকম কোন মানুষও নেই। আবার মাঝে মাঝে রাগও লাগছে নিজের উপর। আমি এত ইমোশনাল কেন? বিকেলের দিকে পাঞ্জাবি পরে বের হলাম। যাবো পুরাণ ঢাকায় নীলের বাসায়।শেষ দেখা করবো । আমি যখন বের হলাম তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে।আগে হলে এই বৃষ্টি উপভোগ করতাম। কিন্তু মনের অবস্থা সেরকম নেই। বাসা থেকে বের হতেই নীলের ফোন আসলো।
– এই কই তুই?
– আরে বাবা আসছি তো
– তুই সকাল সকাল আসবি না? এত কাজ বাসায়। আমাকে একটু সাহায্য করবি। তা না?
– আরে আসছি তো
– ওকে আয়।
বৃষ্টির জন্য পুরাতন ঢাকার রাস্তায় পানি জমে গিয়েছে। আমি রিক্সা নিলাম বাস থেকে নেমে। আজ কেন জানি বৃষ্টিও বিরক্ত লাগছে। নীলের বাসা নাজিমুদ্দিন রোডে। ওদের বিশাল বাসা। মাঝখানে বড় উঠান। আমি মাত্র দুইবার গিয়েছি। পথ চিনতে পারবো তো? চিন্তা হচ্ছে।বাসা একটু ভিতরে। কিন্তু চিনতে অসুবিধা হল না। শুধু একটা বাড়িতেই আলোকসজ্জা করা হয়েছে। লাল নীল মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ি টা। সদর দরজায় বিশাল গেট বসানো হয়েছে। কত গুলো চীনা লন্ঠন ও ঝুলানো হয়েছে গেটে। ঢুকতেই উঠোনে ।একদল মেয়ে গান ছেড়ে নাচা প্র্যাকটিস করছে। মনে হয় নাচবে মূল অনুষ্ঠানের সময়। সবার পরনে হলুদ শাড়ি লাল পার। চিনতে পারছি না কাউকে। হটাত দেখলাম আনটি এগিয়ে আসছেন।তিনি একটা বাসন্তী শাড়ি পরেছেন। আমাকে দেখে এক গাল হেসে বললেন
– বাবা ভাল আছো? আরও আগে আসবা না? নীল একা একা অস্থির হয়ে গিয়েছে কাজ করতে করতে। সাদ তো লজ্জায় নিচেই নামছে না। তারই হলুদ ।দেখো অথচ তার কোন খবর নাই
একটা ধাক্কা খেলাম আমি।সাদের হলুদ! সাদ নীলের ছোট ভাই। পিঠাপিঠি। ১ বছরের ছোট।নীল এত বড় মিথ্যা কথা কেন বলল। কিন্তু আমার রাগ হওয়ার বদলে কেমন যেন হালকা লাগছে। তার মানে নীলের বিয়ে হচ্ছে না।কিন্তু একটা অভিমান কাজ করছে।ও কি সত্যি বুঝে না আমি তাকে ভালবাসি।আমি আনটি কে জিজ্ঞেস করলাম
– নীল কোথায় আনটি ?
– আছে মনে হয় ওর ঘরে। তুমি উপরে যাও।
আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। দেখলাম বারান্দায় আলপনা আঁকছে নীল। ঘেমে টেমে একাকার।আমাকে দেখে হেসে বলল
– এতক্ষণে আসলি?
– তোর সাথে আমার কথা আছে। আমি কিন্তু খুব রেগে আছি।
– জানি তুই এই কথাই বলবি। চল ঘরে যাই। ওখানে বসেই কথা বলি।
নীল এর ঘরটা খুব সুন্দর করে গুছানো। পর্দা গুলো নীল। ঘরের দেয়ালের রঙ নীল। বিছানার চাদর আকাশী। মনে হয় যেন এক টুকরো আকাশ এনে রাখা হয়েছে।নীল একটা তোয়ালে নিয়ে আমাকে বলল
– এই শোন আমি একটু শাওয়ার নিয়ে আসি। তারপর সব কথা হবে।
– আচ্ছা।
আমি একা বসে আছি নীলের ঘরে। খুব অভিমান হচ্ছে। নীল এর মিথ্যা কথা গুলো আমাকে কত কষ্ট দিয়েছে।কিন্তু এমন করলো কেন?কিন্তু সে তো জানেই না যে আমি তাকে ভালবাসি। আমি ঠিক করলাম আজকে তাকে আমার ভালবাসার কথা বলবো । বন্ধুত্ব নষ্ট হলে হবে। কিছুক্ষণ পর নীল মাথা মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলও।একটা নীল পাঞ্জাবি পরেছে। খুব সুন্দর লাগছে।
– হ্যাঁ এখন বল কি জন্য আমাকে মিথ্যা বলেছিস?
– আরে শোন সাদ একটা মেয়ে কে ভালবাসে। কিন্তু আমাদের কারো মত ছিল না সাদ কে এত দ্রুত বিয়ে দিতে। এদিকে মেয়ের পরিবারও অপেক্ষা করবে না। তখন সাদ পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করলো। এখন দুই পরিবার মেনে নিয়েছি আমরা। কিন্তু পালিয়ে যেয়ে বিয়ের কথা তো আর প্রকাশ করা যাবে না।মানুষ কি বলবে? তাই নতুন করে বিয়ে সাজানো। আর তাই বড় ভাইয়ের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো । আর কানের দুল আমি উপহার দেয়ার জন্য কিনেছি।
– কিন্তু আমাকে মিথ্যা বললি কেন?
– না মানে এমনি মজা করলাম।
– মজা! কি মজা পাইলি?
– না মানে তোর প্রতিক্রিয়া দেখলাম
– কি ভেবেছিস?আমাকে তোর বিরহে কেঁদে ভাসাতে দেখবি? নাকি আত্মহত্যা করতে দেখবি?
– ছিঃ । আমি কি তাই বলেছি? এত রিয়াক্ট করছিস কেন? জাস্ট মজা ছিল ব্যাপার টা
– মজা তক্ষুনি হয় যখন আমি সেরকম ভাবে রিয়াক্ট করবো না।সেরকম রিয়াক্ট করলে মজা কোথায় ?কাউকে কষ্ট দেয়া নিশ্চয়ই মজা নয়?
– ওকে আমি সরি।
আমি আর পারলাম না চোখ থেকে পানি পরতে শুরু করলো । নীল এসে আমাকে হাত ধরে বলল
– আর গোপন করিস না। আমি জানি তুই আমাকে ভালবাসিস। আর তোর মুখে এই কথা স্বীকার করানোর জন্যই এই নাটক। কোন মজা নয়।
– কেন তুই ভালবাসিস না?
– বাসি অনেক ভালবাসি। তাই তো হারানোর ভয় ছিল। নিজে থেকে বলতে পারি নাই তাই।যদি না করে দিস।তাহলে তো বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।আর তুইও তো বলিস নাই।
– আমারও একই ভয় ছিল। চট্টগ্রাম গেলাম।এত কাছাকাছি হলাম দুইজন। তখন তুই একবারও আমাকে আদর করলি না। তাই তো আমার মনে হয়েছে তুই আমাকে ভালবাসিস না
– আমি তো কক্ষনো নিশ্চিত ছিলাম না। তাই এপ্রোচ করি নাই।আর এই কারণে এই নাটকও সাজালাম। যাই হোক এখন তো বুঝতে পারছিস আমরা দুই জন দুই জন কে ভালবাসি
আমি জড়িয়ে ধরলাম নীল কে। নীলের বুকে মাথা রেখে বললাম
– কক্ষনো আমাকে ছেড়ে যাবি না তো ?
– উহু। এভাবে বুকে থাকবি সারা জীবন।
ছয়
রাত বাজে দশটা। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ধানমন্ডি লেকে ব্রিজের উপর। বৃষ্টি হচ্ছে। ব্রিজ থেকে দূরে ভবনের আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলো আবার লেকের পানিতে পরছে।বৃষ্টি তে ভিজছি আমরা। বৃষ্টি বিলাস করছি।গায়ে হলুদ থেকে বেরিয়ে সোজা ধানমন্ডি তে এসেছি।রাস্তায় হাঁটছি। সোডিয়াম বাতির আলো ভেজা পিচ ঢালা রাস্তায় পরে এক অদ্ভুত সুন্দর প্রতিবিম্ব তৈরি করেছে। আজ আমাদের ভালবাসার দিন। বর্ষার প্রথম দিন। বৃষ্টিতে ভেজার দিন।বৃষ্টি বিলাস করার দিন।
এসো নীপবনে ,ছায়া বীথি তলে এসো করো স্নান নবধারা জলে……………।