লেখকঃ নিরালোকে দিব্যরথ
নির্জনার ব্যানার্জির শাশুড়ি। ভদ্রমহিলা অক্কা পেলেন গ্যাসের আগুনে পুড়ে। শরীরের নব্বই ভাগ ছারখার হয়ে গিয়েছিল। বার্ন ইউনিটে একটুখানি হুঁশ ফিরে পেয়ে প্রশ্নটি তিনি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন নির্জনার উদ্দেশ্যে; জানতে চেয়েছিলেন তাকে কি আরও কাটবে! সব ধ্বংস হয়ে গিয়েও বাঁচবার উপর মানুষের কীই না এক দুরাচারী স্বপ্ন!
রসুইঘরের জানালা এঁটে দেয়া পাপ- খবরটি এবং গ্যাস লিক হওয়ার দানবীয় রূপটি ভদ্রমহিলা জানান দিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের মূল্যে, আমাদের দুর্বল মগজে।
শুনে প্রথম প্রথম বিষাদে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম; নৃশংসতা আমি সইতে পারি না। কিন্তু কদিন পরেই নিষিদ্ধ এক আনন্দে অজান্তেই খুশি খুশি হয়ে উঠেছিলাম ভেতরে। এর কারণটি এই যে- নির্জনা চক্রবর্তী শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ব্যানার্জি হয়েছিল।
নির্জনাই তথ্যটি কদিন পরপর প্রশস্ত বক্ষে শুনিয়ে দিত। একবার শুনেছিলাম সংখ্যাটা বার। তার পরে সতের। তার পরে উনিশ। চব্বিশ। শেষ দেখা হওয়ার আগে সর্বমোট আটাশজন অবিকল রাইমা সেনের সঙ্গে তুলনা করেছিল তাকে। আমার মনে পড়ে- বিউটি কন্টেস্টের ক্যাম্প-রাউন্ডের আগে হকার্সে ঘুরে টপস আর প্লাজো সংগ্রহ করছিলাম আমি আর সে। অসময়ে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়েছিল আমাদের। নির্জনা বলেছিল- তার নিজেকে বোম্বাই চলচ্চিত্রের হিরোইন মনে হয়েছিল সে সময়।
সেই নির্জনা বটি দিয়ে শাক ছানবে; ছোট আধা হাতের মাছ দেখলে ভ্রু কুঁচকে নেবে, কারণ বড় মাছ কেটে কুটে রাখতে আর যাই বল ফিকির নেই; চুলোঘরের জানালা অর্ধেকটা খোলা রাখবে যাতে গ্যাস লিক হয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে না পারে?- এমন শাড়িপাঁজাকোলা নির্জনাকে আমি কল্পনাতেই আনিনি।
আমার বাপ-মা ধার্মিক মানুষ। আমি গিয়েছি বিগড়ে। আস্তিকও নই, নাস্তিকও হতে পারলুম কই ছাই! এক রাতে ঠিক হয়েছিল- নির্জনা আমার ঘরে থাকবে। তার বায়োলজির না-কষা প্র্যাকটিক্যালগুলো জমে ভাণ্ড হয়েছে, অথচ জমা দিতে হবে কালই। নির্জনা, আমি আর নির্জনার ছেলেবন্ধু- (‘বয়ফ্রেন্ড’ শব্দটিকে বাংলার আর কী নাম দেয়া যেতে পারে, প্রেমিক? তাও সুবিধা হল কই!)- কথা ছিল তিনজনে মিলে একরাতে শেষ করে দেব প্রাণীর দেহের ভুঁড়ির ছবি আঁকাআঁকি। কিন্তু কিছু না জানিয়ে গ্রাম থেকে সেদিনই আমার বাপজান এসে হাজির হলেন কোন্ এক নিমন্ত্রণ রাখতে। একটি ভরা যৌবনের মেয়ে নিজের অভিন্ন বয়সের দুই জোয়ানের সঙ্গে এক ঘরে কাটাবে রাত- আমার কাছে গল্পটি যতটাই নিষ্কলঙ্ক; বাপজানের বিবেকে ততটাই বাজ পড়েছে তা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছ। এর পরের কাহিনি আমি পুরোটা শোনাতে চাইনে। শুধু একটা দৃশ্য স্মৃতি ভরে দপদপ করে জ্বলছে- শেষ রাতে প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে নির্জনা কীসের জানি গন্ধ শুঁকে দেখেছিল; ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ার অভিনয়ে মোহনীয় দৃশ্যটি চোখ টিপে দেখে নিয়েছিলাম আমি। আমার বাপজান শহরের বাসা ভাড়া মিটানো লাটে দিয়েছিলেন।
প্রথমদিকে আমার সঙ্গে নির্জনার ইষ্টিনিষ্টি প্রেম আছে কিনা এমন সন্দেহ করা শুরু করে অনেকে; শুধু আমি আর নির্জনা ছাড়া সব্বাই জল্পনা আঁটে। সব্বাই বলতে থিয়েটারের সবাই। সুশান আর মণিকা নামের এক যুগলবন্দি ছিল আমাদের দলটিতে। তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরও গুটিকয় যুগল জন্ম দেয়ার মিশনে নেমেছিল। তাতে তাদের স্বার্থ কী ছিল আজও ঠাহর করে উঠতে পারিনি। মণিকা ছিল নাস্তিক। জোর করে আমি আর নির্জনার সম্পর্ককে হিন্দু-মুসলমানের সঙ্গমে পরিণত করতে চেয়েছিল মেয়েটা। মনিকার সমস্যাটি ছিল এই, নাস্তিকতাকে সে একটি ধর্ম বানিয়ে তুলেছিল। ধর্ম আর মতবাদ দুটোই সমান অপরাধী, জেঁকে বসে; এক প্রিয় প্রাবন্ধিকের এই কথাটি মণিকাকে য্তবার দেখতুম মনে হত। আমার আর নির্জনার গুজব রটিয়ে সে খুব একটা সুবিধে করে উঠতে না পারলেও আরেক মুসলমান ঘরের সন্তানের সঙ্গে সত্যি সত্যি নির্জনার প্রণয় ঘটিয়ে দিলে। সেলুকাস রকমের জিনিয়াস মণিকা।
কষ্ট পেয়েছিলুম। নির্জনাকে হারিয়ে নয়, নির্জনা আমার যা- তা-ই আছে। বলেছিলাম না বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু আমাদের মধ্যে সম্ভব নয় তা কেবলা আমি আর নির্জনাই জানি; এমনকী প্যান্টোমাইমের টিম হয়ে ঢাকা ট্যুর দেয়ার সময় বাসে নির্জনা আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েও গিয়েছিল- তখনও আমরা জানতুম আমরা বন্ধু। ভুলটা করেছিল মণিকা, স্বর্ণাদি, সায়েম। সুশানের কথা তুলব না, ঐ ভ্যাঁদাটা মণিকার দড়িতে বাঁধা মোষ বৈ আর কিছু নয়। সালেকিনের সঙ্গে নির্জনার প্রণয়ে আমি আঘাত পেয়েছিলাম শুধুই মণিকার কাছে হার মেনে যাওয়াতে।
মণিকাকে আমি দু চক্ষে সহ্য করতে না পারার কারণ সে আমার ব্যক্তিগত একটি খবর না জেনেই রটিয়ে বেড়িয়েছে। খবরটি যদিও আংশিক সত্য। কিন্তু মণিকা অনুমানের উপর ঢিল ছুঁড়েছে। তার লজিক নির্জনার সঙ্গে আমি শুতে যাইনি কেন যেমনটা সুশানের সঙ্গে সে রুটিনমাফিক গিয়ে ফটো খিঁচিয়ে রাখত। যেমনটি মুসলমান ফরিদার মাথায় সে তার গোপন ঘরে নিয়ে হিন্দু সর্বজিতের দ্বারা সিঁদুরে রাঙিয়ে দিয়েছিল। আমার দ্বারা নির্জনাকে সিঁদুর দেয়া সম্ভব হয়নি তা বলে আমি নপুংসক; আমি মণিকার বেডরুমে নির্জনার দেহসুধা চেখে নিইনি তাতে মণিকা নিঃসন্দেহ আমি…। আমি যে অন্তত সাম্প্রদায়িক নই এ কথা মণিকা ভাল করেই জানে। তাই তার সমস্ত সন্দেহ গিয়ে পড়েছে আমার পুরুষত্বের উপর। ধর্ম যেরকম রক্ষণবাদিতা দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে; নাস্তিকতা কলঙ্কিত হয়েছে মণিকার উন্নাসিকতা দ্বারা। এই মণিকাকে আমি বুদ্ধের মূর্তির সামনে নতজানু প্রণামে দেখেছি, নারীবাদ কপচাতে দেখেছি, ঈশ্বরকে দোষারোপ করতে দেখেছি, সুশানকে ভ্যাঁদা বানাতে দেখেছি, দেখেছি নানা রঙে ঢঙে। সে নিজে একটি স্বেচ্ছাচারী ঈশ্বর হয়ে উঠেছিল।
সালেকিন সেই প্র্যাকটিকেল কষার রাতের পর আমাকে পছন্দ করে ফেলল। মণিকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে নির্জনা আর আমাকে নিয়েই একটি রাজ্য গড়ে তুলতে চাইল। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে পার্টনারশিপের নামে মণিকা তার অনেক টাকা খসিয়ে দিয়েছে- পক্ষান্তরে আমি- মানে প্রেমিকার এমন নিষ্কাম সহমর্মীকে শুধু ভালবাসা দিয়েই পুরস্কৃত করা যাবে, হিংসা, ঈর্ষা, চপেটাঘাত দিয়ে নয়- সালেকিন আবেগে পড়েছিল।
নির্জনার নামটি আমার কাছে ছিল ঠিক তার চরিত্রের উল্টো। এক্সট্রোভার্ট। দুষ্টুমি করেই আমাকে সে বলে বেড়াত- তুই যদি বয়েসে বড় হতিস তোকেই ঘাড়ে ধরে প্রেমিক বানাতাম। জোকস। বয়সই এখানে একমাত্র সমস্যা নয়, এমনকী ধর্মও নয়… যাকগে সে জগাখিচুড়ির কথা। বিউটি কনটেস্টসহ টেলিভিশনে রিয়েলেটি শোগুলোতে ঠেলে ঠেলে নির্জনাকে আমি পাঠিয়েছি, গ্রুমিং করিয়েছি সাধ্যিমত। দুজনে মিলে লাইব্রেরি ঘেটে কবিতা খোঁজার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ধিতাং ধিতাং স্বভাব হলেও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল ওর শুরুতে। কবে টেলিভিশনে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে সে- তার চেয়ে বেশি আমারই মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তীতে সালেকিন ওকে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য বানিয়ে নিলে। আর্ট কালচারের সাধনা শিকেয় তুলে সে লেগে রইল রক্তদান কর্মসূচি, সেমিনার, কমার্শিয়াল উপস্থাপনা এসবে। নির্জনার মতে ফাউ ওসব করেছিল সে তখন। ফ্রুটলেস। আমার থিয়েটারের নির্জনাকে হিঁচড়ে সমাজসেবায় নামিয়ে দেয়াতে সালেকিনের সঙ্গে আমার কোনও দ্বন্দ্বই হয়নি; যেমনটা ঘটেছিল মণিকার সঙ্গে। এর কারণ সালেকিন কখনও উপেক্ষা করেনি আমাকে। নির্জনাই যে এক দিকে মাথা দিতে গিয়ে অন্যদিক ডুবিয়ে দিবে তা কি সালেকিন জানত! তার দোষ কী! শেষ পর্যন্ত কিন্তু দুকূলই ডুবল নির্জনার।
ছোড়দার কাছে ছাড়া তার এইসব স্বেচ্ছাসেবা, সংস্কৃতি কোনওটিই তার পরিবারে সে পরিমাণ গুরুত্ব বহন করেনি যাতে করে বিয়ের প্রস্তাব ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে। এতদূর যে গিয়েছে তাও বাক্যবাণ হজম করে ছোড়দা তাকে সমর্থন জুগিয়েছেন বলে।
নির্জনার সঙ্গে সালেকিনের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে দুহাজার তের সালে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে। ‘ক-তে কাদের মোল্লা’ শ্লোগান দিতে সালেকিনকে সে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিল না। সালেকিনের মুখোশ উম্মোচিত হয়েছিল সে সময় আরও লক্ষ লক্ষ মুখোশধারী বাংলাদেশির মত। অবশ্য ফেসবুক ব্লগে সে এসব নিয়ে তিলকে তাল করেনি। তার কারণ নির্জনাকে সে সত্যি ভালবাসত। নির্জনার কারণেই নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস সে শিথিল করে দিয়েছিল। নির্জনাও। ভালবাসাবাসি ছাড়তে পারল না। কিন্তু সেই থেকে তাদের ভালবাসা হয়ে পড়েছিল শত্রুপ্রীতির আরেক নাম। ঝগড়া, মান-অভিমান, কথা বন্ধ, মা-বাপের নাম ধরে গালি। তারপরও ভালবাসা।
নির্জনার বিয়ে ঠিক হল ব্যানার্জি পরিবারের সাথে। নির্জনার মনটা আমি সেই মুহূর্তে ঠিক পড়তে পারিনি। সে কেনইবা হঠাৎ করে সালেকিনকে কোনওরকমেই অবকাশই দিচ্ছিল না! শাহবাগ আন্দোলনের পরও কিন্তু বিশাল দুটি বছর তারা ছিল একই সঙ্গে, হোক না শত্রুপ্রীতির কোন্দল নিত্যসঙ্গী করে নিয়ে। পুরুষ সালেকিন কেঁদেকেটে একশেষ হয়ে আমার কান ঝালাপালা করে তুলতে লাগল, দিন রাতে মোবাইলে তার এক কথা- “শালাম, আমি মুসলমান ধর্ম ছেড়ে দেব, নির্জনকে বোল হিন্দু হয়ে যাব। ও যেন ফিরে আসে। তুমি আমার ভাই। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই মুহূর্তে। ভাইগো…”
নির্জনাকে আমি ফেরাতে পারিনি সে দোষে সালেকিন খুন করার হুমকি দিয়েছিল আমায়, মোবাইলের এক বার্তায়। আমি জানতুম তাতে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না, নিঃস্ব প্রেমিকের কএকটি আস্ফালন মাত্র।
আমাদের নির্জনাকে আমি দেখিনি কয়েক বছর ধরে। তার বিয়ের বছরেই শাশুড়ি পুড়ে মারা গেলেন সেই শেষ দেখা। ফোনে যদি বলি নির্জনাকে জোটের কবিতাউত্সবে তোকে আবৃত্তি করতে হবে- সে বলে- “না রে, আমি পুজো নিয়ে ব্যস্ত। শাশুড়ির মৃত্যুর পর আমার শ্বশুরটা পাগল হয়ে গেছে, জানিস না? বুড়ো না মরা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।”
ভাবছি নির্জনার শাশুড়ির পটল তোলা যেমন উল্লাসিত করেছিল আমাদের; তেমন আরও একটি সুসংবাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তার শ্বশুরের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত। এর কি শেষ আছে? নির্জনার বর, ব্যানার্জি মশাইও পটল তুলে ভূত না হলে লাভ কী!
ছোড়দার মেয়ের জন্মদিনেও নির্জনা এলো না দেখে আমি তো অবাক। সেদিনই পেলাম খবরটা। তৃতীয় সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে। এই খবর শুনে আমি সালেকিনের মত বদ্ধ পাগল হয়ে গেলাম না কেন? নপুংসক তাই?! এই কাহিনি শুনে আমার স্ত্রী নায়িকা হতে চেয়েছিল।