
-মুহতারিম শাহরিয়ার পৃত্থুজ(পৃত্থুজ আহমেদ)
উৎসর্গঃ-ফাহাদ তানভী
গত কয়েকমাস যাবত খুব একটা খারাপ যাচ্ছেনা দিনকাল।বেশ চলে যাচ্ছে।খাওয়া,ঘুম আর মাঝেমাঝে ছোটখাট কিছু কাজকর্ম করা।এইত জীবন।কেটে যাচ্ছে সময়।যাই যাই করে জীবন থেকে অবেকগুলো দিন,মাস,বর্ষ হারিয়ে গেছে।পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো শীত,বসন্ত।এই অনেকগুলো বলতে দুই,এক বছর না।গুনে গুনে আশি বছর ১১ মাস ২৯ দিন।একাশি বছর ছুঁই ছুইঁ করছে বয়সটা।আর মাত্র কয়েকটা প্রহর,তারপরেই আমি আশি বছর পূর্ণ করে একাশি বছরের দোরগোড়ায় কড়া নাড়বো।আমিত এখন অশীতিপরায়ণ বুড়ো।হা হা হা!হাতের দিকে তাকালাম।শরীরের চামড়ায় ভাজ পড়েছে।আর এই লোলচর্যার ভাঁজে চাপা পড়ে আছে অনেক স্মৃতিবিজড়িত মূহুর্ত।অনেক হাসি,কান্না আর কোনো একজনের ছোট ছোট স্পর্শ।তার ঠোঁট,দাঁত,নাক,দাঁড়ি,মুখ,মুখের লালা সবই মিশে আছে এই লোলচর্যাময় গাত্রে।অদ্যপি আমার শরীরি গন্ধে তার গন্ধ আমি অনুভবি।খুব পুরুষালি একটা গন্ধ।নিজের দিকে তাকিয়ে আজ আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে।ভাগ্যিস ফাহিম নেই!ও নেই বলেই হয়ত এখন এসব ভাবতে পারছি।ও থাকলে তো এখন মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে খুঁজতেই দিশেহারা হয়ে যেতাম।ও থাকলে নির্ঘাত আমাকে ফায়াদ বুড়ো,ফায়াদ বুড়ো বলে ক্ষ্যাপাত।আমার চামড়ার ভাঁজগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত এতক্ষণে।আমার পাঁকা দাঁড়ি,পাঁকা চুল,পাঁকা লোম সবকিছুই বিজ্ঞানীদের মত পর্যবেক্ষণ করত গভীরভাবে।আর কোথাও একটু খুঁত পেলেই আমাকে ক্ষ্যাপান শুরু করতো।ফাহিম বরাবরই ছিল এমন।একটু সুযোগ পেলেই আমাকে নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিত।মনে হত সে একজন বিজ্ঞানী আর আমি তার গবেষণার বিষয়।আমার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাই ছিল যেন ওর মূখ্য কাজ সঙ্গমের পর সবার তার সঙ্গীদের উপর কিঞ্চিৎ হলেও বিরক্তি আসে।কিন্তু ফাহিমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন।রতিক্রিয়ার পর ফাহিম অনেকক্ষণ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখত।তারপর ধীরে ধীরে আমাকে তার থেকে আলাদা করত।আলাদা করেও তার কাজ শেষ হতনা।আমাকে নিজের বন্ধন থেকে মুক্ত করেই আমার শরীর নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিত।প্রায়শই আমি ঘুমিয়ে যেতাম কিন্তু ও বেশিরভাগ সময়ই ঘুমাত না,হোক রাত কিংবা দিন সে আমাকে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতই।আমার নাম আয়াদ।কিন্তু ফাহিমের ভাষ্যমতে আমি ফায়াদ।আমাদের দুজনের নামটা কেটেকুটে মিলিয়ে নিয়ে আমার নামটা ফায়াদ রেখেছে।ফাহিম সবসময়ই আমাকে ফায়াদ ডাকত।
আজ ফাহিম আমার সাথে নেই।আমার এই শেষ বয়সে হাতের লাঠি হওয়ার জন্য ওকে খুব দরকার ছিল।এই বৃদ্ধাশ্রমের চারদেয়ালের মাঝে মাঝেমাঝে দমবন্ধ লাগে।ফাহিম থাকলে আমার এমনটা হতনা কখনও।তবুও ওর প্রতি অনুভূতিগুলোই যেন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।ওর ভালোবাসাই আমার হাতের লাঠি হয়ে আমাকে সঙ্গ দেয়।আগলে রাখে সকল বিপদ থেকে।ফাহিম চলে গেছে আজ থেকে ৪৭ বছর ২ মাস ২৫ দিন আগে।আর আজ আমার বয়স আশি বছর ১১ মাস ২৯ দিন।স্মৃতিগুলো এখনও যেন জীবন্ত।ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করে আমাকে আগলে রাখে,প্রগাঢ় তমসায় পথনির্দেশক হয়ে পথ দেখায়।মনে হয় এইত সেদিনের কথা।কিন্তু এক মূহুর্ত,এক মূহুর্ত করে পেরিয়ে গেল ৪৭টা বছর।আজ আমি অশীতিপরায়ণ বৃদ্ধ।ঠিকানা এই বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট গন্ডির অন্তরালে।তবে এই বৃদ্ধাশ্রমের অপরাহ্ণগুলো খুবই উপভোগ্য।প্রাণবন্ত এবং জীবন্ত।যৌবনের সেই জৌলুসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।এখানে প্রতিটা অপরাহ্ণই ফাহিমের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।এইরকম কত অপরাহ্ণ আমি ফাহিমের কাঁধে মাথা রেখে দিগন্তের পাণে তাকিয়ে পার করেছি তার ইয়ত্তা নেই!কিন্তু আজ এই মাথাটা সেই কাঁধটা খুঁজে বেড়ায় প্রতিনিয়ত।এই অশীতিপরায়ণ দৃষ্টি এখনও দিগন্তের পাণে তাকিয়ে থাকে।কিন্তু এই দৃষ্টি আজ অন্তঃসারশূন্য।এখানে নেই কোনো স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি,নেই কোনো আশা আকাঙ্ক্ষার হি জি বি জি।তবু দৃষ্টি স্থির রেখে তাকিয়ে থাকি রোজ নিয়ম করে।যদি একটিবার আনমনে মাথাটা ফাহিমের কাঁধে হেলে পড়ে।যদি এক পলকের স্থায়ীত্বেও ফাহিমকে দেখতে পাই।এই বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর থেকেই প্রতিদিন নিয়ম করে অপরাহ্ণ পালন করা হয়।আর কেউ না,শুধু আমি আর আমার ফাহিম।হ্যাঁ ফাহিম!ফাহিম চলে গেছে ঠিকই কিন্তু ওর অনুভূতি,হৃদস্পন্দন এখনও আমার হৃদপিন্ডে ঢিপঢিপ করে।ওর ভালোবাসা এখনও আমার আমিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।মিশে আছে আমার অস্তিত্বে।আমার আমি বলতে তো ঐ ফাহিমই।আমার নিজের কিছু নেই,সবটাতেই ফাহিম জড়িয়ে আছে।এই বৃদ্ধাশ্রমের অপরাহ্ণে আমি রোজই ফাহিমের জপ করি।মনে হয় ফাহিম আছে,আশেপাশে থেকেই আমাকে তার উষ্ণতা বিলচ্ছে।ওর উষ্ণতা নিয়েই তো এতগুলো বছর পার করে এসেছি।আজকাল শীতের রুক্ষতায় শরীর কেমন জানি বিকল হয়ে আসে,সাথে মনটাও অবসাদের কৃষ্ণগহ্বরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন।শরীরটা ধীরে ধীরে বরফে আক্রান্ত রুক্ষ বাকলের মত ঝরে পড়ছে মনে হচ্ছে।ফাহিম তোমার কেমন জানি কমে যাচ্ছে।তোমার উষ্ণতা ধীরে ধীরে শীতল থেকে শীতলতর কেন হচ্ছে।হয়ত ওপারের ডাক এসে গেছে।নয়ত তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ।দূরে বহুদূরে।যেখান থেকে কোন অনুভূতির অনুভব ফিরে আসেনা,টানেনা কোন ভালোবাসার টান।চলে যাচ্ছ হয়ত সেই দূরের পানে নিজেকে বিলীন করতে।তুমি হারিয়ে গেলে ফায়াদও হারিয়ে যাবে।তোমার উষ্ণতা ছাড়া তোমার ফায়াদও এই পৃথিবীর গরল অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবেনা।একটু একটু করে এভাবেই হারিয়ে যাব উভয়ই দূর থেকে বহুদূরে.. সমাপ্ত।
সমপ্রেমের গল্প