
ঘাসফড়িং
১
-টাকাটা কোথায় পেলে?
-কোথায় পেলাম সেটা জানার দরকার কি তোমার? কত আছে এখানে সেটা একবার দেখে নাও।
-কেন? তুমি গুননি?
-আমি তো গুনেই এনেছি।তারপরও তোমার গুনে দেখা দরকার।
-তাহলে বলছনা কে দিল টাকা গুলো!
হাতের টাকাগুলোকে গুনতে গুনতে বলল রাফি।
সিয়াম বোকার মত মুখ করে বলতে লাগল,
-আমি এভাবে পুরুষের মত টাকা গুনতে পারিনা।
রাফি ভ্রু কুচকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গিতে বলল,
-পুরুষের মত বলতে? কি বলছ এসব!
-আরে তুমি যেভাবে আঙ্গুলের ডগায় থুথু লাগিয়ে টাকা গুলো গুনছ না,আমি ওই রকমটার কথা বলেছি।
এবার রাফির মুখের স্থির হাসিটা অস্থির আকার ধারণ করল। সে শব্দ করে হেসে উঠল।
-কিউট ছেলেরা পুরুষের মত টাকা গুনতে পারেনা।
একটু দুষ্টুমির ছলে কথাটা বলেই রাফি সিয়ামের বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। সিয়াম মলিন মুখে রাফির বের হওয়া শূন্যের দিকে চেয়ে থাকে।
কি যেন মনে করে রাফি আবারো ফিরে আসে সিয়ামের রুমে। এসেই হুট করে সিয়ামকে চেপে ধরে একটা চুমু খায় সিয়ামের গালে।রাফির এবারের প্রস্থানটা আগের বারের থেকে আরেকটু দ্রুত গতির ছিল। রাফি লজ্জা পেল কিনা সেটা সিয়াম বুঝতে পারছে না। কিন্তু সিয়ামের শরীরে যেই কাঁপনটা এসেছিল তার কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না।
একটু লজ্জা,একটু ভাল লাগা আর একটু কামনার মিশ্রণে রাফির ঠোঁটদুটোর স্পর্শ সিয়ামকে আলাদা এক ভাল লাগা যে দিয়েছে, সেটা সে টের পেয়েছে।এসব ভাবতে গিয়েই বিভোর হয়ে ছিল কিছুক্ষণ।
তবে মুহুর্তেই কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ল সে,ফোন কলে তার বাবার কল দেখে।
ধীরে ধীরে সিয়াম বালিশের পাশ থেকে ফোন এনে কানে ধরল।
-হ্যালো আব্বু।
-বাবা টাকাটা গেছে তো?
-হ্যা আব্বু এসেছে।
-বাবা এই মাসে তোমার হাত খরচের টাকাটা দিতে পারিনি।কয়েকদিনের মধ্যেই আব্বু পাঠিয়ে দেব।তুমি চিন্তা কর না।
-আমার কোন সমস্যা হবে না আব্বু।
-আচ্ছা এখন রাখি বাবা।
-আচ্ছা।
কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখতেই দুশিন্তার রেখা সিয়ামের মুখে পড়তে লাগল।
প্রতি মাসে হোস্টেলের ফী আর সিয়ামের হাত খরচ বাবদ তার বাবা তাকে পাচ হাজার টাকা পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু এমাসে শুধু হোস্টেল ফী তিন হাজার টাকাই পাঠিয়েছে। কোন মাসেই টাকা পাঠানো নিয়ে একবিন্দু এদিক ওদিক হয় না সিয়ামের বাবার। নতুন একটা জায়গা কিনতে গিয়ে তাদের একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। সিয়ামের বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেড টিচার।দু ভাই বোনের সংসারে খুব ভাল ভাবেই চলে যায় তারা। তবে তার বাবা জায়গা কিনতে যাওয়ায় একটু আর্থিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সিয়ামকে।
আসল সমস্যাটা সে নিজেই বাঁধিয়েছে।তার বাবার পাঠানো পুরো টাকাটাই যে সে রাফিকে দিয়ে দিয়েছে।
রাফি সিয়ামের এক ক্লাস সিনিয়র। এক হোস্টেলের বাসিন্দা দুজন।রাফির অবশ্য টাকা পয়সার প্রয়োজন পড়েনা তেমন একটা। বড় ঘরের সন্তানই সে। ছেলে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে,খরচ তার একটু বেশিই হবে-এমনটা ধারনা করেই হয়ত রাফির ঘর থেকে রাফির জন্য প্রতি মাসে ৬-৭ হাজার টাকা তার বাবা মা পাঠিয়ে থাকে। তারপরও কেন যে রাফির তিন হাজার টাকার দরকার পড়ল কে জানে।আর রাফিও বা চাইতে না চাইতেই সিয়ামও কেন যে নিজের হোস্টেল ফী এর পুরোটাই রাফিকে দিয়ে দিল সেটা সে নিজেও জানে না।
তবে এটুকু সে বুঝতে পারছে, রাফিকে হেল্প করতে পেরে তার একটু নয়, অনেক ভাল লাগছে। এই ভাল লাগার অর্থ ষোল বছরের কোন ছেলে বের করতে পারবে না। তবে তারা এই ভাল লাগার জন্য অনেক কিছু করতে পারে।
সিয়াম ভাবতে লাগল, রাফির টাকার দরকার পড়তেই পারে। তার ফ্রেন্ড সার্কেল আবার খুব বড়। তাদের নিয়ে এই হোটেলে অই হোটেলে, এই পার্কে অই পার্কে ঘুরে বেড়ানো রাফির একরকম অভ্যেস।এমন একটা ঘটনা থেকেই রাফির সাথে বন্ধুত্ব হয় সিয়ামের।
প্রথম যখন হোস্টেলে ওঠেছিল সিয়াম, তখন প্রায় একমাস হয়ে যাওয়ার পরও সে ক্লাস আর রুম ছাড়া কোথাও যায়নি। পরে রুমমেটদের চাপাচাপিতে একদিন কলেজের পাশেই কোথাও সাত রঙা চা খেতে যায়। সেখানে নানান মানুষের ভীড়। চা খাওয়ার এক পর্যায়ে পাশেই একগাদা ছেলেদের হাসাহাসি আর কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পায় সিয়ামরা। ছেলেগুলোর কথাবার্তায় যেটুকু বুঝতে পারে সিয়ামরা, তাদের মধ্যে কোন একজন বাজি ধরেছিল – কেউ ১০ মিনিটের মধ্যে ১০ কাপ চা খেতে পারবে কিনা। কেউ একজন এই বাজির মোকাবেলা করে বাজি জিততে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু প্রতি কাপ ২৫ টাকা দরে হওয়ায় এখন চায়ের বিলই দিতে পারছেনা বাজি ছুড়নেওয়ালা। সরল মনের সিয়ামই সেদিন বাজি ছুড়নেওয়ালা রাফিকে সেই বিপাকের হাত থেকে বাঁচায়। তখন থেকেই রাফির আলাদা এক ভাল লাগা জন্মায় কোমলমনা সিয়ামের প্রতি। একই হোস্টেলে থাকায় তাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হয় সময়ের সাথে।
এই সম্পর্কের মূল্য সিয়ামের কাছে অনেক কিছু। আজ হোস্টেল ফী পরিশোধ করতে না পারলে আজ থেকে খাবার বন্ধ সিয়ামের; এটা জানা সত্ত্বেও রাফির টাকার প্রয়োজন পড়েছে শুনেই তাকে ডেকে এনে নিজেকে বিপদে ফেলে টাকাটা দিয়ে দিয়েছে সিয়াম। শুধুমাত্র এই সম্পর্কের টানেই। কিন্তু অদ্ভুতভাবেই রাফিকে অবগত করেনি যে টাকাটা সে নিজেই দিয়েছে। কখনও জানতেও দেবেনা সিয়াম, রাফির জন্য অগোচরে কিছু করতে পারাটকেই সিয়াম প্রকৃত কোন টান মনে করে।
কিন্তু এই টান কিংবা কেন এই খেয়াল রাফির জন্যে তার সুস্পষ্ট কারণটা ঠিক জানা নেই সিয়ামের কাছে। তবে রাফির জন্য কিছু করতে পেরেছে সেটা ভেবেই তার ভাল লাগছে।
২
শীতকাল চলছে। আর এই সীজনে ঠান্ডাও পড়েছে বেশি। এই ঠান্ডার মধ্যেও সিয়াম আর রাফি দুজন ছাদে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবত চুপ করে থেকে রাফির দিকে সিয়াম তাকায়। রাফির ছলছল চোখদুটোর দিকে দৃষ্টি দিতেই সিয়ামের বুকের ভেতর কোথাও হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যথা জমানো একটা দীর্ঘশ্বাস সিয়ামের নাকমুখ ভেদ করে বেরিয়ে এল। স্থির কন্ঠে রাফিকে প্রশ্ন করল সে,
-তোমাদের রেজাল্ট বেরোবে কবে?
-আজ কয় তারিখ চলছে? ৩ তারিখ না? তাহলে বেশিদিন নেই। ১১ তারিখই রেজাল্ট পাব্লিশ হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি মন খারাপ কর না। আরো অনেকদিন আছে।
-অনেকদিন নেই সিয়াম। আমাদের কলেজের নিয়ম তো তুমি জানোই। পরিক্ষা শেষ হল ২৯ তারিখ। খাতাও দেখা শেষ। স্যারের ভাগ্নের মুখ থেকে যা শুনলাম স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়া অনেককেই নাকি ফেইল করিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে আমার রোলও নাকি দেখেছে সে। আর খাতা কাল অফিসে জমা দেওয়া হবে। পরশু থেকেই হয়ত নাম্বার যোগ করা শুরু করবে অফিসের লোকরা।
– স্যারের কথা আর কি বলব। শিক্ষক মানুষ এত খারাপ হয়! আর তুমি মন খারাপ কর না তো রাফি। দেখবে কিছু একটা হয়ে গেছে। তুমি ফেইল করবে না। আমি বললাম।
সিয়ামের ভিত্তিহীন এক অভয়ে রাফি ঘুণাক্ষরেও বিচলিত হয় না। হোস্টলের ছাদ থেকে শহরের যেটুকু পর্যন্ত নজর যায়, সেই শূন্যের দিকেই তাকিয়ে থাকে রাফি। এত রাতে হোস্টেলের কেউ জেগে নেই। এই দুজন ছাড়া। জেগে থাকার কারণ বলতে গেলে রাফির মন খারাপকেই আনা যায় সামনে। সিয়ামেরও যে মন ভাল সেটা বলার আর কোন সুযোগ নেই। রাফির এই বিষন্নতা দেখে সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। রাফি নিরবতা ভেঙে বলল,
-মডেল টেস্টের রেজাল্ট এটা সিয়াম। ফলাফল যদি অন্তত পাশ না রাখতে পারি, তাহলে ফাইনাল দেওয়ার কোন চান্স নেই। ফ্যামিলির লোকজনের কাছে কি বলব! আব্বু যদি শুনে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটা আমি ভাবতেই পারছি না।
সিয়াম বুঝতে পারছে না এখন তার কি বলা উচিত। তারপরও সে দুজনার গায়ে দেওয়া চাদরটাকে আরো কাছে নিয়ে রাফির দিকে এগিয়ে গেল। তার হাত চেপে ধরে বলল।
-কিচ্ছু হবে না। আমি বলছি। তুমি শুধু মন খারাপ কর না প্লিজ।
আকাশে চাঁদ ছিল, তবে খুব একটা আলো ছিল না। আবছা আবছা আলোতে সিয়াম রাফির মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেখল। সে বলল,
-সিয়াম, তুমি আছো বলেই এখনও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি। তোমার মত করে এই অবাস্তব শান্তনা দেওয়ারও তো কেউ নেই। কিচ্ছু হবে না সিয়াম, আমার পাশ করা হবে না।
বলেই ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে চাদরের ওম ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল রাফি। সিয়াম সেই আগের মতই বসে রইল। কেমন অদ্ভুতুড়ে একটা পিণপতন নিরবতা জেঁকে বসেছে তাকে। দূর হতে যানবাহনের হর্নের শব্দ গুলোও সিয়ামের নিরবতাটাকে কাটাতে পারছে না। উলটো যেন নিরবতাটাকে আরো গাঢ় করে দিচ্ছে। সিয়াম ভাবতে থাকল, কলেজের দপ্তরির সাথে তো তার ভালই সখ্যতা রয়েছে। এই সূত্র থেকেই কিছু করা যায় কিনা। রাফির কথাটা তার কানে বাজতে থাকল, ‘তোমার মত এই অবাস্তব শান্তনাটাও তো দেওয়ার মত কেউ নেই।’ অবাস্তব শান্তনাকে বাস্তবে পরিণত করার এক ঝুঁকিপূর্ণ পণ মনে মনে আওড়াতে লাগল সিয়াম।
৩
আজ খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল সিয়ামদের ক্লাস। বড় বড় কলেজ গুলোতে বছরের অধিকাংশ সময়েই নানান রকম কেন্দ্রীয় পরীক্ষার সিরিয়াল পড়ে থাকে। এই মাসেও চলছে জেএসসি।
সিয়ামদের ক্লাস শুরু হল দেড়টায়,আর প্রথম ঘণ্টার পরই ছুটি হয়ে গেল।
সিয়াম ক্লাস শেষে অফিস রুমে দপ্তরির কাছে গেল। গিয়েই মুখে একটা অভিনয়ের হাসি নিয়ে এল। যেখানে তার এই হাসিটা সবসময়ই অন্তর থেকে আসতো।
-আচ্ছালামু আলাইকুম রুহুল ভাই।কেমন আছেন?
-এইতো চলছে। তোমার কি খবর সিয়াম?
-ভাল আছি।
-কিছু বলবে?
সিয়াম একটু ইতস্তত করে বলল,
-না, এমনিতেই এসেছি।আচ্ছা রুহুল ভাই, আপনি যে এভাবে চাবি দিয়ে কান চুলকাচ্ছেন কানে সমস্যা হবে না?
-আরে বোকা না। কি হবে!
-রুহুল ভাই এত চাবির মধ্যে আপনি কোনটা কোন রুমের চাবি শনাক্ত করেন কিভাবে?
রুহুল আমিন ভাই হাসলেন কিছুটা।কান থেকে চাবির ছড়াটা হাতে নামিয়ে এনে কান ঘষা চাবিটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ময়লা বের করতে লাগলেন।যেন রাজ্যের ময়লা লেগে আছে এতে।
-শোন সিয়াম, ৬ বছর যাবত এই কলেজে আছি। কোনটা কোন রুমের চাবি এতটুকু চিনতে পারবো না! তুমি তো এলে ৬ মাস মাত্র হল, বরং তুমিই আমাকে চেনো না।
বলেই হো হো করে হেসে উঠল দপ্তরি রুহুল আমিন।
সিয়ামের হাতের বইদুটোর দিকে তাকিয়ে রুহুল আমিন বললেন,
-তা ক্লাস কি এক বিষয়েরই হয়েছে?
-হ্যাঁ, পরীক্ষা চলছে না! তাই….
প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বেল বাজার শব্দ শুনতেই দপ্তরি রুহুল আমিন নড়েচড়ে বসলেন। এই বেল বাজা মাত্রই প্রিন্সিপালের কক্ষে ছুটতে হয় তাকে।
রুহুল আমিন সিয়ামের দিকে না তাকিয়েই অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,
-তুমি একটু বসবে অফিসে? প্রিন্সিপাল ডাকলেন মনে হয়। আমি একটু আসি?
-অবশ্যই।আমি আছি, আপনি যান।
দপ্তরি রুহুল আমিন অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। সিয়াম ভয়ার্ত চোখে টেবিলের উপর রুহুল ভাইয়ের ফেলে যাওয়া চাবির ছড়াটার দিকে তাকায়। সময় নষ্ট না করেই সে চাবির ছড়াটা হাতে নিল।
ভাবলো, ‘দেরি করা যাবে না। যা করার তাড়াতাড়িই করতে হবে।’
৪
-এই আকিব, সিয়ামকে দেখেছো?
-না, রুমে নেই।
-কতক্ষণ আগেও তো একই কথাই শুনলাম। কোথায় গেছে বলতে পারছো না?
-না রাফি ভাইয়া, আপনি নিচে গিয়ে দেখতে পারেন। জাকির স্যার ডেকেছিল কিছুক্ষণ আগে। ওখানে থাকতে পারে।
রাফি স্যারের রুমের দিকে যাওয়ার সাহসটা করে উঠতে পারলো না। স্যারকে কলেজের সবাই শ্রদ্ধা না করুক, ভয়টা মাত্রাতিরিক্তই পায় সবাই।
এই ভয়ের মধ্যে দিয়েই সিয়াম কিভাবে অফিস রুমের চাবিকে কপি করে রাফির ফেইলের খাতাকে পাশ মার্কে টেনে এনেছে সেটাই রাজ্যের ভাবনার বিষয়।
জাকির স্যারের রুমের এককোণে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সিয়াম। তার নজর পায়ের আঙ্গুলের দিকে। রুমের অপর প্রান্তেই জাকির স্যার ডেস্কের উপর খাতা নাড়াচাড়া করছেন, আর আঙ্গুলের ডগায় থুথু লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর পর খাতার পাতা উল্টাচ্ছেন।
-তা রাফি, তোমার ফিজিক্স পরীক্ষা কেমন হল?
সিয়ামের অকারণেই বসে যাওয়া কন্ঠটাকে সে ঠিক নাড়াতে পারছে না। কষ্টেশিষ্টে গলায় আওয়াজ এনে বলল,
-ভাল হয়েছে স্যার।
স্যার সেই খাতা দেখাতেই মনযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। পরীক্ষার খাতায় কে কি লিখল তার দিকেই উনার নজর।
-এক্সাম তো ভালই দেবে, এত বড় কলেজের একাদশ শ্রেণির তৃতীয় নং ছেলে। ইন্টারনাল পরীক্ষাতে ভাল করলেও এক্সটারনাল পরীক্ষাটাই কিন্তু আমাদের আসল টার্গেট, ওখানে ভাল করাটাই আমাদের লক্ষ্য। তাইনা?
-জি স্যার।
-তা সিয়াম, তুমি যেতে পারবো তো সে পর্যন্ত? প্রি টেস্ট-মডেল টেস্টের গন্ডি পেরিয়ে?
কথাটা বলেই সিয়ামের দিকে মুখ উঁচিয়ে একটা ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকান তিনি।
সিয়াম কেমন একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়ে স্যারের দিকে করুণ চোখে তাকায়।
-না না, এভাবে তাকিয়ো না।আমি কিছু করবো না তোমার। তুমি তোমার কর্মের ফল ভোগ করবে এই যা।
সিয়াম স্যারের নরম স্বরের কঠিন কথা গুলোর মানে বোঝার চেষ্টায় দিশাহীন হয়ে যেতে থাকে ভেতরে ভেতরে। ঠোঁটের মাঝখানে জিভ এনে ঠোঁট দুটোকে ভিজিয়ে নেয় একবার।
জাকির স্যার আগের মত সেই খাতা দেখায় মনযোগ দেয়। কলম দিয়ে খাতায় আচড় দিতে থাকে,এদিকে মুখ চালিয়ে যেতে থাকে কাউকে মানসিক হুমকিতে পর্যুদস্ত করায়।
-মানুষকে বোকা ভেবো না সিয়াম, কেমন? রুহুল আমিন,জাকির আহমেদ- আমরা সবাই তোমাদের পড়াই,শিক্ষা দেই।এখানে কেউই বোকা না। তুমি এখানে এলে কিছুদিন মাত্র হয়েছে,আর আমি রয়েছি সাত বছর যাবত,বুঝলে? চাবিটাকে আর কোন কাজে লাগিও না।বাথরুমে ফেলে দিয়ো।
বর্তমান থেকে ভবিষ্যত নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তা হতে লাগল সিয়ামের। স্যারের কাঠিন্যতার বর্ণনা দেওয়াও কঠিন কাজ।সামনে কি ঘটবে সিয়ামের সাথে সে ভাবতেই পারছে না। তার বাবার একটা মাত্র ছেলে সে, যাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার বাবার।স্বপ্ন পূরণের পথ কি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! এমন সব জটিল নিয়তির কথা ভাবতেই এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এলো সিয়াম।
-তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি জানো? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
সচ্ছল ভঙ্গিতে বলতে বলতে এগিয়ে এলো রাফি।
সিয়াম অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু হাসতে চেষ্টা করলো।কিন্তু মুখের বিবর্ণতা সেই হাসিকে আড়াল করে রাখলো।
-কেনো খুঁজছিলে?
-আমাদের মডেল টেস্টের রেজাল্ট বেরোল।আমি পাশ করেছি।
খুশিতে প্রায় কেঁদেই দেবে রাফি এমন অবস্থা হয়েছে তার। গোল গোল চোখদুটো চিক চিক করতে লাগলো। সিয়াম মলিন মুখে বলল,
-বলেছিলাম না,সব ঠিক হয়ে যাবে।
-হ্যাঁ, তোমার কথাতে ভিত্তি খুঁজে না পেলেও আশ্বাস পেতাম কোথায় জানি।
চোখের সচ্ছ জলকে গোপন রাখতে রাফি সিয়ামের বুকে মিশিয়ে নেয় নিজের বুক।ঘাড়ের কাছে মাথা রেখে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়।
রাফির এ-কয়দিনের চিন্তার রেখা পড়ে থাকা মুখটার দিকে তাকায় সিয়াম-একটা সতেজতা তার চোখে মুখে স্পষ্ট। চাপা ব্যথায় নিষ্পেষিত হওয়া মানুষটাকে উৎফুল্ল দেখে তার তৃপ্তি হচ্ছে। রাফির এই বুকের স্পর্শের জন্য এমন হাজারো রুহুল আমিন আর হাজারো কঠিন জাকির স্যারের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়। “তোমার কথায় আশ্বাস খুঁজে পাই” বাক্যটার মত ফিসফিসে বাণী শ্রবণ করার জন্য হাজারো ত্যাগ কারো অগোচরেই করা যায়-
ভাবলো সিয়াম।
৫
দিন বা রাত কোনটাই থেমে থাকার নয়।সময়ের গন্ডিতে থাকা বিষয় গুলো সময়ের সাথে সাথেই ফুরিয়ে এলো- ঘনিয়ে দিলো সিয়ামের মডেল টেস্ট আর কিছু কালো রাত্রির সূচনা।
রাফি ভাল রেজাল্ট করে ভার্সিটির স্টুডেন্ট হয়ে গেছে মাস খানেক পেরোতে চলল।
পরিস্থিতি, পরিবেশ- অনেক কিছুকেই বদলে দিতে লাগল সময়। সেই সাথে মানুষ গুলোকেও।এটাই যেন বিধান- আর কারো কারো নিয়তি।
রাফির আর সিয়ামের নামহীন সম্পর্কটাও ফিকে হয়ে যাচ্ছিলো দিনকে দিন। তার কারণও ঠিক স্পষ্ট নয়।হয়ত শিক্ষা জীবনের নতুন অধ্যায়ে অনেক প্রেশারে আছে, খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না সব কিছু; এ জন্য হয়ত সিয়ামের সাথে রাফির মেলামেশায় ভাঁটা পড়ছে- এই বলে সিয়াম নিজের মনকে বোঝায়। ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারেনা সে।কোথাও যেন ঘাপলা থেকে যায়, খুতখুত করে কোথাও যেন- সেটা ঠিক সেদিনকার ফারিয়াকে নিয়ে কিনা সিয়াম নিজেকে প্রশ্ন করে- আর গোলক ধাঁধায় আঁটকে পড়ে বারবার।
অবশ্য তার দিন গুলোই রহস্যজনক ভাবে আঁটকে যাচ্ছে। জীবনের পথটা এই অল্পতেই তার জন্য কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ছে!
যেদিন সিয়ামদের এইচএসসি পরীক্ষার টিকেট বেরোল, সিয়ামদের ব্যাচের কয়েকটা অভাগার কাতারে সিয়ামের নামটাও দেখা গেলো।এই অঘটনের ইঙ্গিত গত একবছর আগেই পেয়েছিল সে- সব টপকেও জাকির স্যারের ফিজিক্সে তার পাশ করা হলো না।
এই অসময়েই হয়ত রাফির অতীত তাকে কিছু স্মরণ করিয়ে দিয়ে সিয়ামের কাছে টেনে এনেছে- অথবা ভার্সিটি লাইফের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।
-জাকির স্যার তোমার সাথেও এমনটা করলো কেন বুঝতে পারছিনা! তুমি তো পুরো কলেজের মধ্যে একদম আলাদা, এমন কি অনেকে তোমাকে দরবেশ বলেও ডাকতো তোমার ভদ্রতা দেখে।
সিয়াম কিছু বলে না।একটু হাসে।
-ভাগ্যে ছিলো হয়ত।
-শান্তনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।এই তুমি প্রিন্সিপালকে ধরে দেখো, তোমার অন্যান্য পরীক্ষার রেজাল্ট গুলো দেখিয়ো।উনি সদয় হতেও পারেন।
-আচ্ছা দেখবো।
-চায়ের স্বাদটা একটুও চেঞ্জ হয়নি। তাইনা?
চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল রাফি।
-চা যিনি বানান উনিই তো বদলান নি।মানুষ যেহেতু বদলায়নি চায়ের স্বাদ কেনো বদলাবে!
-এখানেই তো বিপদটা ঘটিয়েছিলাম। মনে আছে তো তোমার?
-কোন বিপদের কথা বলছো?
-ঐ যে বাজি ধরা নিয়ে।
-ও আচ্ছা। হ্যাঁ, বিপদই তো বটে। দোকানি তোমাদের বেঁধে রাখতো না হয়।
বলেই ভাঙা চোখের চাউনিতে হাসি আনতে চায় সিয়াম।
-সেদিন তো এই আপনিই রক্ষা করেছিলেন জনাব।নয়ত কি যে হতো!
-হু, বাদ দাও ওসব।এটা তেমন কোন বিপদই না।আমাকে তেল দেওয়ারও কিছু নেই।
-হা হা, আসলেই।এর থেকেও কত কঠিন কঠিন সময় গুলো পার করে এসেছি। দস্যু রাহাতের ফোন হারিয়ে ঘন্টার মধ্যেই তার জরিমানা প্রদান করা- একই রুমের ছেলে হয়ে বুঝি কেউ এমন করে! এজন্যই রুমমেটে গুলো সবাই ওকে জল্লাদ বলে ক্ষেপায়। ঐ রাহাতের জন্য তিন হাজার টাকা যোগাড় করা- মডেল টেস্টের রেজাল্টের সময় একপ্রকার মিরাকল ঘটার মত ঘটনা ঘটে পাশ করে আসা- ওগুলো যে কিভাবে পাড়ি দিলাম তা কেবল উপরওয়ালাই জানে।
সিয়াম চুপচাপ রাফির কথাগুলো শুনে যেতে থাকে।রাফির সচ্ছ-সজল চোখ দুটোর দিকে সিয়াম তাকিয়ে থাকে, যেখানে শত শত আশা আর স্বপ্নের বাড়িঘর। তাই বুঝিই রাফির চোখ দুটো এতো সুন্দর? কাকে যেন মনে মনে প্রশ্ন করে সিয়াম।
নিরবতা ভেঙ্গে সিয়াম বলে,
-হুম। আমার তো এসব ভালভাবেই জানা আছে।
-খুব ভালোভাবে জানা আছে বলতে? রাফি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সিয়ামকে।
সিয়াম একটু চমকে উঠে।বলে,
-মানে যা যা বললে এতক্ষণ, আগে তো এসব তুমি আমার সাথেই বলতে।
-ও হ্যাঁ, তাই বলো। এমন কি সেদিনও তো একটা মারাত্মক বিপদে পড়লাম।
-গত সপ্তাহের এক্সিডেন্টটার কথা বলছো?
-ওটাকে তুমি এক্সিডেন্ট বলছো?
-নয়তো কি,
একটু চাপা হাসিতে চোখের কোণ সংকুচিত করে সিয়াম, এরপরই আবার চায়ের কাপের আড়ালে ঢেকে যায় চোখ দুটো।
-ঐ কুত্তার বাচ্চাটাকে আমি মেরেই ফেলতাম,যদি না ওখানে ইন্সপেক্টরটা আসতো।
-আহা গালি দিচ্ছো কেন!
-গালি দেব না, ফারিয়া ঐ ছেলেকে নাকি অনেকদিন আগেই বলে রেখেছে তাকে যেনো বিরক্ত না করে।ঐ ছেলের কোন পরিবর্তনই নেই। ছেলে ভার্সিটি থেকে ফারিয়ার বাড়ি পর্যন্ত সব জায়গায় ওর পিছু পিছু নেয়, ফলো করে, বিরক্ত করে।
-অনেকদিন আগে থেকেই?
-হ্যাঁ।
-তা এতদিনেই বুঝি ফারিয়ার ছেলেটাকে তাড়ানোর ইচ্ছে হলো? এর আগে ছেলেটা বিরক্ত করতো না?
-করতো। বাট কেউ ছিলো না হয়ত, কাউকে বলার মত হয়ত পায়নি।
-ফারিয়ার তো নাকি বড় দুই ভাই আছে! ওদের কাছেও বলতে পারতো না?
-কি যে বলো বোকার মত। ভাইদের কাছে কিভাবে বলে! লজ্জায় পড়ে যাবেনা!
-লজ্জায় না, বলো বিপদে পড়ে যেত।
-মানে? কি বলছো এসব?
-সেদিন রাতে রাস্তায় যখন ছেলেটাকে কিল ঘুসি মারছিলে, ছেলেটা কিন্তু ফারিয়াকে কিছু কথা বলেছে চীৎকার করে করে ‘ফারিয়া তুমি কি আমাকে চিনোই না? এতটা খারাপ হতে পারলে তুমি’- এই টাইপের। ফারিয়ার সাথে ছেলেটার পূর্ব পরিচয় না থাকলে এই কথা গুলো কিন্তু ছেলেটা বলতো না!
-অর্থ কি দাঁড়ালো?
-আমার বিবেচনায় ছেলেটাকে তাড়াতে ফারিয়া তোমাকে ব্যবহার করেছে।
রাফি এবার কিছুটা স্তম্ভিত হলো।তার চৈতন্য ফিরে পেয়ে ফারিয়ার আসল রূপ ধরতে পেরে এখন বলবে,
‘ফারিয়া এত খারাপ!’
না, এমনটা নয়।রাফি বলল,
-আচ্ছা ফারিয়াকে তুমি সহ্য করতে পারো না?তুমি জানো, মেয়েটা একরকম পাগল আমার জন্য।এই একমাসের মধ্যে একদিনও আমার জন্য দুপুরের খাবার বাসা থেকে আনতে ভুলেনি ও।কত কেয়ার যে করে! সারাদিন অনলাইনে মেসেজ করে খোঁজ নেয়।এরকম খেয়াল কে রাখতো আমার?
সিয়াম রাফির কথার পেছনে আর কিছু ঠেকালো না।এখানে এসেই সে পরাজিত। রাফির এইমাত্র বলা কথাটা সিয়ামের কানে কঠিন আঘাত করলো, সেই আঘাত কান থেকে তার বুকে গিয়ে লাগলো। সিয়ামের খেয়াল গুলো কেন যে সে চাপিয়ে রেখে গেলো- সে নিজেও জানে না।আজ যখন ভালবাসার বস্তুটাকে হারাতে বসেছে,
সিয়ামের ভ্রমটা কেটে গিয়ে কিছু মুহুর্তের জন্য তার মনে হলো সব যদি বলে দেওয়া যেত, ‘আমিই ছিলাম তোমার সব থেকে আপন-তোমার খেয়াল নেয়ার অগোচরের সেই মানুষটা।’ কিন্তু না, এসব আর বলা যায় না-সময় কথা গুলোকে ডুবিয়ে দিয়েছে সময়ের অসময়ে। তাই প্রসংগ পালটে বলতে চাইলো,
-হ্যাঁ, মেয়েটা আসলেই তোমাকে ভালো বাসে।
সিয়ামের ফোনে ইন্সপেক্টর নামে সেইভ করা একটা নাম্বার থেকে কল আসাতেই সে অপ্রত্যাশিত ভাবে চমকে উঠলো। তাড়া পড়ে গেল তার।
-রাফি এখন আমাদের উঠতে হবে।
-হঠাৎ?
-হঠাৎ কই? অনেকক্ষণ হলো।
-তোমার ফোনে কার কল এলো? কেটে দিয়েছো নাকি? রিসিভ করলে না যে!
সিয়ামের মুখ শুকিয়ে যেতে লাগল। সে কি কিছু লুকোতে চাইছে? হয়তো হ্যাঁ। তবে ব্যাপারটা সে চেপে গেল সেখানেই।
-না, কাস্টমার কেয়ারের কল তো।তাই।
-আচ্ছা আজ উঠি তবে।
৬
সিয়াম তার ফোনকে ফ্লাইট মোড করে রেখেছে, আর কিছুক্ষণ পর পর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছে বিধ্বস্ত হওয়া দুটি চোখে- তার বাবার ফোন আসছে কিনা! অথচ ফ্লাইট মোডে যে কোন রকম কল এন্ট্রির সুযোগ নেই সেটাও সে মাথায় রাখতে পারছে না।
সিয়ামের আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। তার বাবা বার বার ফোন করছে তার ছেলের মডেল টেস্টের রেজাল্ট শুনতে। সে এইমাত্র প্রিন্সিপাল আর জাকির স্যারের দ্বারস্থ হয়ে এলো। একজন তার নীতি থেকে নড়ছে না- অপর জন তার ক্ষোভ থেকে।
আজ থেকে একদিন পর সিয়ামের সাথে কি হবে সেটাও সে ভেবে নিতে পারছে না।ঘোর অন্ধকার ছাড়া কি-ই বা আছে সামনে ! সিয়াম তার টেবিলের ড্রয়ার খুলল। এখানে তার মায়ের দেওয়া কিছু অষুধ-পত্র।
নাপা, পিরিটন, ই-ক্যাপ আর সাথে কিছু ভার্গন ট্যাবলেট। তার মায়ের কড়া নির্দেশ ছিলো একেকটা অষুধ সেবন সম্বন্ধে। নাপা মাথাব্যথা কিংবা জ্বর, পিরিটন সর্দি-কাশি আর ই-ক্যাপ প্রতিবেলা খাবারের পর- আর ভার্গনকে বলা হয়েছিল ঘুমের খুব ডিস্টার্ব হলে যেন মাত্র একটা খায়।
আর কিছু অষুধ ছিল তার বাইবর্ন হৃদরোগের জন্য। সিয়াম সেগুলো সরিয়ে ভার্গন ট্যাবলেট গুলো হাতে নিলো।
আজ সিয়ামের খুব প্রব্লেম হবে ঘুমের। সে ট্যাব্লেট গুলোর প্রায় ৬ টাই খেয়ে নিলো।
যখন ঘুম ভাঙলো, তখন তার রুমে সে রাফিকে আবিষ্কার করলো। হঠাৎ কি ভেবে রাফি আজ হোস্টেলে সেটা চিন্তা করতে করতেই সিয়াম চোখ কচলাতে লাগলো।
-সিয়াম, এখনো ঘুম কিসের?
-আজ হঠাৎ এত সকালে! ভার্সিটি নেই?
-আছে। তারপরও আসতে বাধ্য হয়েছি।ইন্সপেক্টর আমাকে অনেক গুলো কল দিয়েছে। তোমার ফোনে নাকি কল ঢুকছে না।
সিয়ামের ঘুমের রেশটা দেবদূতের মত লাগা রাফিকে দেখেও কেটে উঠেনি।’ইন্সপেক্টর’ এর কথাটা শুনেই সে স্তম্বিত ফিরে পেলো। ফোনটা হাতে নিয়েই জেনারেল মোডে ফিরিয়ে আনলো। সাথে সাথেই কিছু টংটং শব্দে মেসেজ এসে গেলো। সিয়াম পড়তে লাগলো,
“ফোনকে কি করে রেখেছো? কল যাচ্ছে না কেনো?”
“তোমার দেওয়া কথা কি তুমি ভুলে গেছো?”
“এমনটা হলে কিন্তু আমি রাফিকে হাজতে না পুরার শর্ত ভাঙতে একমিনিটও নেবো না।”
সিয়াম তার ঘুমের তীব্রতায় বিবর্ণ হওয়া চোখ দুটোকে খুব কষ্টে খুলে রাখল। রাফির দিকে আবারো তাকালো। সেই আগের চোখ, আগের মুখ। তারপরও যেন কি নেই। যা ছিল, সেটা মনে হয় কোথাও বিকিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। সিয়াম ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো রাফিকে,
-এটাই বলতে এসেছিলে শুধু?
-হ্যাঁ। তবে আরেকটা কথা তোমাকে বলব ভাবছিলাম, যে ছেলেটাকে সেদিন মারলাম, ঐ ছেলে আমাকে রাস্তায় ঘেরাও করে।আর কি থ্রেট মারে রে বাবা!
-তোমাকে এখনো শাসায়? কি বলে?
-বলে পুলিশ নাকি আমার দুলাভাই। তাই সেদিন আমার অপরাধ থাকা সত্ত্বেও নাকি কোন শাস্তি দেয়নি। ওই ছেলে নাকি আমাকে দেখে নেবে।
-আচ্ছা বুঝলাম, এসব কানে নিয়ো না।
-এখন যাই আমি।
-আরেকটু বসো।
-বসতে পারবো না সিয়াম। আজ ফারিয়ার বার্থ ডে।তাই তাড়া আছে।
সিয়াম একগাল ঠেলে হেসে দেয়।
বলে,-যাও।
আর কিছুই বেরোয় না তার মুখ দিয়ে।শুধু মনে পড়ে, গত পরশু সিয়ামেরও জন্মদিন ছিলো!
৭
-এসেছো তাহলে?
বলেই কেমন এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর
শফিক।
-আমি তো ভেবেছিলাম সেদিন বিপদে আমাকে ব্যবহারই করেছ শুধু।
-এমনটা কেন মনে হলো?
-ফোন বন্ধ করে রেখেছো। যোগাযোগ করার কোন পথ খোলা রাখোনি ভাবলাম।
-আজকেই আপনার বাসায় আসার কথা ছিলো। এসেছি কিনা?
-হ্যাঁ। তা এসেছো।
কিচেন রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল ইন্সপেক্টর শফিক।
-তাহলে রাফির কাছে ফোন দিয়েছিলেন কেন? এত উতলা কেন হচ্ছিলেন?
শফিক চূলায় কেতলি বসিয়ে চূলাটা পরিমাণ মত বাড়িয়ে দিয়ে সিয়ামের দিকে এগিয়ে এলো। সিয়ামের কপালে পড়ে থাকা চুল গুলোকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,
-পাখি যদি পালিয়ে যায়?
সিয়াম রেগে যাচ্ছিল। তার ইচ্ছে করছে এই বদমাশ ইন্সপেক্টরটার হাতটা ঝারা দিয়ে ফেলে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। শফিক বলতে লাগল,
-কেন? রাফি কিছু জানতে চেয়েছে তোমার কাছে?
-ওর গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিন না হলে আপনি কেন ফোন দিয়ে আমার খোঁজ করছেন তার কারণ অবশ্যই বের করতো ও।
শফিক সাহেব ভ্রুক্ষেপ দিলো না সেদিকে। চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল,
-তা ঐ ছেলে কি রাফিকে আর কিছু বলেছে?
-হ্যাঁ, রাস্তাঘাটে নাকি আঁটকায়।থ্রেট দেয়।
-সেদিনের জেদটা তো ঐ ছেলের রয়েছে, এরূপ যে করবে তা জানতামই। এমন খোলা রাস্তায় মারামারি করার অপরাধে রাফিকে জেলে ঢুকানোর বদলে আমি মার খাওয়া ছেলেকে দোষী বানিয়ে রাফিকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলাম। শুধু তোমার অনুরোধে।
-নাও, চা ধরো।
শফিক সিয়ামের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল।
একটু মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
-আড়ালে নিয়ে গিয়ে সেদিন তুমি আমাকে ঘুষ দিতে চাচ্ছিলে?
সিয়াম শফিকের দিকে তাকায় না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাণ ধরে থাকে স্বাভাবিকের।
-পুলিশ মানেই ঘুষখোর? তাই মনে হয় তোমার?
সিয়াম এবার তার রাগটা উগ্রে দিলো। বলল,
-ঘুষখোর নয়ত কি! ছেলেখোর?
ইন্সপেক্টর হো হো করে হেসে উঠলো। হাসির চুটে তার মুখের চা ছিটকে পড়লো।
-এটা তো ভালবাসা। তোমার মত কাউকে ভালবেসে দেখার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের।
সিয়ামের শরীর কেঁপে উঠে।ভালবাসার হিসেবটা কত সহজ এই লোকটার কাছে।সে নিজেকে সংবরন করে নিতে পারছিল না।হাত থেকে আধ খাওয়া চা নামিয়ে রাখলো। বলল,
-ভালবাসা দেখাতে কেউ বুঝি শর্ত দাঁড় করায়? এটা ভালবাসা না ইন্সপেক্টর সাহেব-এটা সওদা।
শফিক হাতের চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে এগিয়ে আসে সিয়ামের দিকে। ঝট করেই কোলে তুলে নেয় সিয়ামকে। বলে,
-এতো রাগ করছো কেন গেলমান!
ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে সোফাতে এনে শুইয়ে দেয় সিয়ামকে। দুএকবার সিয়ামের বস্ত্রসজ্জিত পুরো শরীরটার দিকে তাকায় ইন্সপেক্টর শফিক। সিয়ামের টি-শার্ট খুলে, তার প্যান্ট খুলে- তার নগ্ন শরীরের দিকে আরেকবার তাকায়। শফিকের কামনা আর উচ্ছাস ভরা চোখ দুটোর দিকে তাকায় সিয়াম- যেখানে কিছু লালসা ছাড়া আর কিছুই নেই।
শফিক সিয়ামকে নিজের মত করে ভোগ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখানে ব্যস্ত না বলে হিংস্র বললে ভাল হবে। সিয়াম সেই আগের মতই তাকিয়ে থাকে সাদা রংয়ের সিলিংয়ের দিকে।বলে,
-একটু আস্তে প্লিজ।
ততক্ষণে ইন্সপেক্টর শফিকের মুখ দিয়ে কিছু গোঙানি ছাড়া আর কিছুই বেরোয় না।
সিয়াম আবারো বলে,
-ঐ ছেলেটা যেন রাফিকে আর হুমকি না দেয়।
৮
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল, যখন সিয়াম রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। সে ঠিক হাঁটতে পারছে না। ব্যথা হচ্ছে কোথাও। মাঝে মাঝে পেছনে হাত দিয়ে দেখছে, ভেজা লাগছে কিনা। সে টের পেল না কিছু। শুষ্ক কিনা সেটাও বুঝতে পারছেনা। তার হাতে কিছু অষুধ। সিয়াম অষুধের প্যাকটা দেখতে লাগলো নাকের ডগার কাছে এনে। কিছু অষুধের সাথে পেইন কিলারও দেখা যাচ্ছে। এগুলো ইন্সপেক্টরের দেওয়া। কিছুক্ষণ আগে তার সাথে ঘটা ঘটনা গুলো সে ভাবতে যেতেই তার পুরো শরীরে আবারো যন্ত্রণা হতে লাগলো।
ওইদিকে তার ভাইব্রেট করা ফোনটা কেঁপেই চলেছে।পকেট থেকে ফোন বের করে তাকায় স্ক্রিনে। বাবা নামক সেভ করা কন্টাক্টটা দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে।বাবার জন্য কোন উত্তরই তো সে ভেবে রাখিনি। কি বলে বোঝাবে বাবাকে?সিয়ামের মাথা ঘুরতে লাগলো। সে তারপরও হেঁটে হেঁটে এগোনোর চেষ্টায়।
হোস্টেলে ফিরে এসে প্রায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করল। গোসলের সাথে কিছু অদেখা বেদনা আর অতীত মুছার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টার সেতুতে পায়চারি। রাতের মাঝামাঝি হতেই সিয়ামের গা কাঁপিয়ে জ্বর চলে এলো। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ আর বেদনাতুর অস্পষ্ট কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেড়োচ্ছিলো না। রুমমেটরা সবাই খানিকটা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। সিয়ামের বাড়ি থেকে আসা কল গুলো একজন রিসিভ করে জানিয়ে দিলো সিয়ামের খুব জ্বর। ছেলের অসুখের খবর শুনে বাবা মা রেজাল্ট জানার কথা ভুলেই গেলো।
প্রায় তিন দিন বিছানায় অজ্ঞানের মত পড়ে থাকার পর সিয়ামের স্বাভাবিক অবস্থা হতে লাগলো। বাবা মায়ের ফোন কলের ভীড়ে সিয়াম কেঁদে উঠে বারবার।
-হঠাৎ এমন কঠিন জ্বর কিভাবে বানালে?
রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল রাফি।
সিয়াম দূর্বল চোখে তাকায় রাফির দিকে।
-হঠাৎ এই অবস্থা কেনো হলো তোমার?
সিয়াম কিছু বলে না। শক্তিও যেন ফুরিয়ে গেছে। এ কয়দিনের অনিদ্রা অনাহারের ফল হয়ত।
-তুমি আজই এলে? জ্বর তো আজ চারদিন পেরোচ্ছে।
রাফি সিয়ামের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
-কালও এসেছি। তোমার কোন হুঁশ থাকলে তো? ডাক্তার নিয়ে এসেছিলাম।অষুধ গুলো খাচ্ছো তো ঠিক মতো?
সিয়ামের উত্তরের আশা না করেই পাশের বেডের আকিবকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো রাফি,
-আকিব, অষুধ গুলো সিয়ামকে ঠিকমতো দিচ্ছো তো?
-হ্যাঁ ভাইয়া।
সিয়াম রাফির মুখের দিকে তাকায়।চোখের দিকে তাকায়।কোথাও কোন অস্থিরতা বিরাজ করছে কিনা তা দেখার জন্য। না, রাফির চোখ দুটো খুব শান্ত।সিয়াম ঠিক হতাশ হয় না। তবে রাফি যে তার কপালে হাত রেখে জ্বরের গতি পরিমাপ করলো, এটাও তার জন্য অনেক প্রশান্তির।
সিয়াম অনেকটা করুণ গলায় রাফিকে বলল,
-চেয়ারে কেন বসে আছো! আমার পাশে এসে একটু বেডে বসো।
রাফি হেসে উঠে মধুর ভঙ্গিতে। ঘাড় নুইয়ে উঠে এসে সিয়ামের পাশ ঘেঁষে বসে। সিয়াম রাফির ঘ্রাণ নেয়। জ্বরের তাপমাত্রায় গরম হওয়া হাতটা দিয়ে রাফির একটা হাত চেপে ধরে রাখে সিয়াম। রাফি অবাক নয়নে সিয়ামের শুকনো মুখটার দিকে তাকায়। চোয়াল দুটো লেগে এসেছে, সাথে চোখের নিচে কালচে ছোপও কিছুটা। কিন্তু আগের সেই স্নিগ্ধতা ঠিকই রয়ে গেছে। হালকা গোঁফ, সাথে লাল ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতেই রাফির ইচ্ছে করে সেই আগের মত করে সিয়ামকে একটা চুমু খেতে। অচ্ছুৎ কিছু কল্পনায় বিভোর হয়ে যেতেই রাফির ফোন বেজে উঠে। সে স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়ে সিয়ামের নুয়ে থাকা মুখের থেকে একটু সরে বসে।
-সিয়াম আমি যাই এখন।
-হঠাৎ?
-হঠাৎ না আসলে। ফারিয়ার সাথে দেখা করার কথা ছিলো আজ।সে ফোন দিচ্ছে। উঠি এখন।
রাফি বিদায় হয়ে যায় সিয়ামের কাছ থেকে।সিয়াম আগের মত নিস্তদ্ধ হয়ে বসে থাকে।
প্রায় দুদিন পর সিয়ামের ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একজন ভরাট গলার পুরুষ বলতে লাগল,
-হ্যালো কে বলছেন?
-ফোন তো আপনি দিয়েছেন।আমাকেই কেন জিজ্ঞেস করছেন আমি কে!
-একচুয়্যালি আমরা ইবনে সিনা হসপিটাল থেকে বলছি।আপনি কি একটু দ্রুত আমাদের হসপিটালে আসতে পারবেন?
-জ্বি পারবো। কিন্তু কেন?
-একজন ইমারজেন্সি রোগী আমাদের এখানে কিছুক্ষণ আগে ভর্তি হয়েছে।তার ফোনের কল লিস্ট থেকে আপনার নাম্বার পেয়েছি আমরা।
-আচ্ছা আমি আসছি। আপনি রাখুন।
সিয়াম ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল মূহুর্তের মধ্যেই। অজানা এক আতঙ্ক তাকে মুষড়ে তুলছে। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে এসেই সে পেটে গভীরভাবে জখম হওয়া রাফিকে দেখতে পেলো।
কিছু সময়ের জন্য সিয়ামের মনে হচ্ছিল পৃথিবী থেমে গেছে- অথবা এটা কোন দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু না, আচমকাই একজন ডাক্তার এসে সিয়ামকে বলে উঠল,
-আপনি রোগীর কে হন?
সিয়াম হকচকিয়ে উঠে। বাস্তবে ফিরে এসে বলে,
-বন্ধু।
-রোগীকে কিছু লোকজন ধরাধরি করে এনে হসপিটালে দিয়ে গেছে। পেটে ছুড়ি দিয়ে খুব কঠিন ভাবে আঘাত করা হয়েছে। কিডনিতে আঘাত লেগেছে।
-এখন কেমন আছে ও?
-আমরা এখনো ট্রিটমেন্ট শুরু করিনি। অপারেশন করাতে হবে।রোগীর বাবা মা নেই? থাকলে উনাদের আসতে বলুন প্লিজ।
সিয়াম রাফির মোবাইল থেকে নাম্বার নিয়ে তার বাবা মা’কে কল করে। রাফির রক্তাক্ত পেটে ব্যান্ডেজ করা ক্ষতর দিকে আবারো তাকায় সিয়াম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে পাথরের মত হয়ে যায়।
রাফির বেডের পাশে এসে বসে তার গালে হাত রাখে।কেমন তাপশূন্য লাগে রাফির রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখটাকে। সিয়াম চিৎকার করে কেঁদে উঠে।হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারের রুমে যায়।
-ডাক্তার সাহেব,রাফির ব্যাপারে কিছু বলুন আমাকে।
-রোগীর কিডনি লাগবে একটা।
-তাহলে আমি দিতে চাই একটা কিডনি।
-আপনি কিডনি দিবেন? এত অল্প বয়সী কারো থেকে কিডনি নেওয়াটা উচিত না।
-আর বেডে শুইয়ে রাখা একটা মানুষকে চোখের সামনে মরতে দেওয়াটা উচিত?
-আমাদের নীতি বলতেও একটা বিষয় আছে।
-রোগীকে সুস্থ করে তোলাই আপনাদের সবচেয়ে বড় নীতি।সেই নীতি থেকেই বলছি। আর আমার থেকে একটা কিডনি নিলে আমার কিছুই হবে না।কিন্তু একজন রোগীকে বাঁচাতে পারবেন।
ডাক্তার আর তর্ক করে না। কিছুক্ষণ নিরব হয়ে বসে থেকে সিয়ামকে বলে,
-চলুন।
ঠিক অপারেশনের কয়েক মুহূর্ত আগে সিয়াম তার ফোনটা হাতে নিলো। তার বাবার অনেক গুলো কল মিসড হওয়া। কল হিস্টরির লিস্টে লাল সিগ্নালে শুধু তার বাবার কল গুলোই দখল করে আছে।সিয়াম অস্পৃশ্য এক নয়নে তাকায় সেই অপ্রাপ্ত কল গুলোর দিকে- আর মনের পাতায় ভাসে তার বাবার কিছু পুরোনো কথা-
“তোমার বড় আপুর তো বিয়েই হয়ে গেলো সিয়াম।এখন সন্তান বলতে শুধু তুমিই রয়েছো আমার। তোমার মা কিংবা আমি,আমরা কেউই তোমার অনুপস্থিতি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবো না।তারপরও আমাদের স্বপ্ন আর তোমার ইচ্ছেতেই ঢাকা পাঠাচ্ছি তোমাকে। জীবনের গুরুত্ববহ এক অধ্যায়ে তুমি অবতীর্ণ হতে যাচ্ছো।মনে রাখবে,এটা কলেজ জীবন।কঠোর পরিশ্রম ছাড়া সফল হতে পারবে না।আর তোমার এই বাবা কখনই তোমার অসফলতা স্বচক্ষে দেখতে পারবে না। তা আমার জন্য ভীষণ কষ্টের এক কারণ হবে।”
সিয়াম ভাবে, বাবাকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে গিয়ে অনেক কষ্টই দেওয়া হয়ে গেছে। এতগুলো কল মিস করায় তার হয়ত প্রচুর টেনশন হচ্ছে।
তবে কিই বা বলতাম তাকে? ‘বাবা আমি ইন্টার পরীক্ষা দিতে পারবো না। মডেল টেস্টেই বাদ পড়েছি’- এমনটা?
থাক। চাপা থাকা বিষয়টা চাপাই থাকুক।আমি বিষয়টাকে স্থায়ী ভাবে চাপিয়ে দেওয়ার কোন পথ খুঁজি। সাথে কিছু অসামাজিক কষ্টকেও।
রাফির এই ছুড়ি-আঘাত হয়ত ফারিয়ার সে ছেলেই করেছে।ইন্সপেক্টর সাহেবকে বশীভুত করেও কোন লাভ হলো না -হিতে বিপরীত ঘটিয়ে দিল ঐ ছেলে।
কিন্তু রাফির সুস্থতা দরকার।তার সচ্ছ চোখ দুটো সজাগ থাকা দরকার। আমার মত অদ্ভুত কেউ হয়ত তার মুখটা দেখেই পরম তৃপ্তি পাবে।
তবে সিয়ামের চিন্তা গিয়ে ঠেকে অন্য জায়গায়।
এই তৃপ্তির কথা রাফি কস্মিনকালেও টের পেয়ে থাকবেনা- এখনও রাফিকে সেসব বুঝতে দেওয়া উচিত না-সিয়াম তাকে এক পাপীর মত ভালবাসে।অপরাধীর মত তার খেয়াল রাখে।
তাই সে তার হাতের ফোনটা থেকে একটা নাম্বার ডায়াল করে। অনুরোধের সুর মাখা গলায় বলতে থাকে,
-ছেলেটা রাফিকে হত্যাই করে ফেলেছিলো প্রায়।আপনার শাসানোতে ঐ ছেলে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
ওপাশ থেকে হয়ত ভরসাদায়ক কোন প্রতুত্ত্যর আসে। সিয়াম একটু স্বস্তি পায়। আড়ষ্ট হয়ে থাকা গলার স্বরকে আবারো নেড়ে বলে,
-আপনাকে একটু হসপিটালে আসতে হবে ইন্সপেক্টর সাহেব। আপনার জন্য একটা মেসেজ যাচ্ছে আপনার ফোনে। আমার জন্য একটু কষ্ট করার বিষয়টা বলা আছে ওখানে।আচ্ছা আমি এখন রাখছি।
-কি হলো, চলুন।
একটু চমকে উঠে সিয়াম। তার পেছনের ডাক্তারের কথায় সে স্বাভাবিক হয়। বলে,
-জ্বি।আসছি।
৯
প্রায় দু’সপ্তাহ পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলো রাফি।হাসপাতালের রিলিজ পত্র পেয়ে তার বাবা খুশিতে নাজেহাল প্রায়। ফারিয়া মাঝে দুপুরের খাবার দিতে এসে নিজের পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে এখন সে তার বাসাতেই আছে। ভীষণ লাজুক মেয়ে। সিস্টার রাফির শরীরের ব্যান্ডেজ খোলবার আগেই তার মা পারছে না সেসব ছাড়িয়ে নেয়! সিস্টার তখন কিছুটা ঝেরে বলে,’আহ!একি করছেন।’
আগের সেই স্বাভাবিক জীবনটা ফিরে পায় রাফি।
রুটিন মাফিক সকাল সকাল উঠা,খেয়েদেয়ে ভার্সিটিতে যাওয়া-সপ্তাহ শেষে ফারিয়ার সাথে দেখা করা। সবকিছুই গতিময়।
এখন আর ফারিয়ার এক্স-বয়ফ্রেন্ডকে রাফি রাস্তাঘাটে কোথাও দেখে না।তবে সেই ছেলেটার সাথের কোন এক ছেলেকে রাস্তায় পেয়ে কষিয়ে দু ঘা মেরেছিল একদিন। আর তখন শুনা হয়,রাফিকে হত্যার চেষ্টা করায় সেই ছেলে এখন হাজতে।
কিন্তু রাফি তো কোন কমপ্লেন করেনি থানায়! সে মস্ত অবাক হয়।
তবে গোলক ধাঁধা শুধু তার এ নিয়েই নয়; রাফিকে কিডনি দান করা লোকেরও কোন হদিস পাওয়া যায়নি, লোকটার কঠিন এক হৃদরোগ থাকার কারণে অপারেশনের পর নাকি আর জ্ঞান ফেরেনি- পুলিশি পোশাক পড়া কোন এক লোক নাকি কিছুটা জোর খাটিয়েই ঐ মৃত লোককে নিজের কেউ বলে হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোন এভিডেন্সই রাফি পায়নি অচেনা সেই লোকটা সম্বন্ধে। সিয়ামের হঠাৎ নিঁখোজ হওয়া নিয়েও রাফির মনে অনেক প্রশ্ন।
সারা দিন- সারা বেলা জুড়ে বিচিত্র জল্পনাতে কেটে যায় রাফির , নানান প্রশ্ন আর জীবন চক্রান্তের অমানিশায় সে হাতরে বেড়ায়।
এত ব্যস্ততা আর অস্থিরতা সত্ত্বেও রাত শেষে রাফির কারো কথা মনে পড়ে-
যার গালে চুমু খেয়ে রাফির ভাল লাগতো, ভাল লাগত চুমু খাওয়া মানুষটার হঠাৎ শীতল হয়ে যাওয়া চোখদুটোও, সাথে স্থির হয়ে যেত রাফির বুকের হৃদস্পন্দনও।
তবে এইসব অনুভূতি অব্যক্তই থেকে যেত নৈঃশব্দে।
তারপরও জানালার ফাঁকের রাতের আকাশে যখন অন্ধকার নামে, রাফির মনের কন্দরে তখন প্রশ্ন জাগে-
রাতের শেষ বেলায় কেন তার সিয়ামের কথা মনে পড়ে, আবার ভোর হলেই কেন তা অগোচরে লুকিয়ে পড়ে- যখন কিছু নাম না জানা পাখিও উড়ে উড়ে অলখ হয়ে পড়ে মেঘ-বৃষ্টির আড়ালে!
—————– সমাপ্ত।
সমপ্রেমের গল্প ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত