
বৃষ্টির গতি কমে গেছে।আমিও কাকভেজা হয়ে বাড়ি এসে গেছি। রেইনকোট খুলে রাখতে গেছি ; ঝনাৎ করে শব্দ হল পকেট থেকে।
একি তার খুলে রাখা হাত ঘড়িটা আমার পকেটে রেখে গেছে।
অজস্র সময় রেখে গেছে আমার তরে।ভাবতেই কেমন গোলাপি গোলাপি লাগছে সবকিছু।
এমন করে তো আগে বুঝায়নি কেউ এ অনুভূতি । এ অনুভূতি তারাই বুঝে যারা খুব কাছ থেকে ভালবাসার চিহ্নগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে।
আমি কি পেরেছি? নাকি পারছি!
জেগে উঠা রাতের প্রহর শেষ হল।
ফুটফুটে সকাল।বৃষ্টির ধারায় যেন প্রকৃতির সব কুলষ ধুয়ে নিয়ে গেছে।
প্রতিটি পাতা যেন নব নব গান গাইছে।
আমার এমন লাগেনি আগে;
***
আজ একমাস পর ভার্সিটি যাচ্ছি।তার জন্য; যার অপেক্ষায় থাকে প্রতিটি মানুষ। প্রতিটি অবস্থানে থাকা মানুষ।
৩০ মিনিটের পথ যেন মহাকাল পাড়ি দিচ্ছে আজ।
গন্তব্য ছুঁই ছুঁই করছে আমার পদযুগল।
আজ ক্লাসে যাব না ;সে নিয়তে বরকত আজ।
আমি তো জানি সে কোথায়।তার লেখা আদ্র চিরকুটটি আমার কাছে।
আদালত পাড়ায় আমি এসে গেছি। কিন্তু সে কোথায়? বাড়ির নম্বর, এমনকি বোকার হস্তির মত আমি তার নামও জিজ্ঞেস করিনি।
কোথায় খুঁজি এবার?
অজানা গন্তব্যে পথ হাটছি।বলাইবাহুল্য এমন সুন্দর রাস্তা আর দালানগুলো এত সুবিন্নস্ত যে তার মত এমন কাব্যিক, হেয়ালি প্রেমিক মানুষ হবেই তো।
গলিগুলো সরু হলেও কেমন যেন মায়াকারা।
সামনেই সরু চারটি রাস্তার মোড় । মোড়ের মধ্যিখানে শীলকড়াই গাছ বাঁধানো । এমন জায়গাই অপেক্ষা করার জন্য উত্তম।
বৃষ্টির পর সব ময়লা ধুয়েমুছে তকতকে হয়ে আছে শহর।
বসে আছি অনাবিল সুখের আশায়।তাকে পাব বলে……..
***
কেউ পেছন থেকে চোখ চেপে ধরেছে।আমি বিন্দুমাত্র না ভেবে হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে অলক্ষ্যের মানুষটিকে সামনে আনলাম।
আসমানী রঙের পাঞ্জাবি পরে কোন এক স্বপ্নকুমার দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।
আমি তাকিয়ে আছি যেন বহুদিন বৃষ্টি হয়নি এধরায়।শুষ্ক কাটফাটা রৌদ্রের এক শীতল পরশ এনে দিচ্ছে সে।
আমি জড়িয়ে ধরেছি গভীর অনুরাগে।
আমার চোখেরকোণে জমে গেছে লবনাক্ত একসমূদ্রের সফেন।
নিজেদের সংবরণ করে নিলাম।আলিঙ্গণ শেষে তার মুখ অবয়বে হাত রাখলাম। সে কি মায়া সে চোখে,মুখে।
যে নিকষকালো কোন বাঁশঝাড়ের শ্রান্ত ছায়া।
যার ছায়ায় কাটিয়ে দেওয়া যায় অনন্তকাল।
নিরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম,”কি নামে ডাকবো তোমায়?
– লোকে তো ডাকে জিহান।আর তোমায়?
– আমায় ডাকে আশিক বলে।
– কার আশিক?
– যখন যার,তার।(একগাল হাসি দিয়ে)
– এখন থেকে আর যার তার নয়।সে শুধু আমারি থাকবে।
– থাকলাম।
“যতদিন কৃষ্ণচূড়ায়, পলাশে আগুন ফুটবে,
যতদিন শীলকড়াই ফুল সবুজে কিংবা গোলাপিতে গন্ধ ছড়াবে//
***
আমি একটা বিষয় এখনো পরিষ্কার না সেটা হচ্ছে; তুমি আমাকেই কেন? বা সে সন্ধ্যে বেলা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বা গেলে কেন? ঠিকানাটা ওভাবে লেখলে কেন?
এত এত প্রশ্নে মাথা গিজগিজ করছে।
– শুনবে?
– হুম; সে আগ্রহ সবার মনেই রয়ে গেছে।
– আচ্ছা, বলছি। তোমার মনে আছে মাস খানেক আগে, ভার্সিটিতে একটা ছেলের সাথে ঝামেলা হয়েছিল তোমার।
– হ্যা,মনে আছে। রোকন ছেলেটা আমার সিনিয়র সে আমার এক বন্ধুর সাথে অসভ্য আচরণ করেছিল।
– হ্যা,সেদিনই তোমাকে আমার ভাল লাগে।তোমার বন্ধুটা একটু মেয়েলী ছিল। তাকে সবার সামনে রোকনটা কিভাবে র্যাগিং করতেছিল( বলতেও আমার রাগ হচ্ছে)।সেও তো মানুষ নাকি।তারপর তুমি কোত্থেকে এসে বীরের মত ব্যাপারটাকে সামলালে।সেদিন শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত গিয়েছিল। ছেলেটার চোখের জলে কি যে আকুতি ছিল বলে বুঝানো যাবেনা। সে মেয়েলী হয়েছে, এতে তার কোন হাত নেই,দোষ নেই।
তবুও এ সমাজ তাকেই বিদ্রুপ উপহার দেয় পদে পদে। আর তুমি তাকে দিলে একটা মর্যাদা।কয়জন পারে এমন করে!” সমকামী” নিজেকে বলা যায় কিন্তু সেটার অন্তর্নিহিত ব্যাপারটা আমরা বুঝিনা।আমরা বুঝি শুধু দুটো ছেলের শরীর। নয়তো প্রেম প্রেম খেলা।মন ভাঙ্গা গড়ার খেলা।
আমরা যদি একে অপরের সম্মান রক্ষা করে চলতে না পারি তবে কিসের সমকামী। সমকামীরা ধ্বংস হয় নিজের অহংকারে আর অন্যকে হিংসে করে।
– তুমি ঠিক বলেছ। বুঝেছও ঠিক। তবে আমি যে সমকামীই হব সেটা বুঝলে কিভাবে?
– আসলে সেটা তো আর বাইরে থেকে বুঝা যায়না।তবে এটুকু বুঝেছিলাম তুমি ভেতর থেকে সত্যনিষ্ঠ সমকামী না হলে এমন করে প্রতিবাদ করতে না।অনেক সমকামীরা ও করেনা।
– হবে হয়তো।আর এ কারনেই একমাস কলেজে যাইনি। রোকনটা খুব ভয়ানক বাজে ছেলে।আমাদেরও ওর থেকে এড়িয়ে থাকতে হবে।নয়তো রোকনের মত লোক আমাদেরকে হেনস্থা করতে ছাড়বেনা।
– আর আমি তোমায় খুঁজতে খুঁজতে সেদিন বৃষ্টির মধ্যে তোমার পেলাম।আমি কল্পনাও করতে পারিনি এতটা কাব্যিক হবে আমাদের দেখা। জানো; তোমার ঠিকানা কেউ বলতে পারেনি। শহরের এতটা ভেতর থেকে গিয়ে তুমি ক্লাস কর ভাবা যায়না।
তারপর; এক স্যারের মাধ্যমে অফিস থেকে তোমার ঠিকানা পেলাম।
তারপর তোমায়;
– আমিও যে তোমাকে এভাবে পাব ভাবিনি।আজ থেকে আমাদের নতুন পথচলা। প্রতিটি দিন হবে আমাদের।আমরা পথ হাঁটব আফটার নভেম্বর রেইনে।
একগাল হেসে দুজনেই হাতে হাত রেখে চলছে রাস্তা।
***************** (সমাপ্ত) *************
লেখকঃ পরিশ্রান্ত পথিক
প্রকাশেঃ সাতরঙা গল্প