
লিখেছেনঃ আরভান শান আরাফ।
বিঃদ্রঃ গল্পটি বন্ধু ‘নিবিড়’র জীবনের কথা থেকে নেয়া।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
গত দু’বছর আগে একটা পত্রিকায় আমার একটা আর্টিকেল বের হয়েছিল।যদিও তেমন লেখালেখি করতাম না।মাঝে মাঝে সামু ব্লগে একটু আধটু টু মেরে কিছু একটা লিখে আসতাম।বলতে গেলে এভাবেই লেখালেখির সূচনা আমার জীবনে।বন্ধু মহলে আমার ব্লগ প্রশংসনীয় ছিল।অবশ্য পত্রিকাতে লেখার ইচ্ছেটা ছোট মামার খেয়ালিই বলা যেতে পারে।উনি সাংবাদিক মানুষ।উনার মতে আমার লেখা অনলাইনে প্রশংসার যোগ্যতা রাখলেও অফলাইনে তার দু’আনা মুল্য নেই।
এক প্রকার বাজি ধরেই লিখে ফেললাম বাংলা সাহিত্যের পূর্ব ও আধুনিক অবস্থায় প্রেম ভালোবাসার দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে এক বিশাল আর্টিকেল।আর্টিকেলটা লেখার পর অনেকেই ফোন করে প্রশংসা করেছে।ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা তো রিতিমত বই লেখার যোগ্য বলে চাপাচাপিই শুরু করে দিল।পাশের বাড়ির রিয়া আপু তো আমার প্রশংসায় মুগ্ধ হয়ে তার বাড়িতে দাওয়াত খেতেও আমন্ত্রণ জানালো।আমি বাবা বকড়ে গিয়েছিলাম রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলাম ভেবে।আর মামা ধরে বসলো সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশাতে আত্মনিয়োগ করতে।কে শুনে কার কথা?
পরে অবশ্য অনেক জোরাজোরির ফলে রাজি হলাম তাদের সাপ্তাহিকে লিখতে।রাত্রে আমি মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখি।কিন্তু ঐদিন সাইলেন্ট করে রাখতে হয়তো ভুলে গেছিলাম।কারন একটা মুভি দেখছিলাম।আর মুভিটা ছিল সমকামী দুই কিশোরের কষ্ট নিয়ে।নামটা হয়তো,’গেট রিয়েল’ ই হবে।আমি সমকামী ছিলাম না।আজও হয়তো হ্যাঁ অথবা না কিছু বলবো না।তবে ঘৃণা ও করতাম না।মুভিটা দেখতে দেখতে রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল।তাই ভুলে গিয়েছিলাম।রাত তখন কয়টা মনে নেই।
মোবাইলটা বেজে ওঠল।আচমকা ঘুম থেকে জেগে স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা অচেনা নাম্বার,ধরিনি ফোনটা।সাইলেন্ট করে বালিশটা সোজা করে আবার শুয়ে পড়ি।উপনিষেদে পড়ে ছিলাম,নিদ্রানমঃ উত্তাম ইয়ুগে নিয়াশং।তাই ঘুম ভাঙিয়ে উপনিষেদকে অমান্য না করাই ভালো,যদিও না হিন্দু জাতির বই।সকালে ভার্সিটিতে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন আবার ফোনটা বেজে ওঠল প্যাতপোত শব্দে।আবার সেই অচেনা ফোন।বিরক্ত না হওয়া মহত্বের গুণ।কিন্তু আমি রাহুল কোন কালেই মহৎ ছিলাম না।
তবেনফোনটা ধরে হ্যালো করতেই ঐ পাশ থেকে একটা বলিষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,রাহুল আবির বলছেন?
-হ্যাঁ।আপনি কে ভাই?
-আমি আপনার ভক্ত।
-আমি তো চিত্রজগতের কেউ না।
-না।না আমি আপনার লেখার ফ্যান।
-ও।তাহলে ধন্যবাদ।যাক আমার লেখার ও ভক্ত আছে তাহলে?
-আছে মানে,আবার পরিবারের সবাই আপনার ফ্যান।
-হা হা হা হা।আপনার নাম কি ভাই?
-আমি রাজীব।
ফোনটা কেটে গেল।বুঝলাম ব্যালেন্স নেই।আমিও আর করলাম না।থাক আর ফ্যানের দরকার নেই।আমার প্যান,প্যান্ট আর ফ্যান সবি আছে।
ঐদিন বিকালের দিকে ছাদে বসে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ পড়ছিলাম।আবার ঐ ছেলেটা কল করলো।ফোনটা রিসিভ করলাম।সে’বার খুব আগ্রহ নিয়েই কথা বললাম।ছেলেটা খুব মিশুক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রাণ খুলে কথা বলল।আমার ভাল লাগলো।সে আমাকে দাওয়াত করলো তাদের বাড়ি একবার যেতে।আমার কেমন যে লজ্জা লাগছিল।তারপরে অনেক জোরাজোরির ফলে আর না পেরে হ্যাঁ বলে দিলাম যে কাল সন্ধ্যায় যাব।
সে বলল,এসে নিয়ে যাবে!
পরের দিন সন্ধ্যায় ভালো করে তৈরী হলাম।দাঁড়িয়ে ছিলাম বাইকটা নিয়ে মুল রাস্তার পাশে।প্রায় দশ মিনিট পরে সে আসলো।
আমি তাকে প্রথম চিনতে পারি নি।বয়সটা বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে না।আমার চেয়ে ছোটই হবে।ছেলেটার চোখ দু’টি কেমন অদ্ভুত মায়া ছিল।তার মধ্যে কেমন যেন সৌন্দর্যতা আমি খেয়াল করছিলাম।সে বাইক চালিয়ে এ দিকেই আসছিল।আমি নিশ্চিত ছিলাম এটা সে।সে কাছে আসতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমিও মনে হয় তাকিয়েই ছিলাম।
কিছুক্ষণবাদে সে লজ্জা চোখে বলল,আপনি তো খুব স্মার্ট।
আমি হাসলাম আর বললাম,আপনিও কম কিসে?
ঐদিন ইচ্ছে করছিল রাজীবের সাথে তাদের বাড়ি না গিয়ে কথা বলতেই থাকি।কিন্তু না,তার অনুরোধে ছুটতেই হলো।
সে আর আমি পাশাপাশি চলছিলাম।উভয় চুপ।প্রায় বিশ মিনিট পরে তাদের বাসায় পৌঁছলাম।তাদের বাসাটা দু’তলা।একটা পনের-বিশ শতক জায়খা বাউন্ডারি করা।চারপাশে গাছ।আর বাড়ির গেইট থেকে বাড়ি অবধি চিকন রাস্তা আর চারপাশে ফুল আর সবজি বাগান।দু’তলা খয়েরী রঙের বাড়িটার মুল দরজায় লেখা সুভাসন ভবন।তাদের বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমাকে দেখে অনেক আনন্দিত।আমার আগমনে ঘরের সবাই বেশি প্রফুল্ল।ঐদিন জীবনে প্রথম অচেনা কারো কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পেয়েছিলাম।গল্পটা এখানেই শেষ হলে ভালো হত।কিন্তু তা শেষ হয়নি।
ঐদিন বাড়ি ফিরে ভাল লাগছিল না একদম।ইচ্ছে করছিল রাজীবকে ফোন দিতে।তাই দিলাম।সারা রাত কথা হলো।জীবনে প্রথম কারো সাথে এতো কথা হলো।রাজীবের প্রতিটি কথা ভাল লাগতে শুরু করলো।তাকে মিস করতে লাগলাম প্রবল থেকে প্রবল ভাবে।সেও মিস করা শুরু করলো।আমাদের পারস্পারিক মিস করা কবে যে এককে অন্যের বানিয়ে দিল তা খেয়ালি করতে পারি নি।প্রতি বিকালে দু’জনে ঘুরতে যেতাম।অনেক দূরে।হাতে হাত রেখে হাঁটতাম।কখনো আবেগে জড়িয়ে ধরতাম।ভাল লাগতো তাকে জড়িয়ে ধরতে।
সবুজ ঘাসে সে আমার বুকে মাথা রেখে শুতো।আমার ভাল লাগতো।তার হাসি,তার অভিমান আমার ভাল লাগতো।ভাল লাগতো তাকে রাগাতে।ভাল লাগতো গাল ছুঁয়ে দিতে।কখনো তাদের বাড়ি চলে যেতাম।দু’জনে এক সাথে গাছে পানি দিতাম।পানি নিয়ে দুষ্টমি করতাম।তার পরিবার আমার পরিবার হয়ে গেল।ভুলেই গেলাম যে আমার বাবা মা নেই।মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো বাড়ি না ফিরতে।হ্যাঁ আমি সমকামে আসক্ত ছিলাম না।তারপরেও তাকে ভাল লাগতো।ইচ্ছে করতো তার ঠোঁট দু’টি ছুঁয়ে দিতে।ইচ্ছে করতো তার শরীরে প্রচন্ড শিহরিত হয়ে আদরের চাদর জড়িয়ে দেই।
ইচ্ছে করতো তাকে চিল্লাইয়ে বলি,রাজীব ভালবাসি তোমায়।মাঝে মাঝে ভয় পেতাম,কারন আমি যদি আমার ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটায়।তবে আমি হবো সমাজ আর ধর্মের কলঙ্কিত পুরুষ।আর তাকে যে জীবনেও পাব না নিজের মতো করে সে ভয়ও মনকে আতঙ্কে ভরিয়ে দিত।তবে ভালো লাগতো রাজীবকে।ভাল লাগতো তার সাথে কথা বলতে।কিন্তু এই সহস হয় নি যে,তাকে বলি,আমার মনের কথা।গত বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে।তখন তো খুব শীত।শীত আমার বড় অপ্রিয় ছিল।এখন হয় তো শীতটাই প্রিয়।আমি আর রাজীব শীতের কাপড় পড়ে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম ফুসকা খেয়ে।
আমার হাতটা রাজীবের হাতে ধরা ছিল।বাড়ি ফিরতে ফিরতে কুয়াশা ঘন থেকে ঘন হয়ে যাচ্ছিল।ঐদিন রাজীব প্রথমবারের মতো আটকালো তার সাথে থাকতে।আমি আর মানা করি নি।রাজীবের রুমে গিয়ে দু’জনে এক সাথে বসে টিভি দেখলাম।দু’জনে পাশাপাশি বসা।আমার হাতটা ওর হাতে হাতে।আমি হাতটা চেপে ধরে আছি।রাজীব বারবর আমার দিকে তাকাচ্ছিল।
সে বলে উঠল,রাহুল!তুমি সারা জীবন আমার সাথে থাকবে তো?
আমি একটু মুচকি হেসে তার দিকে ফিরে বললাম,কিভাবে?
সে বলল,ভালবেসে।
আমার জানি না কি হয়েছিল।আমি তার দু’গালে দু’টো হাত রেখে,চোখে চোখ রেখে বললাম,থাকবো।কারন আমি তোমায় ভালবাসি।
কথাটা বলে তার কপালে আলতো করে একটা কিস করলাম।এটাই আমার প্রথম চুম্মন।রাজীব আমাকে জড়িয়ে ধরলো।তার ঘনশ্বাস আমার গর্দানকে উষ্ণ করে দিচ্ছিল।
আমি তাকে বললাম,রাজীব!তোমাকে আদর করবো?
রাজীব মুচকি হেসে বলল,কীভাবে?
আমি অট্টহেসে বললাম,দাঁড়াও,দেখাচ্ছি।
তাকে ধাক্কা মেরে বিছানাতে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ঠোঁটে চুম্মন করতে লাগলাম।
সেই সুখ যা রাজীব আমাকে দিল তা বর্ণনা করার শক্তি নেই।সেটা ছিল আমাদের ভালবাসা।কেউ সেখানে কাম পেলে বলব তা কাম না।তা আমাদের প্রেম।আমি তো রাজীবকে আমার সবটা দিয়ে শুরু থেকেই ভালবেসে আসছি।আজও বাসি।আর সারা জীবন বাসবও।আমাদের সম্পর্কের এক বছর চলে গেল।আজও সেই প্রথমদিন সাক্ষাতে তাকে যেমন ভালো লেগেছিল তেমনি ভাল লাগে।আজও তার স্পর্শে প্রথম দিনের মতো প্রেম অনুভব করি।তাকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন।সে হয়তো আমার জন্যে প্রেরিত ঈশ্বরের কোন অবতার।আর তাকে পাবার শিহরণ স্বর্গীয়।প্রতিদিন সকালে সে যখন মেসেজ করে আজও বলে,ভালবাসি তোমায় বন্ধু।তখন মনে হয় এ আমার শ্রেষ্ঠপ্রাপ্তি।আজও মাঝরাত ঘুমের ঘোরে বলে উঠি,ভালবাসি তোমায়,রাজীব।খুব ভালবাসি।
সমপ্রেমের গল্প