
মৃন্ময় রায়
গভীর রাত,আমি বসে আছি আমার একমাত্র সঙ্গী এইচপি ল্যাপটপ টার সামনে।মনিটর টা জ্বলজ্বল করে জলছে আর আমি কিবোর্ডে দ্রুত বেগে খটখটিয়ে যাচ্ছি। আমার সামনেই চেয়ারটাতে বসে আছে একটি ছেলে। ছেলেটি আমার দিয়ে তাকিয়ে আছে।তার মুখে মৃদু হাসি। হয়তো আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে।কিন্তু সেদিকে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।কারন বর্তমানে ছেলেটির এখানে কোনো বাস্তবতা নেই। ছেলেটি শুধুই কল্পনা।
‘কি করছেন আপনি?’
‘কিছু না। এমনি বসে।’
‘কীবোর্ডে খটখটাচ্ছেন যে?’
‘এমনিই’
‘কি গল্প লিখছেন? ভালোবাসার?’
‘নাহ। ঐসব গল্প এখন আর আসে না।’
‘আসে না কেন?’
‘আসে না কারণ আসে না।’
‘আমার জন্য নাতো?’
ছেলেটার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। তা করুণা হতে পারে। উপহাস হতে পারে। দুঃখবোধ মিশে থাকাও বিচিত্র না। সেই ‘কিছু একটা’র টানে ওর দিকে তাকালাম। যত্ন করে মায়াবী একজোড়া গভীর আয়ত চোখ তাকিয়ে আছে অপলক। না চাইতেও বুকের ভেতরের কোন এক অন্ধকার কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এলো শামুকের খোলে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। আমরা দুজন সেই দীর্ঘশ্বাসে চড়ে ফিরি ফেলে আসা অতীতে।
আড্ডা শেষ। রিকশায় চড়লে পুরো আকাশটাকে মাথার ওপর পাওয়া যায়। তাই রিকশা আমার এত পছন্দের। শেষবিকেলের ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের ছুঁয়ে পেছনে রয়ে যায়। এবার ভালোই শীত পড়ছে। সময়ের আগে আগে শীত পড়াটা এখনকার একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে বোধহয়। মাঘ মাস আসতে এখনো ঢের দেরি আছে। অথচ এখনই হাড়কাঁপানো শীত পরে গেছে। এটা বাস্তবিক অর্থেই হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আর আমি কী না বোকার মত একটা সাধারণ টিশার্ট পরেই ভার্সিটি চলে এসেছি। মনে মনে নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছা করছে।
‘নিন জড়িয়ে নিন।’ সুজন ওর বিশাল চাদরটার একদিক বাড়িয়ে দিলো।
‘লাগবে না। শীত করছে না।’ বোকামীটা স্বীকার করতে ইচ্ছে করছে না।
‘আর ঢং দেখানো লাগবে না। নিন তো।’
ভাতের উপর রাগ করে লাভ নাই। তাই চাদরের একদিক গায়ে জড়ালাম। আর সুজন বকবক করে যেতে লাগল। আমি ভালো শ্রোতা। আর অভ্যাসও হয়ে গিয়েছিলো। রিকশাওয়ালা প্যাডেলে পা চালাচ্ছিল দ্রুত। হয়ত আজকে আর ‘খ্যাপ’ মারবে না। আমরাই লাস্ট প্যাসেঞ্জার। ঘরে ফেরার তাড়া আছে বোধহয় বেচারার। হয়ত নতুন বিয়ে করেছে। ঘরে নতুন বউ। ‘আহা। ভাই আস্তে চালাস না। তোর বউকি ভেগে যাইতেসে?’ মনে মনে রিকশাওয়ালাকে মিনতির সুরে বললাম। সে আমার মিনতি শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলো না।
রিকশা দ্রুত চলছিল। সুজন বককববক করছিলো। আর আমি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম- কত ছোট এই জীবন। তারচেয়ে কত ছোট এই রিকশা ভ্রমণ। দেখতে দেখতেই রিকশা জিগাতলা পৌছে যাবে; বা জিগাতলা নিজেই রিকশার কাছে চলে আসবে । রিকশাটা যদি অনন্তকাল ধরে এমনি চলতে থাকতো। আর আমরা একটা চাদর জড়িয়ে বসে থাকতাম। এ কথাটা মনে হতে একটু ভালো লাগলো। নিজেকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম চাদর না আনার জন্য। সাথে সুজনকেও।
আজকাল মশা এত বেড়েছে। ‘শালার মশা’।কল্পনার ছেলেটা পাশ থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলো। ওর চোখে বিষণ্ণতার হালকা নীল রঙ।
‘আপনি আমাকে ভালবাসতেন, হৃদয় ভাইয়া?’
‘বুঝতেনা?’
‘এখনো বাসেন?’
‘কি মনে হয়?’ হাসার চেষ্টা করলাম। ‘এটা কি ইলেক্ট্রনিক্স ক্লাস? যে ইচ্ছে হলেই করবো না।’
‘বলেননি কেন আমাকে?’
আবারো দীর্ঘশ্বাস। এবার পাথরের নীচে চাপা থাকা শ্যাওলা মাখা স্যাঁতস্যাঁতে দীর্ঘশ্বাস।
আমি জানি কেন বলিনি। নিজের ভীরুতাকে পায়ে পিষে, আয়ানার সামনে বারবার রিহার্সেল শেষে সুজনকে বলতে গিয়েছিলাম। একটা ঘোরের মাঝে চলে গেছি তখন আমি। উন্মাদপ্রায় অবস্থা- ‘ডু অর ডাই’। কিন্তু প্রথমটা করতে পারিনি। মরেছিলাম। কেউ জানলোও না আমি মারা গেছি। আমার সৎকার হলো না, শেষকৃত্য মিললো না। একফোঁটা চোখের জলও কারও চিবুক বেয়ে গড়ালো না। শুধু আমি জেনেছিলাম- মারা গেছি।
সেদিন হাতে বেশ সময় নিয়েই শাহবাগ গিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে কোথাও সুজনকে দেখলাম না। তপ্ত মন খুঁজছিলো ওকে। হঠাৎ চোখ খুঁজে পেলো কাঙ্ক্ষিত চোখটাকে। টিএসসির কোণে। ওরা দুজন বসে আছে। সুজনের হাত ধরে আছে নায়ক নাহিদ। যে নাটকে এতক্ষণ আমি নায়ক ছিলাম সেই নাটকের দর্শকরা চমকে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে- আমি নায়ক না, আমি প্রতিনায়ক। আসলে তাও না। আমি কিছুই না। আই এম নোবডি। ফিরে এসেছিলাম এতদিনের অভিনয়ের পারিশ্রমিক- চোখঝাপসা করা লবণাক্তটা আর ফুসফুস ভর্তি কষ্ট নিয়ে।
এবারের দীর্ঘশ্বাসটা আদতেই বেশ দীর্ঘ হলো। সুজন পেছনে বসে থাকে চুপচাপ। পেছনে বলে ওর মুখ দেখতে পাই না।
এখনও তোমাকে দেখি। তোমাকে দেখার জন্যই শাহবাগ যাই। এমন ভাব করি যেন কিছুই হয়নি। সব ঠিকঠাক চলছে। তুমি হয়তো বুঝেছ কিছু। হয়তো না। নতুন নায়ক নিয়ে তোমার সুখ দেখে আমি পুড়ে যাই। হিংসা, অভিমান কিংবা অসহায়ত্বের আগুনে। জানি আমি স্বার্থপর; সবসময় নিজের দিকটাই দেখি আমি। কারন আমি হৃদয়। মহাত্মা গান্ধী বা গৌতম বুদ্ধ নই। তোমাকে এড়িয়ে চলি। নিদেনপক্ষে তোমার কাছ ঘেঁষি না। ভুলেও চোখের দিকে তাকাই না। মাঝে মাঝে সামনে পড়ে যেতে হয় অবশ্য। ‘কি ব্যাপার ইদানীং এত পার্ট নিচ্ছেন যে?’ হাসার চেষ্টা করি।
সত্যি বলছি আমি পার্ট নেই নারে। কষ্টগুলো লুকানোর জন্যই এই পালিয়ে বেড়ানো। আমি শুধু দূর থেকে তোমাকে একটু দেখি। ওতেই চলবে।একেক দিন থিতিয়ে ওঠা কষ্টের আগুনটাতে ফুঁ দেই। কষ্ট তার ফেনিয়ে ওঠা শিখা নিয়ে আমাকে গিলে নেয়। হারিয়ে এখন এই কষ্টটাই সম্বল আমার। অন্তত এই কষ্টটা হারাতে চাই না।মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে হাই-হ্যালো হয়। তারপর আবার নীরবতা। আবার এক টেবিল-চামচ কষ্ট গিলে ফেলি।
পেছনে ফিরি। সুজন নেই। চলে গেছে। এই ছেলেটা হঠাৎ আসে- হঠাৎ যায়। কোনো ঠিকঠিকানা নেই। আবার পুরনো কুয়ায় জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস।
নিজের সাথে অভিনয় বেশ মজার একটা খেলা। কখনোই হারতে হয় না, কখনো জেতা যায় না। মাঝে মাঝে গম্ভীর মুখে নিজেকে বোঝাই- সুজনকে ভোলা আসলে কোনো ব্যাপারই না। আর আমি কি বেহায়া নাকি? তবুও মাঝে মাঝে খুব আলতোভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। যেন যাকে এতক্ষণ বোঝানো হয়েছে সে শুনতে না পায়। তার কানে যেন ডানা ঝাপটানোর শব্দটা না পৌছায়। অন্তত কানটা জানুক আমি ভালো আছি।তারচেয়ে আমি বরং খাঁচার সাথেই সন্ধি করি।
ইদানীং রাত জাগাটা বেশি হচ্ছে। এত রাত জেগে থাকা ভালো কিছু না। এটাকে কনট্রোল করতে হবে। সবকিছুই কন্ট্রোল করতে হবে। সুজনর ব্যাপারটাও। এমন না যে ওকে ছাড়া থাকা যাবে না। ওকে না দেখলে মন সবসময় অশান্ত হয়ে থাকবে। সুজনের চেয়ে কত সুন্দর ছেলে তো আছে আশেপাশেই। আমিও দেখি মৃদুলের সাথে চান্স নিতে পারি কী না। অথবা প্রবীরের সাথে।
এসব ভাবতে ভাবতেই সুজনের গলা শুনতে খুব ইচ্ছা করলো। যেন এক মরণতেষ্ণা চেপে বসেছে গলায়। অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কিছু হলো না। একেবারে অবুঝের মতো করে ছেলেটা মাঝে মাঝে। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় ফোনটা হাতে নিলাম। একবার নাহয় ডাক দিয়ে দেখি। মাঝে মাঝে প্রায়ই ইদানিং ফোনে ভুলে চাপ পড়ে যায়।
‘দুঃখিত। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি… ‘
আবার চেষ্টা করলাম। আবারো ভদ্রমহিলা অনর্থক ক্ষমা চাইলো।একটা হতাশার ভাঁজ পড়লো কপালে। ভেতরের পাখিটা সর্বশক্তিতে ডানা ঝাপটাচ্ছে। এই মাঝরাতে পাড়াসুদ্ধ লোকের ঘুম ভাঙ্গাবে নাকি।
সুজন তো কখনো সেল অফ রাখে না। ওর কি শরীর খারাপ? ওর কি অসুখ? ওর কি মন খারাপ? নাহ। কালকে খোঁজ নিতে হবে- আড়াল থেকে; কিছুটা আড়াল রেখে। রাতটা শুধু কোনোমতে কেটে যাক।
…………………………… সমাপ্ত।
সমপ্রেমের গল্প ২০১৯