সমকামিতা ও আমাদের ভঙ্গুর সহনশীলতা

লেখকঃ Living Large in the Boxes

“এটাই কি তাহলে বাংলাদেশ? 

এর ভবিষ্যৎ কি হবে? নাউজুবিল্লাহ! দেশটা এতোটা নিচে নেমে গেলে কেমনে কি? আগামীতে আপনার ছেলে মেয়েরাও যে এদের দারা প্রভাবিত হবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? তোরা কেন এমন করিস? বে অব বেঙ্গল কে ডেড সি বানাবি আল্লাহ তুমি কি আছ? এদের সবাইকে ধরে লিঙ্গ কর্তণ করে হিজড়া বানিয়ে হাতে চুড়ি পরিয়ে গলায় ঢোলবেধে শাহাবাগে বসিয়ে জুতা পিটা করতে হবে, এরাই এদেশের আবহমান আমাদের বাঙালী সংস্কৃতিকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করতে চায়। এদেরকে এখনি প্রতিহত করতে হবে। গে কুত্তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই জুতা পেটা করতে হবে। কয়েকদিন আগেই একটাকে রামধোলাই দিয়েছিলাম। একটা বেটা কুকুর ও তো অন্য একটা বেটা কুকুরের সাথে শারীরিক ভাবে মিলিত হয়না। হাত পা বেধে এদের ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া দরকার। পাবলিক কি খালি পায়ে ছিল? কারো পায়ে জুতা বা সেন্ডেল ছিল না? কুকুরগুলোর চেহারা দেখে রাখতে পারলে ভাল হতো। ওখানে যারা ছিলো, ছেলেরা জারজ, আর বেহায়া মাইয়া গুলি বেশ্যা, এদের উপর আল্লার গজব পড়া উচিৎ, দেশটাকে নোংড়া করে ফেলল। এইসব লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের কি কমু, বাইঞ্চোদ সব। খানকির পুতের দেশে মাগির পুতের বসবাস। মুসলমানদের মাটিতে ওরা এত সাহস পায় কিভাবে? কুত্তাগুলারে ব্রাশ ফায়ার করে আগুনে পুড়িয়ে মারা উচিত। আল্লাহ তুমি এদের ধ্বংস কর। আমিন।।”

পহেলা বৈশাখে কিছু মানুষ একটা র‌্যালি করেছে। বৈচিত্র্য উদযাপনের জন্য ষড়ঋতুর ছয়টি রং ব্যবহার করা হয়েছে। এতেই অনলাইন পত্রিকাগুলোর মন্তব্যে সবার যে মনোভাব আর ঘৃণা দেখছি তাতে মনেহচ্ছে অশ্লীল কথাবার্তার মাধ্যমে নিজেদের ঘৃণা জাহির করতে পারাটাই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অনেক বড় একটা মূল্যবোধ। তাই সবাই গালি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে। এই দেশে সব মানুষ পাশাপাশি নিজের ধর্ম, জাতিসত্তা আর বৈচিত্র্য নিয়ে সহনশীলতার সাথে বাস করে এসব কেবল লোক দেখানো কিছু বুলি মাত্র।

পৃথিবীর দশ শতাংশ মানুষ সমকামী। সময়ের শুরু থেকেই এই সত্য বিরাজমান। কোন রকম ধার্মিক, সাংষ্কৃতিক বা নৈতিক অঙ্গন দেখিয়ে তা পরিবর্তনের অবকাশ নেই। এংলো-স্যাক্সন যুগেও তারা ছিলো, অন্ধকার যুগেও ছিলো, আলোর যুগেও ছিলো, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এবং তারা তাঁদের পছন্দমতো জীবন বেছে নেবে। এতে আপনি-আমি আপত্তি তোলার কে? এরাতো আপনাকে সমকামী হবার দাওয়াত দিচ্ছেনা।

সমকামিতা কোন রোগ নয়। সমাজের সেই অংশের মানুষদের জন্য, যারা সমলিঙ্গের প্রতি যৌন এবং মানষিক আকর্ষন বোধ করে থাকে, তাদের জন্য এটা জীবনের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। সমকামিতা পাশ্চাত্যের কোন বিশেষত্ব নয়।তবে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং আইন পাশ করেছে সমকামীদের সমান স্থান নিশ্চিত করতে। সেখানে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যৌনমিলন এখন আর কোন অপরাধ নয়। অপরাধ নয় একজন আরেকজনকে ভালবাসলে। ধীরে ধীরে তারা একজন আরেকজনকে বিয়ে করতে সক্ষম হচ্ছে। সংস্কারপন্থীদের জন্য এই যুক্তি মেনে নেয়া কষ্টকর বইকি, কিন্তু তাদের যদি এসব কথা নাই শুনানো হত তাহলে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ করতে পারতেন না। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আইন চালু করতে পারতেন না। বেগম রোকেয়া তার রচনা দিয়ে ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে সফল হতেন না। দক্ষিন আমেরিকা থেকে দাশপ্রথা কখনই উচ্ছেদ করা যেত না।

মন্তব্যগুলো পড়ে আরো মনে হচ্ছিল সমকামীদের গুষ্ঠি উদ্ধার করা ধর্মীয় বিধান। কোরআনে কি ভালবাসাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সমকামিতা কীভাবে সমাজ নষ্ট করবে? সমকামীরা তো সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকেনা। সুযোগ দিলে অনেকেই বিবাহিত দম্পতির মতো একত্রে সুখদুঃখে একসঙ্গে থাকতে চাইবে। এর ফলে বাকিদের মতো সমকামীদেরও স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত হবে। ভালো থাকার অধিকার নিশ্চয়ই সবার আছে।

কিন্তু আমাদের এই সমাজের মানুষেরা তাদের মনের মতো কিছু না হলেই ধর্মকে টেনে আনে। নারী অধিকার বলি আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আঁতে ঘা লাগলেই ধর্ম আসে। ঘুষ, জোচ্চুরি, প্রতারণা, মানুষের অধিকার হরণ করা, অন্যকে চুষে সম্পদের পাহাড় বানানো এসব ক্ষেত্রে আর ধর্ম আসে না। বাংলাদেশই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ধর্মের নামকরে ধর্মকেই প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করা হয়। সমকামীরা ঘুষ খাচ্ছে না, চুরি করছে না, গুদামজাত করে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি করছে না, জঙ্গীবাদ করছে না, খুন করছে না। শুধুমাত্র ভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি হবার কারনে রাস্তায় কি দলবেঁধে তারা হাটতে পারবে না? দেশে তো কত অন্যায় হচ্ছে, অবিচার হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে। মদ খাওয়া তো হারাম, খুঁজলে এই দেশে খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যে জীবনে এটা ছুঁয়ে দেখে নি। সুদ বা ঘুষ কি হালাল? এখানে কয়জন আছেন যে ব্যাংকে টাকা রাখেন নাই? এইসব নিয়ে কোন কথা নাই, কারণ তাতে নিজের স্বার্থে টান পড়ে। আর আমরা সেসব থেকে চোখ ফিরিয়ে নিশ্চুপ থেকে যে বিষয় আমাদের কোন ক্ষতির কারণ হচ্ছে না তা নিয়ে অশ্লীল গালির বন্যা বইয়ে দিচ্ছি। কারণ ওইসব অন্যায় আর দুর্নীতির সাথে আমরা নিজেরাই জড়িত। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজেদের পূর্ণ সম্মতিতে কি করল সেটা নিয়ে তৃতীয় ব্যাক্তির কি বলার থাকতে পারে?। প্রত্যেকের স্বাধীনতা আছে সে কার সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হবে সেটা নিজেই ঠিক করবার, যদি না তা অন্য কারও কোন ক্ষতির কারন হয় এবং দুইজনের যদি তাতে সম্মতি থাকে। আপনি ব্যক্তিগত ভাবে সমকামী যৌনতা সম্পর্কে কি মনোভাব পোষণ করেন তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একজন মানুষের অধিকার কতটুকু। যতক্ষণ পর্যন্ত না কারো যৌন প্রবৃত্তির কারণে কোন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, কারো ক্ষতি হচ্ছে, ততক্ষণ এই বিষয়ে অন্য মানুষের কিছুই বলার থাকতে পারে না।

অনেকেই সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত থাকেন। নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন। সমকামীরা হচ্ছে কুৎসিত রুচিসম্পন্ন, মানসিক বিকারগ্রস্ত। এমনকি প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম ওজর আপত্তি। যারা শিক্ষিত, ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, গে লেজবিয়ান ইত্যকার শব্দের সাথে কমবেশি পরিচিত হয়েছেন, তাদের অনেকেই এখনো ভাবেন পুরো ব্যাপারটি উৎকট ধরনের ব্যাতিক্রমধর্মী কিছু, এ নিয়ে ‘ভদ্র সমাজে’ যত কম আলোচনা করা যায় ততই মঙ্গল। আসলে এগুলো সবই সমকামিতা সম্পর্কে না জানার ফল। অধিকাংশ মানুষই চটি এবং ক্যানভাসারলব্ধ জ্ঞানই বহন করে এবং সেগুলোই মনের মাধুরী মিশিয়ে বিতরণ করে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উগ্রভাবে সমকামিতা নিয়ে অনেক রসিকতা হয়। শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করে অন্যকে ‘’তুই গে’’ বলতে পারলে অনেক মজা হয়, উচ্চ মানের রসিকতা হয়। আর তার সাথে অনলাইনে ইদানিং যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন রসময় পেজ-পোর্টাল। ফলে ধারণা আরো বিকৃত হচ্ছে।

আপনি যদি সমকামিতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন তাহলে দেখতেন তারাও ঠিক আপনার মতই প্রিয় মানুষটিকে ভালবাসতে জানে, দেখতে পেতেন ভালবাসার জন্য তাদের আকুলতা। আরেকজন মানুষকে ভালবাসার আপনার যেমন অনুভূতি, তাদেরটাও ঠিক একই রকম। তাই একটা র‌্যালি করে দেশটাকে নিচে নামানোর কোন প্রশ্ন এখানে আর থাকে না। চিল কান নিয়ে গেল তাতে বিশ্বাস না করে কান এর জায়গায় হাত দিয়ে দেখুন কান সেখানেই আছে!

সমকামীদের প্রথম যুদ্ধ হয় নিজের কাছে স্বীকার করে নেয়া যে সে অন্যদের মতো ‘স্বাভাবিক’ না, সে এমন একটা কিছু যেটাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তার এমন একটা ‘বিশেষত্ব’ আছে যে কথা জানতে পারলে তার সব প্রিয় মানুষগুলো তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে । এটা কি পরিমাণ অসহনীয় কষ্টের হতে পারে তা হয়তো যারা কখনো এরকম ‘সব হারাবার’ ভয় এর মুখোমুখি হইনি তারা বুঝতে পারবো না। অথচ আজকে পত্রিকাগুলো যে যেখান থেকে পারছে ছবি আর ইচ্ছে মত খবর পরিবেশন করছে। একবার ও ভেবে দেখছে না যে এর কারনে হয়ত কাউকে অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। কেউ হয়ত সারাজীবনের জন্য আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে অপরাধী ভাববে।

একটা র‌্যালি করা এমন কি খারাপ কাজ আমি বুঝলাম না যাতে করে সমস্ত দেশ ও জাতির মূল্যবোধ মাটির সাথে মিশে যাওয়া শুরু করে দিল। সমকামী মানুষতো আমাদের সমাজে আছে। সমকামীদের অধিকার মানে এই নয় আপনার আমার সবার সমকাম করতে হবে। এটা হচ্ছে এমন একটা বিষয় যারা সমকামী তাদেরকে মেনে নেয়া। ইচ্ছা করে কেউ সমকামী হয় না এটা প্রকৃতিগত ভাবেই। আপনার ক্ষেত্রে যেমন আপনি পুরুষ হলে নারী আর নারী হলে পুরুষের প্রতি আপনি আকৃষ্ট – এটা যেমন ইচ্ছা করে আপনি তৈরি করেননি, প্রকৃতি গত ভাবেই পেয়েছেন, তেমনি সমকামীরা একই লীঙ্গের মানুষদের প্রতি আকৃষ্ট – এটা তারা প্রকৃতিগত ভাবেই পেয়েছে। এটা মেনে নেয়াটা মানবিক, না মানাটাই অন্যায়। কারন সংখ্যায় কম বলেই সমাজে তাদেরকে আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। আজকের পৃথিবীতে সমকামীতার ব্যাপারটা আর লুকোচুরির পর্যায়ে নেই। এটাকে সামগ্রিক মানবাধিকারের একটা অংশ হিসেবে দেখা হয়। তাছাড়া আমি মনেকরি একজন মানষের সঙ্গী কে হবে সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারণ আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, কে আপনার বউ হবে সেটা দেশের আইন আপনার উপর জোর করে চাপিয়ে দিক। সমকামীদের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের ধার্মিক ও সাংষ্কৃতিক প্রেক্ষাপট অন্তরায় বইকি, তবে সেটাকে উপেক্ষা করে দেশ ও সমাজে আমাদের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে, যদিও এটা বলাবাহুল্য যে এতে সময় লাগাটা স্বাভাবিক। অন্ধের দেশে আয়না ফেরী করার বিপত্তি অনেক।

প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবীর অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ সমকামী, উভকামী বা বাই সেক্সুয়াল অথবা ট্রান্সজেন্ডার হয়ে জন্মগ্রহন করে। এটাকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে সমকামীতা একটি অতি সাধারণ প্রবৃত্তি৷ এখানে ধর্ম, আমাদের সমাজ ইত্যাদি কী বলল না বলল তাতে কিছু যায় আসে না৷ ইতিহাস, প্রমাণ, বিজ্ঞান তার সত্য নিয়ে এগিয়ে যাবে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজকে একদিন এটা মেনে নিতেই হবে এবং এটাকে সম্মান দেখাতে হবে। এই বিষয়ে সবার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে, তার মানে এই নয় যে, সমকামীরা অস্বাভাবিক এবং তারা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে না। সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ছাড়া দর্শনে ও মননে তারা আমাদের সমাজের অন্য আর দশ জন মানুষের মতই। আর মানুষ কে মানুষ হিসেবে দেখতে পারাটাই বোধ হয় সবচাইতে কঠিন কাজ, যেদিন আমরা এটা করতে পারব, সেদিন হয়ত আরও অনেক সমস্যারই সমাধান পাওয়া যাবে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.