
লেখকঃ-জরৎকারু দাশগুপ্ত
গল্পটা বছর পাঁচেক আগের, আমার বয়স তখন ২৫। একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করি। দেহরাদুনে এসেছি একটা প্রজেক্টে এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। মাস তিনেকের কাজ আছে। প্রথমটায় নতুন পরিবেশ এবং অচেনা লোকেদের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল। যার হাত ধরে সব মুশকিল আসান হয়ে গেল তিনি আমাদের প্রজেক্টের এসিস্টেন্ট সাইট ম্যানেজার পুলকিত সিং রাওত সাহেব। তার বয়স ওই বছর ৩২ মত হবে। লম্বা (ছয় ফুটের উপরে), চওড়া, পেশীবহুল, সুদর্শন রাজপুত ঘরানার চেহারা।
প্রথম দিন সাইটে তাকে দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ মেঘমন্দ্র একটা গলার স্বরে ঘোর কাটল। হ্যালো জরৎকারু আই এ্যাম পুলকিত সিং রাওত, ইয়োর ইম্মিডিয়েট বস। ইফ দেয়ার ইস এনি প্রবলেম, ডু কনভে মি ইম্মিডিয়েটলি।
চমক ভেঙ্গে বোকার মত জিজ্ঞাসা করলাম, হাউ ডু ইউ নো মাই নেম স্যা-আ-আ-র।
পুলকিত স্যার একটা ভুবন ভোলা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে আলতো করে আমার মাথার চুল ঘেঁটে দিলেন… এ্যাম আই নট সাপোসড টু নো ইয়োর নেম কিড? ইট’জ মাই ডিউটি টু টেক কেয়ার অফ দ্য প্রোজেক্ট এ্যান্ড দ্য এমপ্লয়ীজ ওয়ার্ক ওভার হিয়ার।
কিড সম্বোধনটা একেবারেই ভালো লাগল না। তবে ওর পার্সোনালিটির সামনে আমি নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ করছিলাম, ফলে প্রতিবাদ করা আর হয়ে উঠল না।
এর পর থেকে আমার সব সমস্যায় ওর থেকে সাহায্য পেতে লাগলাম। পুলকিত স্যার খুবই কেয়ারিং। সবার খোঁজ খবর নিতেন, আমাকে যেন একটু বেশীই ভালোবাসতেন। দুপুরে লাঞ্চ করেছি কিনা খোঁজ নিতেন, কাজের শেষে কখনো কখনো ওর এনফিল্ডে চাপিয়ে আমার মেস পর্যন্ত ছেড়ে আসতেন। ছুটির দিনে ওর এনফিল্ড চড়িয়ে আমাকে দেহরাদুন শহরের আনাচ কানাচ ঘুরিয়ে দেখাতেন। আমরা একে অপরের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। ওসব স্যার ট্যার বলা অনেক আগেই ঘুঁচে গেছে, আপনি আজ্ঞেরও আর বালাই নেই। বয়সে অনেকটা বড়, নাম ধরে তো আর ডাকতে পারিনা। শেষে ঠিক হল পুলক ভাইয়া বলে ডাকব। আমরা একে অন্যকে নিজেদের পরিবারের গল্প করতাম। ওর বিয়ে হয়েছে ২ বছর, বউ পেগনেন্ট৷ এখন বাপের বাড়িতে আছে। কথায় কথায় পুলক ভাইয়া জানতে চেয়েছিল আমার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা? মাথা নেড়ে না বলতেই মৃদু হেসে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেছিল… দেন বয়ফ্রেন্ড?! তারপর দুজনেই হেসে উঠেছিলাম।
দেখতে দেখতে কাটল দেহরাদুনের সোনালী দিনগুলি। আমার মেয়াদের তিনমাস প্রায় শেষ হয়ে এল। আর এক সপ্তাহের কাজ আছে এখানে। এরপর আমায় ফিরতে হবে কলকাতায়।
খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। উইক এন্ডে সকাল সকাল পুলক ভাইয়া আমার মেসে এসে আমাকে ওরকম মনমরা অবস্থায় দেখে তো হেসেই অস্থির… আরে পাগল, ইয়ে হোয়াটস এ্যাপ, ফেসবুক কা জামানা হ্যায়। তেরে আউর মেরে বিচ ফাসলা তো বহত হোগা, লেকিন ও এক সেলফোনসে জ্যাদা থোরিই না হ্যায়।
আমার কেমন কান্না কান্না পাচ্ছিল।
খাটের উপর শান্ত ভাবে বসে কান্না চাপার চেষ্টা করছি। পুলক ভাইয়া হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে পড়ল। তারপর চিবুক ধরে মুখটা তার মুখের সামনে নিয়ে এসে বলল… চল ছোটে তেরা মুড ঠিক করতে হ্যায়। মুসৌরি চলে? কথাটা বলে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার দিকে।
আমিও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। কি মায়াময় সে মুখাবয়ব! মাথাভরা হালকা কোঁকড়ানো চুল, জোড়া ভ্রু, পদ্মের পাপড়ির মত টানা টানা চোখ, খড়গের মত টিকালো নাক, অবিন্যস্ত গোঁফের নিচে পাতলা পাতলা দুটি গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট। কিছু উত্তর দিতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম ঝড়ঝড় করে।
সে আমার কপালে একটা আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বলল.. আবে পাগল হ্যায় ক্যা? চল ঘুমকে আতে হ্যায়। তেরি ভাবী কাল ঘর লওটনে বালী হ্যায়, চেক-আপ কে লিয়ে। আজ হি লওটনা জরুরী হ্যায়। চল জলদি জলদি নিকলতে হ্যায়।
আমি রাজী হয়ে গেলাম। দিনের দিন ফিরব। ফলে লাগেজের কোন বালাই নেই। ৩০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে দু ঘন্টা, ফিরতে দু ঘন্টা। মাঝে ঘন্টা চারেক সময় পাওয়া যাবে মুসৌরিতে ঘোরার।
আমরা পথে প্রকাশেশ্বর মহাদেব মন্দিরে দাঁড়ালাম। মুসৌরি রোডের ধারেই অপরূপ সুন্দর শিব মন্দির। অনেক দূর থেকে মন্দিরের অনেকগুলি লাল রঙের চুড়া দেখা যাচ্ছিল। পুলক ভাইয়া মন্দিরের সিঁড়িতে মাথা ঠেকালো। দেখাদেখি আমিও ঠেকালাম। তারপর সে আমার মাথাটা নিজের মাথার সাথে টুক করে ঠুকে দিল। ফিরে তাকাতেই দেখলাম তার মুখে একটা দুষ্টু হাসি, আমিও হেসে ফেললাম। আমরা উভয়েই নন্দী মুর্তির কানে কানে উইশ করলাম।
মন্দিরের বাইরে বেড়িয়ে এসে আমরা খাঁদের দিকে মুখ করে ঘাসের উপর বসলাম। কেউ কোন কথা বলছিলাম না। অদ্ভুত মুগ্ধতায় আমার ভেতরের খারাপ লাগা গুলিকে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে বার করে দিতে দিতে পুলক ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সে ও খাঁদের দিকে তাকিয়ে উদাসী ভাবে ধোঁয়া ছাড়ছিল। আমার মাথায় একটা দুষ্টুমি চেপে বসল। মুখ থেকে বেরোনো ধোঁয়া ওর মুখে ছড়িয়ে দিয়ে সাথে সাথে উঠে পালাবার চেষ্ঠা করলাম। ততক্ষণে ভাইয়া আমার হাত ধরে ফের বসিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজের মুখ আমার মুখের খুব কাছে এনে একরাশ ধোঁয়া আমার মুখের উপর ছেড়ে দিল। দুজনেই অনেক্ষণ ধরে হাসলাম।
আবার পথ চলা শুরু হল। এতক্ষণ সিটের শেষে যে ধাতব অংশটা থাকে, সেটি ধরে ছিলাম। এবার সাহস করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম পুলক ভাইয়া কে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর মাথাটা তার প্রশস্ত পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। বাইক চালাতে চালাতেই সে বাঁ হাত ঘুরিয়ে আমার মাথার চুলে একবার বিলি কেটে দিল। আমার কাছে সব স্বপ্নের মত লাগছিল। পাকদন্ডী বেয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। সারাদিন অনেক ঘুরলাম, ম্যাল, কেএমটি ফলস আরো অনেক অনেক জায়গা। ফুলে ফুলে ভরা মুসৌরি পাহার আর গায়ের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া হালকা ভিজয়ে দেওয়া মেঘ আমাকে যেন একটা কল্পনার জগতে নিয়ে গিয়েছিল। এবার ফেরার পালা। আমার একদমই ইচ্ছা করছিল না ফিরতে।
পথে আসতে আসতে শুনলাম রাস্তায় কোথাও ধ্বস নেমেছে। আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠল, কিন্তু পুলক ভাইয়ার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কাল ভাবী মানে ওর বৌ এর চেক আপ। যা মনে হচ্ছে আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। রাস্তা এত তাড়াতাড়ি ক্লিয়ার হবেনা।
আমরা একেবারে ডিনার সেরে এসে একটা হোটেলে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হবার দরকার ছিল। পুলক ভাইয়া বলেছে কাল সকালে খুব তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
আমি যে কোন পরিস্থিতিতে আজ রাতটা ওর সাথে কাটাতে চাইছিলাম। সেটা হয়ে যাওয়ায় বেশ রিল্যাক্সড ছিলাম।
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে আমি বার হতেই পুলক ভাইয়া ঢুকল। জামা কাপড় কিছুই আনিনি। এদিকে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ঠান্ডাও পড়ছে ভালোই। আমি খাটে উঠে কম্বল গায়ে জড়িয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমের দড়জায় খুঁট করে একটা শব্দ। পুলক ভাইয়া বেড়িয়েছে ফোনে কথা বলতে বলতে। বোধহয় ভাবীর সাথেই আজকের এই দুর্ঘটনা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমার চোখ আটকে গেল ওদিকে। এভাবে কোনদিন ওকে আগে দেখিনি। ভেজা চুল, গায়ে বিন্দু বিন্দু জল, প্রশস্ত রোমশ বুক, পেশিবহুল দুটি সুদীর্ঘ বাহু, মেদহীন পেটের শেষপ্রান্তে সুগভীর নাভি, পরণে সাদা রঙের একটি টাওয়েল ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
ফোন রেখে পুলক ভাইয়া আমায় বলল…চল ছোটে আব শো যা। কাল সুবহ জলদি জলদি নিকলনা হ্যায়।
একটু ভ্রুকুটি করে এবার প্রতিবাদ করলাম, ছোটে?! আমি যে আদৌ বাচ্চা নই সেটাই বলতে চাইলাম। পুলক ভাইয়া দড়াম করে লাফ দিয়ে আমার পশে এসে বসল। তারপর আমার মতই হেলান দিয়ে বসে কম্বলটা বেশ খানিকটা তুলে নিয়ে বলল… আচ্ছা… তো তু আব বাচ্চা নেহি রাহা!! উম্মম… মুঝে তো তুঝ মে বড়োওয়ালা কুছ ভি দিখাই নেহি দেতা!! একথা বলে ঠোঁটের কোনে একটা দুষ্টু মিষ্টি হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমিও চেয়ে রইলাম আচ্ছন্নের মত। আমার যেন সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। আচমকা কি যে হল…উঠে গিয়ে তার গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁটে আমার ঠোঁট লাগিয়ে একটা চুমু খেয়ে দৃঢ় ভাবে বললাম.. ম্যায় বাচ্চা নেহি হুঁ।
শুধু এটুকুই ঘৃতাহুতি বাকী ছিল বোধহয়। পুলক ভাইয়া চট করে আমায় বিছানায় পেড়ে ফেলে তার বিশাল শরীরটা আমার শরীরের উপর চাপিয়ে পাগোলের মত চুমু খেতে লাগল। সেরাতে আমরা উভয়ে উভয়ের শরীরের প্রতি ইঞ্চির হিসাব নিলাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই আমরা দেহরাদুন রওনা হলাম। পুলক ভাইয়া আজ সকাল থেকে যেন কেমন থম মেরে রয়েছে। কোন কথা হল না। আমিও সাহস করে কোন কথা বলতে পারছিলাম না। ফেরার পথেও একবার পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিলাম খুবই সংকোচের সাথে। আগের দিনের মত কোন প্রশ্রয় তো পেলামই না উলটে অস্বস্তি সুলভ একটা গা ঝাড়া দেওয়া অনুভব করে হাতটা সরিয়ে নিলাম।
বাড়ির কাছাকাছি এসে পুলক ভাইয়া খুবই নির্লিপ্ত ভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করল যে মেসে পৌঁছে দেবে, নাকি আমি চলে যেতে পারব? আমি আর কথা বাড়ালাম না। অস্ফুট স্বরে জবাব দিলাম… আমি চলে যাব।
ওদের বাড়ির গেটে আসতেই ভাবী ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন, তার চোখ কান্নাভেজা। কালকের ধ্বসের খবরে এমনিতেই বিচলিত ছিলেন। পুলক ভাইয়া ভাবীর কপালে একটা চুমু দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করল। ওদের এই আবেগ ঘণ মুহুর্ত কেন জানিনা আমাকে খুব কষ্ট দিল। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
ভাবী ভেতরে আসতে বলছিলেন। কিন্তু পুলক ভাইয়ার তরফে সেটুকু সৌজন্যও না পেয়ে আমি আর দাঁড়ালাম না।
গত কাল নিজেকে দুনিয়ার সবথেকে সুখী মানুষ মনে হয়েছিল। আজ অনুভব করলাম আমি যেন একেবারে নিঃস্ব। ফেরার পথে বারবার দু চোখ জলে ভিজে যাচ্ছিল। মনকে বোঝালাম, এক রকম ভালোই হল। যাবার সময় যতটা খারাপ লাগবে ভেবেছিলাম। ততটা বোধহয় আর লাগবেনা।
দিন শেষে সব পাখিই ঘরে ফেরে।
( সমাপ্ত)
সমপ্রেমের গল্প