
লেখকঃ-পৃত্থুজ আহমেদ
উৎসর্গঃ-ফুয়াদ হাসান ফাহিম
———————————-
এ কী হিমু?তুমি এসব কী করছ?
ফাহিম তুমি আগামিকাল চোখের ডাক্তারের কাছে যেও আমার সাথে।আমার এক বন্ধুর বাবা অনেক বড় চোখের ডাক্তার।সমস্যা নেই,একদম কম খরচে তোমার চোখের চিকিৎসা করিয়ে আনব।
মানে কী হিমু?তোমাকে আমি কী জিজ্ঞেস করেছি আর তুমি কীসব হযবরল বকে যাচ্ছ।
তুমি দেখতে পাচ্ছ না আমি কী করছি?আমি পড়ছি তুমি দেখেও কোন আক্কেলে জিজ্ঞেস করলে আমি কী করছি।
সিরিয়াসলি হিমু!তুমি পড়ছ?মানে টেবিলের উপর বসে পড়ে কীভাবে মানুষ? তোমাকে পড়ার জন্য চেয়ারে বসতে হবে তারপর বইটা টেবিলে রেখে পড়তে হবে।তোমাকে আর কতবার বারণ করতে হবে টেবিলে বসার জন্য?
আমি মানুষ তোমাকে কে বলল?ফাহিম তুমি নিজেই তো আমাকে বলো আমি নাকি এলিয়েন।আর তাছাড়া টেবিলের উপর বসা ছাড়া আমার পড়া হয়না।
হিমু সত্যিই তুমি না একেবারে অদ্ভুত একটা চরিত্র মাইরি।
এক মিনিট ফাহিম,তুমি এক্ষুণি কী বললে আবার বলো তো!
কী বললাম আমি?আমি অবাক হয়ে হিমুর দিকে তাকিয়ে আছি আর হিমু সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে করতে আমার সামনে চলে এলো।আমি আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম,কী বলেছি আমি হিমু?
এই যে তুমি একটু আগে বললে না মাইরি না কী যেন একটা শব্দ।এটা কী ধরণের কথা?না মানে এসব কারা বলে জানো তো?এসব তো বখাটে ছেলেদের মুখের ভাষা।
হ্যাঁ।আমি আবার কখন ভাল মানুষ হলাম?হিমু তুমি নিজেই তো আমাকে বলো আমি নাকি বখাটে।
হিমু কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল।আসলে তার আর বলার মত কিছু নেই।সে তার নিজের কথার জালে ফেঁসে গিয়েছে।তাই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে আমার হাতে বইগুলো দিয়ে হনহনিয়ে রুমের বাইরে চলে গেল।হিমুর এই ফোঁস করাটা আমি চিনি।খুব পরিচিত।আজকে কপালে কী আছে জানিনা।তবুও কিয়ৎক্ষণ পূর্বের ঘটনায় ক্রমান্বয়ে হাসি পেয়েই যাচ্ছে।
*
খুব মনোযোগের সহিত বসে খেলা দেখছি।বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।হিমুকে দেখলাম টেবিলের উপর বসে পড়ছে।আজ এমনিতেই আমার সাথে কথায় হেরে গিয়ে বেচারা ক্ষেপে আছে।তাই আর তাকে না ঘাঁটিয়ে এসে খেলা দেখায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করলাম।একটুপর হিমু আসলো।এসেই আমার থেকে রিমোট চাইল।
রিমোট দিয়ে তুমি কী করবে হিমু?
আমি কার্টুন দেখব এখন।
মানে কী?দেখতে পাচ্ছ না আমি খেলা দেখছি!খেলা শেষে দেখো।
না আমি এখনই দেখব কার্টুন।আমাকে রিমোট দাও।
আমি তোমাকে এখন রিমোট দেব না হিমু।।আমার সাথে পারলে বসে খেলা দেখো,নাহয় গিয়ে ঘুমোও।
হিমু আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমার বাম পাশে এসে বসল লক্ষ্মী বাচ্চার মত।আমি খুব একটা অবাক হইনি।আমি জানি,হিমু মনে মনে রিমোট হাতানোর কোন ফন্দি আঁটছে।তাই আমি রিমোট টা শক্ত করে ডান হাতের মুঠোয় ধরে রাখলাম।
হিমু ধীরে ধীরে আমার আরও পাশে ঘেঁষতে লাগল।আমি সোফায় হেলান দিয়ে পা উপরে তুলে বসে আছি।হিমু আমার আরও কাছে ঘেঁষতে লাগল।এক পর্যায়ে হিমু তার একটা হাত আমার পিঠের কাছ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আমার টি-শার্ট তুলে আমার পেটে আলতো করে হাত বুলিয়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল।আমি বুঝতে পারছি আমি হিমুর জালে ফেঁসে যাচ্ছি।যতটা পারছি দূরে সরে আসার চেষ্টা করছি।কিন্তু খুব একটা লাভ হলনা।কারণ আমি সোফার একেবারে শেষপ্রান্তে।হিমুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।হিমু কিন্তু থেমে নেই।সে আমার গলার কাছে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল।তার একটা হাত আমার হাতের উপর রাখল পেট থেকে সরিয়ে।আর আমার ঘাড়ে তার ঘন নিঃশ্বাসের প্রবাহ তো চলছেই।যেই হাতে রিমোট ছিল সেই হাতটা যেই তুললাম হিমুর গাল স্পর্শ করার জন্য অমনি হিমু রিমোট টা ছিনিয়ে নিয়ে সোফার অপর পাশে এক লাফে চলে গেল।তারপর হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি ফাহিম।আমার হাসি পেল।মনে মনে বললাম,তোমার কাছে হেরে গিয়ে যে কতটা তৃপ্ততায় আমি পূর্ণতা পাই তা যদি তুমি জানতে হিমু!একবার না,হাজারবার তোমার কাছে হাসিমুখে পরাজয় বরণ করতে রাজি আমি।অথচ,মুখে এমন একটা ভাব রেখেছি যেন আমি হেরে গিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছি।
*
হিমু রিমোট নিয়ে ডোরেমন দেখতে শুরু করল।অগত্যা আমাকেও এই বুড়ো বয়সে কার্টুন দেখা লাগছে তার সাথে বসে।হিমুর মুখে রাজ্যজয়ের হাসি।সে খুব মনোযোগ দিয়ে কার্টুন দেখছে।আর আমি দেখতে লাগলাম হিমুকে।আমার হিমু।কী নিষ্পাপ চেহারা।যেন জগতের কোন পাপ কখনও এই মুখশ্রী স্পর্শ করেনি।হাজার বছর হিমুর পানে তাকিয়ে থাকলেও তাকে দেখার সাধ মিটবেনা।এক নিমেষেই পার করে দেওয়া যাবে শত সহস্রাধিক জন্ম হিমু মুখ পানে চেয়ে।কোন ক্লান্তি কখনও স্পর্শ করবেনা।হঠাৎ লক্ষ্য করলাম,হিমুর চোখেমুখে কেমন বিরক্তি নেমে আসছে।আমার দিকে কেমন করুণ দৃষ্টিতে তাকাল।আমি বুঝতে পারলাম পাগলটার সমস্যা কোথায় হচ্ছে।আমি হাতদুটো উন্মুক্ত করে দিলাম।হিমু একলাফে এসে আমার বুকে ঢুকল।আমি পরম মমতায় জড়িয়ে নিলাম আমার এলিয়েন হিমুকে।
হিমু আমার বুকে মাথা রেখে কার্টুন দেখতে লাগল।দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে ডোরেমন নবিতার বন্ধুত্বের গল্প।একটা দৃশ্যে দেখাচ্ছিল নবিতা ডোরেমনের জন্য কান্না করছে।হিমু সেটা দেখে আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।যেন ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাব।একটুপর,বুকের কাছে ভেজা অনুভব করলাম।বুঝতে পারলাম,আমার পাগলটা কাঁদছে।এই হিমুটা আসলেই বাচ্চাদের মত।আমি হিমুর চোখের জল মুছে দু’গালে দুটো চুমু দিলাম।এরপর,তাকে কোলে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগোলাম।হিমুকে শুইয়ে দিয়ে আমিও তার পাশে তাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।জানালা দিয়ে হিম বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে বিধায় হিমুর ঠান্ডা লাগছিল।তাই হিমুর গায়ে কাঁথা টেনে দিলাম।হঠাৎ হিমু ডাকল,
ফাহিম!
হুম বলো হিমু।
না কিছুনা।
আমি একটু নিচু হয়ে হিমুর মুখটা দু’হাতে আলতো করে তুললাম।হিমুর চোখ ছলছল করছে।দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ার আগেই হিমু দু’চোখে দুটো চুমু দিলাম।আস্তে আস্তে হিমুর ঠোঁটের কাছে মুখ নিলাম।হিমুর ঠোঁটদুটো মুখে তুলে নিলাম।হিমুর ঠোঁটের স্বাদ যেন জগতের সকল অমৃতকেও হার মানায়।এই ঠোঁটে যখন ঠোঁট রাখি জগতের সকল স্বাদ বিষাদ ভুলে যাই।।যেন স্বর্গীয় অনুভূতি পাই।আচ্ছা স্বর্গ কী আমার হিমুর চাইতেও শান্তিময়?
আমি অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি।হিমু এখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।ইচ্ছে করেই ঘুম থেকে ডেকে তুলিনি হিমু কে।গতরাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে।এখন একটু ঘুমোক।আমি রেডি হয়ে হিমুর কপালে লম্বা একটা চুমু দিয়ে সারাদিনের উষ্ণতা সঞ্চয় করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
*
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতে গিয়ে দেখি হিমু ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।আমি বাসায় না গিয়ে সোজা ছাদে চলে গেলাম।ছাদে হিমু ছাড়া আর কেউ নেই।আমি গিয়েই হিমুকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরলাম।হিমু ঘুরে আমাকে জড়িয়ে ধরল।সে এখন এভাবে আমাকে আরও কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখবে।এটা তার নিত্যকর্ম।সে আমার গায়ের ঘামের গন্ধ নেয়।রোজ আমি অফিস থেকে ফিরলে হিমুকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকতে হয়।সে প্রাণভরে আমার গায়ের গন্ধ উপভোগ করে।হিমুর এসব পাগলামো দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয় যদি মৃত্যু না থাকত!যদি নশ্বর এই পৃথিবীতে সকল প্রেমিক অবিনশ্বর হয়ে থাকত তাহলে কত ভাল হত।একটা কোকিলের মিষ্টি সুর স্মরণ করিয়ে দিল বসন্ত চলছে এখন।আহা!কত সুন্দর মূহুর্ত।কোন সমকামি কবি এই দৃশ্যের স্বাক্ষী তার কলমের আগায় কাগজে বন্দি করে নিতেন পঙক্তির মাখামাখিতে।কত শত কবি,লেখক,প্রেমিক এই মূহুর্তে এই বসন্ত উপভোগ করছে তাদের প্রিয় মানুষদের নিয়ে।
আর আমি জড়িয়ে আছি আমার জীবনের বসন্ত কে।আমার হিমুকে।যার আগমনে শীতের রুক্ষতার ফাটলে আমার জীবনে আগমন ঘটেছে নব বসন্তের।
সমপ্রেমের গল্প