
শঙ্খ দীপ
১.
ইঞ্জিনিয়ার না ইন-জানোয়ার বলা উচিৎ! ওর মত চুতিয়া বয়ফ্রেন্ড আর হয় না! আর আমিও সেরম, আমার তো ভাল জিনিষে চোখ যাবে না! যথারীতি… এসব যতবার ভেবেছি ততবার কানে কানে কে বেশ বলে যায় “চুপ কর… হয়েছে অনেক ন্যাকামো! এবার থাম!” সঙ্গে সঙ্গে জানাবের ফোন আর কুচু বাবু সোনা মনা আরো কত কি! আর আমরা আর্টসের ছেলেরা তো একটু ভাবুক। এতেই গলে যাই! কতবার ভেবেছি ব্রেকাপ করে নেবো! এর মত পাব্লিকের সাথে প্রেম করা যে কি হ্যাপার ব্যাপার যে করে সে’ই বোঝে! প্রথমে তো আউট না! সে নয় মানা গেল। স্ট্রেট সেজে থাক– ঠিকাছে! তা না ওনাকে সুপার স্ট্রেট সাজতে হবে! ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে গেলে ভুলেও তাকায় না! আর বন্ধুগুলো তো এক একটা আস্ত পিস! সব কটাই আলিপুরে সাজিয়ে রাখার মত! ইঞ্জিনিয়ারিং করছে বলে যেন আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে। কতকিছু বলে আমাকে আর আমার বন্ধুদের। উনি তো প্রতীবাদ করেনই না, বারণও করে না! যা তা!
সারাদিন ক্লাসের পর দেখা করব! না ক্যাম্পাসে না, অন্য কোথাও! সেটা যে কোথায় তা আমি জানি না! অন্তত আমাদের পৃথিবীতে কি’না আমি জানি না! ঠিকাছে বলো কোথায়? — না! আজ না! প্রতিদিনই তার কাছে আজ। কাল.. পাক্কা! এরাই বাঙালীর ইঞ্জিনিয়ার! সব কাল। প্রতিদিনই তার বন্ধুদের সাথে বেড়ানো থাকে! সব বুঝি… বেড়ানো মানে তো খেলার মাঠের কোণায় বসে টানা আর ঢালা! এক এক সব এক! জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল মাইরি! দুদিন ফোন না ধরলেই হল, বাবুর রাগ! তখন বন্ধুরা না, নিজে আসরে নামেন! ছক্কা, গে, হোমো.. কি বলে না! পারলে বাপ-মা তুলে গালাগালি দেয়! এটার মানে তিনি আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন! কি আপদ! এটা আবার কি ক্ষমা চাওয়ার ধরণ? কথায় কথায় বলে “আমরা ইঞ্জিনিয়ার… আমাদের সবকিছু একটু আলাদা!” আলাদা না ছাই! ভীতুর ডিম। এরপরও পাত্তা না দিলে সোজা ডিপার্টমেন্টে। এসে কাকুতিমিনতি করে এমন করবে তার বুকে কত পাটা যে সবার সামনে তার আমাকে accept করতে কোন সমস্যা নেই! ওর মত Open আর কেউ নেই! যাই আমি গলে যাব… ওমনি “আগে আমি বেরই.. তারপর তুমি বেরবে!” আমি একদিন রেগে বলেই দিলাম “প্লিজ এসো! তুমি আমাকে মুক্তি দাও! আমি আর তোমাকে নিতে পারছি না!”
“তুমি কথায় কথায় রেগে যাও কেন বলো তো?” রাগব না তো কি করব বাড়া! স্মার্ট হবে এই হবে সেই হবে বলেই ওর প্রোপোজাল accept করেছিলাম। বাল.. সব বাল! স্মার্ট না ছাই! ওদের মত মিনমিনে ভিজে বেড়াল আর একটা নেই। কাজকাম নাই… উঠতে বসতে আর্টসের ছেলেদের গালি দেয়। ইনিও দেয়। খালি বলে “তুমি বাদে!” আমিও গালি দিয়ে বলি “তুমি বাদে!” বোঝ ঠ্যালা!
কাল আমাদের দু’বছর হল! সে তো মনে রাখবেই না! মনে করালে বলবে ” আর দু’বছর তিন বছর দিয়ে কি হবে! আজকের দিনটা আছে সেটাই আমার কাছে সব! ” ভাবছে আমি ওর স্ট্র্যাটেজি জানি না! ভুলে গেছে, স্বীকার করবে না, তাই এখন এরম ভাবালুতা দেখাচ্ছে! দু’বছর ধরে দেখছি! ম্যাগিচুল আর অর্ধনিমীলিত চোখে যে আমি কি দেখেছিলাম সে ভগাই জানে!
তবে হ্যাঁ… আদরটি করতে পারে বেশ। এটিই প্লাস পয়েন্ট! রোম্যান্টিকও। তবে সময় বিশেষে। যেমন বৃষ্টি পড়লে না! ওর পরীক্ষার আগের সন্ধ্যাবেলা। কত কথা, কত রোম্যান্স! তখন মনে হয় এবার ফোনটা রাখো… একটু বাথরুম থেকে আসি! আর বৃষ্টি পরলে আমার প্রেম চাপলে ফোন করলে “আরে কি দারুন ওয়েদার.. ঘোমাচ্ছ না? ঘুমাও ঘুমাও! আসো ঘুম পাড়িয়ে দি!” আর ওর একটা চামচা আছে, ওরই বন্ধু, ঋষি। সে’ই একমাত্র জানে ওর ব্যাপারটা। ও হচ্ছে ওর বাহক। বেশি রাগ করলে চকলেট পাঠায় ওকে দিয়ে। প্রথম প্রথম আমার কয়েকটা বন্ধু ভাবত আমি ঋষির সাথে প্রেম করি। আমার নিজেরও খুব অস্বস্তি হত। আর এই দু’বছরে অনেককিছু গা সওয়া হয়ে গেছে! একটুও বদলায়নি!
সেদিন হঠাত ফোন। তুললাম। “কি করছ?”
“পঞ্জিকা দেখছি!”
“এখন? কেন? ”
“তুমি নিজে থেকে ফোন করলে… দেখি আজকে কোন তিথি! সূর্য পূর্ব দিকে অস্ত গেল নাকি!”
“তুমি আমার পেছনে লাগার কোন চান্স মিস করোনা না!”
“না… এবার বলো! কী দরকার!”
” কেন দরকার ছাড়া আমি তোমায় ফোন করি না?”
” না করো… তবে তার জন্য আমাকে অনেক পরিশ্রমও করতে হয়! ”
” ভাল….”
” কি হয়েছে কি বলো? ”
” ভাবছি কাম-আউট করব!”
” কোথায়? বন্ধুদের কাছে?”
“হুম… তুমি খুশি হবে তো!”
” আমার কথা ভেবে কাম আউট করতে হবে না! তুমি তোমার কথা ভেবেই কাম আউট করো! ”
” তুমি আসবে কালকে একবার?”
“কোথায়?”
“ডিপার্টমেন্টের এদিকে…”
” সে যাব… কিন্তু ঐ হিংস্র জন্তুগুলোকে আমার থেকে দূরে রাখবে!”
” কাল অন্তত একবার ওদের সামনে এসো…”
“বেশ”
আমি মনে মনে খুশীই হলাম। যাক… মতিগতি হল তাহলে! at last… ক্যাম্পাসে হাত ধরে প্রেম করার স্বপ্নটা সত্যি হবে এবার!
পরেরদিন সাত সকালে ফোন! “শোনোনা… উঠেছ?”
“হ্যাঁ.. কেন? ”
” না একটা কথা বলার ছিল! রাগ করবে না বলো! ”
” বোলো না, আমি জানি!”
” তুমি সব জানো? কি বলতো? ”
“যে তুমি আজকে কাম আউট করবে না! পরে কোন একদিন করবে!”
” কি করে জানলে তুমি?”
“রাখো তো ফোনটা!”
” তুমি রাগ করলে তো সেই! ”
” আমার পায়খানা পেয়েছে… আমি ওয়াসরুম যাব!”
” ও… যাও! ”
আমি জানতাম। ও লাস্ট মুহুর্তে এসে যে পিছিয়ে যাবে আমি জানতাম! ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না! কি করতে ওর প্রেমে পরেছিলাম কে জানে! আসলে ঠিক প্রেমে পড়িনি… ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। এর একটা ইতিহাস আছে।
দু বছর আগে, আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ার। তখন আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটাও বেশ বড় ছিল। একদিন মাঠের পাশে ছোট মাঠে বসে ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলা হচ্ছে! এদিকে আশেপাশে বিভিন্ন গ্রুপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের মত বসে আছে। আমার এক বান্ধবী রুপা, ওর ডেয়ারে ওকে দেওয়া হল, মাঠের কোনায় যে বড় গ্রুপটা বসে আছে, ওখানে গিয়ে ওদের থেকে কিছু একটা নিয়ে আসতে হবে! রুপা খুব স্মার্ট মেয়ে। টুক করে গেল, টুক করে একটা খালি সিগারেটের বাক্স নিয়ে এল। আমরা খেলছি, দেখলাম ওদের গ্রুপ থেকেও আমাদের গ্রুপে ছেলে পাঠাল। যে ছেলেটি এসেছিল ওর ডেয়ার ছিল, আমাদের গ্রুপ থেকে কোন মেয়েকে নিয়ে যেতে হবে! গেল একজন। কে গেছিল মনে পড়ছে না এখন। এরম করতে করতে আমার ডেয়ার পড়ল। পর পর দুবার ট্রুথ নেওয়া যায় না! খেলার নিয়ম ঠিক হয়েছিল আগেই। রুপাটা এত শয়তান, বলল যা, ঐ গ্রুপে যা! গিয়ে কারোর নাম্বার নিয়ে আয়। এমনিতে এসব কথাবার্তায় আমার লজ্জা লাগে না, তবে সব ছেলে এমন গ্রুপে যেতে একটু অস্বস্তি হয়। কিন্তু প্রেস্টিজের ব্যাপার! এখন না যেতে পারলে…! গেলাম। গিয়ে বললাম আমার তোমাদের কারোর একটা নাম্বার দাও! ব্যস ফাঁসলাম!
একটা ছেলে, পুরো ফাটাকেষ্ট টাইপের গলা ” এই তোমাকে দিয়ে এরকম করে তোমার বন্ধুরা কত ছেলের নাম্বার নিইয়েছে!”
কেলো করেছে! এ আবার কেমন প্রশ্ন! ভয় ভয় যে করছিল না তা না, তাও সাহস অবলম্বন করে বললাম ” excuse me! This is just a game!”
“we know that this is just a game! সেটাই তো বলছি এই গেম খেলতে খেলতে কতগুলো ছেলের নাম্বার নিয়েছো?”
” তোমাদের দিতে না হলে দেবে না… এত কথা বলার দরকার নেই!”
“আগে তোমার নাম্বার দাও… তারপর আমাদের নাম্বার দেবো!” অন্য একজন বলল।
অগত্যা দিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল নাম্বার দেবো! তারপর ভাবলাম যদি কল করে এক্ষুণি, যদি জানতে পারে ভুল নাম্বার দিয়েছি তাহলে ওরা নাম্বার দেবেও না.. আর মানসম্মানের ব্যাপার! আমি কি ওদের ভয় পাই যে নাম্বার দিতে ভয় পাব? ফুস… দিলাম নাম্বার! কে বেশ একটা লিখল। যেমন ভেবেছিলাম, ঠিক ফোন করল। ভাগ্যিস ঠিক নাম্বার দিয়েছিলাম। তারপর ওদের একজন একটা নাম্বার দিল। আমিও ফোন করে দেখলাম, আরেকটি ছেলের ফোন বাজল। যার ফোন বাজল সেই ছেলেটিই সেই গ্রুপে সবচেয়ে চুপচাপ ছিল। কার্লি চুল। চোখ দুটো আধবোজা, যেন ধ্যান করছে। রিমলেস চশমার পিছনে ঐ অর্ধ নিমীলিত চোখ দুটো যেন জ্বলছে। মুখে হালকা হাসি। পরণে একটা ব্লু-রঙের গেঞ্জি। বেশ লাগছে। আমাদের গ্রুপ থেকে ওদের গ্রুপে আসতে আসতেই ছেলেটার দিকে চোখ গেছিল। ইনিই হচ্ছেন আমার গুণধর বয়ফ্রেন্ড। ওর বন্ধুরা ইয়ার্কি মেরে ওর নাম্বার দিয়েছিল।ফোন বাজার আগে থেকেই গাঁইগুঁই করছিল “কেন আমারটা কেন… তোরটা দে!” শেষে যখন শুনল না, আমাকে ফোন তুলে দেখালো ” হয়েছে?”
আমি ফিরে এলাম। আসার সাথেসাথেই রুপা জিজ্ঞাসা করল “নাম জিজ্ঞাসা করেছিস?”
না করিনি। আমি আর যেতে পারছিও না! মাঠের ঐ টুকু কোণাটা ধোঁয়ায় যেন ভরে গেছে। সিগারেটের ধোঁয়া। মদও খাচ্ছিল। ভদকার বোতল বলেই তো মনে হল!
এ গেল প্রথম দেখা পর্ব। আমরা মাঝেমাঝেই ওদিকের ক্যান্টিনে খেতে যাই! ক্যান্টিনের সামনেই ওদের মেটালারজি ডিপার্টমেন্ট। পরপর কিছুদিন দেখা হয়েছে। মানে, চোখাচোখি হয়েছিল আর কি!
একদিন শরীর খারাপ, ইউনিভারসিটি যাইনি। একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন।
“হ্যালো..”
“আজকে ইউনিভ আসনি?”
” কে বলছেন? ”
“ঋত্বিক! ”
“কে ঋত্বিক?”
“সেই দিন নাম্বার নিলে! ”
“ম্যাগিচুল? ” আমিও যা, মুখ থেকে বেড়িয়ে গেছিল, ইচ্ছা করে বলতে চাইনি।
” মনে রেখেছ তাহলে!”
” আমার মেমোরি খুব সার্প ”
” হ্যাঁ… তোমাদের তো খুব মুখস্ত করতে হয়… সার্প তো হবেই ” সেদিন থেকেই ঝাঁট জ্বালাতে শুরু করেছে!
” কেন ফোন করেছিলে বলো! কোন দরকার?”
” না… তোমার বন্ধুদের দেখলাম তোমাকে দেখলাম না!”
“যাইনি আজ!”
” ও!”
তারপরে প্রায়ই ফোন করত। তখনই বুঝেছিলাম একটু কেবলা কেবলা মত। তাও “ইঞ্জিনিয়ার” শব্দটাই স্মার্ট। কতদিনের স্বপ্ন একটা ইঞ্জিনিয়ার বয়ফ্রেন্ড হবে! ক্যান্টিনে এসেছি দেখতে পেলেই হাত নাড়াত। চক্ষুলজ্জা… আমিও নাড়াতাম। আচ্ছা, মানছি, শুধু চক্ষুলজ্জা নয়, আমারও সখ ছিল ষোলআনা!
একদিন আমরা বসে খাচ্ছি, উনি ওদের বিল্ডিং-এর তিনতলায়। ফোন করেছেন।
“বলুন!”
“আপনাকে তো আজ দারুন লাগছে! ”
“Thank you… আপনি কোথায়?”
” বিল্ডিং এর তিনতলার দিকে দেখো!”
আমি বন্ধুদের চোখের আড়ালে তাকালাম। হাত নাড়ছে। আমি নাড়িনি। শুধু হেসে ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম।আবার ফোন করল ” এই ফোনটা কেটে দিলে কেন?”
বন্ধুদের সামনে কথাও বলতে পারছি না! জিজ্ঞাসা করলাম ” বলো কি দরকার!”
” তাকাও একবার আমার দিকে!”
তাকালাম!
“I love you! Will you be my boyfriend? ”
মানেটা কি? এরম করে এসব হয় নাকি! বললাম। বলল ” সময় নাও…”
“তুমিও নাও!”
” আমি সেদিন থেকেই নিচ্ছি! ”
তখনকার ও আর এখনকার ও-র মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ! তখন কথা শুনলে মনে হত কত রোম্যান্টিক… আর এখন রোম্যান্টিক না ছাই! ঐ থোবড়াটাই আছে! ভিজে বেড়াল একটা! ধুস!
বলে ফোন রেখে দিল। মুডটাও অফ হয়ে গেল আমার! অফ হয়ে গেল এই জন্য নয় যে ও কাম আউট করবে বলে করল না, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা যে একটু খোলা বাতাস পেতে পারত, এই লুকোচুরিটা শেষ হত, এটা ওর চোখে পড়ল না! লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম হয়? প্রেম সবসময় মুক্ত হতে চায়, দৃশ্যত হতে চায়, নিজেকে জাহির করতে চায়! কে বোঝাবে ওকে? ও বোঝে না তা’ও না! একটু ক্যাবলা ঠিকই, কিন্তু বয়স তো অনেক হল! আজকাল প্রথম দিনকার কথা গুলো মনে পড়ে। আমি ওকে উত্তর দিচ্ছিলাম না বলে কি করে আমার পিছনে ঘুরত। বলা ভাল ঋষিকে ঘোরা করাত। তখন ওরও ফার্স্ট ইয়ারই। বন্ধু বলতে ঋষিই।তাই হয়ত বলেছিল ওকে। সেই কত চিঠি লেখা! দেখা হলে চোখ মারা! হাসা!সবার চোখের আড়ালে হাতটা ছুঁয়ে দেওয়া! সেসব দিনগুলোই ভাল ছিল! দিন দিন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে ও! বন্ধুগুলো যত নষ্টের গোড়া! বন্ধুসার্কেল বাড়ার পরপরই ওর মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। অবশ্য কেউ চেঞ্জ না হতে চাইলে কি তাকে জোর করে করা যায়? যায় না বোধ হয়! ওর আমাকে আর না পছন্দ হলে বলে দিতেই পারে, আমি রাগ করতাম না! করবও না! করবই বা কেন! শুধু শুধু জোর করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখায় আমি বিশ্বাসী নই! এসবই ভাবছিলাম, আবার ফোন করল!
“আজ একবার দেখা কোরো না! ফ্রি আছ?”
“কখন? কোথায় বলো!”
“পাঁচটা! দক্ষিণাপন! ”
“ওকে!”
ওর আবার সময় জ্ঞান দারুন। পাঁচটা মানে পাঁচটা! এটাও একটা প্লাস পয়েন্ট ওর! গেলাম। বসলাম সিঁড়ির ওপরে! আমার হাতটা ওর হাতে নিয়ে বলল “রেগে আছ?”
“নাহ…”
“সত্যি বলো!”
” তুমি আগে তো এত ভীতু ছিলে না! তুমি আমাকে প্রোপোজ করবার সময় দিনের পর দিন আমার পিছনে ঘুরেছ! তখন তো এত সবার কথা ভাবতে না!”
“তখন তোমাকে পাওয়ার তাড়া ছিল… আই মিন কেউ নিয়ে নেওয়ার আগে!”
” ভেরি ফানি!…”
“সিরিয়াসলি… ”
” যাই হোক… তুমি বলো! কি জন্য ডাকলে!”
“একটা কথা বলার ছিল!”
“বলো!” সত্যি কথা বলতে আমার তখন সিরিয়াসলি মনে হচ্ছিল ও ব্রেকাপ করবে বলেই ডেকেছে। এখানেই আমি ওকে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। মনে আছে, একদিন ঋষি গিয়ে জিজ্ঞাসা করল “ক্লাস কটায় শেষ রে তোদের?” ও আমাকে তুই-তোকারি করে।
“যেরম হয়! চারটে! ”
“আচ্ছা… শোন, সাড়ে চারটে দক্ষিণাপন পৌঁছে যাবি… ”
” কি করতে?”
” ও কথা বলতে চায়! ”
আমি ভাবছিলামই “হ্যাঁ” বলে দেবো, এতদিন ধরে ঘুরছে। সেদিন দক্ষিণাপন না ডাকলে আমি ঋষির হাত দিয়েই চিঠির উত্তর পাঠিয়ে দিতাম!
গেছি। সেবার খুব মুখটা সিরিয়াস করে বলেছিল “তুমি কি চাও বলোতো? এরম করে আমায় ঘোরাচ্ছ কেন?”
“কিছুই চাই না! তোমাকে চাই! ”
প্রথমে বোধ হয় বুঝতে পারেনি! কারণ মুখাবয়ব দেখেই বোঝা গেছিল ও কথাগুলোকে মাথায় ভেঙে ভেঙে বোঝার চেষ্টা করছে! তারপর একগাল হেসে বলল “সিরিয়াসলি? ”
” না… তুমি রেগে বলছিলে তাই রাগটা ভাঙালাম! ”
” এইভাবেই সবসময় আমার রাগ ভাঙিয়ো
..”
উত্তর দিতে হয়নি আলাদা করে। জড়িয়ে ধরেছিলাম। ও’ও ধরেছিল। পাঁচমিনিট ওরমই!
“তুমি শিওর তো?” জিজ্ঞাসা করেছিল।
“কিসে?”
” এই রিলেশনের ব্যাপারে?”
“হুম…”
“আমি কিন্তু খুব সিরিয়াস!”
নাহ, সিরিয়াসলিই রিলেশনটা নিয়েছে ও! কিন্তু সব কি আর সবসময় সমান চলে? ওর সেই সিরিয়াসনেসটা হয়ত কেটে গেছে এখন! বুকের ভিতর এক অচেনা শব্দদ্বৈত অনুরণিত হচ্ছে! বলতে শুরু করল : আমি জানি আমাদের সম্পর্কের দু’বছর হয়ে গেছে… এটা আলাদা করে এখন বলার কথাও না! কিন্তু মাঝে মাঝে গাড়ী সার্ভিসিং করে নেওয়ার মতই রিলেশনেরও সার্ভিসিং করা দরকার বলে আমার মনে হয়!”
“মানে?”
” মানে… আই লাভ ইউ! ডু য়ু স্টিল লাভ মি লাইক বিফোর! ”
ও মাঝে মাঝে এত ম্যাচিওর ব্যবহার করে না! আমি আজও ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম : কেন? doubt আছে কোন?
” না… কিন্তু আমাকে তুমি ভুল বুঝো না প্লিজ! আমি চেষ্টা করছি… কাম আউট করার! প্লিজ আমার পাশে থাকো!”
“আছি!”
সেদিন ওর কি হয়েছিল কে জানে, টকাস করে ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বসল। আমি আশেপাশে তাকালাম। সবাই দেখতে পায়নি। কিছু কিছু দেখেছে। তারমধ্যে মেয়েগুলো বিশেষ করে হাঁ করে চেয়ে ছিল! মেয়েগুলো আমাদের দেখে এত ইনসিকিওর ফিল করে কেন কে জানে! ছেলেগুলো, মানে তাদের বয়ফ্রেন্ডরাও বসে আছে, কিন্তু তাদের যেন কিছু এসে যায় না! কিন্তু মেয়েগুলো এমনভাবে চেয়ে থাকে!
যাই হোক, সেদিন অনেকক্ষণ বসলাম! আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে বসেছিলাম অনেকক্ষন! ঘড়ি দেখলাম মাঝে একবার! সাড়ে সাতটা তখন।
“চলো উঠি! ”
“আরেকটু বসো না…” বলে হঠাত বলল “আজকে রাতে তোমার বাড়িতে থেকে গেলে অসুবিধা আছে?”
না নেই! আমি পিজিতে থাকি। অতএব কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার কোন ব্যাপার নেই! আর বাড়িওয়ালা বলেছেন ঝামেলা করতে না! আমি তো করিনি! “না… অসুবিধার কি আছে?”
“অনেকদিন হয়নি!”
“তোমার এই মতলব?”
” মতলবের কি আছে? বয়ফ্রেন্ডকে ভালবাসতে চাওয়া বুঝি মতলব? ”
ইঞ্জিনিয়ার… কথায় পারা যায় না!
২.
বুকের হালকা লোমগুলো যখন পিঠময় শুঁয়োপোকার মত হেঁটে বেড়ায় তখন সারাশরীরে শ্রাবণ নামে কালবৈশাখীর মত! গলার কাছে ওর ঠোঁটের কারসাজিকে ম্যাজিক বললে কম হয়। চাবি দেওয়া পুতুলের মত আটকে নেয় আমাকে ও নিজের বুকের মাঝে! হালকা দাড়িগুলো ইচ্ছা করে গালে ঘষে দেয়, জানে আমি ভালবাসি! চুমু খেতে খেতে বলে “আজ কিন্তু সিগারেট খাইনি…” আমাকে হাসতে দেখে, ও’ও হেসে ফেলে! তারপর জাপটে ধরে অনেক কথা বলে! কালকের কথা! এই করব, সেই করব!অনেককিছু করবে সে চাকরি পেলে! বাড়িতে কাম আউট করবে! আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে ওর বাবা-মা’র সাথে আলাপ করাতে!”তারপর তোমার পি এইচ ডি শেষ হতে হতে আমার পাঁচ-ছ বছর চাকরি হয়ে যাবে… একটা ফ্ল্যাট কিনব! আমাদের জন্য!” তারপর আমি চাকরী পাব। তারপর সময় বুঝে একটা বেবি অ্যাডপ্ট করা হবে! ওর অনেক প্ল্যান। আমি মাঝে মাঝে ভাবি কিছু বলব না, তারপর ভাবি সবসময় স্বপ্ন দেখতে দেওয়া ঠিক না! এখনই ভেঙে দেওয়া ভাল। বলি দেশের অবস্থা! এখনও ৩৭৭ আছে! ভাবে অনেকক্ষণ! তারপর বলে “ঠিকাছে বাদ দাও… আমাদের কিছু লাগবে না!আমরা একে অপরের জন্য তো আছি… আর কি চাই!”
“হুম…”
“আমি জানি তুমি মাঝে মাঝে আমার ওপর রেগে যাও… প্লিজ রাগ কোরো… গালাগালি দিও… কিন্তু ছেড়ে যেও না কোনদিন!”
কথাগুলো ওর হৃদয় থেকে বলা! আমি বুঝতে পারি! ওর এই সরলতাটাই এতকিছুর পরও আমাকে ওর কাছে বেঁধে রাখে!
পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ওর বুকের বালিশে!সে এক আলাদা অনুভুতি। আমি একটু নড়তেই ও-ও নড়ে উঠল। “উম” বিরক্তির সুরে আরো কাছে টেনে নিল। “এত সকালে উঠতে হবে না!”
“তুমি শৌ না.. আমি উঠি!”
” নাহ…একটু শৌ না! আমার জন্য! ”
অগত্যা শুয়ে থাকতে হয়। ঘুম ভেঙে গেলে শুয়ে থাকতে খুব বিরক্তিকর লাগে কিন্তু সেটাই ভালবাসা! উঠে বলল “ভাবছি তোমার পাশের ঘরটায় সিফট করে যাই… ফাঁকা আছে বলেছিলে না?” আমি একবার ওকে বলেছিলাম ও যদি আসতে চায়।তখন সবে সবে পাশের ঘরের ছেলেটা গেছিল।যাই হোক, তো ও বলেছিল বাড়ি থেকে পারমিশন দেবে না!
“আজ্ঞে ছিল… এখন নেই!”
” কোই কাল রাতে আওয়াজ পেলাম না তো!”
“থাকেই তো না বেশিরভাগ দিন! ”
আমি সত্যিই লোকটাকে বুঝিনা, সপ্তাহের আর্ধেক দিন থাকে না!কি করতে শুধু শুধু ভাড়া দিয়ে থাকে কে জানে! কত ধরণের যে পাব্লিক হয় বিশ্বে! যাই হোক, এই প্রথমবার একসাথে ইউনিভ যাব। এক নাম্বার দিয়ে ঢুকতেই বলল “আমি আগে আগে হাঁটছি! ”
“দরকার নেই! আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি… তুমি সেফলি ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে ফোন কোরো… তারপর আমি যাব! ”
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কি একটা দেখে হঠাত করে একবার হেসে বলল “কি ভাই.. কি খবর?”
“ভাল! তোর?”
“ভাল..” এই ছেলেটাকে আমি চিনি। কোথায় একটা দেখেছি বেশ। “ওর সাথে কি কথা বলছিলিস…” তারপর মনে পড়ল হ্যাঁ সেদিন ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলার সময় এই ছেলেটি সেই গ্রুপে ছিল।
“চ… ডিপার্টমেন্টে যাবি তো? আমি ওদিকেই যাচ্ছিলাম… ১২ টা থেকে ক্লাস! ”
“ধুর ভাই… তুই চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছিস… হোমোটোমোর সাথে কথা বলছিস..”
সেদিন ঋত্বিকের দাঁত ক্যালানোটা দেখলে মনে হয় সব দাঁতগুলো খুলেনি। এমন গা জ্বালান হাসি! আমি দাঁড়াইনি। চলে এসেছিলাম। যখন আমাদের বিল্ডিং-য়ের সামনে,একটা মেসেজ ঢুকল : সরি!
: বারবার সরি বললে সরির প্রখরতা কমে যায়! সত্যিই ওর সরিগুলো আমার কানে আর বাজে না! ভেবেছিলাম রিপ্লাই দেব না, তাও দিলাম!
: বললাম তো সরি!
আমি আর রিপ্লাই দি নি! সেদিন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আর কতদিন? একবার মনে হয় আমি ওকে ভালোবাসি, খুব। এই সময়গুলো মনে হয় সব শেষ। কিছুই নেই ভেতরে!
আবার মেসেজ : কি করছিস? ক্লাস শুরু হয়ে গেছে?
রিপ্লাই দি নি!
:আমাদের ম্যাম আজ আসে নি! প্রথম ক্লাসটা হবে না মনে হচ্ছে!
এবারও রিপ্লাই দি নি। কেন দেব?
: তোমাদের ক্লাস কটায় শেষ?
নো রিপ্লাই!
: খেয়ে নিও সময় করে!
নো রিপ্লাই!
: বাইরে বৃষ্টি পড়ছে!
আমি জানলা দিয়ে তাকালাম। ধুস কোথায় বৃষ্টি! আলোই আলো! রোদ্দুরই রোদ্দুর!
: জানলা দিয়ে বাইরে দেখা হলে এবার মেসেজের রিপ্লাইটা দেওয়া হোক।
নো রি-প-লা-ই!
ও ও আর মেসেজ করেনি! আমিও করিনি। অনেক হয়েছে আর না! আগেরদিন রাতে কাছাকাছি আসার পর কেউ এভাবে একজনকে উপেক্ষা করতে পারে ওকে না দেখলে বোঝাই যায় না! অ ই ছো একটা! মানে অসভ্য ইতর ছোটলোক আর কি!
সেদিন ক্লাস শেষ হলে দাঁড়াইনি। একদম বাড়ি ফেরার রাস্তা! তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সামনে! পিছন থেকে কে একটা চোখ চেপে ধরল। যত বলছি “কে? কে?” ছাড়েই না! তারপর সেই হাতদুটো পিছন থেকে কোমর বরাবর জড়িয়ে ধরল।
“এবার খুশি?”
একে নিয়ে আর পারা যাবে না,রাস্তার মাঝে, সবার সামনে… জড়িয়ে ধরে!মানে চলো ঠিকাছে… তাও! তবে মাঝে মাঝে ওর বীরত্ব অনেকটা বেড়ে যায়। যার ফলস্বরূপ ও এসব করে!
“এবার খুশি তো বলো? সবার সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম! ”
আমি কোন উত্তর দিলাম না!
“কি হল বলবে তো?”
” আমাকে জড়িয়ে ধরতে তোমায় বলিনি ঋত্বিক… তোমার এই সো-কলড স্ট্রেট অভিনয়েও আমার কোন অসুবিধা নেই… কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অন্যকে হার্ট করছ নাকি ভেবে দেখো!” আমি কথাটা বলেই চলে এলাম।
ওটা ওকে ভাবিয়েছে! সেটা পরে বুঝেছিলাম… এই ঘটনার পর যেটা হল সেটা মারাত্মক… আমি কখনই ওর কাছ থেক এরম একটা কিছু এক্সপেক্ট করিনি!
তবে সে’ই কাজ করার মাঝে আরো অনেককিছু ঘটেছে! সেদিন সেটা বলে চলে আসার পর বাবুর না একটা ফোন, না মেসেজ! সব বন্ধ। আমিও করিনি। ওর ভুলটা এবার বোঝা দরকার! আর ভুল তো নয়, জেনে শুনে ভুল করাটা অন্যায়। ওর জানা দরকার আমিও কোনভাবে আর এটাকে সমর্থন করতে পারব না! ইউনিভ গেছি। দেখা হয়েছে। সে’ও কিছু বলেনি। আমিও বলিনি। দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে! আমিও গেছি। আমার যদিও পাশ কাটানোর কোন ইন্টেনশন ছিল না! আসলে ওর বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে আমরা কথা বলব কি না, সেটা ওর ডিসিশনের ওপরই নির্ভর করে! আমিও মেনে নিয়েছি। তাই আগে ও কথা বললে তাহলেই আমি কথা বলতাম। ও হাসলে আমিও হাসতাম। এ ক’দিন একদম চুপ। তাকায়ওনি পর্যন্ত! মনে একটু একটু ভয় করছিল না তা না! ব্রেকাপের ভয় আমি পাইনা! কিন্তু ওকে ছেড়ে থাকাটা ওর কাছে কতটা যন্ত্রণার আমি জানি না, আমার কাছে সেটা, যাকে বলে, আনবিয়ারেবল্! আর অভ্যাস বলেও তো একটা বস্তু আছে। তবে আজকাল অভ্যাসের কথা বলততে আর ইচ্ছা করে না। শিবপ্রসাদ আর নন্দিতা ওদের ছবিতে এই অভ্যাসের ব্যাপার স্যাপার দেখিয়ে সেটাকে খুব খেলো করে দিয়েছে! অভ্যাস বললেই সবাই ভাবে নিশ্চই আমি ঐ ছবিটা দেখে এসেছি। আমি দেখিনি। তবে, বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি। যাই হোক, ওরা দেখাক আর না’ই দেখাক, তাতে অভ্যাসের ব্যাপারটা মিথ্যা হয়ে যায়না! ইগো যে আমারও ছিল না তা না। নয়ত আমি কেন একবার একটা মেসেজ করতে বা একটা ফোন করতে পারছিলাম না? খালি মনে হচ্ছিল ‘আমিই কেন করব সবসময়’? পরে মনে হয়েছে সেদিন কি আমি একটু বেশিই ওভাররিয়্যাক্ট করে ফেলেছি? বেচারা এত সাহস সঞ্চয় করে এল! সেদিনই কি ও কাম আউট করতে এসেছিল তবে!
ঋষিকে ফোন করলাম! বললাম সব কথা! শুনে বলল “তোদের সাংসারিক ঝামেলা কি কখনও শেষ হয়না?”
“এটা ইয়ার্কি নয় ঋষি… এটা সিরিয়াস! ও এর মধ্যে আমার… মানে আমাদের কথা কিছু বলেনি তোকে?”
“না.. সেরম কিছু বলেনি!… বলেইনি আই মিন! আমি জানি তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক চলছে…”
“তুই তাও একবার মনে করে দেখ… ”
” না তোর সম্মন্ধে কিছু বলেনি সেটা কনফার্ম… তবে ও কাম আউট করার কথা বলছিল! বলছিল যে এবার মনে হয় কাম আউট করা দরকার! আমি বললাম তুই শিওর থাকলে… কনফিডেন্ট থাকলে কর! ”
“কবে সেটা?”
” দুদিন আগে মনে হয়…এই সোমবার! ঝিলের পারে সিগারেট খাচ্ছিলাম তখন!”
“আচ্ছা!”
“আমি কী ওর সাথে একবার কথা বলব? ”
“নাহ… দরকার নেই! আমি দেখছি! ”
বলে তো দিলাম দরকার নেই, কিন্তু তাও নিজে একটা ফোন করতে পারছি না! এর মাঝে একদিন আমি আর আমার এক বন্ধু ওদের ডিপার্টমেন্টের সামনের ক্যান্টিনটায় খেতে গেছি! ওখানে আমাদের আরো কিছু বন্ধু ছিল। ওদের মধ্যে কয়েকজন একটু এফেমিনেট! আমার মধ্যেও এফেমিনিনেসি আছে, তবে সবসময় ধরা পরে না! কেউ খুব মন দিয়ে আমায় ফলো করলে বুঝতে পারে!
কিছুক্ষণ পর হঠাত কানে এল কারা বেশ ওদের মত কথা নকল করে বলছে! বলে না যেরকম করে ” ও… তাই নাকি?” শুধু এটাই! ওরা আদতে স্মার্ট হতে চায়। তবে লাগে ক্যাবলা! আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম ঋত্বিকও আছে ওখানে! সে কিছু বলেনি কিন্তু হাসছে! আমরাও কিছু বললাম না! কিন্তু ওরা থামার পাত্র নয়। কন্সট্যান্টলি ডিস্টার্ব করে চলেছে! থাকতে না পেরে পিছন ফিরে বললাম “কি হয়েছে? সমস্যা কী তোমাদের?”
“আমরা তোমাদের কিছু বলেছি? ” যে ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে টোন কাটছিল সে বলল।
” মেয়েলি বলে নকল করছ.. নিজে তো পুরুষ! স্বীকার করার হিম্মত নেই? ”
“তোদের সাথে বাড়া মুখ লাগাতে চাই না… ”
ইঞ্জিনিয়ার ছেলেদের এই এক সমস্যা। ওরা খুব তাড়াতাড়ি ‘তুই’এ চলে আসে!ওটা শুধু এর ক্ষেত্রে না, আগেও দেখেছি!
“পৌরুষ বেরিয়ে গেল তো! স্বীকার যখন করতে পারো না রাগানোর সাহস দেখাও কেন? ”
এইবার তার আঁতে লেগেছে! সাহস বলে কথা! তারপর আশেপাশের ছেলেপুলেরাও শুনছে!উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল। “কি সাহস দেখবি বল…! হ্যাঁ… টোন্ট করছিলাম!তো? কি করবি? কমপ্লেন করবি?”
“দরকার পরলে তাই করব! আছে বলতে তো ঐ পুটকি! পুটকির অত গর্ব কিসের? ” আমারও রাগ উঠে গেছিল ছেলেটার ঔদ্ধত্য দেখে। আরো রাগ উঠেছিল এটা দেখে যে ঋত্বিক নিরুত্তাপ। ওর কিছু বলার নেই। মাথা নিচু করে ফোন ঘাঁটছে!
ছেলেটি এবার রেগে এসে আমায় একটা ঠ্যালা মাড়ল। আমি পড়ে গেলাম মাটিতে! হেব্বি রাগ উঠেছিল। গিয়ে চড়িয়ে দিলাম আমিও! ছেলেটি যেন তাতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। “বাড়া… হোমো…” বলে আমাকে মারতে এল! তবে আশেপাশের কিছু ছেলে এসে আটকে দিল। ওদেরও পাঠিয়ে দিল। আমার বন্ধুরাও বলল ” চ… এখান থেকে!”
“যাব কেন? ভয় পাই নাকি? আর এটা ওদের একার জায়গা নাকি!”
তাও বুঝিয়ে নিয়ে এল আমায়। আমি আর ক্লাসে যাইনি। ঘরে চলে এলাম। ঘরে এসে ছেলেটার থেকে আমার ঋত্বিকের ওপর বেশি রাগ উঠছে! ও বসে বসে দেখলো? কিছু বলল না? এত ভয় ওর? নাকি এটা ওর মুভ-অনের মধ্যেই পরে? ভাল… বেশ! ঠিকাছে!সেদিন সকালে একবার ভাবছিলাম যে রাতে ফোন করব… আর না! ফোন করার কোন দরকার নেই! ওর মতিগতি আমার বোঝা হয়ে গেছে!
৩.
এর মাঝে কেটেছে আরো কিছু দিন। কেটে গেছে এন্ড সেমিস্টার এক্সাম। সে যে কি পরীক্ষা হয়েছে বলার মত না! সাপ্লি না পেলেও রেজাল্ট যে চূড়ান্ত খারাপ হবে তা জানাই ছিল। তাও ইন্টারনাল গুলোতে মার্কস তোলা ছিল তাই রক্ষে কিছুটা!নয়ত ফার্স্ট ক্লাসটাও কেটে যেত হয়ত। অবশ্য ফার্স্ট ক্লাস থাকবেই সেটাও জানতাম না! কানের পাশ দিয়ে গেছিল। ৬০.০৬ %। যাই হোক.. রেজাল্টের চিন্তা আমায় কখনই ভাবায়নি! কারোর চিন্তাই ভাবাইনি। কার জন্য চিন্তা করব? আমার বয়ে গেছে কারোর জন্য চিন্তা করতে! ঋষি মাঝে একবার ফোন করেছিল।
“তোরা কি ঝামেলাটা মেটাবিটা ঠিক করেছিস?”
“আমি কিছুই ঠিক করিনি রে!”
“তোরা দুটোই সমান…”
“সরি… আমি মানতে পারলাম না!”
সেইদিনের ঘটনাটা মন থেকে মুছে দিতে পারলে তাও কিছুটা সংযম দেখাতাম! তা সম্ভব নয়, ফলে মেনে নেওয়ার কোন প্রশ্নই নেই যে আমি আর ও একইরকম। ঋষিকে আমি সেদিনের ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করলাম জানে কি না! বলল জানে!
“এর পরও তুই বলবি?”
“তুই ঋত্বিকের দিকটাও বোঝ একটু?”
“তোর কী মনে হয় আমি এতদিন বুঝিনি?”
“না… তা বলিনি! ও নয় হুইমসিক্যাল… তুই তো ম্যাচিওর! ”
“আমি ম্যাচিওর বলেই আমাকে সব সহ্য করতে হবে? সেদিন ওখানে যা হয়েছে যে কোন মেরুদণ্ডযুক্ত মানুষ এর প্রতিবাদ করবে! আর ও তো আমাদের কম্যুনিটির! ”
“তোর কথা বুঝতে পারছি… দেখ আমি ওকে ডিফেন্ড করছি না! কিন্তু তুই তো ওকে ভালবাসিস.. ও’ও বাসে! সেটার জন্য একটু স্যাক্রিফাইস করা যায় না নিজেদের ইগোগুলো!”
“এটা ইগো না ঋষি! এটা মোরালিটির প্রশ্ন! যাই হোক… তুই ওকে আগ বাড়িয়ে কিচ্ছু বলবি না!”
“ঠিকাছে… ”
“আর শোন…”
“বল…”
“সে আছে কেমন? ”
“আছে… ভালোই!”
“হুম ঠিকাছে! রাখছি! ”
“হুম! ”
ভাল থাকুক নিজের মত। আমি তাতেই খুশি। আর নতুন কাউকে পেলে তো কথাই নেই! আমি তো ওকে বুঝিনি, এই কথাটাও আমাকে শুনতে হল।থাক আর বুঝে কাজ নেই! যে বুঝবে তার কাছে যাক!
মাঝে মাঝে এই দুঃখগুলোকেই কল্পণা করে আমরা সুখ পাই। কিন্তু সত্যিই যখন এই দুঃখগুলো আসে তখন সত্যিই তা সহ্যাতীত হয়ে যায়! কাউকে বলা যায় না! যার ওপর রাগ তাকেও বলা যায় না! একটা বিদিগিচ্ছিরি অবস্থা হয় মনের!
নতুন সেমেস্টার শুরু। এটাই শেষ বছর। এটা শেষ হলেই ছুটি এখান থেকে! শেষ বছর। কত প্ল্যান ছিল। ধুস! আমি সত্যিই এসব ভুলে যেতে চাই! আর দুটো সেমেস্টার ভাল করে দিতে পারলে বাঁচি।
সেদিন আমি বাড়ি যাচ্ছি দেখি ওদিক থেকে আসছে। একবার চোখাচোখি হল। দেখলাম ওর সাথে যে ছিল তাকে কি একটা বলতে মশগুল হয়ে পড়ল। অ্যাভয়েড করতে চায়। বেশ! আমি পাশ দিয়ে চলে আসছিলাম। ওর সাথের ছেলেটা বলল “হোমো…”
আমি তাকাইনি আর!শুধু শুধু ঝামেলা আমি বাড়াতে চাই না! বাড়িয়ে কি ই বা হবে? কিন্তু আমি পাত্তা না দিলেই বা! সে আমায় ছাড়ছে কেন! তারপরের দিন ক্যান্টিনে খেতে গেছি। যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না! ভাববে আমি হ্যাংলামো করছি। এদিকে না গেলে বন্ধুরা ভাববে সেদিনের ঝামেলায় ভয় পেয়ে আমি যাচ্ছি না! হ্যাংলা ভাবলে ভাবুক। আমি যে কাউকে ভয় টয় পাইনা, সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার! আর ভয় পাব কেন? গে বলে? গে হব একশোবার হব! কারোর বাবার পয়সায় গে হইনি…
সেদিন খেতে বসেছি পিছন থেকে একটা কাগজের বল এসে লাগল। আমি কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম আশেপাশে। বসে আছে নিজের গ্রুপের সাথে! কাগজটা খুললাম। লেখা : হোমো খায় মোমো! আমরা মোমো খাচ্ছিলাম কি না!
আমি দেখে কাগজটা ফেলে দিলাম। আবার কিছুক্ষণ পর আর একটা এসে লাগল। এবারও একটা কাগজের বল। লেখা : ছক্কা!
আমি এবারও ছেড়ে দিলাম। আমার সাথে প্রিয়াঙ্কা ছিল। ও বারবার বলে যাচ্ছে “কিছু বলিস না! তাড়াতাড়ি খেয়ে চল…”
আবার একটা কাগজের বল ছুঁড়ে মারল। এটা ডিরেক্টলি আমার বাঁ গালে এসে লেগে আমার থালায় পড়ল। আমি সেটা তুলে খুললাম : চুষতে কত নিস?
আমি উঠে গিয়ে সপাটে ঋত্বিককে একটা চড় মারলাম ডান গালে! “চুষতে কত নি জিজ্ঞাসা করার কি আছে! তুমি তো জান! তুমিই বলে দিও!” সেদিনকে কি হয়েছিল কে জানি আমি সচরাচর কান্না পেলেও চাপতে পারি! সেদিন পারলাম না! দাঁড়াতেও পারিনি আর! প্রিয়াঙ্কাকে ছেড়েই চলে এসেছিলাম।
আমি এমন একটা মানুষকে ভালবাসলাম যে নুন্যতম সম্মান আমাকে দিতে পারে না! আমি জানতাম না কাগজগুলো ও ছুড়েছে কি না! কিন্তু ও তো ওখানে বসেছিল। জানে যে কি লিখে ছোড়া হচ্ছে! তাও…? অবশ্য আমি ওর থেকে এক্সপেক্ট করেছিলামই বা কেন! সেদিন ঋষি আবার ফোন করেছিল।
“ঠিক আছিস?”
“কে বলল? ”
“প্রিয়াঙ্কা!”
“হুম…ঠিকাছি!”
“ভাল করেছিস মেরে… আমি এবার তোর পক্ষে!”
“Thanks…” আমার কারোর সাথেই কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না! তাই বললাম “রাখছি রে! খুব ঘুম পাচ্ছে!”
“You are okk…right? ”
“হুম…” বলেই কেটে দিলাম। যতবার মনে পরছে আমার কেমন একটা হচ্ছে যেন! কেঁপে কেঁপে উঠছে ভেতরটা! অথচ কাঁদতে পাচ্ছি না!
সেদিন ক্লাসেই ছিলাম। দুটো ক্লাসের মাঝে ব্রেক চলছিল। স্নেহা ওয়াসরুম গেছিল। ফিরে এসে বলল “স্নেহাশিস তোকে বাইরে ডাকছে! ”
“কে?”
” কে আমি চিনি না… একটা ছেলে!”
আমি ভেবেছিলাম ঋষি হবে। গিয়ে দেখি ঋত্বিক!দাঁড়িয়ে ফোন ঘাঁটছে।আমার কথা বলার কোন ইচ্ছা ছিল না!আমি ভাবছিলাম একবার ঢুকে আসি! কিন্তু আমাদের ক্লাসরুমের দরজার এমন আওয়াজ! খুলতেই তাকাল। আমি ভাবলাম আমি কেন চলে আসব? আমি তো কোন ভুল করিনি! আমি সোজা গটগট করে হেঁটে গেলাম, মুখটা গম্ভীর করে!
“কি হয়েছে?”
“কেমন আছ?” মিনমিন করে বলল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরীহ ছেলে!
“তুমি কেন এসেছে সেটা বলো!”
“I’m sorry! জানি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য… তাও ক্ষমা করতে পারলে কোরো!”
” sorry পারছি না!”
“its ok… কেমন আছ? ”
“ভাল… খুব ভাল!”
“আমি ভাল নেই… তুমি আমায় শেষবারের মত ক্ষমা করে দাও প্লিজ! আমি আর কখনও তোমায় কমপ্লেন করার সুযোগ দেবো না!”
সিনেমা দেখে এসেছিল মনে হয়। আমিও একটু সিনেম্যাটিক ভাবেই বললাম “আমার কোনদিন তোমায় নিয়ে কোন কমপ্লেন ছিল না… ঋত্বিক! ”
“ঋত্বিক?… তুমি কবে থেকে আমায় আবার ঋত্বিক বলে ডাকছ? ”
আমি কোন উত্তর দিলাম না! আমার কাছে আলাদা করে কিছু উত্তর ছিলও না। এতদিন ধরে ওকে “বাবু” “সোনা” বলেই ডেকেছি! অবশ্য কোন জায়গায় সেন্টি দিয়ে কথা বলতে হয় তা আমিও জানি! তবে ‘ঋত্বিক’টা সেদিন নিজে থেকেই বেরিয়েছিল।
“তুমি আমার ওপর রেগে আছ জানি… স্বাভাবিক… কিন্তু প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও তুমি!” বলে আমার হাতদুটো ধরল। “তুমি আমায় সেদিন সবার সামনে চড় মারলে! ভাল করেছ! আরো মারো… কিন্তু তুমি আমায় ছেড়ে যেও না প্লিজ…”
“ঋত্বিক প্লিজ… এটা আমার ডিপার্টমেন্ট! এখানে এসব করব না!”
“সরি… কিন্তু তুমি বলো তুমি আমায় ক্ষমা করেছ! ”
” না… করিনি! তুমি ক্ষমা করার মত কিছু করোনি…” বলতে বলতে আমি দেখিনি আমাদের পাশ দিয়ে রুপক দা চলে গেলেন। রুপক দা আমাদের প্রফেসর! আমাদের দিকে একবার ঘুরে তাকালেন। বাথরুমে গেলেন!
“আমি জানি বাবু… আচ্ছা, তুমি আমায় শাস্তি দাও… তুমি আমায় যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব… কিন্তু তুমি আমায় তোমার থেকে দূরে যেতে বোলোনা… আমি চেষ্টা করেছিলাম… আমি পারিনি!”
” তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না! তুমি যাও এখন! ”
“প্লিজ বাবু… প্লিজ!” বলে হাতজোড় করে বলল “এই যে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি” হঠাত করে পায়ের সামনে বসে পড়ল ” তোমার পায়ে ধরছি…প্লিজ!”
“ঋত্বিক কি হচ্ছেটা কি! ”
“আমি ক্লাসে যাচ্ছি… ক্লাসে আয়!” আবারও রুপক দা চলে গেলেন পাশ থেকে! ঋত্বিক তখন নিজের হাঁটুর ওপর বসে!
“তুমি উঠবে…!” আমার মাথাটা গরম হয়ে গেছিল। আমি ওকে ওখানে ফেলেই ক্লাসে চলে এলাম।
ক্লাসের পর বেরিয়ে দেখলাম নেই। জানতাম অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য ওর নেই! রুপক দা বেরতে বেরতে বললেন “স্নেহাশিস… এত করে যখন বলছে ক্ষমা করে দে!” বলে মুচকি হেসে ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে! রুপক দা’র খালি আমার পেছনে লাগার একটা ছুঁতো চাই! কোন চান্স মিস করেন না! যাই হোক, তখন রুপক দা’র ইয়ার্কি বোঝা বা উত্তর দেওয়ার জায়গায় আমি ছিলাম না! আমি নীচে এলাম। দেখি দাঁড়িয়ে আছে। আমি না দেখার ভান করে চলে গেলাম! পিছন পিছন ছুটে এল। “বললাম তো সরি! এই যে কান ধরছি!” বলে রাস্তার মাঝে কান ধরে আমার সামনে মুখটা কাছুমাছু ক’রে দাঁড়াল।
“কি করছ টা কি? সবাই দেখছে?”
“সবার দেখার চিন্তা তুমি কবে থেকে করছ?… তোমার সাহস দেখে আমি প্রতিমুহূর্তে ইন্সপায়ার হই… আর তুমি এসব বলছ!” ভেবেছে আমায় তেল দিলে আমি পটে যাব!ওসব দিন গেছে!
“আমাকে না তোমাকে দেখছে…”
“দেখুক… কারোর দেখার ভয়ে আমি তোমাকে হারাতে পারব না!”
“বেশ… এই কথাটা নিশ্চই শুধুমাত্র এই আর্টস ফ্যাকাল্টি চত্বরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়… ইউনিভারসিটির অন্যত্রও প্রযোজ্য… তাহলে তোমাদের ঐ বন্ধুগুলোর সামনে বলো! বলো পারবে?”
একটু চিন্তিত দেখাল। জানতাম। এদিকেই যত ওর হম্বিতম্বি! আমি ওকে মাঝ রাস্তায় রেখেই হাঁটতে আরম্ভ করলাম!
পিছন পিছন এল “পারব… কিন্তু আমাকে একটু সময় দাও…”
“যত খুশি সময় নাও… তবে যত দিন না পারছ… আমার সাথে কথা বলতে আসবে না…”
“কথাও বলব না?… আমাদের কতদিন ঠিক ক’রে কথা হয়নি বলতো..”
যেন আমার জন্য কথা হয়নি! কথা শুনলে গা জ্বলে যায়! আমিও তেমন। বললাম “এতদিন যখন হয়নি… আর কিছুদিন নয় না’ই বা হল..”
“তুমি কিন্তু ছেলেমানুষি করছ বাবু…”
আমি আর কোন কথা বললাম না! সারা রাস্তা বকে গেল! তারপর নিজেদের জায়গা আসতেই চুপ করে গেল। এমন কী এতক্ষণ পাশে পাশে হাঁটছিল, দেখলাম আসতে আসতে পিছনে চলে গেল! আমি নিজের মনেই হাসলাম! কাওয়ার্ড!
ও সত্যিই একটু ভীতু। কিন্তু বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলাম ওকে চাপ দিয়ে কাম আউট করানোটা কি ঠিক হবে! যতই হোক… ভালোবাসি তো, ও অসুবিধায় পরুক আমি চাই না! এইক্ষেত্রে অন্তত ইগোটা দূরে রাখাই ভাল। রাতে আমিই ফোন করলাম!
“আমি জানতাম…” তুলেই বলল! ওর গলার উত্তেজনা দেখে মনটা দুলে উঠেছিল একবার!
“কি জানতে?”
“তুমি আমায় ক্ষমা করে দেবে!”
” শোন যে কারণে ফোন করেছি… তোমাকে তাড়াহুড়ো করে কাম আউট করার দরকার নেই! যদি মনে করো… কোরোই না! শুধু শুধু নিজের অসুবিধা করে এটা করা ঠিক হবে না!”
“Thanks… ”
“হুম…”
“কি করছ? ”
“রাখছি এখন! ”
ফোন করেছি মানেই আমার রাগ পড়ে যাইনি! হুঁ! সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল ঘুরিয়ে। আমি কেটে দিলাম। মেসেজ করল : kothai jokhn blbe na…tokhn ph krle kno?
আমি রিপ্লাই দি নি! এসব সম্পর্ক টম্পর্কের একটা বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে। একদিকে রাগ অভিমান অন্য দিকে ভালবাসা… একসাথে! রিপ্লাই দিতে মন চাইছে না, অথচ রিপ্লাই দিতে না পেরে মনের ভেতরটা কেমন যেন হচ্ছে!
কিছুদিন এভাবেই কাটল। ফোন করেছে অনেকবার। ধরিনি। মেসেজও করেছে। রিপ্লাই করিনি। তিনচার দিন দেখলাম ডিপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে! আমি কথা বলতে যাইনি! ও’ও আসেনি। শুধু দাঁড়িয়েছিল। কথাই বলবে না যখন তাহলে শুধু শুধু ডিপার্টমেন্টে এসে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী! আমি যতবার ওর সামনে দিয়ে গেছি ততবার শ্লথ হয়ে গেছি যদি কিছু বলে.. যদি কিছু বলে! নাহ… বলেনি! একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক ভাবলাম। ভাবলাম কাল গিয়ে আমিই কথা বলব! কিন্তু দেরী হয়ে গেছে বুঝিনি! পরেরদিন আর ও আসেনি! প্রায় একমাস পর ঋষির হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল :
“
প্রিয় স্নেহাশিস,
জানি ক্ষমার যোগ্য আমি হয়ে উঠতে পারিনি। পারব কি না জানি না! যে দোষ আমি করেছি তা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে জানি! কিন্তু আমি তো ক্ষমা চেয়েছি। প্রায়শ্চিত্ত করার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি! নিজের হাতে যা ছিল তাই করেছি। তোমার চোখে আমাকে নিয়ে এতদিন যে পরিতৃপ্তি দেখতাম তা শেষ ক’দিনে আর দেখিনি। আমি ভাল বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি। সেদিন বলেছিলাম আমরা একে অপরের জন্য সারাজীবন থাকব… অদৃষ্ট তা চায় না, এমনটাই মনে হচ্ছে!
এখন কথা না বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে! যে নৈঃশব্দিক আলাপচারিতা আমাদের শুরু হয়েছে এখন সেটাই সাধারণ হয়ে গেছে! সামনে পরীক্ষা! ক্যাম্পাসিং এ একটা জব পেয়েছি। জানাতে গেছিলাম তোমাদের ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু কেন জানিনা, কি মনে হল, চলে এলাম। আমাদের মধ্যে কোনকিছুই আর আগের মত নেই! আমার দোষেই… কিন্তু নেই যে এই সত্যিটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই!
আমাদের সম্পর্কটা তো এখন সেই অর্থে নেই! আলাদা করে ব্রেকাপ করার দরকার নেই। তুমি একবার বলেছিলে, এখন মনে পড়ছে, যে আমাদের ব্রেকাপ হলেও যেন “ব্রেকাপ” শব্দটা ব্যবহার না করি!সেদিন ইয়ার্কি মেরে বলেছিলে,কে জানত সত্যি সত্যিই এই পরিস্থিতি আসবে! জানো আমি ভেবেছিলাম আমাদের কোনদিনও ছাড়াছাড়ি হ’বে না! কিন্তু ঐ কথায় আছে Change is the only constant thing. যাই হোক,তোমার সেদিনের কথার মান রেখেই বলছি : ভাল থেকো! নিজের খেয়াল রেখো! জল বেশি করে খেয়ো! চোখটা অনেকদিন ধরে দেখাবে দেখাবে করছিলে, জানি দেখাওনি। দেখিয়ে নিও তাড়াতাড়ি! ফেলে রেখো না! তোমাকে চশমা পরলে ভাল লাগবে না! নাহ.. ভাল লাগবে না ঠিক না, কিন্তু তোমার চোখদুটো ঢেকে যাবে!
তুমি খুব সাহসী স্নেহ! খুব। তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব কখনও কমবে না! শুধু আফসোস এটাই তুমিও যদি আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারতে!
চিঠির উত্তর দিলে ভাল লাগবে!তবে জোর নেই!
ঋত্বিক!”
শেষ হয়েই গেল তাহলে! বেশ! আচ্ছা… ঠিকাছে! আমার প্রথমে মনে হয়েছিল একটা বড় উত্তর দেবো! লিখতে বসে কিছুই লিখতে পারলাম না! কষ্ট হচ্ছে না! কিন্তু হওয়ার কথা ছিল। কেন হচ্ছে না সেটাই বুঝতে পারছি না!শুধু লিখলাম : ভালো থেকো!
ঋষিকে যখন ডেকে কাগজটা দিলাম, ও বলল ” তুইও?”
আমার বলার ওপর কিছু নির্ভর করছে না! তাই “তুইও” প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই! ওকেই বললাম “এটা দিস… আর খেয়াল রাখিস!”
কি একটা ক্লাস ছিল, চলে গেল তাই ও। ঋষি চলে যেতে মনটা আরো ফুরফুরে লাগছে। যেন কিছুই হয়নি। শরীরটা হালকা লাগছে। মনটাও!
উঠছি, বাংলা বিভাগে শ্রেয়া আর সোহমকে দেখে মনে ধাক্কাটা লাগল। ওরা সিঁড়িতে বসে প্রেম করছিল। তারপর থেকেই মনটা কেমন যেন হতে শুরু করল! নাকি আগেই ছিল.. ওদের দেখে সেটা টের পেলাম… কে জানে!
ছাড়াছাড়ি বললেই যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত তাহলে পৃথিবীটা অন্যরকম হত। ছাড়াছাড়ি কি? কি করে ছাড়তে হয় একজনকে! তার উত্তর কারোর কাছে কি আদৌ আছে! আজ ছাড়াছাড়ি বললে কাল থেকে ভালবাসাটা কেটে যায়? কমে যায়? যায় না! আমার তো যায় নি! ঋত্বিকের যদি গিয়ে থাকে আমি জানিনা! চুপচাপই ছিলাম কিছুদিন। তারপর আর বসে থাকতে পারলাম না! ঋষিকে একটা ফোন করলাম :
” কি রে কেমন আছিস?”
“সর্দি হয়েছে… ঠান্ডা লেগেছে খুব! জ্বর! ”
ওর গলা শুনে তো মনে হচ্ছে না! বললাম ওকে সেটা!
“আমার না, ঋত্বিকের! ওর খবর নিবি বলেই তো ফোন করেছিস?”
কি বলব… কিছু বললাম না! ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বলল “আমি কথা বলব?”
“না…থাক!”
“তোদের দুজনের এই এক সমস্যা! কেউ কাউকে ছেড়ে ভাল থাকবি না! তবু জেদের ঠ্যালায় অন্ধকার! ”
অন্তত একটা জিনিষ তো কমন!
“ওকে ফোন কর না একবার… ওরও ভাল লাগবে!”
“হুম…” বলে ফোনটে রেখে দিলাম!
ফোন করব? রেস্ট নিচ্ছে হয়ত। শরীরটা খারাপ! ফোনের স্ক্রিনে ওর নাম্বারটা বার করেও যেন কল করতে পারছি না! সত্যিই ঋত্বিক ঠিকই লিখেছিল আমাদের মধ্যে আর কিছুই আগের মত নেই! যদি ফোন না তোলে? যদি কথা না বলে..? যদি সত্যিই ও আমাকে ভুলেই থাকতে চেয়ে থাকে! উফফফ… এসব ভাবার সময় এটা না! ওর শরীর খারাপ! একবার খোঁজ নেওয়াটা দরকার! আমি অনেককিছু ভেবে মায়ের ফোন থেকে ফোন করলাম! ভাগ্যিস বাড়িতে ছিলাম, পিজিতে থাকলে এটা হত না!
রিং হতে শুরু করল… আগে কখনও ওর সাথে কথা বলব বলে এত উত্তেজনা হয়নি। এমনকি ওর সাথে সম্পর্কের প্রথম প্রথমও না!
“হ্যালো…” গলাটা বসেছে!
আমি কিছু বললাম না!
“হ্যালো…”
এতদিন পর ওর গলাটা পেয়ে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। হেরে যাওয়ার আনন্দ পেলাম যেন! ভালবাসার কাছে, জিদ.. ইগো এসব গুলো ছাড়তে পারলে যে কি আনন্দ হয়! সব যেন একসাথে মনের মধ্যে হচ্ছে!
“বাবু তুমি?”
“হুম…”
“কেমন আছ?”
“ওষুধ খেয়েছ?”
“হ্যাঁ…”
“গলায় কিছু জড়িয়ে শুয়েছ তো?”
“হ্যাঁ”
“পাখা কমানো আছে না হুরহুর করে চলছে..”
“কমানো ”
“মাথার দিকের জানলায় পর্দা টানা!”
“হুম… টানা!” ওর গলায়ও স্বস্তির ছাপ যেন! “তুমি কেমন আছ?”
“ভাল…”
“পেট কেমন এখন? ”
“ভালোই…”
“স্যুট করেনা যখন বাইরের খাওয়ার খাও কেন? “.
আচ্ছা, তিনিও খবর রেখেছেন তাহলে আমার পেট খারাপের!
“একদিনই খেয়েছি! ”
“একদিনই কেন খাবে?জানো তো পেট পাতলা” পুরোন দাবিগুলো ফিরে পেতে খুব ভাল লাগে। এই অধিকারবোধগুলোই হারিয়ে গেছিল জীবন থেকে!
“আর খাব না!”
“হুম… লাস্ট সেমেস্টার তো?”
“হুম… তোমার জয়েনিং কবে?”
“সেপ্টেম্বর থেকে ছ’মাসের ট্রেনিং! দিল্লিতে! তারপর.. ”
“ও…” ও দিল্লি চলে যাবে?
“ওখানে গিয়ে এরম অনিয়ম করবে না!”
” হুম… নেট লাগিয়ে ফেললে যে জানালে না তো?”
“না জানালে জানলে কি করে?”
“ঋষি বলেছে!”
“ঋষিকে কে বলেছে?”
“ও…ডিরেক্টলি বলতে পারতে!”
“পারতাম… আবার পারতাম না’ও!”
“কেন?”
“ছাড়ো…”
হেসে বলল “তাহলে আমার শরীর খারাপটা হয়ে ভালোই হয়েছে… অন্তত তোমার গলাটা শোনা গেল…”
“হয়েছে…”
হাসল। “বেশ… রেস্ট নাও!”
“তুমিও…”
“হুম…” বলে ধরে রইলাম!
ওও কাটেনি!
“বাবু?”
“হুম?”
“তুমি এখনও আমায় ভালবাস?”
“না…!তুমি?”
“একা একা বাড়িতে ভাল লাগছে না… বাড়িতে এসো না,পারলে! ”
“দেখি… আসব!” বলে ফোনটা রেখে দিলাম!
*
মনের মেঘ কাটেনি কিন্তু পরিবেশ মনোরম। এসে বসলাম টিভির ঘরে। মা যথারীতি সিরিয়াল দেখছে! “এখন কিন্তু ঘোরাবি না! ইন্টারেস্টিং জায়গায় চলছে!”
“তোমার কখন ইন্টারেস্টিং জায়গায় চলেনা?”
“আমি মোটামুটি এখন ঘোরাতে দেব না!”
“আমি ঘোরাচ্ছিও না!” আমিও বসে দেখছি!
“কি হয়েছে রে? অন্যদিন তো সিরিয়ালের শব্দ শুনলেই পালাস!”
“ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছে না!”
“তা ঘুরে আয় একটু বাইরে থেকে!”
ভাল আইডিয়া!
বেরলাম। বৃষ্টি হচ্ছে এক’দিন টানা! বাতাসটা ঠান্ডা ভারি মত। হাওয়া দিচ্ছে! ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদার! তবে ঘোরা হল না বেশিক্ষণ। বৃষ্টি শুরু হল। জোর কদমে বাড়ি ফিরলাম। ঘরে চলে এলাম।
রাত তখন পৌনে দশটা! ঋষির ফোন!
“হ্যা বল…”
“তুই ওকে ফোন করেছিলি?”
“হুম…”
“কি বলেছিস ওকে তুই?”
“কিছু বলিনি তো… সাধারণ কথা হয়েছে..!”
“সাংঘাতিক কান্ড করেছে! ”
“কি করেছে?”
“whatsapp এ পাঠাচ্ছি… দেখ!”
কি হল রে বাবা! আমি তাড়াতাড়ি নেটটা অন করলাম। whatsapp টা খুললাম! একটা ছবি পাঠিয়েছে ঋষি। কোন গ্রুপের চ্যাট! ওদের ক্লাসের গ্রুপ! ঋত্বিকের একটা বেশ বড় বয়ান :
Hey guys… I have something to confess. I’m Gay..and I’m proud of that! If anyone do not want to keep friendship with me after this… its absolutely fine! but I can’t change myself for anyone or anything …. if you can accept me as I’m… its good.. if you can’t… then just stay away.. thank you!
O M G : এটাই ছিল আমার প্রথম রিয়্যাকশন। ঋষি আবার ফোন করল। “দেখলি?”
“হ্যাঁ… বাট্ রেসপন্স কেমন?”
“মেলানো মেশানো!”
” ওর একটু খেয়াল রাখিস…”
“তুইই রাখ না… ” আমি হাসলাম।
আমি ওকে আবার ফোন করলাম! “ঠিক আছ?”
“হুম কেন?”
“সাংঘাতিক কান্ড করেছ তো!”
“সঙ্গদোষ… ”
হিহিহিহি…
“বাবু… আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না…আর!” খুব সিরিয়াসলি বলল।
“হুম… জানি!”
“তুমি তো সব জানো…”
“হুম… জানিই তো!”
“ভাল…”
“I’m so proud of you…”
“really?”
” no…I was kidding…”
“very funny… ”
“I love you…”
“I hate you too…”
“I hate you 3 4 5..”
“I love you…
”