আগস্টে দেখা হবে

লেখকঃ গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ 
রূপান্তরঃ মে হাসান

দ্বীপটিতে সে ফেরে ১৬ আগস্ট শুক্রবার, বেলা দুটোর ফেরিতে।

তার পরনে স্কটিশ চেকের শার্ট, জিন্সের প্যান্ট, সাধারণ জুতা, মোজাহীন পা, মাথায় স্যাটিনের হ্যাট আর মালপত্র বলতে শুধু সমুদ্র সৈকতে নেওয়ার মত একটা ছোট ব্যাগ। ফেরিঘাটে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ ট্যাক্সির মধ্যে সে সোজা পুরোনো মডেলের নোনা হাওয়ায় ক্ষয়ে যাওয়া একটা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠে। ট্যাক্সিচালক তাকে বহুদিনের পরিচিত মানুষের মত সম্ভাষণ জানায়। পথে ঝাকি খেতে খেতে তাকে নিয়ে চলে তপ্ত সমুদ্রপারের মাটি এবং শন ও তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরবাড়ি আর আর সাদা বালুময় রাস্তার দরিদ্র জনপদের মাঝ দিয়ে। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে পুরোনো আর অপাঙ্ক্তেয় হোটেলটিতে সে থামে।

হোটেলের পোর্টার হ্রদের মুখোমুখি দোতালার একমাত্র কামরার চাবি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। চারকদমে সিঁড়ি ভেঙে অনেকটা যায়গা জুড়ে থাকা বিয়ের খাট আর কীটনাশকের গন্ধ ভরা জীর্ণ কামরাটায় ঢুকে সে। গোলাপি রেশমের নাইটগাউনটা বের করে বালিশের নিচে রাখে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পাখির ছবি ওয়ালা রেশমের ছোট একটি রুমাল, একটা হাফ হাতা শাদা শার্ট আর ব্যাবহারে জীর্ণ এক জোড়া টেনিস খেলার কেডস বের করে। চামড়ার ব্যাগ সহ সেগুলি নিয়ে বাথরুমে যায়।

তৈরি হওয়ার আগে সে স্কটিশ চেকের শার্ট, বিয়ের আংটি আর ডান হাতে পড়ে থাকা ঘড়ি খুলে রাখে। মুখে জমে থাকা ভ্রমনজনিত ধুলোবালি আর চোখে লেগে থাকা সিয়েস্তার রেশ কাটানোর জন্যে মুখে পানি ছিটায়। এরপরে মুখটা মুছে আয়নায় নিজেকে পরখ করে- দু সন্তানের পিতা আর বয়স জীবনের দুই-তৃতীয়াংশে পৌছে যাওয়ার পরও এখনো সে তারুন্যে ভরপুর। যৌবনে সে কেমন ছিল, সেটা বোঝার জন্যে দুহাতের প্রান্ত দিয়ে গালটা একটু পেছনে টেনে ধরে। দেখতে পায় উজ্জ্বল একজোড়া চোখ, খাড়া নাক আর পুরুষালী একজোড়া ঠোট। গালটা সামান্য উচু করতেই চোখে পড়ে সদ্য শুরু হওয়া গলার ভাজ, যার কোন নিরাময় নেই। আরো দেখতে পায় দুপুরের খাওয়া শেষে ভালো করে মাজা নিখুঁত পরিপাটি দাঁত। সদ্য কামানো বগলে ডিউড্রেন্ট দিয়ে পকেটের মুখে হাতে সেলাই করা এএমবি লেখা সুতির শার্ট পরে সে। আংটি আর ঘড়িটা পরার পরই বুঝতে পারে দেরি হয়ে গেছেঃ পাঁচটার যাযগায় এখন ছয়টা। তবু হ্রদের জ্বলন্ত ভাপে স্থির হয়ে ভেসে বেড়ানো সারস গুলিকে দেখতে একমিনিট সময় নেয় সে। সাগরের পাশে জমে থাকা কালো ঝড়ো পুঞ্জমেঘ তাকে ছাতা নেওয়ার সতর্কবার্তা দেয়।

হোটেলের প্রবেশপথে কলাগাছের নিচে দাঁড়ানো ট্যাক্সিটা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। পাম গাছে ছাওয়া এভিনিউ পেছনে ফেলে হোটেলবিহীন একটা যায়গায় ট্যাক্সিটা পৌছায়, সেখানে খোলামেলা লোকনন্দিত একটি বাজার। একটা ফুলের দোকানের সামনে ট্যাক্সি থামে। সৈকতের আরামকেদারায় সিয়েস্তামগ্ন বিশালদেহী এক কৃষ্ণকায় মহিলা ধড়ফরড় করে উঠে গাড়ির পেছনে বসে থাকা ভদ্রলোককে চিনতে পেরে মুখে হাসি আর কথার খই ফোটাতে ফোটাতে তাকে একটা গ্লাডিওলার তোড়া দেয়, সকাল থেকেই তার জন্য এটি সে আলাদা করে রেখেছিল।

আরো কয়েক ব্লক পরে ট্যাক্সিটা ধারালো পাথুরে ঢালের দিকে উঠে যাওয়া রদ্দি এক পথের দিকে বাঁক নেয়। টিলার উপরে গরিবদের দুঃখভরা কবরস্থান। হালকা মরচেপড়া বড় দরজায় সে ধাক্কা দেয়। ফুলের তোড়া নিয়ে রোদে পুড়ে ছাই, মূল্যহীন হাড়ের টুকরো আর কফিনের জঞ্জাল ও আগাছায় গিলে খাওয়া কবরস্থানের পথ ধরে সে হাটতে থাকে। অসম্ভব তেতে থাকা পাথরের টুকরা গুলি তার রাবার সোলের জুতা ভেদ করে পায়ের তলায় খোঁচা মারে। ঝোপঝাড় থেকে একটা ইগুয়ানা বেড়িয়ে চকিতে থামে, খানিকটা দেখে দৌড়ে পালায়।

তিনটি কবর পরিষ্কার করে ঘামে ভিজে যখন ক্লান্ত, ঠিক তখনই চোদ্দ বছর আগে তার স্ত্রীর নাম আর মৃত্যুর তারিখ খোদাই করা হলদেটে মার্বেলের ফলকটি সে খুঁজে পায়। ফুল গুলি কবরে রাখে। কাজ শেষ। তেরো বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যেক ১৬ আগস্ট, একই সময়ে, একই হোটেলের একই কামরায়, একই ট্যাক্সিতে চেপে, একই ফুলবিক্রেতার কাছ থেকে ফুল নিয়ে আগুনঝরা রোদে একই কবরস্থানে এই সফরটা সে করে আসছে। এর পরেরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত, ফিরতি ফেরিতে উঠার আগ পর্যন্ত তার আর কিছু করার থাকে না।

সেই সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসে সে। সুতির আন্ডারওয়ার ছাড়া আর কিছুই তখন তার পরনে নেই, সফরে পড়তে শুরু করা বইটা সে আবার পড়তে শুরু করে। ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’। বরাবরই সে বেশ ভালো পাঠক। তার পছন্দের বই গুলো বিভিন্ন ধাচের উপন্যাসিকা, যেমনঃ লাসারিইয়ো দো তোমেস, দ্যা ওন্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি, দ্যা আউটসাইডার – খুটিয়ে খুটিয়ে সে পড়েছে। কয়েক বছর ধরে, পঞ্চাশ যখন তার ছুঁই ছুঁই, সে ডুব দিয়েছে অতিপ্রাকৃত উপন্যাসের গভীরে। ড্রাকুলা তাকে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই মুগ্ধ করেছে, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় সিলিং থেকে ঝুলে থাকা পাখার অবিরাম গর্জনের কাছে নতিস্বীকার করে বুকের উপর বইটা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে দুঘণ্টা পরে, অন্ধকারে প্রচন্ড ভাবে ঘামতে ঘামতে, খিটখিটে মেজাজ আর বোবা এক ক্ষুধা নিয়ে।

হোটেলের পানশালা রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা। সচরাচর এসময়ে যে কজন খদ্দের থাকে তার তুলনায় আজ সংখ্যাটা একটু বেশি। পরিচারকটিকে দেখে মনে হল না গত বছর সে ছিল। সে একটা টোস্টেড পর্ক – চীজ স্যান্ডউইচ আর দুধ মেশানো কফি চাইল। পরিচারক খাবার নিয়ে আসতে আসতে সে লক্ষ করল চারপাশে বরাবরের মতই বয়স্ক খদ্দেরদের ভিড়। একটি মুলতা মেয়ে বাজার চলতি ‘বোলেরো’ গাইছে, আর সেই অগাস্তিন রোমেরো, এখন অনেক বুড়ো, চোখে দেখতে পায় না, দরদ দিয়ে মেয়েটির গানের সাথে গ্রান্ড পিয়ানো বাজাচ্ছে।

একা একা খাওয়ার অস্বস্তিতে সে দ্রুত খাওয়া সারল। তবে মিষ্টি নরম সুরের গানটা ভালোই লাগছে, মেয়েটিও ভালো গাইছে। সংবিৎ ফিরে পেতে দেখে ছড়ানো ছিটানো টেবিল গুলোয় তার সামনে অবশিষ্ট রয়ে গেছে কেবল তিন জোড়া দম্পতি আর নিসঃঙ্গ এক আগন্তুক। লোকটির ধাঁচ বেশ আলাদা। পরনে সাদা লিলেনের স্যুট, ছাই রাঙা চুল, গোফ মাস্কেটিয়ার্সদের মত পাকানো। টেবিলে একটি ব্রান্ডির বোতল আর আধখানি পানীয় ভর্তি গ্লাস, দেখে মনে হয় জগতে কেউ নেই।

পিয়েনোয় সুন্দরভাবে বোলেরোর ঢঙে ক্লদ দ্যবুসির ‘ ক্লেয়ার দ্যা লুন ‘ বাজছে। মুগ্ধ মার্ক এলেন সোডা ও বরফ দিয়ে জিন চাইল।

প্রথম চুমুকেই দুনিয়াটা বদলে গেলো। শরীরে একটা চনমনে ভাব জাগে। সুরের সঙ্গে সুরার পবিত্র মিশ্রনে নিজেকে তার মুক্ত বিহঙ্গ মনে হয়। তার মনে হয়েছিল সামনের টেবিলে বসা লোকটি তাকে দেখেনি। কিন্তু জিনে প্রথম চুমুক দেওয়ার পর যখন দ্বিতীয়বার লোকটির দিকে তাকায়, অবাক হয়ে বুঝতে পারে লোকটি তাকে লক্ষ্য করছে। সে চোখ সরিয়ে নিল, লোকটিও ততক্ষণে ঘড়ির দিকে তাকায়, অস্থির ভাবে সময় দেখে, দরজার দিকে চোখ ফিরিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে আরেক পাত্র মদ নেয়, কারন এরই মধ্যে সে বুঝতে পারে মার্কের গাঢ় নীল চোখ তার দিকে তাকিয়ে। সেও তখন সামনে তাকায়। মার্ক তার দিকে তাকিয়ে দ্বিধাহীনভাবে হাসে, লোকটিও মাথা নুয়িয়ে সম্ভাষণ জানায়। সামনে এগিয়ে মার্ক পুরুষোচিত ভাবে প্রস্তাব দেয়, ‘আমার সাথে বসে একচুমুক পান করবে?’

‘সসম্মানে’ থতমত খেয়ে লোকটি বলে।

টেবিলের উপর মার্কের গ্লাসটি তখনো খালি হয় নি। আগন্তুকের জন্যে এক পেগ আর নিজের জন্যে আরেক পেগ ঢালে সে।

‘তোমার সুস্বাস্থ্য কামনায়’, মার্ক বলে। সেও পালটা উত্তর দেয়, তারপর এক ঢোঁকেই দুজন গ্লাস খালি করে দেয়। লোকটির গলায় আটকে বিষম খায়, সারা শরীরে ঝাকুনি দিয়ে কাশির দমক উঠে, এতোটাই যে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। সে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি মাখা সাফসুতরো রুমাল বের করে, মার্কের দিকে জলে ভরা চোখ নিয়ে তাকায়। চোখ মুখ মোছা ও গলা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘক্ষণ দুজনেই নিরব থাকে। মার্ক সাহস করে লোকটির পাশে বসে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তুমি কি নিশ্চিত যে আর কেউ আসবে না? ‘

‘না’, কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই সে বলে, ‘ একটা ব্যবসার ব্যাপার ছিল, কিন্তু এখন আর আসবে না।’

মার্ক হিসেবি সংশয়ের সুরে বলে, ‘ব্যবসা? ‘

লোকটি জোড় দিয়ে বলে, ‘ এখানে আমার আর কোন কাজ নেই।’

মার্কের সুন্দর অবয়বের দিকে লোকটি চোরাচোখে তাকিয়েই থাকে। তারা পরস্পরের বয়স আন্দাজ করার খেলায় মাতে। ভুল করে একটি বছর সে বেশি বলে ফেলে। কথা বলার ধরন থেকে সে লোকটির বের করার চেষ্টা করে লোকটি কোন দেশের, কিন্তু তিনবারই ভুল করে। সে তার পেশাও অনুমান করে, কিন্তু লোকট চট করে জানায় সে একজন ইঞ্জিনিয়ার। মার্কের সন্দেহ হয়, লোকটি সত্য আড়াল করছে।

এগারোটা সময় গান বন্ধ হয়ে যায়। সবকিছু বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করে। মার্ক এতক্ষণে লোকটিকে ঠিকঠাক বুঝতে পারে, যেন একসাথে তারা আজীবন কাটিয়েছে। সে লক্ষ্য করে লোকটি পরিপাটি ও ধোপদুরস্ত – এতোটাই, যে মনে হয় নখ গুলো এপর্যন্ত পালিশ করা। মার্ক তার জীবনে, এমনকি স্বপ্নেও ঘটেনি তেমন একটি পদক্ষেপ নিতে নিজের ভেতর তাগিদ অনুভব করে। কোন হেয়ালি না করেই সে বলে, ‘ এবার আমরা উঠি?’

সে জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ায়, নেশাটাকে বশ করার জন্যে মাথাটাকে ঝাকি দেয়, চোখ দুটো আনন্দে ঝকঝক করছে।

‘প্রথমে আমি উপরে যাই, তারপর তুমি বিল দাও,’ মার্ক বলে। ‘দোতালা, ২০৩ নাম্বার রুম, সিঁড়ির ডান পাশে। দরজায় টোকা দিবে না, সামান্য ধাক্কা দিলেই হবে।’

মধুর এক অস্থিরতা নিয়ে মার্ক দোতালার বিশ্রী কামরাটায় ফিরে আসে। সিলিং ফ্যান ছেড়ে অন্ধকারে স্বচ্ছন্দে পোশাক ছাড়ে, তার কাপড় দরজা থেকে শুরু করে বাথরুম পর্যন্ত মেঝেতে টপটপ করে ঝরে পড়ে। ড্রেসিং টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বালতেই সে সে চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হয়, শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক আর হাতের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণ করতে সে লম্বা একটা শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে। তড়িঘড়ি করে সবকিছু ধোয়ঃ পুরুষাঙ্গ, বগল, জুতার রাবারে ঘষটা খাওয়া আঙ্গুল। দুপুরবেলা প্রচণ্ড ঘাম হওয়া সত্ত্বেও রাতে গোসল করার চিন্তা তার মাথায় ছিল না। দাঁত মাজার সময় না থাকায় জিবে একদলা টুথপেস্ট রেখে সে কামরায় ফিরে আসে।

সিঁড়ি ভাঙার শব্দ পেয়ে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আগেই সে দরজা খুলে দেয়। লোকটি আতকে উঠেঃ মা গো! কিন্তু মার্ক তাকে দাড়ানোর সময় দেয় না। হ্যাঁচকা টানে তার জ্যাকেট খোলে, খুলে ফেলে টাই আর শার্ট, কাঁধের উপর দিয়ে সেগুলো মেঝেতে ছুড়ে মারে। ল্যাভেন্ডারের তিব্র সুগন্ধে কামরা ভরে উঠে। শুরুতে লোকটি সাহায্য করার চেষ্টা করে, কিন্তু সাহস আর কর্তৃত্ব নিয়ে মার্ক তাকে থামিয়ে দেয়। কোমর পর্যন্ত খালি হওয়ার পর সে খাটে বসে জুতা-মোজা খোলে। লোকটি যখন বেল্টের বকলেস খোলে, মার্ক তখন তার প্যান্টটি খুলে ফেলার জন্যে টানাটানি শুরু করে। চাবিরতোড়া, একগাদা টিকেট আর টাকা পয়সার মেঝেতে ছড়িয়ে পরা দুজনের কেউই লক্ষ্য করে না। শেষে লোকটির হাটু পর্যন্ত লম্বা অন্তর্বাস খুলতে সাহায্য করে। সে লক্ষ্য করে লোকটির শিশ্ন তার নিজেরটার মত ছিমছাম নয়, বরং শান্ত আর উন্নত।

লোকটিকে কোন সুযোগ না দিয়ে মার্ক তার উপর চড়াও হয়ে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। দুজনেই ঘামে ভিজে ক্লান্ত-শ্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত লোকটির কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে তীব্রভাবে সে নিজের ভাগটুকু উপভোগ করে। সে লোকটির উপরেই থাকে। ঘাম, গরম আর ফ্যানের দমবন্ধ করা আওয়াজের নিচে নিজের বিবেকের প্রাথমিক সংশয়ের সঙ্গে সে একাকী লড়াই করে, যতক্ষণ অব্দি না সে বুঝতে পারে যে তার শরীরের ভারের নিচে আড়াআড়ি ভাবে নগ্ন লোকটি ভালো ভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। শরীরের উপর থেকে নেমে মার্ক এবার উপরে তাকিয়ে তার পাশে শুয়ে থাকে। লোকটি অনেক্ষণ আনড় শুয়ে থেকে প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু আমি কেন?’

‘আমার কাছে তোমাকে সুপুরুষ মনে হয়েছে’, মার্ক বলে।

‘তোমার মত কারো কাছ থেকে আমন্ত্রণ পাওয়াটা’, সে বলে, ‘সম্মানের।’

রাতের নিস্তব্ধতার ভেতর তারা দুজনেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে থাকে। কাছেই ডানা ঝাপটানোর আবছা শব্দ পাওয়া যায়। লোকটি জানতে চায়, এ শব্দ কিসের। মার্ক তাকে সারসের নৈশ স্বভাবের কথা শুনায়। অনেক্ষণ ধরে তুচ্ছ ফিসফিসানির পর পুনরায় তাদের অভিযাত্রা শুরু হয়, প্রথমে আঙুল, তারপর খুব ধীরে ধীরে বুক থেকে শুরু করে পেটের নিচ পর্যন্ত। সে তার পায়ের পাতা দিয়ে লোকটির পায়ের পাতা ছোঁয়। অনুভব করে তার সারা গা ভাঁজ খাওয়া আর নরম, যা তাকে এপ্রিল মাসের ঘামের কথা মনের করিয়ে দেয়। তারপর কান আর গলায় নরম চুম্বনের মাধ্যমে লোকটিকে সে উত্তেজিত করতে শুরু করে। প্রথমবারের মত তারা ঠোঁটে চুমু খায়। লোকটি তাকে আস্তে আস্তে উত্তেজনার চরম বিন্দুতে নিয়ে যায়।
এরকম শিশুসুলভ হাত যে এতটা স্নিগ্ধতা দিতে পারে, তা আবিষ্কার করে মার্ক অবাক হয়। লোকটি দৃঢ়তার সঙ্গে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মার্কের পছন্দ আর পন্থা মত তাকে বশে আনে। আনন্দে ভরিয়ে দেয়।

দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভবন কাপিয়ে তোলা বজ্রপাতের আওয়াজ আর দমকা হাওয়ায় সজোরে জানালার কপাট খোলার ঝটপট শব্দে মার্ক জেগে উঠে। দৌড়ে মার্ক জানালা বন্ধ করে। আরেকদফা বজ্রপাতের আলোয় বিক্ষুব্ধ লেকটি তার চোখে পরে, বৃষ্টির ভেতর দিয়ে দিগন্তের বিশাল চাঁদ আর ঝড়ে পাখা ঝাপটানো সারস গুলি তার মন বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দেয়।

বিছানায় ফিরতে গিয়ে দুজনের ছড়ানো কাপড়ে তার পা জড়িয়ে যায়। পরে তুলে নেবে ভেবে নিজের কাপড়টা সে মেঝেতে ফেলে রাখে। চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখে লোকটির জ্যাকেট, তার উপরে রাখে শার্ট আর টাই, প্যান্টটা যাতে কুঁচকে না যায় সে জন্যে সযত্নে ভাঁজ করে। পকেট থেকে পরে যাওয়া চাবি, পকেটনাইফ, আর টাকা তুলে রাখে। তারপর লোকটির কাধের কাছে শুয়ে পরে কোমর জড়িয়ে ধরে। ঘামে ভেজা দেহের এমনিয়াগন্ধী নিঃশ্বাস তাকে আবার উত্তেজিত করে তোলে। সামান্য দুষ্টুমি করে সে লোকটির পেছনদিকে আঙুলের ডগা দিয়ে খেলতে শুরু করে। লোকটির নাক ডাকা আচমকা বন্ধ হয়ে যায়, বিশ্রান্ত শিশ্ন আবার জেগে উঠতে শুরু করে। এক মুহূর্তের জন্য লোকটিকে সে ছেড়ে দেয়, একটানে রাত পোশাক খুলে ফেলে। কিন্তু আবার লোকটির কাছে ফিরে এলে সে বুঝতে পারে তার শিল্পকলা বিফলে গেছে। লোকটি এমনভাবে ঘুমের ভান ধরেছে যেন তৃতীয় বারের মত তাকে আর কোন ঝুঁকি না নিতে হয়। মার্ক অন্যদিকে ঘুরে রাতপোশাকটি পরে নেয়, উল্টো দিকে ফিরে গভীর ঘুমে ডুবে যায়।

চিরাচরিত নিয়মে তার ঘুম ভাঙ্গে সকালবেলা। চোখ বন্ধ করে এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সে সামান্য শুয়ে থাকে।

সহসা, বিদ্যুৎ ঝলকের মত, নির্মম বিবেক তাকে বজ্রপাতের মত আঘাত করে। কারন সে ব্যাভিচার করেছে, শুধু তাই নয়, এই প্রথম কোন পুরুষের সাথে শুয়েছে। ভয়ে ভয়ে সে কাধের উপর দিয়ে বিছানার দিকে তাকায়। লোকটি নেই, বাথরুমেও নেই। সবগুলি বাতি জ্বালানো, লোকটার কোন কাপড়ও নেই। বরং মেঝেতে ছুড়ে ফেলা তার কাপড় গুলো যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করে চেয়ারের ওপর সাজানো। এই মুহূর্তটির আগ পর্যন্ত তার মাথাতে একবারও আসে নি যে, সে লোকটি সম্পর্কে কিছুই জানে না, এমনকি তার নামটিও না। এই পাগলামি ভরা রাতের লোকটির একমাত্র যে চিহ্ন রয়ে গেছে তা হল ল্যাভেন্ডার এর মৃদু সুবাস। যাই হোক, নটার ফেরি ধরতে হবে, তড়িঘড়ি করে সে সব গুছাতে শুরু করে। ব্যাগে ভরার জন্য খাটের পাশের টেবিল থেকে বইটা তুলে নেওয়ার সময় সে দেখতে পায়, তার অতিপ্রাকৃত কাহিনীর বইটির ভেতর লোকটা বিশ ডলারের একটা নোট রেখে গেছে।

(*** ‘আগস্টে দেখা হবে’ বা ‘এন আগোস্তো নোস বেমোস’ একটি মিষ্টি অথচ অস্বস্তিকর যৌনতায় ভরা প্রেমের গল্প। ১৯৯৯ সালের মার্চে গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এটি পাঠ করেন। আগস্টে দেখা হবে একটি নভেলার প্রথম অধ্যায়। নভেলাটি রুপান্তরের সময় বহুলাংশে সংক্ষেপ ও পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ঈদে “সমপ্রেম” পেইজে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি সামান্যতম ভালো লাগলেও তার পুরো কৃতিত্ব মার্কেজের। আর খারাপ লেগে থাকলে তা অবশ্যই রুপান্তরের দোষে, যে দোষ সম্পূর্ণই আমার।)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.