
লিখেছেন– নিরালোকে দিব্যরথ
ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা, টুপি। ইস্ত্রি করে আদর করে সাজিয়ে রাখা। কিন্তু মাজেদুল ওর আন্ডাগার্মেন্টস নিয়ে চিন্তিত। ধোয়া কাপড়গুলো লাল রঙের ট্রলিতে মা সাধারণত ভাজ করে ঢুকিয়ে দেন। আর নাহয় স্টিল আলমারির দ্বিতীয় তাকে খুঁজলেই পাওয়ার কথা। কিন্তু জাঙ্গিয়াগুলো কোথাও নেই। নীল, লাল, দুটি কালো এবং একটি সাদাকালো। সর্বসাকুল্যে পাঁচটি জাঙ্গিয়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না দেখে দরিফ হোসেনকে হাঁক দিল মাজেদুল, ছাতে যান।
আয়নার সামনে হাতঅলা মিহি গেঞ্জিটি পরে গায়ে পাঞ্জাবি ওঠাবার ঠিক সময়ে মাজেদুলের ত্রিভুবন টলতে শুরু করে। লাল নীল জাঙ্গিয়াগুলো অর্থহীন মনে হতে থাকে। সে খেয়াল করল তার উস্কোখুস্কো চুলে একটা ববকাট চল এসেছে এতক্ষণে। সেই চেঞ্জটা। এই পৃথিবীর এক বিরল ঘটনা। মাজেদুল জানে আর সামান্য কয়েকটি মিনিট বাদেই কী ঘটতে চলেছে। মাজেদুল অজ্ঞান হয়ে বেসিনের সামনে ধাক্কা খেয়ে নিচে ঢলে পড়ে।
আমাকে কি মেয়ের মত লাগছে?
মাজেদুল যতখানি জানে সে একটা ঘিয়ে পাঞ্জাবি পড়েছে। পাশে বসা ছেলেটি তার প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে নিল!
মানে? আপনাকে মেয়ের মত লাগছে মানে? মানেটা কী?
না, এমনি। এমন হয়, মাঝে মাঝে।
আপনি তো মেয়েই। মেয়ের মত লাগার প্রশ্ন আসছে না।
না। আমি মেয়ে নই। তবে আমি মাঝে মাঝে হয়ে যাই। আচ্ছা, এই প্রায় হলুদ ঘিয়ে পাঞ্জাবিটাতে কি এখন বড্ড বেমানান লাগছে আমাকে?
পাগল নাকি!
বিশ্বাস হচ্ছে না?
মোবাইলটা চট করে বের করল।
মাজেদুল শালাম। টাইটেল। আইডি লগ ইন করা আছে। ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, এই দেখুন, আমার ছবি আছে এখানে। এবার বলুন তো, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমি মেয়ে নই?
ছবি তো ঝাপসা। ক্লিয়ার ছবি দেখান।
মাই ফুট। আপনি। রোড এসে গেছে। আমাকে নামতেই হবে এখনই। এক কাজ করুন জলদি আমার নম্বরটা সেভ করে নিন। ডিটেইলসে পরে সব কথা হবে। জিরো ওয়ান…
বাসের সামনে দেয়ালের একটি নম্বরের চিকা মারছে কেউ। মোবাইল অপারেটরে নম্বরটির শেষের দুটি ডিজিট হবে এক আর চার। কিন্তু পাশের ছেলেটি ভুল লিখে চলেছে। চৌদ্দ আগে এসে যাচ্ছে বারেবারেই। এত ভুল! এমন হলে নম্বর লেখা শেষ হবে না।
পাশে বসা ছেলেটি নম্বরটি দেয়ালে লিখে চিকা মারছে, হ্যালো মাজেদুল।
শাজাহান চাচার সাথে কথা বলা খুব জরুরি ছিল। মাজেদুল দেখল সলিমুল্লা মঞ্জিলের মূল ফটক সব দিক দিয়ে পুলিশ আটকে রেখেছে। চাচার সাথে দেখা করার কোনও সুযোগ নেই। মাজেদুলকে যেতে হবে দূরের একটা রাস্তা দিয়ে। বাসে উঠে পড়ল। ঐ রাস্তায় গেলেই একটা কানাগলি দিয়ে চাচার কাছে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
সে কেন সময়ে সময়ে মেয়ে হয়ে যায়, চাচা পরিষ্কার করে কিছু যদি নাও বলেন একটা গল্প শোনাতে পারেন। গল্প শোনা এখন খুব প্রয়োজন।
কানাগলি পাড় হয়ে ঢোকার ব্যতিক্রম রাস্তায় স্লিভলেস পোশাক, জিন্স পরা আর ববকাট একটি মেয়ে ধরা পড়েছে। টপসের রঙ ছিল হালকার উপর বেগুনি।
এসব ঘটনা কবেকার? অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত বাদ দিয়ে কোন সময়ের ঠিক মনে পড়ে না। নাকি ধাক্কার ছলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কত শত জীবনের আর পুনর্জন্মের ইতিহাস মনে পড়েছিল!
কথা ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাজেদুল পরিপাটি বেশে যাবে। দরিফ হোসেন থাকবেন সহকারী। দরিফ ছাত থেকে আন্ডারগার্মেন্টস আনতে যাওয়ার একটা ফাঁকেই বেসিনের আয়নায় মুখ ধুতে গিয়ে অত্যন্ত অসহায়বোধ করা শুরু হল মাজেদুলের।
ছেলেটি ঐ মোক্ষম সময়েই কিনা হয়ে গেল অষ্টাদশী নারী। দরিফের ভেতর ক্রোধ শুরু হয়। এই ক্রোধ মাজেদুলের উপর নয়। দুর্ভাগ্যের উপর। আলাউদ্দিন ফকিরের বাড়ির মেহফিলে সবাই ভাববে কী! একজন সৌম্য পাজামা পাঞ্জাবি টুপি পরা যুবকের পরিবর্তে ববকাট। চোখে মেরুন গ্লাস। টপ আর জিন্স পরা এক মেয়ে প্রোগ্রামে এসেছে প্রধান অতিথি হয়ে। ইশ!
সিদ্ধান্ত হল দরিফ সবাইকে খুলে বলবেন কথাটি যে, দাদাভাই সময়ে সময়ে মেয়ে হয়ে যান।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে ছেলেটি। এমন ঘটনা আর কক্ষনও শোনেনি পৃথিবীর কোনও মানুষ। কেউ দেখেনি কখনও। মাজেদুল নিজের জীবন থেকেই চলচ্চিত্র দেখে।
আচ্ছা, সে তো কখন জেন্ডার বদলে যেতে থাকে আগেভাগে ইঙ্গিত পায়। কে দেয় সেই ইঙ্গিত? তার শরীরে ডাক দেয় কেউ একজন।
কিন্তু মাজেদুল আবারও পুরুষে পরিণত হয়। কখন?
ঝিমাচ্ছিল।
অষ্টাদশী মাজেদুলের বয়েস এখন ত্রিশ ছুঁই।
আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু টেকা দ্যান। টেকা দিলে আল্লাহর রহম করবেন। আল্লাহর ওয়াস্তে…
হঠাৎ দরিফ মিয়া বলে উঠলেন ‘টেকা দিলে যদি আল্লাহ রহম করত, সব ধনীলোকগুলান বেহেস্ত পাইত’।
মসজিদের মাইকে সকাল থেকে বকবক শুনে মাজেদুল অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতক্ষণ ধরে মাজেদুলের মাথার পাকা চুল তুলছিলেন দরিফ। পাকা চুল নেই। বয়েস চব্বিশ ধরে নিয়ে বিভ্রান্ত হবে কেউ দেখলেই তাকে। দুএকটি পাকা চুল থাকলেও চোখে পড়ে না। দরিফ মিয়ার ইচ্ছে হয়েছিল বেজায়। নেমে পড়লেন চুল তোলার মিশনে, মসজিদের মাইকের পাশাপাশি তিনিও বকবক শুরু করেছিলেন পুঁথিপাঠের মত কী সব আউড়ে। কতশত ধর্মের কেচ্ছা শুধু হু হা করে যায় মাজেদুল, অনর্থক কথাগুলো শুনে খেয়ে পরে কাজ নেই।
তার মধ্যেই “টেকা দিলে যদি আল্লাহ রহম করত, সব ধনীলোকগুলান বেহেস্ত পাইত” মাজেদুল শুনতে পেয়েছে। মূল্যবান একটা কথা, এটা ভাবতেই দরিফের মুখের দিকে তাকাতে গেলে মাথাটা আবার ঘুরতে থাকল প্রচণ্ড গতিতে। মাজেদুল ফ্যান ঘুরতে দেখতে পাচ্ছে, আর কিছু না, অথবা তার মাথায় ফ্যানটা ঘুরছে। কীসের জানি শব্দে কানটা ঝালপালা হয়ে গেল। ঘূর্ণি শেষ হলে মাজেদুল দেখল সে অজ্ঞান হয়ে যায়নি।
মাথায় তেল দিয়া দিব? জানতে চাইলেন দরিফ। কেমন চাপা। মেয়েলি গলা।
মুখ ঘুরাতেই মাজেদুল মাথায় একটা হোঁচটের মত খায়। দরিফ মিয়া নন!
নাসিমা নাম্নী রাঁধুনি মাজেদুলের চুল ধরে সিঁতি বিলিয়ে দিচ্ছে। কোমরের নিচে নেমে আছে মাজেদুলের লম্বা চুলের গোছা।
আমার বয়েস তো আঠের, বিড়বিড় করল মাজেদুল।
মাজেদুল একেবারে শিশু বয়েসে নাসিমার নিকা দেখেছিল। নিকা হয়েছিল আসগর আলির সাথে। কোলের শিশু জন্ম নিয়েই নিউমোনিয়ার জেরে অল্পকদিন বাঁচে।
অপ্রয়োজনীয় গপ্পো সেসব। সাজাহান চাচা থাকলে প্রয়োজনের গল্প শোনাতেন। ঐ রাস্তা থেকে কোনদিন পুলিশপ্রহরা উঠে যাবে অপেক্ষার প্রহর গুনছে মাজেদুল।
অবশ্য নাসিমার গল্প সে নিজেই শোনাতে পারে। নাসিমার কোলের বাচ্চা মরে যাওয়ার মাস না যেতেই লিভার ক্ষয়ে আসগর আলিও ধরাধাম ত্যাগ করেছিল। সেই নাসিমার আর কখনও নিকা হয়নি। অপয়া মনে করেছে লোকে তাকে। বশর দর্জি তাকে ‘নাছু’ ডেকে কাছে নিয়ে সোহাগ দিত, সেও বিয়ের নাম শুনলে চম্পট। শেষে ধুকতে ধুকতে নাসিমা অন্ধ শহিদের দ্বিতীয় বৌ হতে চেঁচামেচি শুরু করেছিল।
মাজেদুল বড় আশা করে বসে আছে নাসিমার ঘটনা সে সাজাহান চাচাকে শোনাবে। চাচা এত গল্প শোনাত, আর সে বলার মত কোন ঘটনা খুঁজে পেত না। নাসিমা এসে তার চুলের ঝাটা ধরে তেল মেখে দিতেই না সব মনে পড়েছিল।
নাসিমার গল্পের প্রয়োজনীয় অংশটুকু বহুলোক শোনেনি। আর কদিন গেলে এই বুড়িকে নিকা করবার কেউ থাকত না। নাসিমা একজন হিজড়েকে কলমা আর কবুল পড়ে স্বামী হিসেবে মনেপ্রাণে মেনে নেয়। এই নিকায় মাজেদুলের মা-বাপ আর বরকনে দুই পক্ষ পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। ধর্মমতেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। অবশ্য ধর্ম বিষয়টি কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
সাজাহান চাচা হয়ত বলতেন, হয় এমন হয়। এই যে তুমি এই ছেলে এই মেয়ের বৃত্তে পাক খাও। কেউ বিশ্বাস করবে না এমন কথা। পাশে বসা ছেলেটি করেছে? কেন করেনি। তার সদিচ্ছাই নেই। দেখনি, নম্বর বারবার ভুল করছিল!
কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ মানে হিজড়া বলে আমরা যাদের জানি, তারা তো সবসময়েই জেনে এসেছি পুরুষের প্রতি যৌনাকাঙখায় তাড়িত। একটা মেয়েকে সে বিয়ে করে উৎসবে পার্বনে শাড়ি দিতে যাবে কী স্বার্থে! তাদের দুজনকে ডাইনিং ঘরের দরোজা ভিজিয়ে দিয়ে গা জড়িয়ে শুয়ে থাকতেও দেখেছি কতবার।
মিয়া মাজেদুল। নাসিমার বর তৃতীয় লিঙ্গ এই কথা নিশ্চিত তো?
আলবৎ নিশ্চিত। নাসিমা জানে।
কী জানে সে?
ট্রেনে ওর বর ওকে কোলে নিয়েই একবার হাতে তালি বাজিয়ে লোকারণ্যে পয়সা আত্মসাৎ করেছে। আত্মসাৎ শব্দটি যদিও বাড়াবাড়ি। কিন্তু অন্য যুৎসই শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
বেকার পুরুষ অর্থ উপার্জনের জন্য এদের দলে নাম লেখায় শুনেছি।
চাচাকে থামিয়ে দেয় মাজেদুল। না, ওদের সন্তান হবে না। দত্তক নেয়ার চিন্তা করছে।
মাজেদুল, এই পৃথিবীকে সবসময় সোজা চোখে দেখো না, সৃষ্টিকর্তা কার মাথা কী দিয়ে বানিয়েছেন একমাত্র তিনিই জানেন। এটা মাথা মাজেদুল, এটা মাথা। এটা তোমার ফেন দিয়ে ভাত খাওয়া গপ্পো মারা দই নয়। মাথা দিয়েই মানুষের হাগা মুতা থেকে নিয়ে সব কাজ করতে হয়। স্ট্রোক করে দাও। সব বন্ধ হয়ে যাবে। মাথার রহস্য কেন কী বিজ্ঞানীরাও সব উদ্ধার করতে পারেননি।
স্লিভলেস পরা একটি মেয়েকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সাজাহান চাচা বলে বলে সে চেঁচাতে থাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়। কিন্তু মেয়েটি জানে না, এই বাড়িটা পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে দুজন বিকৃত যৌনমস্তিষ্কতাড়িত মানুষ মার্ডার হয়েছিল বলে। সাজাহান বলে এখানে কেউ থাকেন না। কিন্তু মেয়েটির আচরণ সন্দেহজনক মনে করে তাকে হাতকড়া পরানো হয়েছে। অস্বাভাবিক সব কথা বলছে মেয়েটি। নামটিও ঠিকমত বলতে পারছে না। মেয়ের নাম কখনও পুরুষ হয়? মেয়েটিকে মানসিক রোগী মনে করেছে উপস্থিত কতজন।
মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকেদের এভাবে মার্ডার করা উচিত, বলছে লোকে। পৃথিবীর সবগুলো ধর্মগ্রন্থে হত্যা, ধর্ষণের বৈধতা দেয়া হয়েছে। শুধু বৈধতা দেয়া নেই নিজের পছন্দের জেন্ডার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে। তার উপরে মিচ্যুয়াল সেক্সরে বাবা! ভয়ঙ্কর ঘটনা। যে সমাজের বিবেক বুদ্ধি ক্ষয়ে যায় তারা এসব ঘটনা মেনে নেয়, স্বাভাবিক মনে করে। বাংলাদেশ নামের উন্নয়নশীল দেশটি এখনও এই ভয়ঙ্কর অধপতনের দিকে ধাবিত হয়নি।