
লিখেছেনঃ-পৃত্থুজ আহমেদ।
উৎসর্গঃ-রাজ চৌধুরী।
আজ একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙ্গল।ছুটির দিন বলেই আলস্য জড়িয়ে রেখেছে।অবশ্য ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার আরও একটা কারণ হল গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে।তাই খুব জম্পেশ একটা ঘুম হয়েছে।ইংরেজিতে যাকে বলে সাউন্ড স্লিপ। হা হা হা!
শ্রাবণের এই সময়টাতে বৃষ্টি কখন আসে কখন যায় ঠিক ঠিকানা নেই একদম।বিছানা ছেড়ে কলঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম।ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকাতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো রোদের প্রকোপে।হালকা শীত শীত করছে।
হাতে হুমায়ুন আহমেদের “শ্রাবণ মেঘের দিন” বইটা।এক পা এক পা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি।গন্তব্য ছাদে যাওয়া।অন্য হাতে অবশ্য এক পেয়ালা চা আছে।আসলে বই পড়ার সময় হাতে চায়ের পেয়ালা না থাকলে বই পড়া উপভোগ্য হয়ে ওঠেনা।ছাদে উঠে এক কোণায় আসন গেঁড়ে বসলাম।এখান থেকে আমাদের বাড়ির উঠোন এবং প্রধান ফটক খুব ভালভাবে লক্ষ্য করা যায়।আমাদের বাড়িটা বেশ পুরনো গোছের।জমিদার আমলে জমিদারদের বাড়ি ছিল এমন।অবশ্য আমার ঠাকুমার মুখে শুনেছি আমার পূর্ব পুরুষেরা নাকি জমিদার ছিলেন।বাড়িটার দেয়ালে শ্যাওলা জমা,পুরো দেওয়াল জুড়ে এখানে,ওখানে ছোপ ছোপ দাগ।কেমন একটা ভূতুড়ে পরিবেশ এই বাড়িতে বিরাজমান।তবুও আমার কাছে এই বাড়িটাই অত্যধিক প্রিয়।কেন জানিনা এই বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে থাকতে পারিনা।তাইতো পড়ালেখা শেষ করেও এই শেকড় আঁকড়ে পড়ে রয়েছি।শিক্ষকতা করছি এখানকার একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
বইটা বেশ আমেজ নিয়ে পড়া শুরু করেছি।দরজার খটখট আওয়াজে মতিভ্রম হল।ওদিকে দৃষ্টিপাত করলাম।বাইরে থেকে কেউ একজন দরজা ধাক্কাচ্ছে ভেতরে আসার জন্য।বৌদি এসে দরজা খুলে দিল।
শ্রাবণ দাদা এসেছে।বৌদিকে কীসব জানি জিজ্ঞেস করছিল।এখান থেকে শুনতে পারছিনা কী বলছে।অবশ্য আমার সেসব শ্রবণ করার খুব একটা ইচ্ছে নেই তারা কী বলছে।নিশ্চয়ই দাদার কাছে এসেছে।দাদার ব্যবসায়িক অংশীদার হল শ্রাবণ দাদা।
আমি পুনরায় বই পড়ায় মনোনিবেশ করলাম।কী জানি মনে করে আবার উঠোনে তাকালাম,দেখলাম শ্রাবণ দাদা নেই।মনে হয় দাদার কাছে গিয়েছে।আচ্ছা উঠোন থেকে প্রস্থানের পূর্বে কী শ্রাবণ দাদা কী আমার দিকে কিয়ৎক্ষণের জন্যও তাকিয়েছিল?কী জানি।তাকালেই বা কী,আর না তাকালেই বা কী!আবার বই পড়ায় মন দিলাম।
কতক্ষণ পার হয়েছে জানিনা।পেছনে কারো গলা ঝাঁকির আওয়াজে স্তম্ভিত হয়ে পেছন ফিরলাম।আমি গলার আওয়াজ শুনেই বুঝেছিলাম এটা কে।শ্রাবণ দাদা!
আমি তাকাতেই আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
বইটা এখনও তোর কাছে আছে?এখনও পড়ছিস বইটা? কত হাজার বার পড়া হয়েছে বলতো শরৎ?
এত হিসেব করে কী আর জীবন চলে শ্রাবণ দাদা?আর আমিত হিসেবে বরাবরই কাঁচা।জীবনের হিসেবেই তো গড়মিল পাকিয়ে রেখেছি।দিনশেষে প্রাপ্তির খাতা শূণ্য।সেখানে একটা বই কতবার পড়লাম সেটা কোন ব্যাপার না।কী আর এমন বড় ব্যাপার এটা।এত হিসেব করে আবার নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে চাইনা আমি শ্রাবণ দাদা।
শ্রাবণ দাদা হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,আজকাল তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনা শরৎ।কেমন দার্শনিকের মত কথা বলিস তুই।
এসব বোঝার সামর্থ্য তোমার নেই শ্রাবণ দাদা।কখনও সামর্থ্য ছিলও না তোমার কোন কিছু বোঝার,উপলব্ধি করার।কথাগুলো খুব শান্ত গলায় বলে চলে যাচ্ছিলাম তার সামনে থেকে।তখনই সে খুব করুণ স্বরে বলল,আমায় এখনও ক্ষমা করিসনি শরৎ?
আমি কিছু না শোনার ভান করে চুপচাপ সেখান থেকে চলে এসেছি।শ্রাবণ দাদা পেছন থেকে কয়েকবার ডেকেছিল।কিন্তু সে জানে সে তার আকাঙ্ক্ষিত উত্তর পাবেনা।
*
শ্রাবণ দাদাকে আমি ভালবাসতাম।হয়ত এখনও ভালবাসি তাকে।সেই কৈশোরের প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে আজ অবধি তাকে ভালবাসি।কেন ভালবাসি?তা নিজেও জানিনা।
শ্রাবণ দাদা আমার দাদার প্রিয় বন্ধু।সেই সুবাধে আমাদের বাড়িতে ছিল তার অগাধ বিচরণ।মা বাবার আরেকটা সন্তানের মতই সে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে সবার আদরের ছিল।আমার সাথেও শ্রাবণ দাদার ভালই খাতির ছিল।দাদা বাড়ি না থাকলে আমাকে নিয়েই শ্রাবণ দাদা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত।আমাদের প্রিয় জায়গা ছিল নদীর পাড়।তার সাথে বেশিরভাগ সময় নদীর পাড়েই কাটত আমার।শ্রাবণ দাদাকে আমি ভালবাসি সে তখনও জানত না।সে আমাকে নিছকই ছোট ভাইয়ের মত খেয়াল রাখত।সবকিছু নিজের মতই স্বাভাবিক নিয়মে চলছিল।
সেদিন শ্রাবণ দাদার বড় ভাইয়ের বিয়ের রাত ছিল।বাড়িতে অনেক আত্মীয়স্বজন থাকার কারণে শ্রাবণ দাদা আমার সাথেই ঘুমোতে এসেছিল।শ্রাবণ দাদার অনেক আত্মীয়স্বজনও আমাদের বাড়িতে এসে ঘুমিয়েছিল।তাই আমার দাদার ঘরে শ্রাবণ দাদা থাকতে চেয়েও পারেনি।
রাতে ঘুমের ঘোরেই হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি শ্রাবণ দাদার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত।ব্যাপারটা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আমার কাছে স্বর্গীয় সুখ মনে হচ্ছিল।তৎক্ষনাৎ মনে হয়েছে,আমি আমার ভালবাসা পেয়ে গেছি।শ্রাবণ দাদা আমার হয়ে গেছে।শ্রাবণ দাদাও আমাকে ভালবাসে।কামের ঘোরে সবটা উজাড় করে দিয়েছিলাম শ্রাবণ দাদাকে।
*
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্রাবণ দাদাকে কোথাও খুঁজে পাইনি।বিয়ের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ভেবেই আর আমলে নেইনি ব্যাপারটা।
ঠিক তার কয়েকদিন পর আমি শ্রাবণ দাদাকে নদীর পাড়ে খুঁজে পেয়েছিলাম।আনমনে বসে ছিল সেখানে।আমি তার কাছে গিয়ে তার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে চলে আসলাম।যাতে আমি মনের মাধুরি মিশিয়ে আমার ভালবাসা প্রকাশ করেছি।আমার বিশ্বাস ছিল শ্রাবণ দাদা আমার ভালবাসা গ্রহণ করবে তাই খুশিতে সারাদিন সারা গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছি।
সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরলাম তখন দাদা আমায় ডাকলো তার কক্ষে।আমি তার কক্ষে প্রবেশ করতেই দাদা আমাকে কষিয়ে একটা চড় মারল।দাদা এর আগে কখনও আমার গায়ে হাত দেয়নি।আমি অবাক হয়ে ছলছল দৃষ্টিতে দাদাকে প্রশ্ন করলাম,দাদা তুমি আমাকে কেন মারলে?
দাদা কিছু না বলে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল এসব কী?
দাদা আমাকে মারায় যতটা অবাক হয়েছি তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছি দাদার দেওয়া কাগজটা দেখে।কারণ,এটা আমার লেখা সেই চিঠিটা যেটা আমি সকালে শ্রাবণ দাদাকে দিয়েছি।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।আমার কিছু বলার নেই দাদাকে।কী বা বলব তাকে?আমি সমকামি?আমি শ্রাবণ দাদাকে ভালবাসি?বললেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে?
দাদা আমাকে অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করতে শুরু করল।আমি শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম।একটা পর্যায়ে দাদা আমাকে ধাক্কা দিয়ে তার কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে বলল,আর কোনদিন যেন তার সাথে কথা না বলি।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির বাইরে এসে দেখি শ্রাবণ দাদা দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখে আমার কাছে এসে বলতে লাগল,তুই মানসিক রোগী শরৎ।তোর চিকিৎসা দরকার।ছেলে ছেলে আবার ভালবাসা হয় নাকি?
আমি শ্রাবণ দাদাকেও কিছু বলতে পারিনি। ফ্যালফ্যাল করে অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।শুধু একটা কথা বলেছি তাকে,ছেলে ছেলে সহবাস করতে পারলে ভালবাসতে পারেনা কেন শ্রাবণ দাদা?
সে কিছু বলল না।চুপ করে হেঁটে চলে গেল।আর আমি তাকিয়ে রইলাম তার গমনপথে।
*
নিজের কক্ষে এসে ভাবছিলাম এতক্ষণ নিজের অতীতের কথা।নিজের ভালবাসার কথা।আমি কী খুব ভুল করেছি?ভালবাসা তো ভালবাসাই হয়।সেটা হোক সমলিঙ্গে।ছেলে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ে তে।ভালবাসার অমৃত ছোঁয়া যে একবার পায় সে যে জগতের সকল রস ভুলে যায়।ভুলে যায় ধর্ম,বর্ণ,সমাজ,সংস্কার,লিঙ্গ সবকিছু।ভালবাসা তো দুটি আত্মায় হয়।সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য কেন আসবে?
শ্রাবণ দাদা বোঝেনি আমার ভালবাসা।শোনেনি আমার আত্মার আর্তনাদ।সে সমাজের গোঁড়া নিয়ম গুলোকেই মেনে নিয়েছে।আর তার বলিদান হলাম আমি।আমার পুরোটা জীবন হেলায় কেটে গেল।অজস্র মানুষের প্রহেলিকার শিকার হলাম আমি।আমার দাদা আজ পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলেনা।এখনও আমার দিকে ঘৃণার চোখে তাকায়।অথচ,আমি শুধু ভালবেসেছি।ভালবাসার অপরাধে আজও আমি অবহেলিত।
শ্রাবণ দাদা আজকাল প্রায়ই আমার কাছে।ক্ষমা চাইতে আসে।প্রতিবার তার একই প্রশ্ন,ক্ষমা করেছিস আমায়?
আমি শুধু তাকিয়ে থাকি সেদিনের মত।কিছু বলিনা।এখন আর বলার মত কিছু নেই।বহু আগেই সবটা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।সব অপরাধ চাইলেই ক্ষমা করা যায়?হ্যাঁ শ্রাবণ দাদা অপরাধ করেছে।আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছে সে।আর আজ এসে ক্ষমা চাইলেই সাতখুন মাফ হয়ে যায়?জীবন তো এতটা সমতলে চলেনা।সবকিছু আমাদের হাতে থাকে না সবসময়।এমনকি ক্ষমাও করা যায়না সবাইকে মন থেকে।শ্রাবণ দাদার ক্ষেত্রেও তাই।
শ্রাবণ দাদাও বিয়ে করেনি আমার মত।কেন করেনি জানি না।কখনও জানতে চাইব না।সে কী আমার ভালবাসা বুঝতে পেরেছে তবে?অবশ্য বুঝলেও এখন আর কিছুই করার নেই।সবটা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।এখন আর কিছুই সম্ভব নয়।
টেবিলের উপর শ্রাবণ দাদার দেওয়া বইটার দিকে চোখ পড়ল।”শ্রাবণ মেঘের দিন”।একবার সবাই মিলে বই মেলায় গিয়েছিলাম।তখন শ্রাবণ দাদা আমাকে বইটা উপহার হিসেবে কিনে দিয়েছিল।সেই থেকে আজ পর্যন্ত বইটা কত যত্নে রেখেছি।শ্রাবণ দাদার শেষ সুখস্মৃতি।
বইটা হাতে নিলাম।হাত বুলিয়ে দেখছিলাম বইটার দিকে।দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল বইয়ের মলাটের উপর।কত স্বচ্ছ চোখের জল!
আশ্চর্য!আমি কাঁদছি!আজ কতবছর পর কাঁদছি।শেষবার শ্রাবণ দাদার আঘাতে কেঁদেছিলাম।এরপর থেকে কখনও কাঁদিনি।তবে আজ কেন?কেন আমার চোখে আজ শ্রাবণধারা?
বাইরে চোখ পড়তেই দেখলাম বৃষ্টি হচ্ছে।শ্রাবণের বৃষ্টি।চোখের জল মুছতে গিয়েও মুছলাম না।কেন জানি আজ মনে হচ্ছে,পড়ুক।সব অশ্রু আজ বিসর্জিত হোক আরও কয়েক মহাকালের জন্য।শ্রাবণের বৃষ্টির ধ্বনির সাথে দাদার ঘর থেকে রবি ঠাকুরের শ্রাবণের গানটা ভেসে আসছে,
শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে।।
সমপ্রেমের গল্প