
লেখকঃ-পৃত্থুজ আহমেদ
উৎসর্গঃফুয়াদ হাসান ফাহিম
তড়িঘড়ি করে বাসায় ঢুকতে গিয়ে দরজার ছিটকিনির সাথে লেগে হাতটা কেটেই।ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।তবুও এসবে তোয়াক্কা না করেই বাসায় ঢুকলাম।বাসায় সম্ভবত কেউ নেই।আমাকে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকতে দেখে বুয়া কিছু না বলেই হাত দিয়ে আমার কক্ষের দিকে ইশারা করল।দৌঁড়ে কক্ষে প্রবেশ করতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ!
এ কী!হিমু টেবিলের নিচে বসে কফি খাচ্ছে! তাও আবার কফিতে বিস্কুট চুবিয়ে!কী জঘন্য খাবার!আমাকে দেখেই বিস্কুট টা মুখে পুরে দিয়ে গোগ্রাসে গিলতে গিলতে কফিতে মুখ রাখল হিমু।এমন উদ্ভট কাজ করাই হিমুর স্বভাব।এমন কোনো অদ্ভুত কাজ নেই যা হিমু করেনা।ওর এসব কাজের প্রভাবে বাসার সবাই মোটামুটি অতিষ্ঠ বলা যায়।একমাত্র আমিই আছি যে এসবের নিরব দর্শক।তাই হিমু এসব উদ্ভট কাজকর্ম সুযোগ পেলে আরও বেশি করে করে।ওর নাকি টেবিলের নিচে বসে কফি খেতে ভাল লাগে।এতে নাকি ও কফি খাওয়ার প্রকৃত স্বাদ অনুভব করে।কী অদ্ভুত!টেবিলের নিচে বসে কেউ কফি খায়?
হিমু জানে এসব আমার অপছন্দের।আমার সামনে আজকাল এসব কাজকর্ম করতে পারেনা বিধায় আমি বাসায় না থাকলে সুযোগটা কাজে লাগায়।এসব উদ্ভট কাজ পাগলামো করতে গিয়ে হিমু নিজেই আহত হয়।তবুও সে এসব করবেই।
একটু আগেই বাইরে গিয়েছিলাম এক প্রয়োজনে।কাজটা শেষ করলাম সবে।তখনই বুয়া ফোন করে বলল,হিমুর হাত কাটা গেছে।বাসায় কেউ নেই,তাই আমাকে আসতে বলল।আমার আসতে খানিকটা দেরিই হয়ে গেছে।এর মধ্যে মনে হয় হিমু ফার্মেসি তে গিয়েছে।ওর হাতে ব্যান্ডেজ দেখছি।সেজন্যই হন্তদন্ত হয়ে আসতে গিয়ে আমার হাতটাও খানিকটা কেটে গেছে।কিন্তু বাসায় এসে হিমুকে এই অবস্থায় দেখে আমার প্রচন্ড রাগ হতে থাকল।মেজাজ চরমভাবে বিগড়ে গেল।তবে রাগটা অন্যভাবে ঝাড়তে হবে।প্রথমে হিমুকে টেবিলের নিচ থেকে বের করে,জড়িয়ে ধরে থাকলাম।হিমু হয়ত আশা করেছিল আমি ওকে বকা দেব।তাই সে খানিকটা অবাকই হল।বুক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে খুব শান্ত গলায় বললাম,হিমু তোমার হাতটা কীভাবে কাটা গেছে?হিমু হাত দুটো পেছনের দিকে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে।আমি ওকে আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পেলাম না।তারপর,খুব জোরে ধমক দিলাম।
কথা বলছ না কেন হিমু?
ইয়ে,মানে ফাহিম আসলে আমাদের পাশের বাসার বিড়ালটা আমাদের বাসায় এসেছিল তখন।আর বিড়ালটা এতটাই কিউট যে দেখলেই ধরতে ইচ্ছে করে।তাই আমি বিড়ালটাকে তাড়া করেছিলাম ধরার জন্য।কিন্তু ধরতে তো পারলামই না,উল্টো পড়ে গিয়ে কীসের সাথে লেগে যেন হাতটা কাটা গেছে বুঝতে পারিনি।
হিমুর কথা শুনে আমার প্রচন্ড হাসি পেল কিন্তু হাসি চেপে রাখছিলাম তবুও।মুখে কঠিন একটা ভাব এনে হিমুকে যথেষ্ট বকাবকি করে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম।
আসলে হিমুর কোন কষ্টই আমার সহ্য হয়না।ওর এসব পাকামোর জন্য ও নিজেই কষ্ট পায়।আর ওর কষ্ট হলে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হয়।তাই ওকে বকলাম।ওকে বকে এখন আমার নিজেরই খারাপ লাগছে।বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে।
*
রাত তিনটা!
ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি।বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে।কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।আমি জানি,হিমুও জেগে আছে।কারণ আমি কিংবা হিমু কেউ কাউকে ছাড়া ঘুমাতে পারিনা।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে রান্নাঘরে গেলাম।এক কাপ কফি বানিয়ে হিমুর কাছে গেলাম।দেখলাম,ব্যালকনির মেঝেতে দু পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে হিমু।আমি কফি মগটা রেখে হিমুর সামনে গিয়ে হাঁটুগেড়ে বসলাম।ওর ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু দিলাম।তারপর,ওর হাতের কাটা জায়গায় ঠোঁট বুলাতেই ও কেমন শিউরে উঠল।আমার হাতের দিকে নজর পড়তেই ও কেমন আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল,তোমার হাতে কী হয়েছে ফাহিম?এই বলে আমার হাতে হিমু হাত ছোঁয়াতেই হালকা ব্যথা অনুভূত হল।শিউরে উঠলাম।
হিমু আবারও জিজ্ঞেস করল,কী হয়েছে হাতে?
আসলে তখন বাসায় ঢুকতে গিয়ে…….
হিমু এটুকু শুনেই আমাকে স্যরি বলা শুরু করল।আমি একটু হাসলাম,হিমুকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলাম।
কিছুক্ষণ পর,বুকে হালকা ভেজা অনুভূত হল।বুঝতে পারলাম হিমুটা কাঁদছে।আমি হিমুকে ছাড়িয়ে নিলাম।ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম,কফি খাবে?
হিমু অবাক হল এমন কথা শুনে।ও মাথা নেড়ে না বলল।
আমি আবারও বললাম,টেবিলের নিচে বসে কফি খাবে?
একথা শুনে পূর্বের তুলনায় আরেকটু বেশিই অবাক হয়েছে।সাথে সাথেই ফিক করে হেসে দিল।
*
আমি আর হিমু দুজনেই বসে আছি টেবিলের নিচে।একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছি।এক চুমুক আমি আর এক চুমুক হিমু।আমরা একসাথে যখন চা কিংবা কফি খাই তখন একটা কাপেই খাই।হিমুর মতে,এতে পরস্পরের ঠোঁটের স্পর্শ পাওয়া যায়।আর পরস্পরের প্রতি ভালবাসাও নাকি বাড়ে।কী অদ্ভুত যুক্তি দিল হিমু। ঠিক এখনও আমরা এক কাপে কফি খেয়ে সেই স্বাদটা অনুভব করছি।আর মাঝেমাঝে একটু একটু লিপকিস তো আছেই।যেটা কফির স্বাদ আরও বাড়িয়ে তুলছে।
আমি মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই হিমুর এসব পাগলামোতে সায় দেই পাগল বশে রাখার চেষ্টায়।মাঝেমধ্যে একটু রাগ হলেও হিমুতে কখনও আমার ক্লান্তিবোধ হয়না।বিরক্তিও আসেনা।যুগের পর যুগ এভাবেই আমি হিমুর পাশে থেকে যেতে পারব কাঠফাটা রোদ্দুর কিংবা হাঁড়কাঁপানো শীতেও।সামান্যতম অবসাদ কখনও আমার আর হিমুর ভালবাসায় অন্তরায় হবেনা।আরও হাজার হাজার বছর পরেও যদি হিমু এসে সামনে দাঁড়ায়!তখনও ঐ একটা বুলিই আওড়াবো,ভালবাসি হিমু।খুব ভালবাসি।