
ইসায়েদ
“ইতি, রূপবান” এখন আমাদের কমিউনিটির মাঝে। খুশির ব্যাপার যে আমরা আরেকটা বইয়ে নিজেদের অব্যক্ত কথা বলতে পারলাম। যেহেতু আমি এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিলাম, তাই আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি (প্রথমবার নয়), এই বই কার জন্য, কি জন্য? বইটার সম্পাদকীয়তে বলা আছে বইটা লেখার “মূল উদ্দেশ্য, আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া দুজন সহযোদ্ধার সর্বশেষ অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করা।” অন্য ভাষায় বলতে গেলে, “ইতি, রূপবান” জুলহাজ-তনয়ের প্রতি আমাদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতিফলন। এটা আমাদের জন্য যারা ভালবাসার অতীতকে বর্তমানে স্থায়িত্ব দিতে চেয়েছি, মন্দিরায়ন করেছি। তবে আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি (প্রথমবার নয়), বইটা করে কমিউনিটির কি লাভ হলো?
মূল উদ্দেশ্যর পাশাপাশি, সম্পাদকীয়তে বলা আছে যে বইটা প্রকাশের মাধ্যমে আমরা যৌন ও লিঙ্গবৈচিত্র্য প্রকাশের আন্দোলনের “চাকাকে সচল রাখতে চাই আর বিচার চাই লেখালিখি কিংবা মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিটি আক্রমণের।” এই কথাগুলা আমার কাছে ঝাপসা লাগে। নিজেকে প্রশ্ন করি (প্রথমবার নয়), এই আন্দোলনের চাকাটা কি? কোথায় সে ঘুরে, কোন রাস্তায়? আর বই প্রকাশের সাথে বিচারের কি সম্পর্ক এই মুহূর্তে? আমি বলছিনা যে সাহিত্য চর্চার সাথে সামাজিক আন্দোলনের কোন সম্পর্ক হতে পারে না। আমি বলতে চাচ্ছি যে সাহিত্য আর আন্দোলনের মধ্যে কোন প্রাকৃতিক সম্পর্ক নেই। সম্পর্কটা তৈরি করতে হয়, নাহলে সাহিত্য চর্চাও হতে পারে জুলুমের হাতিয়ার (উদাহরণ স্বরূপ বুর্জোয়া সাহিত্য, উপনিবেশিক সাহিত্য নিয়ে অনেক ভালো বিশ্লেষণ আছে)।
আমাদের মধ্যে অনেকে বই পেলেও, খুব কম মানুষ বই পড়ছে। যারা বই পড়ছে, তাদের মধ্যে আরও কম মানুষ কুইয়ার লেখালিখির বিশ্লেষণ করছে। এটা সত্যি যে আমাদের সাংস্কৃতিক কাজের একটা সামাজিক প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই প্রয়োজন মিটাতে কুইয়ার সংস্কৃতি, সমাজ, এবং রাজনীতি নিয়ে কয়েক ধরনের গভীর আলাপ দরকার, যা এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না (হয়তো আমারই দৃষ্টিবাধকতা?)।
সার্বিকভাবে চিন্তা করতে গেলে, পরিষ্কার বিশ্লেষণের অনেক বিষয় আছে। যেমন, প্রথমত ভাবা লাগবে আমরা কোন কুইয়ার মূল্যবোধগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে মানুষের সামনে হাজির করছি। দ্বিতীয়ত, এই মূল্যবোধগুলো ধারণ করার মত পরিপক্বতা কুইয়ার কমিউনিটির নিজের মধ্যে আছে কিনা (না থাকলে কেন নেই)। তৃতীয়ত, এই জল/ভূমি অঞ্চলের পূর্বের এবং বর্তমানের সাংস্কৃতিক চর্চার ধারাগুলির সাথে আমাদের মূল্যবোধের মিল এবং তার সাথে যুক্ত হয়ে নতুন কুইয়ার শিল্পচর্চার উদ্ভাবন করার সম্ভবতা।
এই তিনটি ব্যাপারে আমাদের বর্তমান বইগুলির, লেখালিখির মূল-মনোভাব অস্পষ্ট। এর প্রধান কারণ, আমার চিন্তায়, হলো আমরা বাঙ্গালি হিটেরোদের সমাজে অত্যাচারিত এবং আমরা সেই নির্যাতনের ও দুঃখের জায়গা থেকে সংস্কৃতি চর্চা করছি। তাই আমাদের কাজে এবং কাজের প্রক্রিয়ায় উপলব্ধি কম, রাগ/জেদ বেশি; যৌক্তিক চিন্তা কম, আবেগ বেশি; সৃজনশীলতা কম, অনুকরপ্রবণতা বেশি; খুলনা, বরিশাল, ঢাকার রাস্তাঘাট কম, স্টোনওয়াল আর দূতাবাসগুলি বেশি। এক এক জন নিজেদের নিয়ে সুন্দর এবং আবেগবহুল গল্প-কবিতা-পারফরমান্স রচনা করছি। কিন্তু এই বিক্ষিপ্ত “আমার” গল্পগুলো থেকে আরও প্রসারিত “আমাদের” সাহিত্ত-আন্দোলনের দিগন্তের দিকে আমরা কি হাঁটতে পারি?
২/২/২০২০