
আয়াদ মোহাম্মদ হিমু
উৎসর্গ:-সুপ্রিয় লেখক চিন্ময়ের ইতিকথা কে।যাঁর হাত ধরেই লেখালেখির জগতে আগমন।যাঁকে দিয়েই হাতেখড়ি।এই গল্পটা তাই চিন্ময়ের ইতিকথা কেই উৎসর্গ করলাম।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
সকাল আটটা।হাঁটছি পাড়ার ছোট্ট গলিটা ধরে।আমার হাতের কনিষ্ঠাগুলি দখল করে আছে অন্তিকার ছোট্ট হাতের মুষ্ঠি।আমার সাথে পা মিলাচ্ছে।যদিও এটাকে পা মিলানোও বলেনা,অন্তিকা একরকম দৌঁড়াচ্ছে বলা যায়।বয়স তো মাত্র পাঁচবছর।আমি অনেকবার ওকে কোলে নিতে চেয়েছি কিন্তু ও কোলে উঠবেই না।ও কখনোই আমার কোলে উঠেনা।সবসময় আমার হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি ধরে হাঁটবে।যদিও ওর হাঁটাকে আমার কাছে এক্কা দোক্কা খেলার মতোই মনে হয়।
বাবাই আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমরা একজন যাদুকরের কাছে যাচ্ছি মামনি।সকলেই কী না যাঁর মায়ায় বশীভূত হতে পারে।
তাই? আমিও বশীভূত হয়ে যাবো বাবাই?
হ্যাঁ!হতেও পারো।কারণ ও এমনই একজন।যে কেউ,যেকোনো সময় ওর মায়ায় পড়ে ওকে ভালোবেসে ফেলতে পারে।ওর আঁখিযুগলে রয়েছে জগতের সকল মায়ার আঁধার।ওর চোখের দিকে তাকালেই মানুষ হারিয়ে যাবে কোনো অজানায়।যেনো মহাভারতের সেই চক্রব্যূহ,যাতে আটকা পড়েছিলো অভিমন্যু। তবে এটা অন্যরকম চক্রব্যূহ,যেনো ভিন্ন মায়া।যেখানে শুরু হয় এক নতুন মোহের অঙ্কুরণ।যা থেকে অঙ্কুরোদগম হয় ভালোবাসার।
আচ্ছা বাবাই ওর কী বড়ো বড়ো দাঁত,বড়ো শিং,লাল লাল চোখ? ঠিক টিভিতে দেখানো যাদুকরদের মতো?
না মামনি।ও খুব সুন্দর যাদুকর।ওর মতো সুন্দর মনে হয় এই ধরনীতে দ্বিতীয়টি নেই।
হ্যাঁ ও খুব সুন্দর।আমি ওর সৌন্দর্য্যের প্রেমে কখনো পড়েছি কী না জানিনা।তবে ওকে ভালোবেসেছি।অদ্যপি ওকেই ভালোবাসি।জীবনের শতো টানাপোড়নেও ওর প্রতি ভালোবাসা কিঞ্চিৎ পরিমাণও কমেনি।না এটা কোনো অত্যুক্তি নয়।ওর প্রতি এই ভালোবাসাই আমাকে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আলো বিকিরণ করে প্রতিনিয়ত আমাকে জীবনের প্রত্যেকটা অন্ধকারেই পথ দেখাচ্ছে।যেনো এক নির্বাক পথনির্দেশক।আমার অগ্নিদগ্ধ হৃদয়ে এ ভালোবাসাই যেনো কিমুলোনিম্বাস এর মতো পুঞ্জীভূত হয়ে প্রতিনিয়ত শীতল বৃষ্টি ঝরিয়ে আমাকে শীতল করছে।
ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলাম আমি চলে এসেছি আমার গন্তব্যে।একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়লো সেই তিক্ত অথচ অমিয়মান লেখাটি।প্রধান ফটকে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা,”মানসিক হাসপাতাল।”
হ্যাঁ এখানেই আছে আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষ।আমার ভালোবাসার মানুষ।আমার মহেশ্বর।প্রথমবার প্রবেশ করেছিলাম এখানে বাবার হাত ধরে,পায়ে পা মিলিয়ে।আজ আবারও একবার নিজের মেয়ের হাত ধরে,পায়ে পা মিলিয়ে প্রবেশ করছি।
*
সেবার সবেমাত্র একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি।পুরো পৃথিবীটাই তখন আমার কাছে রঙিন ছিলো।কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।বলতে গেলে খুব আনন্দেই আছি নিজের কলেজ জীবন নিয়ে।তেমনই একদিন অপরাহ্ণে ছাদে বসে বই পড়ছিলাম।কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই তাকিয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছে।
বাবা কিছু বলবে?
হ্যাঁ।আসলে আমাদের এখানকার যেই মানসিক হাসপাতাল টা আছে ওখানকার রোগীদের জন্য কিছু জিনিসপত্র দিতে হবে।
কী দিবে তুমি ওদের?
বেশি কিছুনা।জামাকাপড় আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর কী!আর তুই আমার সাথে যাবি কাল ওখানে।
আচ্ছা বাবা যাবো।
বাবা চলে গেলো।আমাদের পরিবার আমাদের এখানকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে একটি।আমার বাবারও যথেষ্ট সুনাম এবং সম্মান আছে এলাকায়।আর আমার কাছে আমার পৃথিবী বলতে আমার পরিবারই।আমার বাবা আর মা।যেমনটা তাঁদের কাছে আমি।
*
আমি বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি।বাবা সকল মানসিক রোগীদের কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিচ্ছেন।আমিও বাবাকে সাহায্য করছি।একে একে সবাইকে দেওয়া হলো।কিন্তু নামের তালিকানুযায়ী একজন নেই।অভিক আহমেদ নামক কেউ একজন অনুপস্থিত।তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেই ওখানকার একজন নার্স বললো ও নাকি আসবেনা।জেদ ধরে বসে আছে।আর মানসিক রোগীদের এমন জেদ ধরাটা অস্বাভাবিক নয় এটা আমাদের সবারই জানা।আমার অনেকটা কৌতূহল জাগলো ব্যাপারটা নিয়ে।তাই ভাবলাম আমি নিজেই গিয়ে অভিক আহমেদ এর জিনিসপত্র গুলো দিয়ে আসি।বাবার অনুমতি নিয়ে একজন নার্সকে সাথে নিয়ে চললাম অভিক এর কক্ষে।নার্স আমাকে রুমটা দেখিয়ে দিতেই আমি নার্সকে চলে যেতে বললাম।ওর কক্ষে গিয়ে দেখলাম ও নিজের বেড এ বসে আছে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।ওর বেডটা জানালার পাশেই।ওকে দেখেই আমি অনেকটা অবাক হয়েছি।আমি ভেবেছি বৃদ্ধ কেউ হবে।কিন্তু ছেলেটার বয়স খুব একটা বেশি না।আমার থেকে বছর তিনেক এর বড়ো হবে।আমি গলা ঝাঁকি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম।
আচ্ছা আপনি ওখানে গেলেন না কেনো?
ও চুপ করেই রইলো।কিছু বললো না।
আচ্ছা যাইহোক এখানে আপনাকে কিছু জিনিসপত্র দেওয়া হয়েছে।এগুলো রেখে দেন।
তখনও কিছু বললো না।এমনকি একবারের জন্যও ফিরেও তাকালোনা আমার দিকে।
আমি চলে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই ও বললো আমি কারো দয়ার দান গ্রহণ করিনা।কথাটা শুনে একটু অবাকই হয়েছি আমি।তবে মানসিক রোগীদের এমন আচরণ অস্বাভাবিক নয় বিধায় ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে চলে আসলাম।কিছুটা অদ্ভুত লাগলো লোকটাকে।
*
অনেকদিন কেটে গেলো।সেই লোকটা মানে অভিক এর কথা মাঝেমাঝেই মনে পড়তো।তবে সেটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই।আমার কেনো জানিনা ওর কথা মনে পড়লেই হাসি পেতো।কেমন অদ্ভুত লোকটা!
তাই একদিন অতি আগ্রহবশতই গেলাম সেই মানসিক হাসপাতালে গেলাম অভিক কে দেখার জন্য।ওর কক্ষটা আমার চেনা। তাই খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট হলোনা।কিন্তু যখনই ওর কক্ষের কাছাকাছি গেলাম তখনই চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলাম।যদিও এগুলো মানসিক হাসপাতালে খুবই স্বাভাবিক।আরেকটু এগোতেই দেখলাম অভিক দৌঁড়ে আমার দিকেই আসছে।ওর পিছনে ডাক্তার আর নার্স ওকে ধাওয়া করছে।ও আমার কাছাকাছি আসতেই ওকে ধরে ফেললাম।ও ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
কী হয়েছে আপনার?
ওরা আমাকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য আসছে।আর আমার এসব ইঞ্জেকশন একদমই ভালো লাগেনা।খুব ভয় লাগে।আমি ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম কেউ আপনাকে কিচ্ছু করবেনা।আপনি আমার সাথে আসুন।ডাক্তার আর নার্সকে ইশারায় সরে যেতে বললাম।আমার বাবার কল্যাণেই এরা আমার কথা শুনেছে বলা যায়।আমি অভিক কে সাথে নিয়ে ওর কক্ষে গিয়ে ওকে বললাম আপনি বিশ্রাম করুন।কেউ আপনাকে কিচ্ছু করবেনা।ও কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো সত্যিই তো?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।ওকে কক্ষে রেখে বাইরে আসতেই ডাক্তার আর নার্স আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আর বললো,অভিক যখন উত্তেজিত হয় তখন ওকে সামলানো বড়ো মুশকিল হয়ে পড়ে।কিন্তু আপনি এতো সহজেই ওকে শান্ত করলেন!
আমি কিছু না বলে হাসলাম।
আচ্ছা ডাক্তার উনার কী হয়েেছ?
ডাক্তার বললো,অভিক এর পারিবারিক কোনো সমস্যার কারণে ও মানসিক আঘাত পায় গুরুতরভাবে।আর তাঁরপর থেকে ওর এই অবস্থা।
আচ্ছা উনি কতোদিন যাবত এখানে আছেন?
প্রায় দু’বছর যাবত।
কথাটা শুনে কেমন জানি লেগে উঠলো।খুব খারাপ লাগছে।
বাসায় এসেও কেনো জানিনা অস্থিরতা কাজ করছে।কী এমন সমস্যা হয়েছে অভিক এর বাসায় যাঁর জন্য ওর এমন অবস্থা!
*
কয়েকদিন পর আবারও গেলাম সেখানে।অভিক এর কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখলাম ও আজ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছে।তবে ওকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে একরাশ কালো মেঘ এসে ওর সুশ্রী বদন খানা ঢেকে রেখেছে।আমি ওর কাছে গিয়ে ওর কাধে হাত রাখতেই আমার দিকে ঘুরে তাকালো ও।আমি ওর পাশে বসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে আপনার? ও কিছুনা বলেই উঠে চলে গেলো বাইরের দিকে।আমি ওর পিছুপিছু হাঁটতে লাগলাম।ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে একটা গাছের নিচে বসলো,আমিও ওর পাশে গিয়ে বসলাম।ওকে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন আপনি?ও বললো ভালো।আবার পরক্ষণেই বললো ভালো না।আর হাসতে হাসতেই চলে গেলো।আমি আর এগোলাম না।ওখানেই কিছুক্ষণ বসে বাসায় চলে আসলাম।
পরদিন যখন গেলাম তখন দেখলাম ও সেই গাছটার নিচেই বসে আছে।আমি পূর্বের মতোই ওর পাশে গিয়ে বসলাম।জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন?ও আবারও সেই একই উত্তর দিয়ে হাসতে হাসতেই চলে গেলো।
*
এভাবেই আমি প্রতিদিন নিয়ম করে একবার হলেও যেতাম ওর কাছে।ওর পাশে বসতাম,কথা বলতে চাইতাম।ও কখনো কথা বলতো,কখনো কথা বলতো না।আবার কখনোবা সেই একইভাবে হাসতে হাসতে চলে যেতো।সত্যি বলতে কী ওর প্রতি কেমন একটা মায়া জমে গেছিলো।তাই ওর উপেক্ষা স্বত্বেও ওর কাছে যেতাম।তবে তখনও ওর প্রতি কোনো ভিন্ন অনুভূতি জাগেনি।
এমনই একদিন ওর পাশে বসে আছি।ওকে জিজ্ঞেস করলাম,আপনার বাসায় কে কে আছে?ও বললো আমার মা,আর….
আর কে?
আর কেউনা বলেই ও চলে গেলো।ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন জানি লাগলো।তাই ভাবলাম ওর পরিবার সম্পর্কে জানতেই হবে আমাকে।তবে কীভাবে জানবো সেটা জানিনা।
এই কয়েকদিনে ওর সাথে কিছুটা হলেও ঘনিষ্ঠ হয়েছি।ওর সাথে আমি এইসেই বিভিন্ন কথা বলার চেষ্টা করতাম।ও তেমন জবাব দিতে চাইতো না।মাঝেমাঝে আমার উপর ক্ষেপে যেতো।কিন্তু পরে আবার ঠিক হয়ে যেতো।
একদিন জিজ্ঞেস করলাম,আচ্ছা তোমার বাবা কী করেন?
ও তখন খুব ভয়ানক ভাবে রেগে গিয়ে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলো।আশেপাশে কিছু নার্সরা ওকে কোনোমতে ওর কক্ষে নিয়ে গেলো।আমি অনেকটা ভয় পেয়ে গেছিলাম তখন।এমন ক্ষেপে যাওয়ার মতো কিছু বললাম কী আমি?
*
প্রায়ই দেখতাম ওর সাথে দেখা করার জন্য মধ্যবয়স্ক একজন লোক আসতো।কিন্তু ও কিছুতেই ঐ লোকটার সাথে দেখা করতে চাইতোনা।যদিও কখনো লোকটা ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতো,ও লোকটাকে আঘাত করতো,মারার জন্য উদ্ধত হতো।
একদিন লোকটা আবারও দেখা করতে এসেছিলো,কিন্তু অভিক দেখা করবেনা এমনকি পাগলামি শুরু করেছে বিধায় লোকটা চলে যাচ্ছিলো।আমি লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,আচ্ছা আঙ্কেল আপনি কে বলুন তো?অভিক এর সাথে আপনার কীসের সম্পর্কে?
লোকটা যা বললো আমি তাতে আরো একবার বিষ্মিত হলাম,উনি বললো উনি অভিক এর বাবা।উনার গলার স্বর বদলে গেলো,অনেকটা ধরা গলায় বললো,অভিক এর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।
আমি বললাম কেনো?কী করেছেন আপনি?
উনি বলতে লাগলেন,অভিক তখন কলেজে ভর্তি হয়েছে কয়েকমাস হলো।একদিন ও বাসায় একটা মেয়ে নিয়ে এলো,আর বললো ও নাকি মেয়েটাকে ভালোবাসে।তখন ওর বয়সটা কম ছিলো।এই বয়সী ছেলেমেয়েরা এসবে জড়াতেই পারে।আর এসব নিয়ে ঝামেলা করলে সমস্যা বাড়বে বিধায় আমরা ব্যাপারটা যেমন আছে তেমনই চলতে দিলাম।তবে একটা অভিক এর প্রেমিকা অনেক সুন্দরী ছিলো।একদিন বাসায় কেউ ছিলোনা।আমি একা ছিলাম।অভিক বন্ধুদের সাথে বাইরে গিয়েছিলো।আর অভিক এর মা ওর কোনো আত্মীয়ের বাসায় গেছিলো।আমার নেশা করার বদ অভ্যাস ছিলো।কিন্তু অভিক এবং ওর মা সেটা মোটেও তা পছন্দ করতো না।বাসা ফাঁকা পেয়ে তাই আমি মদ্যপানের নেশায় মত্ত হয়ে গেলাম।কলিংবেল এর আওয়াজে দরজা খুলতেই দেখি অভিক এর প্রেমিকা মানে নীলা দাঁড়িয়ে আছে,আমাকে দেখেই বললো অভিক বাসায় আছে কী না!আমি ওর কচি শরীরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম,হ্যাঁ বাসায় আছে।সত্যি বলতে মদের নেশায় আমার তখন হুশ ছিলো না।আমি নীলাকে দেখে ওরপ্রতি কামার্ত হয়ে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।আমার প্রস্তরময় লিঙ্গ দ্বারা আঘাত করতে থাকলাম ওর নিতম্ব।মদ এর এবং যৌন নেশায় আমার তখন পাগলপ্রায় অবস্থা।আমার পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ও সেখানেই মারা যায়।ঠিক সেই সময়ই অভিক এর মা বাসায় এসে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে ফেলে।আমি কী করবো না করবো ভেবে হাতের কাছে থাকা লোহার ফুলদানী টা দিয়ে সজোরে আঘাত করি আমার স্ত্রীর মাথায়।আর তখনই আমার স্ত্রীও মারা যায় সেখানে।আর তাঁরপর থেকেই অভিক আমাকে ঘৃণা করে।নিজের মা আর প্রেমিকার দুঃখে ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।কিন্তু আমার প্রতি ঘৃণাটা ওর এখনও আছে।
মানুষ এতোটা জঘন্য আর নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে!আপনার কু কর্মের ফল আজ আপনার ছেলে ভোগ করছে।আমার ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে দেখে।
কথাগুলো বলেই চলে আসলাম ওখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে।কিন্তু আমি কাঁদছি কেনো?
*
অভিক আর আমি পাশাপাশি বসে আছি।আজ কেনো জানিনা আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।তাই চুপ করেই বসে রইলাম।কী অদ্ভুত মানুষের জীবন!নাহলে অভিক এর মতো একটা ছেলের এই অবস্থা কেনো!
হঠাৎ করেই ওকে বললাম চলো ঘুড়ি উড়াই।আমি ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে দৌঁড়ে গিয়ে একটা ঘুড়ি কিনে নিয়ে আসলাম।আর দুজন মিলে হাসাপাতালের পাশেই একটা খালি জায়গায় ঘুড়ি উড়াচ্ছিলাম।আমি আর অভিক খুব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলাম।ওর গায়ের মাতাল করা গন্ধ অনুভব করছিলাম।আকাশে ঘুড়ি উড়ছে আর আমি তাকিয়ে আছি অভিক এর দিকে।ও আমার থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আনন্দে বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে।এভাবেই আমি দিনদিন ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম।আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি কোন অনুভূতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছি।একবার সাইকেল নিয়ে এসে আমি আর অভিক পুরো হাসপাতাল চত্বর ঘুরেছিলাম। আমি সাইকেল চালাচ্ছিলাম আর অভিক পিছনে বসে হাততালি দিচ্ছিলো আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলো।শুধু অভিক ই নয়,এখানকার প্রায় সব রোগীদের কাছেই আমি খুব প্রিয় হয়ে উঠলাম।এমনকি ডাক্তার, নার্সরাও আমাকে প্রচুর ভালোবাসতো।মনে মনে বাবাকে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাতাম।কারণ বাবার জন্যই এখানে আসা,এখানকার মানুষগুলোকে পাওয়া,আর অভিক কে পাওয়া।এরা মানসিক রোগী হলেও সাধারণ মানুষ থেকে কেনো জানিনা অনেক ভালো।এদের মাঝে কিছু একটা বিশেষত্ব আছে।আর এরা খুব ভালোবাসতে জানে।এদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।নেই অভিক এর মাঝেও কোনোরকম কৃত্রিমতা।মাঝেমাঝে অভিক প্রচন্ড পাগলামি করে ঔষধ খেতে চায়না,খাবার খেতে চায়না।তখন আমাকেই ওকে খাইয়ে দিতে হয়।আমার কেনো জানিনা এটা খুব ভালো লাগে।অনেক সায়াহ্নে আমরা একসাথে চন্দ্রোদয় দেখেছি।আবার অনেক যামিনীতে করেছি তারকা গুণন।।
আচ্ছা আমি কী অভিক কে ভালোবাসি?হয়তো বাসি।না আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি।তাইতো জীবনের শতো জটিলতায়ও আমি অভিক কে ছাড়তে পারিনি।ওর সাথেই জীবনের শেষ পর্যন্ত চলার পণ করেছি আমি।কিন্তু অভিক!ও কী কখনো আমাকে ভালোবাসবে?ডাক্ত
ার বলেছে অভিক কখনোই স্বাভাবিক হবেনা হয়তো।অভিক তো জানবেওনা কখনো আমি ওকে ভালোবাসি।
তাতে কী!ভালোবাসা সুখের পরিণতি প্রাপ্তির আশায় জন্মায়না।ভালোবাসা কেনো জন্মায় সেটাও আমরা জানিনা।ভালোবাসাতো অপ্রাপ্তির প্রাবল্যতা দূর করে এক নতুন জীবনের সূচনা করে।সেখানে থাকেনা কোনো চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।ভালোবাসার মানুষের জন্য কোনো কিছু ভালো করতে পারার মাঝেই যেনো বড়ো প্রাপ্তি।
*
এভাবেই চলতে থাকে আমার ভালোবাসাময় জীবন।অভিক এর সাথে জীবনটা খুব ভালোই কেটে যাচ্ছিলো।আমি নিরবতায় খুঁজে পেয়েছি আমার ভালোবাসা।যেটা আমৃত্যু অব্যক্তই থাকবে।একসময় চলতে চলতে থমকে গিয়েছি।আর দশটা সাধারান মানুষের মতো আমারও এসেছে সংসারের ডাক।যেটা আমি উপেক্ষা করতে পারিনি।পারিনি এই সমাজ,সংসার আর নিজের পরিবারকে উপেক্ষা করতে।করবোই বা কীভাবে!আমিও তো এদের একটা অংশ।একবার ভেবেছি পালিয়ে যাবো এই বানোয়াট সমাজের নিয়ম শৃঙ্খল থেকে।কিন্তু না।সেই সমাজের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে সমাজের নিয়ম,সংসারের সম্মান রক্ষার্থে বাঁধা পড়লাম সংসার নামক বেঁড়ীর বন্ধনে।যাঁর ফল হলো অন্তিকা।কিন্তু বুকের মাঝে লালিত ছিলো অভিক এর প্রতি কঠোর ভালোবাসা।যেটা এখনো বিদ্যমান আছে।যা কখনোই এসব সমাজ,সংসারীয় নিয়ম কানুনের অন্তরালে চাপা পড়ে নিষ্পেষিত হবেনা।
*
এটুকু পথ হাঁটতেন হাঁটতেই পুরো জীবনটাকে একবার পড়ে নিলাম।সত্যিই কতো ক্ষুদ্র আমাদের জীবন!এক নিমেষেই শেষ হয়ে যায় একেকটা জীবনী।একেকটা জীবনের আত্মকথা।অভিক এর কক্ষের সামনে দাঁড়াতেই অভিক আমার দিকে তাকালো।সাথে অন্তিকা কে দেখে যেনো আকাশের চাঁদ সামনে দেখলো সে।
বাবাই এই কী সেই যাদুকর?
হ্যাঁ মামনি।তুমি যাও ওর কাছে।
অন্তিকা ওর কাছে যেতেই ও কোলে নিলো।ও কয়েকদিন আগেই অন্তিকা কে দেখতে চেয়েছিলো।তাই আজ নিয়ে আসা।ও খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্তিকার সাথে কথা বলছে।মনে হচ্ছে ওরা হাজার জনমের চেনা।
আমি এমনটাই তো চেয়েছিলাম।আমি,অভিক আর অন্তিকা।ছোট্ট একটা সংসার।
চোখের কোণায় ভেজা অনুভব করছি।চশমার কাচটা ঝাপসা হয়ে এলো।
আমি একটু দূরে সরে এলাম।আর দেখতে লাগলাম অন্তিকা আর অভিক কে।
আচ্ছা আমি কী কখনো অভিক এর মনে জায়গা নিতে পেরেছি?হয়তো বা না।তবে আশা ছাড়িনি।তাইতো রবীন্দ্রনাথের “অপরিচিতা”গল্পের সেই অনুপমের মতো দিন,মাস,বছর পার করেও যে কল্যাণীর পাশে ছিলো।আমিও তেমনই পাশে আছি আমার অভিক এর।যখন সুবিধা হয় তখন ওর কিছু কাজ করে দিই,পাশে থাকি,কথা বলি।আর মন বলে,এইতো জায়গা পেয়েছি।যেখান থেকে শুরু সেখানেই এসে থেমে যাই বারবার।কারণ এটাই তো আমার ভালোবাসার অঙ্কুরোদগম।
প্রথম প্রকাশঃ-সাতরঙা গল্প
সমপ্রেমের গল্প