
লেখকঃআনন্দ
উৎসর্গঃসকল মা কে
[মা।শব্দ বড়ই মধুর।মা কখনো সন্তানের খারাপ চান না।হয়ত পরিস্থিতি ভিন্ন হয়।কিন্তু মা সব ক্ষেত্রেই মা]
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
১.
সকাল আটটা।বৃন্দাবন মেনশনে সসবে সকাল হয়েছে।তবে দুজন মানুষ সেই ভোরেই উঠে গেছে।তাদের একজন হল মমাধব রায়।বয়স প্রায় সত্তরের কোঠায়।কিন্তু মনের চাঞ্চল্য যুবকের চেয়ে কিছু কম নয়।বয়সটা শুধু শরীরে বেড়েছে।আজ পনেরো বছর ধরে বৃদ্ধ তার পুত্রবধূর সাথে এইখানে থাকেন।ব্যবসায়ের ভার তার পুত্রবধূর উপরই।ছেলে নারায়ন রায় অন্য সংসারের ভার গ্রহনে এই পরিবার ছেড়েছেন আজ পনেরো বছর।এখন আর ছেলের কথা বৃদ্ধের মনেও হয় না।এখন আপন বলতে নাতি এবং কন্যাতুল্য পুত্রবধূ। বৃদ্ধের আপনজন হিসেবে আরেকটি প্রাণী হল হিরণ।হিরণ এ বাড়ির কেউ নয়।তবে সম্বন্ধ নেই এমন নয়।এ বাড়ির মালকিন তার মাসি হলেও ডাকে ও কর্মে তিনি হিরণের বড়মা।
হিরণের মা বেহুলা রাণী একসময়ে তার বড়মার ঘণিষ্ট বান্ধবী ছিল।এখন অনেকদিন যাবত যোগাযোগ নেই।দশ বছর বয়সে হিরণের বাবা মারা যান।তখন বছরখানেক সে এখানে ছিল।বেহুলার অন্যত্র বিয়ে হওয়ায় হিরণ তার সাথে সেখানে চলে যায়।কিন্তু পাচ বছর পর সে একদিন এখানে ফিরে আসে।সেদিন সে মুখে কিছুই বলেনি।চোখে এক ফোটা জল ছিল না।কাধে একটা ছেড়া ব্যাগ আর একটা রাধাকৃষ্ণর মূর্তি হাতে সেদিন সে এ বাড়িতে আসে।হাজার জিজ্ঞাসার পরও সে আজও কারো বিরোদ্ধে কিছুই বলে নি।পরে বেহুলা তাকে নিতে চাইলেও সে যায়নি।তার বড়মা জোড় করে তাকে রেখে দিয়েছিল।
উপর থেকে একটা তীব্র চিৎকার শোনা গেল।ঠাকুরের সামনে হাত জোড় করে দাড়িয়ে ছিল হিরণ।পাশে দাদু মানে মাধব রায় বসে আছেন হুইল চেয়ারে।দুজনেই চোখ বুজে আছে।
-দাদু।বড়মা উঠে গেছে।আজ শান্তিদিদির ক্ষান্ত নেই।
-চুপচাপ প্রণাম করে কেটে পর।জশো কফি পায়নি মানেই ডাকাতে কালী ক্ষেপেছে।
একবার মুখ টিপে হেসে শেষ প্রণাম করে দাদুকে নিয়ে ডায়নিং-এ বসিয়ে হিরণ রান্না ঘরে গেল।উপর থেকে গলার স্বর ক্রমশ নিচের দিকে তীব্র হতে লাগল।একটু পর গজ গজ করতে করতে নিচে নেমে এলো মাধব রায়ের একমাত্র পুত্রবধূ জশোধারা রায়।
স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের বহু বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজ তিনি জশোধারা রায়।নামেও কর্মেও।শ্বশুরের দেওয়া ব্যবসায় তিনি একা হাতে অনেকটা এগিয়েছেন।আজ তা অনেক বড় পরিসরে আছে।একটা এনজিও এর সভাপতিত্বও করেন তিনি।সময়ের সাথে তার স্টেটাস এবং রুচি দুটোই বদলেছে।এখন আর হাটু গেড়ে ঠাকুর প্রণাম করা হয় না।সেটা শুধুই আঙুল আর কপালে সীমাবদ্ধ।এখন আর মোটা করে সিঁদুর দেওয়া হয়না।মাঝে মাঝে না পড়লে হিরণ মনে করিয়ে দেয়।এখন কফি ছাড়া মেজাজ ভাল থাকে না।এখন আর লালপাড় কাপড় পড়া হয় না।স্নান সেড়ে নতুন জামদানি পড়ে নিচে নেমে এল জশোধারা।
-শান্তি..শান্তি…।আমার কফিটা এখনও রাখিসনি কেনো।মর্নিং বাবা।
-আয় মা আয়।বোস বোস।কি হয়েছে এত রাগ কেন।
-আর বলবেন না বাবা।শান্তি আজ আমার কফি দেয়নি।কফি না খেয়েই স্নান করেছি।
-আচ্ছা তা না হয় এখন খেয়ে নিবি।দাদুভাই উঠেছে?
-সেকি ও এখনও বেডে?আজ শান্তির সাথে ওকেও বের করে দেবো।
-হেরে হোনো চা হলো রে??
জশোধারা অবাক হয়ে একবার শ্বশুরের দিকে তাকালো।রান্নাঘর থেকে হিরণকে বের হতে দেখে আরো অবাক হলেন তিনি।
-একি।হিরণ।তুই কেন।শান্তি কোথায়??
হিরণ ট্রেটা টেবিলে রাখতে রাখতে শান্ত গলায় বলল,”শান্তিদিদির মা অসুস্থ তাই আজ আসতে পারেনি।”
-জানি জানি।সব বাহানা।আমার ছেলেটাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে।নিক ছুটি একেবারে।বলে দিবি আর আসতে হবে না।
-বড়মা।বেচারি কি প্রতিদিন এমন করে নাকি।ছাড়ো না।আর করবে না।আর করলেও আমি রেখে আসব কফি।
-না না।তুই কেন??হাতে লেগেটেগে যাবে।তখন কি হবে।বেহুলা আমার ভরসায় তোকে এখানে রেখেছে।আর যদি গেছিস তাহলে কান ছিড়ে দেবো।
-আচ্ছা আর যাব না।
দাদুর হাতে চা টা ধরিয়ে দিতেই দাদু বললেন,”যা তো দাদুভাইয়ের গায়ে এক গ্লাস জল ঢেলে আয়।”
-ও বাবা।এতে হবে নাকি।এক জগ দিতে হবে।কি বলো বড়মা।
-যা বলেছিস।
বলে একটু হাসল জশোধারা।কফিটা নিয়ে উপরে যেতে যেতে বলল,”শোন ওকে একটু আগে উঠার জন্য বলিস।নাহলে বলবি বড়মা এবার বালতি ভরে জল দেবে।”
-হুম যাচ্ছি।
-ওফফফ জোর বাচা বেচে গেছে শান্তি।
দাদু আর হিরণ শব্দ করে হেসে উঠল।
২.
কৃষ্ণ এখনও পড়াশোনা করছে।সাথে মডেলিং এর দিকেও ঝোক আছে।এ বাড়িতে প্রথম হিরণ আসার পর যে ছেলেটা বলেছিল বাড়িকে একেবারে ধরমশালা বানিয়ে ফেলেছে।সেই ছেলেই যে একদিন হিরণ এর চোখের মায়ায় পড়বে।তার কম্পিত ওষ্ট্রাধর এর দিকে তাকালে লোভ হবে।তা কেই বা জানত।তখন কৃষ্ণ বিশ বছরের যুবক যখন সে প্রথম বুঝতে পারে যে সত্যি সে হিরণের প্রেমে পড়েছে।তার পর হঠাৎ একদিন হাটু গেড়ে বসে ভালবাসার কথা জানানো।তারপর কেটে গেছে অনেক সাতরঙা বসন্ত শুধুই হাতে হাত রেখে।হঠাৎ শরীরে ঠান্ডা লাগাতে একটু নড়ে আবার শুয়ে পড়ল সে।
-কৃষ্ণ উঠো।নইলে বড়মা বলেছে শরীরে বালতি ভরে পানি দিতে।
কোনো পরিবর্তন না দেখে আরেকবার কয়েক ফোটা পানি ছিটিয়ে দিল হিরণ।কিন্তু কোনো কাজ হলো না।হিরণ এবার বুঝতে পারছে মহারাজ ইচ্ছা করে শুয়ে আছে।জেগে গেছে উঠবে না।কিন্তু ওকে উঠানোর পদ্ধতি হিরণের ভালো করেই জানা আছে।
চোখ বুঝে ওপাশ ফিরে মুচকি হাসছিল কৃষ্ণ।সে জানে হিরণ তার হাত ধরে টানতে আসবে।তখন সে টেনে তাকেও ফেলে দেবে বিছানায়।
“আ শ্যাম..”একটা ঘোঙানি শুনে বিছানা ছেরে লাফিয়ে উঠল সে।হিরণ হাতে আঙুল চেপে বসে আছে।
-হির!!কি হলো।হাতে লাগল নাকি।
এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে হিরণের চেপে ধরা হাতটা বের করে মুখে নিয়ে নিল।এমন ভাবে তাকিয়ে আছে হিরণের দিকে যেন সে নিজে ব্যথা পেল।হিরণ কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।উদোম গায়ে পাজামা পড়ে জীম করা শরীরে বড়ই সুন্দর লাগছে কৃষ্ণকে।যেন দেবদুত নেমে এসেছে।কিন্তু যখন ওর মুখের ভঙিমাটা দেখলো আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারল না হিরণ।খিল খিল করে হেসে উঠল সে।
কৃষ্ণ মুখ থেকে আঙুল বের করে জিজ্ঞাসা করল,”একি।তুমি হাসছো কেনো।”
অমনি টুক করে নিজের হাতটা সরিয়ে দুইপা পিছিয়ে গেল হিরণ।
-বিছানায় ফেলার প্লেন চলছিলো।
-তুমি কি করে জানলে।
-তুমি মনে যা ভাব তাই আমি পড়তে জানি।আর এটাও বুঝতে পারছি যে তুমি বুঝে গেছ আমার হাতে কিছু হয়নি।তাই হাত চেপে দাড়িয়ে ছিলে যাতে আমি পালাতে না পারি।
-আমার মনে আরো একটা কথা চলছে।বলতো কি?
-সেটি হবে না।আমাকে ধরা অত সোজা না।
বলেই পিছন ঘুরে ছুটিতেই দাদুর সাথে ধাক্কা খেয়ে দুনিয়াটা এক চক্কর মারা হয়ে গেল।
-আহ,শ্যাম!!দাদু মেরে ফেললে গো।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাড়াতেই একটা হাত এসে শক্ত করে তাকে ধরে ফেলল।একেবারে পুরো কোমড় জরিয়ে ঘাড়ে মাথা রেখে বলল,”আমাকে ডাকলে??”
দাদু হেসে বলল,”আরো জোরে চেপে ধর বেটাকে।নিজে লাফা লাফি করে এসে আমাকে দোষ দেয়।হারামজাদা বাদর।
-বুড়ো হুলো।আমি ছাড়া পায় তোমার হচ্ছে আজ।
দাদু এবার সোজা সামনে তাকিয়ে চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে চলে গেল।এখন কথা বাড়ালা হিরণ দাদুর বারোটা বাজাবে তা জানা।কারন কালকেই বেচারা ডায়াবেটিস এর রোগী মিষ্টি চুরি করতে গিয়ে হোনো মানে হিরণের হাতে ধরা পড়েছে।আর তা জানলে জশোধারা যে তার মিষ্টি বন্ধের অন্য উপায় বের করবে তাও জানা।তাই নিরবতাই উত্তম।
দাদু গেলে কাধটা নাড়িয়ে চোখ বুঝা কৃষ্ণকে সরানোর চেষ্টা করলো হিরণ।
-হায় শ্যাম তোমার নাম নিয়েও শান্তি পেলাম না।এই কি করছো।ছাড়ো আমাকে,দাদুর সামনে নাটক করছে।আর আমি বাদর হয়ে গেলাম।
-হির,আমাকে যখন ডেকেছো তখন তো আসতেই হবে।আমিই তো কৃষ্ণ আমিই শ্যাম।
-আমি তোমাকে ডাকিনি।আমার ঠাকুরকে ডেকেছি।এত বছরে এটা নিশ্চয় বুঝেছো।
-তুমি আগে রুমে চলো।তোমাকে আমি বুঝাচ্ছি।চলো।
-কেন?না আমি যাব না।ছাড়ো নইলে খবর আছে।
কিন্তু কে শুনবে কার কথা।এভাবে জড়িয়ে ধরেই ওকে রুমে নিয়ে দড়জা আটকে দিল কৃষ্ণ।হিরণ জানে এবার তার নিজেরই খবর হবে।ও পিছতে লাগল এদিকে কৃষ্ণ এগিয়ে আসছে।পিছতে পিছতে এবার বিছানাতে পা আটকে গেলো।আর উপায় নেই।এদিক ওদিক পালাবার জন্য পথ খুজছিল সে।হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই সে সামনে এগিয়ে এলো।সোজা এসে কৃষ্ণের দুইপায়ে ভর করে দাড়ালো।তাকে এভাবে নিয়ে কৃষ্ণ ঘুরে গেল।এবার সে পিছিয়ে পিছিয়ে হাটছে।হিরণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে।
-খালি গায়ে বেশ হট দেখাচ্ছে আমার শ্যামটাকে।
-তাই..??
কৃষ্ণর পা ঠেকলো বিছানায়।
-একটা জিনিস চাইবো?
-হ্যা।
হিরণ একটু বেকে আবার সোজা হলো।সামনের দুটি চোখ শুধু তার চোখেই তাকিয়ে।সে কি করছে কিছুই দেখছে না।
-বলবো?
-বলো।
ঝপ করে এক গ্লাস জল পড়ল কৃষ্ণর মাথায়।হঠাৎ যেন ঘোর কাটলো ওর।ততক্ষনে হিরণ লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে গেল।
-যাও স্নাস করে এসো।ব্রাশ তো করেনি মুখে কি বিচ্ছিরি গন্ধ।যাও।
-এটা কি হলো।
বলে বিছানায় বসে পড়ল কৃষ্ণ।
-বড়মা….!!
-আরে বাবা যাচ্ছি তো।
-যাও নইলে ঠান্ডা পানিতে স্নান করাবে বড়মা।
৩.
নাস্তা করতে বসে হঠাৎ হিরণের দিকে লক্ষ্য করল কৃষ্ণ।খাচ্ছিল না।কি যেন ভাবছিল।নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।মাথার ঘন কালো চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে।একটু পর সে উঠে দাড়াল।
-বড়মা আমি একটু ঘরে যাই।
-খাবারটা খেয়ে যা।
-না।পরে খেয়ে নেবো।
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘরে চলে এল হিরণ।এসে দড়জা বন্ধ করে তার পড়ার টেবিলের উপর রাখা রাধাকৃষ্ণ মূর্তিটা হাতে নিল।কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে হাতের কাছে রেখে মাথা টেবিলে রেখে কেঁদে উঠল।
-শ্যাম।মাকে বুঝাও শ্যাম।আমার যে ও বাড়িতে ভয় হয়।কিছু করো শ্যাম কিছু করো।মা জানে আমি তোমার কথা শুনলে ঠিকি যাবো।
হঠাৎ দড়জাতে টোকা পড়ল।হিরণ তখনও মাথা নিচু করে কাঁদছে।
-হির দড়জা খোলো।
কৃষ্ণর গলা শুনে চেয়ার থেকে তাড়াতাড়ি উঠে চোখ মুছে নিল হিরণ।দড়জার খুলে কৃষ্ণকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিল।
-এসো।আজকে আমার ঘরে যে।
-কি হয়েছে তোমার।
কৃষ্ণর কথায় ওর চোখের দিকে তাকালো।ওর চোখে সন্দেহ।কৃষ্ণ খুব নিখুঁত ভাবে তাকে দেখছে।
-তুমি না খেয়ে আসলে কেন।
-ভাল লাগছিল না।পরে খেয়ে নেবো।
-কেন খেলে না সেটা বল।
-সবদিন সমান নয় কৃষ্ণ।
বলে ঘুরে গেল হিরণ।কৃষ্ণ টেবিলের দিকে তাকাল।রাধাকৃষ্ণ মূর্তিটা রাখা।একটু এগিয়ে গেল।কয়েক ফোটা জল।
-হির এদিকে ঘুরো।কি হয়েছে তোমার।
-কিছু হয়নি কৃষ্ণ।
একটা হেচকা টানে হিরণকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল কৃষ্ণ।অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে হিরণের দিকে।হিরণ এখনও মাটির দিকে তাকিয়ে।
-কি হয়ছে হির।বলবে তো।
হিরণ এবার চোখ তুলে চাইল।ছল ছল করছিল তার চোখ দুটো।মায়া হরিণের মতো চোখ দুটোর গভীরতা যেন ঝিলের মতো।চোখে জমে উঠা জলে আলো পড়ে ঝলমল করছিল।হিরণ একবার দড়জার দিকে তাকাল।কৃষ্ণ গিয়ে দড়জাটা লাগিয়ে এসে শান্ত গলায় আরো একবার জিজ্ঞাসা করল,”কি হয়েছে এবার তো বলো।”
-মা ফোন করেছিল।শরীর ভাল না।আমাকে দেখতে চাইছে।ও বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো।মা বলেছে আমি না গেলে পুজো করবেন না।
-কি হয়ছে মাসিমনির।
-আজ ডাক্তার বলেছে হার্টে সমস্যা।
বলে কৃষ্ণকে ঝাপটে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠল হিরণ।
-আজ সকাল তোমাকে স্নানে পাটিয়ে ঘরে আসতেই মা ফোন দিয়েছিল।আমি ও বাড়িতে যেতে চাই না কৃষ্ণ।আমার ভয় করে।আমি কি করবো।
-তুমি যাবে।আমি নিয়ে যাব।
কৃষ্ণ হিরণকে বিছানায় বসালো।জল মুছে বলল,”হির তুমি ওই বাড়িতে কেন যেতে চাও না??আজও তুমি আমাকে বলনি।কি হয়েছে হির।আজ তো বলো।”
কৃষ্ণর দিকে তাকিয়ে ওইদিন গুলোর কথা মনে হয়ে যেন কেঁপে উঠলো হিরণের ভিতরে।
-আমার নতুন বাবার জন্য।
-কেন?কি করেছেন ওনি।
হিরণ চুপ করে রইল।কৃষ্ণ অস্থির হয়ে উঠল।
-হির।বলো।আমার কাছে কি এমন লুকাচ্ছো তুমি।
হিরণ এবার তার গেঞ্জিটা খুলে ফেলল।কৃষ্ণ একটু অপ্রতিভ হয়ে গেল।আজও হিরণ আর কৃষ্ণ আলাদা ঘরে থাকে।কখনো তারা এক রুমে থাকেনি।কৃষ্ণ অনেকবার বলেছে কিন্তু হিরণ কখনো রাজি হয়নি।প্রথমবার হিরণের শরীর দেখে ভিতরে একটা শিহরন ধারা বয়ে গেল।
-হিরণ।এসব…..কি বলতে চাইছো বুঝতে পারছি না।
-এদিকে এসো।
কৃষ্ণ এগিয়ে হিরণের কাছে গিয়ে দাড়াল।হিরণ কৃষ্ণর হাতটা টেনে নিজের ঘাড়ের কাছে নিয়ে এলো।কৃষ্ণর শরীরে আরেকবার শিহরন বয়ে গেল।কিন্তু হঠাৎ হাতে একটু ফোলা ফোলা লাগতেই চমকে উঠলো কৃষ্ণ।
-কিসের দাগ।এমন করে ফুলে আছে কেন?
-অনেক বছর ধরে একই জায়গায় দাগ লাগলে তা ফুলেই যায় কৃষ্ণ।
-কিন্তু এটা তো কামড়ের দাগের মত দেখাচ্ছে।
কথাটা বলে এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল কৃষ্ণ।সে কিসের মুখোমুখি তা সে এখন অনুধাবন করতে আরেক সেকেন্ডের মত লেগে গেল তার।একবার নিচের দিকে তাকাল সে।তার পর আবার হিরণের দিকে তাকিয়ে বলল,”কে করেছে এসব।”
-ওই লোক।
-মাসিমনির স্বামী।
হিরণ আরেকবার ঝাপটে ধরল কৃষ্ণকে।কৃষ্ণ আর কোনো কথা তাকে জিজ্ঞাসা করেনি।শুধু ওকে বুকে নিয়ে দাড়িয়েছিল।
৪.
“মা..”একটা পরিচিত কন্ঠে ফিরে তাকালো বেহুলা।বহুদিন পর খুব কাছ থেকে এই ডাক শুনে প্রানটা জুড়িয়ে গেল।চোখের সামনের সব কিছু ঝাপসা করে আবার স্পষ্ট হয়ে গেল।দুই ফোটা অশ্রু মাটিতে পড়ল।
-বাবাই।তুই এসেছিস বাবাই।
-হ্যা মা।
-কেমন আছিস বাবাই।
বেহুলা উঠে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।আজ পাঁচ বছর ধরে ছেলেকে দেখে না।সেই যে জশোধারার বাড়িতে চলে যাওয়ার পর দুইবার গেছিল।তারপর হিরণ কেনই বা তাকে ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়ে বলিছিল সে যেন আর না যায়।তার কিছুই সে বুঝতে পারেনি আজও।
হিরণের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
-কেমন আছো মা।ভাই আর বোনকে তো দেখলাম না।
-ওরা বাইরে গেছে।এক্ষুনি চলে আসবে।কেমন আছিস কৃষ্ণ।
কৃষ্ণ এগিয়ে এলো।
-ভালো মাসিমনি।তোমার শরীর কেমন।
-ভগবান ভালই রেখেছে রে বাবা।আয় বোস তোরা।ওরা এক্ষুনি এলো বলে।সত্য..সত্য….।
হিরণ একবার কৃষ্ণর দিকে তাকালো।এদিক ওদিক দেখছে।কি দেখছে তা হিরণ জানে।
-জ্বী কাকিমা।
-এই দেখ বাবাই এসেছে।
হিরণ এদিকে ঘুরে দাড়ালো।চোখের স্পষ্ট আনন্দ।
-সতুদি কেমন আছো।
-ওমা কাকিমা এ আমাদের বাবাই??সেকি কত বড় হয়ে গেছে।কেমন আছিস ভাই??
-ভাল আছি সতুদি।অনেক ভাল আছি।
সত্য নামের মেয়েটাকে খুব ভাল করে লক্ষ্য করছিল কৃষ্ণ।বয়সে সম্ভবত তার বড়।সত্য এগিয়ে এলো।
-একি কাকিমা।ওদের কিছু এনে দাও।মিষ্টি আলাদা করে রাখা আছে।
কৃষ্ণ অবাক হল।এমনটা ও কখনো দেখেনি।একে বেহুলা অসুস্থ তার উপর নিজে না গিয়ে তাকে মিষ্টি আনতে বলাটা একটু অদ্ভুত লাগল তার।বেহুলা দ্বিরুক্তি না করে চলে গেল।সত্য এবার এগিয়ে এসে হিরণের হাত ধরল।
-কেমন আছো সতুদি।
মিষ্টি একটা হাসি টেনে সত্য বলল,”বললাম তো ভাল আছি।”
-সত্যি করে বল।ভাল আছো তো??
-হ্যা।সত্যি বলছি।
-তাহলে চোখের নিচের দাগ কিসের।এখনও এই কালো দাগ রয়েছে সতুদি।তুমি আমাকে মিথ্যা বলছো??
এবার হাসির মধ্যে দিয়েই দুই ফুটা চোখের জল গড়িয়ে পরল সত্যর গাল বেয়ে।হিরণ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরল।
-বিয়ে করোনি কেন?
-তুই জানিস না??
-আর কতদিন সতুদি।পালিয়ে যেতে পারো না?
-পারিনি রে।মেয়ে মানুষ বাইরে গিয়েই বা এর থেকে বাঁচবো কি করে।
-মা কখনো বিয়ের জন্য বলেনি?
-অনেক ঘর এসেছিলো।কিন্তু কেউই আর কিছু জানায়নি।ছাড়।বোস।ওনি…
-ও বড়মার ছেলে।
-ওহ।নমস্কার।
কৃষ্ণ এতক্ষন শুধু শুনছিল।কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।হঠাৎ সত্যর কথায় যেন ঘোর কাটলো তার।
-নমস্কার দিদি।
-বোসো ভাই।আমি যাই রে হিরণ।ওদিকে পুজোর অনেক কাজ পড়ে আছে।কাকিমা..ও কাকিমা।
সত্য ব্যস্ত হয়ে চলে গেল।হিরণ বসলো না।ঠাই দাড়িয়ে আছে।একটু পর বেহুলা হাসি মুখে মিষ্টি নিয়ে ঢুকলো।
-একি তোরা দাড়িয়ে কেনো।বোস।
-না মা।আমি আর থাকবো না।
-সেকি।এতদিন পর এলি।ওকে প্রথমবার নিয়ে এলি।পুজো শেষ হলো না চলে যাবি।
-না মা।তোমাকে দেখতে এসেছিলাম।আমার আর পুজোতে বসতে হবে না।
-এমন করিসনা বাবাই।সত্যনারায়ণ পুজো।অতিথি নিয়ে এসেছিস।এভাবে যায় না বাবা।তোর ভাই বোন ও তো এলো না।আর তোর বাবা….
কথা শেষ করতে না দিয়ে হিরণ বলল,”আমি আসি মা।আমার বাড়িতে পড়া আছে।”
-জশোর কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না।আরেকটু থাক না বাবাই।
-না মা।আসি।
হিরণ বেরিয়ে গেল।কৃষ্ণ কি করবে বুঝতে পারছিল না।
-আসি মাসিমনি।
-সাবধানে যাস বাবা।জশো শুনলে কি ভাববে।ছেলেটা আমার কথায় শুনলো না।
বেহুলার কন্ঠ ভেঙে আসল।
-চিন্তা করো না মাসিমনি।সময়মত ওষুধ খেওয়ো।আসি।
কৃষ্ণ ঘুড়ে দাড়াল।বেহুলার দিকে তাকাতে পারছিল না।বড্ড অসহায় দেখাচ্ছিল বেচারিকে।
সামনে হাটতে হাটতে সত্যর সাথে দেখা হলো হিরণের।
-যায় সতুদি।
-সেকি।আবার কবে আসবি।
-জানি না।
হিরণ চাপা কান্না নিয়ে বেরিয়ে এলো।আর সহ্য হচ্ছে না তার।দম আটকা লাগছিল।
৫.
পাঁচদিন হয় গেল।হিরণ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।কৃষ্ণ ওর ঘরে আসছিল দেখলো শান্তি ওর পাশে দাড়িয়ে।
-হিরণ দাদাবাবু।কি হয়েছে গো তোমার।মুখখানা কয়েকদিন ধরে দেখছি।কেমন যেন হয় গেছে।
হিরণ একবার শান্তির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,”কিছু হয়নি শান্তিদিদি।পড়ার চাপ বেড়েছে তাই।
-তা হবে হয়তো।
কৃষ্ণ ঘরে গেল না।বাইরে থেকেই নিজের ঘরে চলে গেল।পুজো থেকে আসার পর থেকে সত্যি ও কেমন হয়ে গেছে।একবার ভেবেছিল সত্য মেয়েটার কথা জিজ্ঞাসা করবে।কিন্তু পারলো না।মা জিজ্ঞাস করাতে অনেক কথা বলল হিরণ।যার বেশীরভাগ মিথ্যা।একটু পর শান্তি কফি নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
-দাদাবাবু আসবো?
-হ্যা এসো।
কফি রেখে যাওয়ার সময় শান্তিকে ডাকল কৃষ্ণ।
-শান্তিদি হিরণ কি বলেছে।
-কিসে?
-ওই যে তখন ঘরে কথা বলছিলে।
-বললো তো পড়ার চাপ।অমন হয় নাকি।একবার হাওয়া বদলের দরকার।ঘুরে আসলে ভাল লাগতে পারে।
কৃষ্ণ একবার মুচকি হাসল।শান্তি চলে গেল।ভাল বুদ্ধি দিয়েছে সে।পড়ার কোনো চাপই নেই।পরীক্ষা আরো পরে শুরু হবে।এর মধ্যে ঘুরে আসায় যায়।কয়েকদিন বাইরে থাকলে ওর মনটাও ভাল হয়ে যাবে।নিজেদের আলাদা সময়ও পাওয়া যাবে।সিলেটে তাদের পুরোনো বাড়ি দেখার খুব ইচ্ছে হিরণের।সেখানেই গেলে ভাল হবে।
****
-ঠিক আছে সাবধানে যাস।আমি সব বলে রাখব কেয়ারটেকার সব ঠিক করে রাখবে।
-ওহ লাভ ইউ মা।
বলেই জশোধারাকে জড়িয়ে ধরলো কৃষ্ণ।বহুদিন পর জশোধারা প্রানখুলে হেসে ছেলের কান ধরে টেনে সামনে আনল।
-আবদার ছাড়া তো মায়ের কাছেই আসিস না।এখন লাভ ইউ??
-আহ মা।আচ্ছা আর এমন করব না।
বলে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আরেক কানে নিজে ধরল।
-আচ্ছা।তবে তাড়াতাড়ি ফিরিস।আমি মোম্বাই যাব কয়েকদিন পর।বাবাকে কি একা রেখে যাব নাকি।
-নো টেনশন।আচ্ছা হিরণকে জানিয়ে আসি।
-সেকি ও জানে না??
-না তো।
-আচ্ছা।মি.মতিউর একটা পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেছেন।আমি সেখানে যাচ্ছি।বাবা জিজ্ঞাসা করলে বলিস।
-ওকে।
-বাই।
-বাই।
*****
হিরণ ঘরে বসে পড়ছিল।হঠাৎ ফোন এলো।ফোন দেখে হিরণ অনেকটা অবাক হলো।
-কৃষ্ণ।তুমি আমাকে ফোন করছো কেন।
-কেন করতে পারি না??
-মাথা খারাপ হয় গেছে?তোমার ঘর আমার থেকে এক ঘর পিছনে।
-তবুও আজ ইচ্ছা হলো।তাই ফোনে প্রেমালাপ করবো।
-ধুর!!কি পাগল মানুষ।
-আচ্ছা হির আমার একটা কথা রাখবে?
-কি?
-আগে বলো রাখবে।
-আচ্ছা রাখবো।
-না না।এভাবে নয়।তুমি তোমার শ্যামের পা ছুয়ে বলো।
-আচ্ছা বললাম।
হিরণ উঠে রাধাকৃষ্ণর পা ছুঁয়ে দাড়াল।
-বলো।এক মিনিট।তুমি কোথায়?
-তোমার পিছনে।
৬.
হিরণকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে।গাড়িতে থেকে মুখ বের করে বসে আছে।এই শীতে সাদা গেঞ্জির উপর একটা নীল জেকেট পরে অপূর্ব লাগছে ওকে।কৃষ্ণ তখন থেকে পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে।দেখতে দেখতে যেন ঘোর লেগে যায়।কিন্তু তবুও দেখতে ভাল লাগে।হঠাৎ ফোন আসতেই ঘোর কাটল ওর।
-হ্যা কাকা।আপনি ওগুলো আপনার রুমে রাখেন।আমি এসে ব্যবস্থা করছি।
হিরণ ফিরে তাকালো।ঢেপ ঢেপ করে তাকিয়ে আছে।চোখে জিজ্ঞাসা।
-কে?
-কেয়ারটেকার।
-ওহ।
-আচ্ছা হির তোমার সতুদি কিসের কথা বলছিলেন তোমাকে??
-বিয়ের কথা।এখনও বিয়ে হয়নি।আমার ওই বাড়ির একমাত্র প্রিয় দিদি।মা বাবা নেই।
-তা বিয়ে করেননি কেনো।
হিরণ কিছুক্ষন কৃষ্ণর দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর নিচে তাকিয়ে বলল,”আমি যে কারনে তোমার থেকে দুরে থাকতাম সে কারনে।”
-মানে।
-ওই লোক…
কৃষ্ণ চুপ করে গেল।একটু পর বলল,”হির,এখন তো তোমার লুকানোর মত কিছু নেই।তাই না??”
-না নেই।
-তাহলে এখনও পালিয়ে বেড়াবে??
হিরণ কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরল।ও এমন করে না এমনিতে।কারন সামনে ড্রাইভার আছে।কৃষ্ণ কিছুক্ষন অবাক হয়েছিল।তারপর আস্তে আস্তে হাত দুটো হিরণের পিঠে আবদ্ধ করলো।
-না আর পালাবো না।
-সত্যি??
-শ্যামের দিব্যি।
বলেই মুখ তুলে বাচ্চার মত হেসে উঠল সে।
****
ঠান্ডা হাওয়া বইছে।বাইরে গোধুলি লগ্নের আভা ছড়িয়েছে।বাইরে থেকে গাড়িতে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছিল।হিরণ সেই কখন থেকে বাইরের দিকে মুখ দিয়ে বিসে আছে।কৃষ্ণ কিছুক্ষন মোবাইল চালিয়ে এদিকে এলো।
-গ্লাস উঠিয়ে নাও ঠান্ডা লেগে যাবে।
-লাগুগ।
-আরে ঠান্ডা লেগে যাবে হির।তখন বুঝবে।
-হুম।তুমি আমাকে কম্বলে নিয়ে বসে থাকবে।ভালই তো হবে।
বলে বাইরে থেকে মুখটা কৃষ্ণর দিকে তাকাল হিরণ।মুখে স্নিগ্ধ একটা হাসি।
-তুমি লাগাবে ওটা?
-ওহু।না।
-ধুর।
বলেই গ্লাসটা উঠিয়ে নিল কৃষ্ণ।
৭.
গাড়িটা হঠাৎ থামল।রাত নয়টা বেজে গেছে।
-নিতাই দাদা।কি হলো?
-এসে গেছি হিরণ দা।
হিরণ গাড়ি থেকে এক লাফে বেরিয়ে এলো।সামনে জমিদার বাড়ির মত বিশাল এক বাড়ি।বাড়ির গেটে একজন মহিলা আর দুইজন লোক দাড়িয়ে।একজন ভুড়িওয়ালা লোক দাড়িয়ে।পাশে একজন বুড়ো লোক কাধে গামছা।তার পাশে কাপড় পড়ে দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে।বয়স কম তা মুখ দেখলেই বুঝা যায়।কিন্তু তুলনামূলক স্বাস্থ্যবান হওয়ায় দুর থেমে মহিলা মনে হয়।কাছে গেলে ভুড়িওয়ালা লোকটা এগিয়ে এলো।
-এসো বাবা এসো।বাহ বাহ কত বড় হয়ে গেছো।অনেক বছর পর এলে।
-নমস্কার কাকা।কেমন আছেন??
-ভাল ভাল।তা এই বুঝি তোমার বন্ধু??
-ও হিরণ।
হিরণ এতক্ষন সব দেখছিল।এবার হাত জোড় করে প্রণাম করল।
-তা যাও তোমরা ভেতরে যাও।আমি মালামাল গুলো দেখছি।
কৃষ্ণ এবার সামনের দিকে এগিয়ে গেল।বুড়ো লোকটাকে জড়িয়ে ধরল।বড়ই উষ্ণ আলিঙ্গন।
-কেমন আছো বামুন দাদু।
-ভাল ভাল।তুই কেমন আছিস??
-ভাল আছি।
হিরণ একবার বামুনকে প্রণাম করলো হাত জোড় করে।মুখে প্রসন্নতার হাসি।কৃষ্ণ পাশে তাকিয়ে আবার বামুনঠাকুরের দিকে তাকাল।
-ও??
-এখানেই কাজ করে।চার বছর ধরে এসেছে।বাড়ি কিশোরগঞ্জ।মা বাপ নেই।ওই কেয়ারটেকার এনেছে।
মেয়েটা একটা শুকনো হাসি দিয়ে প্রণাম করল।
-হ্যা রে লক্ষ্মী দেখ গিয়ে রান্নাটা।যাহ যাহ।
মোটা শরীর নিয়ে যতটা সম্ভব জোরে ছুটলো লক্ষ্মী।
বাড়ির ভেতরে অনেক বড় একটা উঠোন।দ্বিতল বাড়ির ঠিক মাঝখানে তুলসীতলাটা দেখে হিরণ
অবাক হল।গাছ দেখে মনে হচ্ছে এখনও সন্ধ্যাহ্নিক হয়।এক সময় নিশ্চয় এখানে বড়মা প্রদীপ দিত।বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকায় বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দুটো ঘরের পরে তাদের ঘর।বিশাল বড় রুম।নিজেকে জমিদার বংশের মনে হচ্ছিল হিরণের।ঘর দেখিয়ে বামুনঠাকুর যাওয়ার সময় বলে গেল নিচে সে আর লক্ষ্মী দুজনে আছে লাগলে যেন ডেকে নেয়।
একটু পরে মাল পত্র নিয়ে ড্রাইভার ঢুকলো।সাথে কেয়ারটেকার সাহেব।
-তাহলে বাবা আমি আসি।অনেক দিন হলো বাড়ি যাইনা।
-জ্বী কাকা।আর হ্যা কাকা ওইগুলো এনেছিলেন??
-হ্যা কিন্তু কি করবে বল তো??
-আমার খুব প্রিয় তো তাই।
-আচ্ছা।তাহলে আমি আসি।
কেয়ারটেকার বেরিয়ে গেলে কৃষ্ণ হিরণকে বলল,”প্রেশ হয়ে নাও।এখানে তো আলাদা ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টাতে হবে।এক কাজ করো পাশের ঘরে চলে যাও।আমি এখানে বদলে নিচ্ছি।”
হিরণ কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে ছিল কৃষ্ণর দিকে।কথা শেষ হলে বলল,”তুমি এ কথা বলছো??এতো লজ্জা কোথা থেকে এলো?”
-এ বাড়ির ভুতে আমার ঘাড়ে ভর করেছে তাই এমন হয়ে গেছি।তুমি যাও।
কৃষ্ণ প্রায় ঠেলতে ঠেলতে হিরণকে পাশের ঘরে ঢুকিয়ে দিল
৮.
সেই কখন থেকে কি করছে কৃষ্ণ কে জানে।দড়জা লাগানো দেখে জিজ্ঞাসা করাতে ভিতর থেকে বলল কাজ আছে।কেউ খায়নি এখনও।বামুনঠাকুর লক্ষ্মী দুজনেই বসে আছে না খেয়ে।হিরণের পেটে তো তান্ডব হচ্ছে।বিশেষ করে যখন রসুই থেকে পোলাওয়ের গন্ধ আসছে তখন ক্ষিদে বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।তবে বামুন আর লক্ষ্মীর মুখে তার কোনো ছাপ নেই।সামনে টেলিভিশনে “বড়বউ” নামক এক ছবির নেশায় পড়েছে তারা।উপায় না দেখে হিরণও দেখছে।
নায়িকা বড়বউয়ের হাতে নায়কের অন্য মেয়ের সাথে ঘণিষ্টতার এক ছবি ধরিয়ে দিয়ে খলনায়িকা স্বরূপা মেজবউ মুখ খটমট করে নিজের সংলাপ বলছে।
-তুমি কিছু বলবে না দিদি।
নায়িকা বাচ্চাদের মত অবাক হয়ে ভেবে বলল,”কি বলি বলো তো।”
খল নায়িকা ফের মুখ খটমট করে সংলাপ বলতে লাগল।
-আমার স্বামী এমন করলে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিতাম।
-আমারও খুব ইচ্ছে করছে।যে এত কষ্ট করে এই ছবিটা তুলেছে তার গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিই।
হঠাৎ নায়িকার এই জবাব শুনে হিরণ হো হো করে হেসে উঠল।
লক্ষ্মী মেয়েটা বড় ভাল।কিছুক্ষনেই ওর সাথে মিশে গেছে।হয়ত বাড়িতে শান্তিদিদির সাথে মিল থাকার ফলে এই পথ সুগম হয়েছে।এতক্ষন অনেক কথা হয়েছে তার সাথে।বামুনঠাকুর বুড়ো মানুষ।বেশিরভাগ সময়ই ঝিমুচ্ছে।
-ও লক্ষ্মীদিদি এবার থাম না।আর কেঁদো না।
-আচ্ছা দাদাবাবু।
বলেই লক্ষ্মী কাপড়ে মুখ চেপে আরেক দফা কেদে নিল।ছবির ক্লাইম্যাক্স দেখে সেই কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে।হিরণ ভাবছে এখনের যুগেও এভাবে কাদার মতো নরম মনের মানুষ আছে।অদ্ভুত!!
****
খেতে বসে হিরণ সবার সাথে কথা বলছে শুধু কৃষ্ণ বাদে।বামুন দাদু আর লক্ষ্মী এখানে দাঁড়ানো।কি এমন সখ্যতা হল কে জানে।কিন্তু এমন তো হিরণ করে না।রাগ করলো নাকি।ওই সময় কাজ আছে বলা ছাড়া উপায় ছিল না।না হলে সব পরিকল্পনা মাটি হতো।যাক,উপরে গিয়ে হিরণের রাগ ভাঙতে দুই মিনিটও লাগবে না।
-দাদু আমাকে আরেকটু মাংস দাও।
হিরণ কৃষ্ণর কথায় কান দিল না।খুব রাগ হচ্ছে।সেই কখন এসেছে।রাধাকৃষ্ণ সেই কখন থেকে ব্যাগে।এখনও বের করা হয়নি।আর কিথায় বলবে না কৃষ্ণর সাথে।
-লক্ষ্মী দিদি আমার খাওয়া শেষ আমি যাই।
বলেই শেষ খাবার টুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ালো হিরণ।
৯.
একি ঘরে তালা দেওয়া কেনো?নিশ্চয় কৃষ্ণর কাজ।
-হায় শ্যাম।কি জালায় পড়লাম।
-কিসের জালা??
কথা শুনে চমকে পিছন ফিরল হিরণ।কৃষ্ণ দাড়িয়ে।মুখে সেই বাঁকা হাসি।মুচকি হাসলে বড় সুন্দর দেখায় কৃষ্ণকে।হিরণ কথা বলল না।ঘুরে দাড়াল।কৃষ্ণ ঘর খুলে দিতেই গটগট করে ঘরে ঢুকে গেল।পুরো ঘর অন্ধকার।হিরণ তবুও কিছু বলল না।কৃষ্ণ লাইট অন করলো।একি,এ কার ঘরে চলে এসেছে হিরণ।সাদা ধপধপে বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছিটানো।পালঙ্কের মাথায় চার কোনায় কিছু গোলাপ।তাহলে কৃষ্ণ এতক্ষন এই করছিলো।
-কৃষ্ণ এসব….
-হুসসস…
মুখ চেপে ধরল কৃষ্ণ।হিরণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।কৃষ্ণ গিয়ে ছিটকিনি আটকে দিল।তারপর ঘুরে দাড়াল।তার হিরকে বড়ই সুন্দর দেখাচ্ছে।অপ্সরাকে তুচ্ছ করার মতো সৌন্দর্য্য ছড়াচ্ছে হিরণের পুরো শরীরে।ও হয়তো সবটা আন্দাজ করতে পেরেছে।ওর মৃদু কেঁপে উঠা ওষ্ট্রাধর এর প্রমাণ দিচ্ছে।কৃষ্ণ এগিয়ে গিয়ে হিরণের একটা হাত ধরে হাটু গেড়ে বসে পড়ল।
-হির।তোমাকে প্রথম দেখেই আমি ভালবেসেছিলাম তা বলবো না।তবে আজ তার জন্য আফসোস হয়।যদি পড়তাম তবে হয়ত অনেক আগেই তোমার ওই চোখে হারিয়ে যেতাম।অনেক আগেই হয়ত তোমার ঠোট কাঁপার কারন যে নার্ভাসনেস তা বুঝতে পারতাম।অনেক আগেই হয়ত আমার হিরকে পেতাম।আজ আমি নতুন করে তোমার প্রেমে পড়তে চাই।হতে পারবো কি তোমার শ্যাম??
হিরণ চুপ।কৃষ্ণ উঠে দাড়াল।
-হির।
হিরণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কৃষ্ণকে।সে আলিঙ্গনের অনুভুতি যে পায় শুধু সেই অনুধাবনে সক্ষম।
-সরি।
-তা বললে তো চলবে না।
-তাহলে।
-প্রায়শ্চিত্ত করো।গান গাও।
-বয়ে গেছে।
-আমার জন্য তো গাও।
হিরণ চলে যাচ্ছিল থামল।জানালার কাছে গিয়ে দাড়াল।কৃষ্ণ তাকে কোলের কাছে টেনে বসাল।হিরণ গান গাইছে।
“তুমি সুতোয় বেধেছো শাপলার ফুল নাকি তোমার মন।।”
হিরণের খুবই প্রিয় গান এটা।
গান শেষ হলে কৃষ্ণ সামনে এসে হাত তালি দিয়ে বলল,”বাহ বাহ।কৃষ্ণ খুশ হোয়া।তোমাকে ইনাম দেওয়া হবে।”
-আচ্ছা??কি ইনাম শুনি।
-এই টা।
এক ঝটকায় হিরণকে কাছে নিয়ে এলো সে।হিরণ কৃষ্ণর থেকে কিছুটা খাটো।কৃষ্ণ তাকিয়ে আছে হিরণের দিকে।চোখ কিছু বলছে কিছু আবদার করছে।যা শুধু হিরণের চোখই বুঝতে পারে।হিরণ পায়ের গোড়াল মেঝে থেকে উপরে ঠেলে দিল পায়ের আঙুলে ভর করে।
১০.
সকালে রোদ চোখে লাগছে।নিশ্চয় হিরণ জানালা খুলে দিয়েছে।কিন্তু কৃষ্ণর উঠতে মন চাচ্ছে না।ইদানীং রাতের ঘুম কমে সকালের দিকে বেড়ে গেছে বেশি।
-কৃষ্ণ।কৃষ্ণ।উঠো বেলা হয়ে গেছে।
-হোক।
বলেই মুখটা অন্যদিকে ঘুড়িয়ে শুয়ে পড়লো সে।একে এভাবে বলে লাভ নেই।
-জল দেবো?নাকি উঠবে।
-দাও না।আজ তোমাকেও শাওয়ার করাবো।
-আরে ধুর।উঠো।লক্ষ্মীদিদি আর বামুন দাদু কখন থেকে বসে আছে।ওরা খায়নি এখনও কৃষ্ণ।
-না খাক।
-আমিও খাইনি।আমার খিদে পেয়েছে।
এবার আর না উঠে উপায় নেই।কারন খিদের পরিমান বেশি হয়ে গেলে হিরণ তান্ডব শুরু করে দেবে।
খাবার শেষে ঘরে রেডি হচ্ছিল হিরণ।হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এলো কৃষ্ণ।এসেই দড়জা আটকে দিল।হিরণ পিছন ফিরে তাকালো।ইদানীং হিরণের ঠোটগুলো বেশি লাল লাগে কৃষ্ণর কাছে।
-কৃষ্ণ।দড়জা খুলো।আমি রেডি হচ্ছি এর মধ্যে ঢুকে গেলে যে।
-তাতে কি আমিই তো।আর এখন তো তোমাইএ রেডি হতে দিচ্ছিনা।
-মানে কি আমি এই অবস্থায় দাড়িয়ে থাকবো নাকি।
-আমাকে লজ্জা করছে??
বলেই এক টানে হিরণকে কাছে টেনে ঘুরিয়ে দাড় করালো কৃষ্ণ।তারপর চোখটা বুজে উচু নাকটা আস্তে আস্তে হিরণের ঘাড়ে রাখল।সেই গন্ধটা।যেই গন্ধে সে এই রাত গুলো মাতাল হয়ে ছিল।হিরণ চোখ বন্ধ করে কুকড়ে উঠল।উদোম শরীরে কাঁপন ধরে যাচ্ছিল।গরম নিঃশ্বাস ক্রমে ঘাড় বেয়ে নিচে যাচ্ছিল।
কৃষ্ণর এতটা খেয়াল নেই কিন্তু কিছু একটার শব্দ হচ্ছে।
-কৃষ্ণ। কৃষ্ণ। ছাড়ো ফোন বাজছে তোমার।
-বাজুক।
-আরে দেখো না।হয়তো বড়মা।
কৃষ্ণর কোনো সক্রিয়তা না দেখে হিরণ ঘুড়ে দাড়াল।
-বের করো বলছি।
-ধুর।মোডটাই বিগরে দিল।
ফোন কানের কাছে নিল সে।
-হ্যালো মা বলো।….কি কখন?…..ওকে ওকে আমরা আসছি।
-কি হয়েছে।
-দাদু স্ট্রোক করেছে
১১.
সারা পথ কৃষ্ণ হিরণে কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে।এত তাড়াতাড়ি সে ঘুমায় না।আজ ঘুমাচ্ছিল।ঘুমন্ত কৃষ্ণকে নিষ্পাপ বাচ্চার মত লাগছিল।রাত নয়টার দিকে তারা বাড়ি এলো।এসেই সোজা ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুলো রেখে হাসপাতালে।
হাসপাতাল হিরণের বড় পছন্দের জায়গা।নানা রঙের মানুষ দেখা যায়।অবশ্য ঢাকা নিজেই একটা রঙের শহর।বড়লোকের কাছে এটা বিলাসিতার শহর, গরীবের কাছে লড়াইয়ের আর মধ্যবিত্তের কাছে অসহ্যকর।লেখক নিজে একবার ঢাকা গিয়েছিলাম এবং বাড়ি এসে কান ধরে বলেছি এই আমার প্রথম আর এই শেষ।যাক সে কথা।
কেবিনে মাধব রায়ের পাশে জশোধারা বসে আছে।অত্যন্ত চিন্তিত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।মাধব রায় ঘুমাচ্ছে।ছেলেকে দেখে এগিয়ে এল জশোধারা।
-মা এসব কখন হলো।
-সকালে হঠাৎ বাবার ঘরে শব্দ পেয়ে শান্তি গিয়ে দেখল বাবা মেঝেতে পড়ে।তারপর এখানে নিয়ে এসেছি।ডাক্তার বলেছেন স্ট্রোক করেছেন।তবে অন্য কোনো সমস্যা হয়নি।
-থ্যাংক গড।
-তোরা বাড়ি যা।আমি এখানে আছি।
-না তুমি হিরকে নিয়ে বাড়ি যাও আমি থাকছি।
-আরে বাইরে থেকে এসছিস।তোরা বাড়ি যা।
-মা…
কৃষ্ণর কথায় বাদ সাধলো হিরণ।
-বড়মা।বলছি আমি থাকি এখন।তুমি আর কৃষ্ণ বাড়ি যাও ফ্রেশ হয় বিশ্রাম নাও।পরে নাহয় কৃষ্ণ আসবে আর বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয় আসবো।
জশোধারা আর কথা বাড়াল না।
****
দাদু বাড়ি এসেছে আজ একমাস।বৃদ্ধের সারাদিন এমনিতেই কোনো কাজ নেই।তার উপর ডাক্তার রেস্ট দিয়েছেন।তবে মিষ্টি থেকে দুরে রাখাটা কঠিন হয় পড়ছে।জশোধারা মোম্বাই গেছে আজ চারদিন।চারদিনে হিরণের পুরো জিনিস পত্র উঠিয়ে কৃষ্ণ নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে।অবশ্য তারা আরো আগে থেকেই কৃষ্ণর রুমে থাকছে।আজ পাকাপাকি হয়ে গেল।টেবিলে রাখা রাধাকৃষ্ণর সামনে বসে পড়ছিল হিরণ।আজ ভার্সিটি বন্ধ।কৃষ্ণ বাড়ি নেই।ফটোশ্যুটের জন্য গেছে।
-হোনো….
পাশের ঘর থেকে দাদুর গলা শুনে হঠাৎ করে চেয়ার থেকে উঠে ওদিকে ছুটলো সে।মাঝে মাঝে এমন করে হিরণ।কেন করে তা জানি না।কিন্তু হঠাৎ এমন করায় হাত লেগে রাধাকৃষ্ণ মুর্তিটা পড়ে গেল।হিরণ সে দিকে খেয়াল করেনি।খেয়াল হল দাদুর কাছ থেকে আসার পর।
মেঝেতে পড়ে মুর্তিটা দুভাগ হয়ে গেছে।হিরণের দুনিয়াটা একবার ঘুড়ে গেল।এই মুর্তিটা ওর বাবা ওকে কিনে দিয়েছিল।অনেক ছোট বেলায়।আজ পর্যন্ত এটাকে সে আলাদা রাখেনি নিজের থেকে।ভার্সিটিতেও এটা সে সাথে করে নিয়ে যেত।কতই তো এমন করে হিরণ।কোনোদিন কিছু হয়নি।
হাটুগেড়ে ছুটো বাচ্চাদের মত টুকরো গুলো হাতে নিয়ে কেদে ফেললো সে।বুক ফেটে কান্না আসছে।শরীরে কম্পন হচ্ছিল।খুব ভয় লাগছিল ওর।
হিরণের শব্দ শুনে পিছনে চেয়ারে করে এসে দাড়াল দাদু।
-হোনো।কি হয়েছে।
এক ঝটকায় দাদুকে জড়িয়ে ধরল হিরণ।
-আমার শ্যাম ঠাকুর ভেঙে গেছে দাদু।আমার শ্যাম ঠাকুর ভেঙে গেছে।
-ধুর বোকা।এতো মাটি দিলেই জোড়া লেগে যাবে।
-আমার ভয় করছে দাদু।ভীষন ভয় করছে।
-ধুর হাদা।ঘরে চল আমার সাথে।
১২.
কৃষ্ণ বাড়িতে এসে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।দাদু আর হিরণ বাড়িতে থাকতে বাড়ি এমন থম থম করছে কেনো।দাদুর কিছু হল না তো।না না দাদুর কিছু হলে হিরণ এমন চুপসে থাকত না।কৃষ্ণ প্রথমে দাদুর ঘরে গেল।দাদু শুয়ে আছে।ঘুমাচ্ছে কিনা জানা নেই।অসুস্থ মানুষ তাই আর ডাকেনি।এবার সে নিজের ঘরে গেল।হিরণ বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে।এমন সময়।মাত্র নয়টা বেজেছে।
হিরণ পাশ ফিরে শুয়ে আছে।কিন্তু সে ঘুমায়নি।হঠাৎ করেই একটা ভয় পেয়ে বসেছে তাকে।খাপছাড়া ভাবে অনেক কিছুই ভেবে চলেছে সে।স্থিরভাবে কোনো কিছু মাথায় আসছে না।
-হির।ঘুমিয়ে গেছো।
-না।
-তাহলে এই সময় শুয়ে??
হিরণ কথা বলল না।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত।কিন্তু কেনো সে জানে না।কৃষ্ণ এবার বিছানায় উঠে হিরণকে এদিকে ঘুড়ালো।
-হির।কি হয়ছে।কাদছো কেনো।
হিরণ আবার শিশুর মত কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরল।
-হির।কি হয়ছে??কাঁদছো কেনো।
-আমার শ্যাম ঠাকুর ভেঙে গেছে কৃষ্ণ।
-আচ্ছা এইদিকে ফিরো।
কৃষ্ণ হিরণকে নিজের মুখের দিকে আনল।”তাতে কি?ওটা ঠিক হয়ে যাবে তো।”
-না কৃষ্ণ।আমার খুব ভয় লাগছে।আগে অনেকবার পড়ে গেছে তবে ভাঙেনি।আজ তার থেকে বেশি আমার ভয় করছে।খুব ভয়।জানি না কেনো।শ্যাম ঠাকুরের জন্য নয়।
-ধুর কি হবে।এত ভয় কেন পাচ্ছো।তোমার ঠাকুর তোমাকে পাপ দেবে না।
-না কৃষ্ণ আমি মজা করছি না।কিছু তো ঘটবে।যা ভাল নয়।
শ্যাম ঠাকুর সেদিন হিরণকে পাপ দিয়েছিলেন নাকি তা জানি না।তবে হিরণ ভয়ার্ত মুখের কথা ঠিকি ফলেছিল।অনেক কিছুই ঘটলো।
*****
কয়েকদিন পর হিরণ একটু স্বাভাবিক হয়েছে।জশোধারা আজ বাড়ি ফিরেছে।ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে শুয়ে আছে।অনেকদিন পর নিজের বিছানায় ভালই লাগছে।ভাবছে অনেক কিছু।চোখ বুজে বসলে স্মরণ হয় অনেক আগের কথা।তখন সে কিশোরী।ষোড়শী মেয়েদের মধ্যে চঞ্চলতা একটু বেশিই লক্ষনীয়।তখন বড্ড রাগি ছিল সে।একবার ঝগড়া করে বাবার কলাবাগান থেকে তৌড় হওয়া পঞ্চাশটা কলা গাছ কেটে ফেলেছিল।কিন্তু তার কোনো বিচার হয়নি।তার দাদুর এক কথা নাতনী আমার ঘরে লক্ষ্মী।তখনকার যোগে এমন আদর তাও আবার মেয়েদের,পাওয়া তো দুরে থাক কেউ ভাবতেও পারত না।
ভাবতে ভাবতে বেহুলার কথা মনে হচ্ছিল তার।বহুদিন কথা হয় না।হিরণের কাছে তো নাম্বার আছে।একবার নিয়ে আসা যায় তো।
১৩.
আজ হিরণ কৃষ্ণর সামনে দিয়ে হাটছে বার বার।কৃষ্ণ জানে কেন এমন করছে সে।
-হির।কিছু চাই??
-না তো।
-আচ্ছা??তাহলে এভাবে সামনে ঘুড়ছো যে।
-কই না তো।
-হির চল কিছু খাওয়া যাক।
-কি??
-মিষ্টি!!
বলেই কৃষ্ণ হিরণের দুই হাত চেপে ধরলো।হিরণ নিজের দিকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।ছটফট করছে না।পা ঘসছে মেঝেতে।কৃষ্ণ তার মুখটা তুলে ধরল।উপরে তুলতে লাগল।হিরণ চোখ বন্ধ করে ফেলল।পায়ের গোড়ালি থেকে শরীরের ভর আস্তে আস্তে আঙ্গুলে চলে এলো।
মধুকর মধু পিয়াসে ফুলের কাছে অপরাধী হলো।
কৃষ্ণ আস্তে আস্তে চোখ খুললো।।হিরণ ও চোখ খুললো।
-কৃষ্ণ।
দড়জার কাছে থেকে ভাঙা একটা পরিচিত গলা শুনে আতকে উঠল হিরণ।
****
বৃন্দাবন মেনশন।অনেকদিন আগে এসেছিল বেহুলা।হিরণ মানা করার পর আর আসেনি।চিনতে কষ্ট হয়নি তেমন নয়।বহুদিন পর জশো ফোন করল।তাই এখানে আসা।গেট দিয়ে ঢুকতেই হিরণকে দেখতে পেল।
-বাবাই।কেমন আছিস বাবাই।
-ভাল মা।
-জশো কোথায়।
-ভেতরে চলো।
হিরণের মুখটা কেমন যেন লাগছে।এ ছেলের কখন যে কি হয় কে জানে।ভিতরে ঢুকতেই জশোধারাকে দেখে চোখে জল চলে এল।বিপরীত দিকের চোখ দুটো অতি দ্রুত পিছন ফিরে গেল।বেহুলা অবাক হয়ে দেখছিল।জশো, এখনও মেয়েটার কোনো বদল হলো না।সেই আগের মতই আছে।তার থেকে বেহুলা নিজে বুড়িয়ে গেছে অনেকটা।হিরণ চুপ করে পাশে দাড়িয়ে।কৃষ্ণ এসে দাড়াল।
-বেহুলা।তুই জানিস আমার এখন কত টাকা আছে??
বেহুল হঠাৎ করে এই কথা শুনে হকচকিয়ে গেল।জশোধারা বলে চলেছে।
-তোর কোনো ধারণা নেই তুই কার সামনে দাড়িয়ে আছিস বেহুলা।আমি তোর ছেলেকে এখানে আশ্রয় দিয়েছিলাম।কিন্তু তুই আমাকে আগে বলিসনি কেনো যে তুই একটা হিজড়া জন্ম দিয়েছিস।
-জশো।কি বলছিস এসব তুই।
-জশোধারা।জশোধারা রায়।কল মি মেডাম।আমি এমন মানুষের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা যার ছেলে এমন।
জশোধারা ঘুরে দাড়াল।তিন জন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
-তুই কি আমার সাথে মজা করছিস জশো??
-অবাক হচ্ছিস??কষ্ট হচ্ছে?দমিয়ে রাখ।এখনও আমার কথা শেষ হয়নি।অবাক তো কাল রাতে আমি হয়েছিলাম।যখন তোর ছেলেকে আমি দেখেছিলাম।
****
সবটা শুনে বেহুলার পায়ের নিচে নড়ে উঠল।বুকে ব্যাথা করছিল।জশোধারা একটা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বেহুলার পায়ের কাছে ফেলে দিল।
-এগুলো রেখে দে।কাজে আসবে।যদি ও হিজড়া হয় তবে সারাজীবন বসে খাবে।আর যদি আদৌ ছেলে হয় তবে ওর মাথার চিকিৎসা করিয়ে নিস।চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।
বেহুলা অনেক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল।শুধু হিরণকে দেখছিল।যে ছেলেকে সে কখনো অধিকার দিতে পারল না তাকে সে আজ কি বলবে।কিন্তু জশোধারা আজ তাকে অনেক কিছুই শিখালো।চোখের জল মুছে সে টাকাগুলো তুলে নিল।হিরণের সামনে গিয়ে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে তাকে একটা থাপ্পড় মারল।
-আজ এমন হবে জানলে জন্মের পর মুখে লবন দিয়ে দিতাম।আর হ্যা মিসেস জশোধারা মেডাম।আমার ছেলেকে আপনার ছেলেও ভালবাসে।আপনি তা নিজের মুখে বলেছেন।টাকাগুলো আপনি রেখে দিন।যদি হিজড়া জন্ম দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার টাকার অভাব নেই।আর যদি সত্যি ছেলে হয় তবে এই টাকাগুলো দিয়ে তার চিকিৎসা হয় যাবে।আলাদা খরচের মানেই হয় না।
টাকাগুলো জশোধারার পায়ের কাছে ফেলে হিরণের হাতে ধরল।
-চল বাবাই।
১৪.
মাধব রায় নিজের ঘরে বসে আছেন।দুইমাস ধরে তার কিছুই আর ভাল লাগে না।জশোও ঠিক করে অফিসে যায় না।দাদুভাই খাওয়া দাওয়া করে না।বাড়ি যেন খা খা করছে।এখন আর মিষ্টি খেতে ধরা পরার ভয় নেই তবুও বুড়ো ফ্রিজের কাছে যায়নি এই দুইমাস।হিরণ চলে যাওয়ার পর থেকে বৃন্দাবনে যেন সেই আগের মত বাতাস বয় না।পুজো ঘরে প্রদীপ জ্বলে নাকি তাও জানা নেই।ওইমুখোও হয়নি এই দিনে।সেদিন মাধব রায় ঘুমিয়ে ছিল।ঘুম ভাঙল কৃষ্ণর শব্দে।প্রাণপণ চেষ্টা করছিল হিরণকে আটকাবার।হাতটা শেষে ছুটেই গেল।হিরণ শব্দ করেনি কাদেনি।তার চোখে ছিল মৃত লাশের চোখের মত শুন্যতা।
কিন্তু জশো এসব কি বলল।হিরণ কৃষ্ণ একজন আরেকজনকে ভালবাসে।এটা কি করে হয়।দুটো ছেলে আর এসব।মাধব রায়ের মাথায় এত কিছু যায় না।শুধু বুঝতে পারে কেউই ভাল নেই।কৃষ্ণ পাগল প্রায় হয়ে গেছে।জশো কারোর সাথে ঠিক করে কথা বলে না।হিরণের ভাঙা রাধাকৃষ্ণ এখনও মাধব রায়ের ঘরে।দুই মাসে এত কিছু হয়ে গেল।মাধব রায় মেনে নিতে পারছেন না কিছুই।তাদের ভালবাসা মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না।
*****
বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে জশোধারা।ঘরে দম বন্ধ লাগছিল।মাথায় বার বার একই চিন্তা আসছে।আচ্ছা কৃষ্ণকে কি বিয়ে দিলে এই সমস্যা সমাধান হতে পারে না??কিন্তু ডাক্তার তো বলেছে এটা প্রাকৃতিক জিনিস।কিন্তু স্বাভাবিক কেমন করে হতে পারে।হিরণ একটা ছেলে।মাথা কাজ করছে না জশোধারার।কৃষ্ণর সাথে কি একবার কথা বলবে??কিন্তু এই চেষ্টাতেও বিশেষ লাভ হয়নি।হিরণের কথা খুবই মনে পড়ছে।সেদিন আয়নার মুখ দেখার সময় লক্ষ্য হল সিঁদুর দেওয়া হয়নি।হিরণ থাকলে বাচ্চাদের মত হা করে বলতো,”একি বড়মা আজ সিঁদুর পড়নি কেন?মনে নেই??আচ্ছা তুমি একদিন মোটা করে সিঁদুর পড়তেও তো পারো নাকি।তুমি জানো তাহলে তোমাকে কত ভাল দেখায়।”
চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে জশোধারার।কিন্তু সে কেনো কাঁদছে।সে তো হিরণের কেউ নয়।যদি হতো তাহলে সে কেনো বের করে দিল ওকে।একবার কৃষ্ণর সাথে কথা বলা দরকার।বিয়ের কথা বলায় যায়।
****
-ডাক্তার বলেছে খাওয়ার সমস্যার কারনে শরীর দূর্বল হয়ে অজ্ঞান হয়েছে।তাই বাড়ি নিয়ে এসেছি বাবা।
মাধব রায় একটা সস্তির নিশ্বাস ফেললেন।কৃষ্ণ সন্ধ্যায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।জশোধারা নিচে এসেছিল তখন হঠাৎ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ছেলেকে।এখনও জ্ঞান ফিরেনি।তবে বাড়ি আনা হয়েছে।মাধব রায় আরামকেদারাতে শরীর এলিয়ে দিলেন।
-বোস মা।
জশোধারা সোজা মেঝেতে বসে কেদারার হাতায় মাথা দিয়ে কেদে উঠলেন।মাধব রায় নড়লেন না।মাঝে মাঝে কাদতে দেওয়া ভাল।কারন কান্না অনুশোচনার বহিঃপ্রকাশ।আজ পনেরো বছরে কখনো এভাবে কাদতে দেখেনি কেউ জশোধারাকে।স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক শক্ত হয়ে গেছে সে।মাধব রায় তার একটা হাত জশোর মাথায় রাখল।
-জশো কেনো এত কিছু করছিস।এই ব্যবসা এই ঘরবাড়ি এসব কার জন্য?সন্তানের জন্য।তার সুখ যাতে তাকে তাতেই থাকতে দে।যদি ভগবানের ঠিক করা ভাগ্যের উপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে তার পুজোর কোনো মানে হয় না।হিরণকে নিয়ে আয়।
-আমি কি করে মেনে নেবো বাবা।হিরণকেই বা কি করে ফিরিয়ে আনবো।আমি নিজে ওকে বের করে দিয়েছি।
-মেনে নে মা।যাদের জন্য এত কিছু তাদের খুশিটা দেখা আমাদের দায়িত্ব।তুই যা।দাদুভাইকে এখন হোনো ছাড়া কেউ সামলাতে পারবে না।
জশোধারা উঠে দাড়াল।মাথায় অনেক কথা ঘুড়ছে।অনেক কিছু জট পাকাচ্ছে।আচ্ছা আজ যদি কৃষ্ণর বাবা তার পাশে থাকত তাহলে কি কৃষ্ণ এমন হতো??আচ্ছা এটা কি সত্যি কোনো রোগ??নাকি ডাক্তার যা বলেছে তেমন।কিন্তু নিজের ছেলেকে এইভাবে দেখতে পারবে না।এখনও সে হিরণের নাম বলছে।
১৫.
দুটো মাস।কি থেকে কি হয় গেল।বাড়ি ছেড়ে দেওয়া।বেহুলার অসুস্থ হওয়া।অতঃপর মৃত্যু।বেহুলা মারা গেছে দেড় মাস হয়ে গেছে।নরপিশাচটা এতদিন বাড়ি ছিল না।ভাই বোন হোস্টেলে চলে গেছে।সত্য তার মামা বাড়ি গেছে।এমনিতে খোজ নেয়নি তারা কখনো মেয়েটার।নেহাত মামাতো বোনের বিয়ে বলে।তার উপর ছোট বোন।মামি যে তাকে ইচ্ছা করে নিয়ে গেছে বলা বাহুল্য।
হঠাৎ ঘরে ঢুকলো সুবাহু দে।বেহুলার স্বামী।কিছুদিন তাকে স্বাভাবিক দেখছে হিরণ।আজ আবার বাইরে থেকে খাবার নিয়ে বাড়িতে এসেছে।কাল সত্য রান্না করেছিল।আজ সে বাড়ি নেই তাই হয়তো এনেছে।টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে লোকটা ডাকল তাকে।
-হিরণ খেতে এসো।
-আপনি খেয়ে নিন।আমি পরে খাব।
-খেয়ে নাও না বাবা।আমাকে এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না??পাচ বছর পাড় হয়ে গেছে হিরণ।আমি আগের মত নেই।
হিরণ উঠে এসে খেতে বসল।সুবাহু জুস এগিয়ে দিয়ে নিজেও খেতে বসল।খাবার খেয়ে হিরণ উঠে যাচ্ছিল।তার হাত চেপে ধরল সুবাহু।
-জুসটা শেষ করে যাও।
হিরণ হাতটা সরিয়ে নিল।এখন সে আর ছোট নেই।সে এখন একজন যুবক।সুতরাং এই লোককে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।সে কথা ওই লোকটাও ভালই বুঝেছে।জুসটা খেয়ে হিরণ ঘরে চলে গেল।একটু পর সুবাহু তার ঘরে এলো।”একি আপনি এই ঘরে কেন?”বলে হিরণ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঘুরে গেল।
-হিরণ।ও বাড়িতে এত বছর একা থেকেছো।আমার কথা মনে হয়নি।আমাকে মিস করো নি।আমি করেছি।অনেক।ভাগ্যিস সত্য ছিল।আজ বহু দিন পর তোমাকে পেলাম।সুযোগ বার বার আসে না হিরণ।
-মানে কি..
সুবাহু হিরণের একটা হাত চেপে ধরল।”ছাড়োন আমার হাত।”বলে হিরণ হাত তো ছাড়িয়ে নিল।কিন্তু মাথা তখনও ঘুরছিল।আস্তে আস্তে মাথা ঘুড়ানোর পরিমান বাড়ছিল।ওদিকে সুবাহু বার বার এগিয়ে আসছে।
-আপনি কি মিশিয়েছেন খাবারে।
পিছিয়ে এসে হিরণ একটা স্টিলের ফুলদানী ছুড়ে মারল।কিন্তু তা সুবাহু কাছেও গেল না।হাত পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিল হিরণের।চোখে ঝাপসা দেখছে সব।মুখে কথা জড়িয়ে আসছিল।ঘর থেকে বেরিয়ে মুল দড়জাটা খুলতেই সুবাহু টেনে তাকে সোফায় ফেলে দিল।দড়জা খোলা পরে আছে।সেদিকে তার খেয়াল নেই।হিরণ আস্তে আস্তে শক্তিহীন হয়ে পড়ছে।সুবাহু তার হাত চেপে ধরেছে।হঠাৎ একটা পরিচিত নারী কন্ঠ শুনতে পেল হিরণ।ঝাপসা চোখে দুরের কাউকে দেখা যাচ্ছে না।হঠাৎ সেই নারী মূর্তি হাতে কিছু নিয়ে সুবাহুর মাথায় মারল।ঘটনার আকস্মিকতায় সুবাহু হিরণের উপর থেকে উঠার সময়ও পেল না।মাথায় লাগায় সে সরে গেল।হিরণ উঠে দাড়ালো।সদ্য দাড়াতে শিখা শিশুর মতো পা টলছিল তার।সেই নারী কাছে আসতেই তার চেহাড়া দেখে অস্পষ্টভাবে “বড়মা” বলে তার গায়ে অজ্ঞান হল হিরণ।
****
সোফার কাছে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সুবাহু।কিছুটা রক্ত বের হচ্ছে।
-আপনি আমার বাড়িতে ঢুকেছেন কেনো?আমাকে মারার সাহস হল কি করে।
মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা।তবুও উঠে দাড়াল সুবাহু।
-আমি পুলিশে যাবো।
হঠাৎ একটা থাপ্পড় এসে পড়ল ওর গালে।সোফায় পড়ে গেল সুবাহু।মাথা ব্যাথা বাড়ায় কিছু করতেই পারছে না।
-পুলিশকে বলে দিস তোকে জশোধারা রায় মেরেছে।ড্রাইভার।ড্রাইভার।
ড্রাইভার ঘরে ঢুকলো।
-দেয়াল থেকে ওই ছবিটা খুলে নাও।
জশোধারা হিরণকে নিয়ে গাড়িতে বসালো।
১৬.
জ্ঞান কখন ফিরল বুঝতে পারল না।চোখ খুলতে অনেক্ষন সময় লাগলো।চোখে আলো লাগছে।আস্তে আস্তে সব স্পষ্ট হতে লাগল।এই ঘর?সে তো হাসপাতালে ছিল।তবে কি মা তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এলো?হয়ত।সকাল হয় গেছে।রাতে হয়ত জ্ঞান ফিরেনি।উঠে বসল কৃষ্ণ।ঘড়ির দিকে তাকালো।আটটা বেজে গেছে।উঠে ফ্রেশ হয়ে এল সে।হিরণকে আজ সে আনতে যাবেই।হয় হিরণ বাড়ি আসবে নয়তো সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।কি পাপ করেছে সে।ভালবেসেছিল,হোক সে ছেলে।এটাই কি তার পাপ।মাও তাকে বুঝলো না।হঠাৎ একটা গানের গলা শুনতে পেল সে।চেনা লাগছে তবে বুঝা যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে কোথায় অনেক আগে শুনেছে।
ঘর থেকে বের হয়ে পুজোর ঘরের দিকে যেতে লাগল কৃষ্ণ।হ্যা সেখান থেকেই তো আসছে।কে গাইছে।আর পুজোই বা কে করছে।কৃষ্ণ পুজোর ঘরের দড়জার কাছে গিয়ে দাড়াল।
কিন্তু যা দেখল তা অভাবনীয়।জশোধারা লালপাড় শাড়ি পড়ে পুজো করছে।অবাক তো তখন হল যখন জশোধারা ফুরে তাকালো।মোটা করে সিঁদুর নাকে নথ ভারী গয়না।
-বড়মা
একটা ডাক।কৃষ্ণর পুরো শরীর কেঁপে উঠল।
-এই বাসি কাপড়ে ঠাকুর ঘরে যাচ্ছো কেন।বের হও।বের হও।
হিরণ।কৃষ্ণর চোখের সামনে দাড়িয়ে হিরণ।কৃষ্ণ এখনও কিছুই বুঝতে পারছে না।জশোধারা এবার হিরণকে নিয়ে বের হয়ে এলো।সাথে দাদুও।
-মা..
-আমাকে ক্ষমা কর বাবা।আমি হয়ত এখনও তোদের ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না।হয়ত মেনে নিতে সময় লাগবে।কিন্তু আমার এত পরিশ্রম তো তোর জন্যই।তুই খুশি না থাকলে আমি এসব দিয়ে করবো কি।
কৃষ্ণ মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলল।
-লাভ ইউ মা।র্যালি লাভ ইউ।
-হয়ছে ছাড়।এত বড় ধামড়া ছেলে কাঁদছে।
কৃষ্ণ হিরণের দিকে তাকাল।
-পাক্কা দুইদিন ঘুমিয়েছিস দাদুভাই।
কৃষ্ণ দাদুর কাছে হাটু গেড়ে বসল।
-দুদিন।
-হুম ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে গেছেন।
কৃষ্ণ উঠে দাড়ালো।অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।জশোধারা সামনের টেবিলে রাখা কিছু কাগজ তার হাতে দিয়ে বলল,”এই নে।”
-এটা??
-ভিসা পাসপোর্ট।ইন্ডিয়ার।
-কেনো।
-তোরা চলে যাবি।আমার সামনে থাকলে হয়ত আমার মন বদলে যাবে।তাছাড়া আমার কিছুটা সময়ের দরকার।তোরা চলে যা।যেদিন আমি এটা সত্যি গ্রহন করতে পারবো সেদিন নাহয় ডেকে নেবো।
জশোধারা আর দাড়াল না।উপরে চলে গেল।দাদুও নিজের ঘরের দিকে গেল।কৃষ্ণ হিরণের কাছে গা ঘেসে দাড়াল।
-বাহ।তুমি তো দেখি জাদুকর।মাকে পাল্টে দিলে।
-হুম।দেখলে হবে,খরচা আছে।এই জানো আজ কি??
-কি??
-আজ জাজমেন্ট ডে।ইন্ডিয়াতে আইন পাশ হয়েছে।৩৭৭ ধারা বদলে গেছে।
-হিরণ।
জশোধারাকে দেখে চমকে উঠল হিরণ।
-জ্বী বড়মা।
-তোর আর কিছু আছে ওই বাড়িতে।
-আমার….বড়মা।সতুদি।
****
প্লেনে জড়িয়ে ধরে বসে আছে হিরণ।অনেকে দেখছে।কিন্তু কৃষ্ণর কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না।হিরণ চোখ বুজে আছে।কৃষ্ণ পরম সুখে বুকে ধরে রেখেছে তাকে।
***পরিশিষ্ট***
বৃন্দাবন মেনশন।আজও সেই কোলাহলময়।সত্য আজ একবছর এখানে থাকে।বিয়ে ঠিক হয়ছে সামনের মাসে।অল্প সময়ে অনেক কাছের হয়ে গেছে।
-মাসি মা।মাসি মা।ওরা বাংলাদেশে এসে গেছে।এক্ষুনি চলে আসবে।
ওরা আজ ফিরছে।জশোধারা ফোন করছিল।মাধব রায় পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।সন্ধ্যা হয়ে গেছে।সকালের উড়ে যাওয়া ঘাস ফড়িং সাঝে ঘরে ফিরছে।
[যবনিকা]
সমপ্রেমের গল্প