
ঘাসফড়িং
ছেলেটা মাস্তান । আমাদের পাড়াতেই থাকে। কলেজ থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে সামনে পড়ে যায় । ভ্রু কোঁচকানো দৃষ্টি নিয়ে হঠাত্ হঠাত্ তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি।চমকে দেওয়া একটা সৌন্দর্য ফুটন্ত মুখাবয়বে। মুখের মধ্যে দেশলাইয়ের একটা কাঠি চিবুতে চিবুতে হেঁটে যায়। হেলেদুলে হাঁটার অভ্যাস আছে তার। আমার সেসব অদ্ভুত লাগলেও ভাল লাগে। ছেলেটা সামনে পড়লেই আমার খুব ভয় করে। বইগুলো বুকের মধ্যে আরও শক্ত করে চেপে দিয়ে সামনে এগোই। চারিদিকে অরাজকতার ঝাঞ্ঝাল। গোমট একটা পরিবেশ । ল্যাংটা দুটো বাচ্চা আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। বুড়ি মা নড়বড়ে একটা লাঠি ধরে কাঁপা-কাঁপা চোখে শূন্যে তাকিয়ে আছে।ওনি আমার মা নন। আমি আদুরে ডাকে ডাকি। ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে একটা বালতিতে পানি ভর্তি করছে একটা মেয়ে । আরও কয়েকজন সিরিয়াল বাঁধিয়ে আছে অবশ্য।সবকিছু পেরিয়ে আমার তৈরি পরিচ্ছন্ন ঘরটায় আমি ঢুকলাম।
বাবা বিছানায় লেগে গেছে একদম। কিছুক্ষণ পর পর কাশছে। ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে আমি ফিরলাম কিনা জিজ্ঞেস করল। মা কাপড়ের আঁচলে হাত হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উত্তরটা তার মুখ থেকেই বেরোল। রাতুল,শামীম,রেজা,রনি আরও কয়েকটা দৌড়ে এসে খাটে লাফাতে লাফাতে উঠে পড়ল। ওদের এখন আমার কাছে আসার সময় হয়েছে। বিকেলে ওদের আমি পড়াই। ছোট্ট একটা পরিবারে বড়ই অভাব।কামাই করার মানুষ না থাকলে এমনই হয়। অভাবের চাপে পড়েও মানুষ কিছুটা রোগা-দূর্বল হয়। আর সেইসবের শিকার আমার বাবা-মা।
প্রাইভেট শেষ হওয়াতে সবগুলো হুরহুরি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সাথে করে বিছানার চাদরটাও গুলিয়ে দিয়ে গেলো। দুহাতে টেনে দিয়ে আমি চাদরটা পরিপাটি করলাম। আমার অপছন্দ ঘর অগোছালো থাকা। মায়ের ডাকে রান্না ঘরে গেলাম। হাতে একটা বালতি ধরিয়ে দিয়ে বলল পানি দরকার । আমার এ কাজটা লজ্জা লাগত আগে। এখন আর তেমন হয়না। অভ্যেস হয়ে গেছে। বালতি ভর্তি পানি নিয়ে ফিরছি।
মাস্তান ছেলেটা আবারও সামনে পড়লো। আমি আবারও ভয় পাচ্ছি।ঢোক গিলছি। পথ আটকে দাঁড়ানো মাস্তানদের কাজ আর, ও মাস্তান। কিছু বলতে সুযোগ না দিয়েই হাতের ভারি বালতি ফেলে দিয়ে দ্রুত ছুট দিলাম ঘরের উদ্দেশে । হাঁপাতে দেখে মায়ের প্রশ্ন ।
‘বালতি কোথায় , আর তুই অমন হাপাচ্ছিস কেনো?’
ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। অবাক দৃষ্টিতে মা চেয়ে আছে আমার দিকে।ঘোর ভেঙে দিয়ে দরজার পর্দা ঠেলে দিয়ে প্রবেশ করলো ছেলেটা।
‘চাচি আফনের বালতি’ এতটুকু বলেই ছেলেটা মেঝেতে পানি ভর্তি বালতিটা রাখল।
আর আমার দিকে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকাল। বাবার কাশিতে ছেলেটা অবাক হলো বোধহয় ।কাষ্ঠের ন্যায় একটা মানুষ দেখে কি জেগেছে তার ভেতর কে জানে ?
———
আজ আর কলেজ থেকে ফেরার পথে সামনে পেলাম না ছেলেটাকে। হতাশ হতাশ লাগছিল নিজের কাছে।চারদিকে চোখ ঘুরাচ্ছিলাম। ছেলেটা সামনে পড়ত, এখন না পড়াতে মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে পাহাড়া দিয়ে রাখত।
এখন সেই খেয়ালী দৃষ্টি নেই। বস্তির অলিগলি সব পেরিয়ে ঘরে এসে চোখ ছানাবড়া । বাবা কেমন প্রফুল্লিত।খাটে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। মায়ের মুখেও হাসি। খাটের পাশে টেবিলে হরেকরকম ফল। বেশকিছু ঔষুধও। হতবাক হয়ে এগিয়ে এলাম সামনে।কিছু চালের বস্তাও চোখে পড়ল। বাবার রোগটা আর মায়ের কপালে পড়ে থাকা চিন্তার ভাঁজটা এখন নেই।
এসব কার কাজ ! ছেলেটার ? মা ‘হ্যাঁ’ বলল।
রুমে গিয়ে অনুতাপে ভুগছি।
প্রথম থেকে শেষ অব্দি ঘটা কতকিছুই মনে পড়ছিল, ছোট্ট একটা গোলাপ নিয়ে হঠাৎ একদিন সামনে উপস্থিত হওয়া থেকে শুরু করে শেষদিনের বকুনি।
লজ্জাও লাগছে।আজ বেশি পড়ালাম না বাচ্চাদেরকে।অল্প পড়িয়েই ছুটি দিয়ে দিলাম।
রাত ! চাঁদনি রাত।
জোছনার রেশ কেটে আমি হেঁটে চলছি অজানা এক গন্তব্যে ।এ পথ শুরু হবে , কিন্তু শেষ কোথায় আমি অনবগত।ক্যারাম খেলছিল ও। আমাকে দেখে কিছুদূরে আড়ালে এল।চোখের পলক পড়ছেনা। চুপচাপ নীরবতা তৈরি করে রেখেছি দুজন। সাইকেলের বেল বাজানো টুংটাং কিছু শব্দ্ই ভেসে আসছে। আর একে অপরের নিশ্বাস হীন কিছু শুনতে পাচ্ছিনা। উষ্ণ তাপে ছেয়ে থাকা প্রশস্ত চওড়া বুকে মাথা গুজে দিলাম। শক্ত দুটো হাত আমার পিঠে পৌছলো। মমতার-মানবতার বৃত্তে আর যাই করুক অন্তত অপরাধ করতে পারেনা।
এটাই আমার ভালবাসার ভিত্তি।আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম তাকে….
“সমপ্রেমের গল্প” ফেসবুক পেইজ হতে সংগৃহীত