অদৃষ্টের পরিহাস

অরিত্র হোসেন

কুড়ি বছর বয়সে জীবনের এক কুৎসিত রূপ দেখতে পাবো সেটা আঁচ করতে পারিনি। দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠা জীবনটা এখন তেজপাতার মতো। আগুনের কাছে নিলেই নিমিষে শেষ। একেকটি রাত কাটানো যেন মৃত্যুর কাছে হামাগুড়ি দিয়ে নয় খরগোশের গতিতে এগিয়ে যাওয়া। এই বুঝি তারা এলো, এই বুঝি তারা আমায় শেষ করতে এলো। ‘আমায়’ পরিবর্তে ‘আমাদের’ বলা সঠিক হবে। কাকে কখন আক্রমণ করবে এ ব্যাপারটা নিয়ে পুরো গোষ্ঠী জুড়ে ভয় কাজ করছে। ইতিমধ্যে তথাকথিত জ্বিহাদীগণ তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা, তারাই রাজত্ব করে। অবশ্য প্রমাণ করবার চেষ্টা করতে হচ্ছে না; সমাজে ভালোভাবে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তারা এখন বীর পুরুষ। দুটো সমকামী হত্যা হয়েছে? বেশ! কারোর কোন ক্ষোভ নেই। তারা সমকামী ছিল কি ছিল না তাতে কি? তারা তো সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতো। তো, যা করা হয়েছে সেটা নিয়ে সাধারণ জনগণের মাথা ব্যথা নেই। সমাজে অনেক গুরুতর বিষয় আছে যেটা নিয়ে তাদের ভাবতে হয়। আর সুশীল সমাজের কাজ হল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ আর হালকা বিষয় নিয়ে কুঁদাকুঁদি করা।

মিডিয়াতে রঙচঙ দিয়ে জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি প্রচারিত হচ্ছে। হাস্যকর! আমার অসংখ্য অভিযোগ আছে। অভিযোগ থাকার বড় এবং শক্ত কারণ দু’টো মানুষকে অত্যন্ত কাছ থেকে আমি দেখেছি। এককালে কাজও করেছি। তাদের মূল পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ভিন্ন পথে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারী দলের লোকেরা বিরোধী দলীয় ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। চতুর্দিকের পরিবেশ দেখে দম বন্ধ হয়ে যায়। আচ্ছা, মিডিয়াকে সব সঠিক সত্য তথ্য দেওয়া কি আমার নৈতিক দায়িত্ব? দিলেও বা কি? তারা সঠিক তথ্যকে সবার সামনে উপস্থাপন করবে? আপনি দেশের ও বিদেশের সংবাদগুলো ঘাটতে পারেন। বিরাট পার্থক্য পাবেন। বিরাট! দেশের সংবাদ পত্রিকাগুলো ‘সমকামী’ শব্দটা লিখতে ভয় পায়। সরকারী দলের এক নেত্রীর নিকটাত্মীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী এমব্যাসির একজন কর্মকর্তা হিসেবেই জুলহাজের ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা করা হচ্ছে। আর অপরদিকে তনয়ের পরিচয় হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে তিনি জুলহাজের বন্ধু এবং নাট্যকর্মী। অবশ্য এ-কথা আমি অগ্রাহ্য করবো না যে দেশী কোন পত্রিকায় সমকাম অধিকার সম্পর্কিত সাময়িকী ‘রূপবান’ নাম আসেনি। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। অবাক করবার বিষয় হলেও এই বিশাল ঘটনার কারণে এক আত্মহত্যার কাহিনি চাপা পড়ে গেলো। ঘটনার দিন আমাদের গোষ্ঠীর এবং বয়েজ অব বাংলাদেশের সাবেক এক ভলেন্টিয়ার আত্মহত্যা করে। দুটো ঘটনা অবশ্য বিচ্ছিন্ন। ছেলেটা দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় ভুগছিল। পরিবারের কাছে নিজের পরিচয় সম্পর্কিত সবকিছু বলে দিলে তারা তাকে চিকিৎসার জন্য উঠেপড়ে লাগে। চারপাশের পরিস্থিতি সহ্য না করতে পেরে ছেলেটা জন্মদিনের দিন নিজের আত্মাকে মুক্তি দেয়। গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া ব্যাপারটি বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখনও অজানা। একে বলে নিয়তি।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি মুহূর্তেই পুরো গোষ্ঠীকে মাটিতে ফেলে পিষে মেরে ফেলেছে। পরিস্থিতি নাজুক। কারোর সঙ্গে কারোর যোগাযোগ নেই। সবাই নিজেকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত। মুহূর্তেই অধিকার আদায়ের জৌলুশ কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। মাথায় একটাই চিন্তা, ‘নিজেকে রক্ষা কর’। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব হচ্ছে? যে দেশের সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদেরকে অগ্রাহ্য করে; আমাদের অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের কাছে কি করে সহায়তা চাইবো? আমাদের জীবন হুমকির মুখে, তাতে কি? আমি কি পুলিশের কাছে কি কারণ দেখিয়ে সাহায্য চাইব? লেখক এখানে নীরব। তার কাছে উত্তর নেই।

বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে একটা বিশাল ব্যাপার চোখে ভেসে উঠে সেটা হল সমর্থক ক্রাইসিস। গুটি কয়েকজন ছাড়া পুরো দেশের মানুষ আমাদের বিপক্ষে। সমকামীতা সম্পর্কিত সবধরনের বিষয়ের বিপক্ষে। কিন্তু সেটা আমাদের ব্যর্থতা বলে দায় নিবো না কারণ আমরা এগুচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে সমাজকে আমাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলাম। খুব মন্থর গতিতে এগুচ্ছিলাম আমরা। ম্যাগাজিন, কমিকস, নাটক, কবিতার বই সহ বিভিন্ন প্রকাশনা আর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্বকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সব ভেস্তে গেলো। গত ১০-১১ বছর ধরে চলে আসা প্রক্রিয়ায় বিশাল ধাক্কা। এক ধাক্কায় হুড়মুড় করে সবাই পড়ে গেলো। পড়ে যাওয়ার বেশিরভাগ মানুষগুলো অধিকার নিয়ে কাজ করতে জীবনেও উদ্বাহু হবে না। সব খায়েশের দুঃখজনক সমাপ্তি।

‘গোষ্ঠীর কোন কর্মী কেন কথা বলছে না? কেন তাদের অবস্থান পরিষ্কার করছে না’ – এমন অনেক প্রশ্নের মুখে আমরা। হত্যাকাণ্ডের পর কেউ একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। কিন্তু সবাইকে তো দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যোগাযোগ বিচ্ছিনতার প্রভাবে অনেকে নিজ দায়িত্বে কথা বলার পণ করলেও শেষমেশ জানের ভয়ে উদ্যত হয়নি। মাঝেমধ্যে নিজেদের বিপদ নাচতে নাচতে ডেকে নিয়ে আসি আমরা। কমিউনিটির এক ছেলে কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে ‘NDTV’কে সাক্ষাৎকার দিয়ে বসে। সেখানে সে এমন কিছু কথা বলে যা আমাদের জন্য এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে বলা বেশ ক্ষতিকর। ওদিকে ‘রূপবান’ সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদের এক ব্যক্তি হত্যার হুমকি পেয়েছে। তার বাসায় হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সে কোথায় কাজ করে, কি ধরণের কাজ করে চিঠিতে সেটার বিবরণ আছে। দু’জন মেরে তো চুপচাপ বসে থাকবে না তারা। আরও মারবে। খুঁজে খুঁজে মারবে। বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে। প্রত্যেকজনের খুঁটিনাটি তথ্য বের করে তারা তালিকা করেছে। পরিকল্পপনা মোতাবেক এগুচ্ছে। তাড়াহুড়া করে নয়, দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের ৮দিন পর জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ ৪ মে তাদের ওয়েবসাইটে ৫ পৃষ্ঠার ‘স্টেটমেন্ট’ প্রকাশ করে। হত্যার উদ্দেশ্য, তাদের সফলতা, রূপবানের কার্যক্রম এবং এলজিবিটি মুভমেন্টে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার কথা স্টেটমেন্ট এ পাওয়া যায়। তারসঙ্গে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশী ইংরেজি সংবাদপত্র ‘ঢাকা ট্রিবিউন’কে কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দেয়। বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আমরা কি করবো, কি করবো না; কে নিরাপদ, কে নিরাপদ নয়; পরবর্তী পদক্ষেপ কিরূপ হবে, সব প্রশ্নের উত্তর এখন – শুন্য!

তারা যা চেয়েছিল তা পূরণ করতে পেরেছে? জ্বিহাদীগণ তাদের কর্মে সফলতা পেয়েছে? আমি বলবো, পেরেছে। তারা ভেবেছিল গুরুকে কর্তন করলে শিষ্যরা আপনাআপনি অন্তরালে চলে যাবে। কিন্তু গুরু তো একটা নয়! সব গুরুকে না মেরে তারা শান্তি পাবে না। আর ‘গুরু-শিষ্য’ শব্দ দুটো নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভুল শব্দ প্রয়োগ করে কাহিনি রচনা করায় ব্যস্ত তারা। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পুরো কমিউনিটিকে উলটপালট করার খায়েশ তাদের অবশ্য সফল হয়েছে। কমিউনিটির ভীতু প্রকৃতির মানুষগুলো অতো সহজে লোকালয়ে এসে নিজের দাবি-দাওয়া নিয়ে জোরালো কণ্ঠে বলার সাহস পায়নি। ধীরে ধীরে উদ্দীপনা জাগ্রত হয়েছে। সময় লেগেছে। যেই না কথা বলা শুরু আর ওমনেই জ্বিহাদীদের কতললীলা শুরু। বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ডিসক্রিট মনুষ্যগুলোর মধ্যে গুটি কয়েকজন সামনে আসতে শুরু করেছিল। দিন দিন ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক ঘটনায় সব শেষ! সব প্রকার প্রক্রিয়ায় এখন বিশাল সাইজের ‘ফুলস্টপ’ সংকেত জ্বলজ্বল করছে।

আমি এতোটুকুই বলবো, কুড়ি বয়সে বিরাট বাধার মুখে পড়েছি। নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে লেখালেখি করেছি, প্রয়োজনে আত্মগোপন করেছি। অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সমাজের ভৎর্সনা শুনেছি। তারপরও কাজ করার স্পৃহা নষ্ট হয়নি। দিনে দিনে আরও শক্ত হচ্ছিলাম, আরও মজবুত হচ্ছিলাম। সব কিছু ছারখার হয়ে গেলো।
আপনজনদেরকে খুন হতে দেখেছে এই কুড়ি বয়সী তরুণ। আর সে কিছুই করতে পারছে না। মানুষ দুটোকে এক নজর দেখে আসতেও পারলো না। কিসের ভয়? নিজের জানের ভয়? পুলিশ দেখবে, ঘাতকরা দেখবে – এমন ভয় কাজ প্রত্যেকটা শিরায় শিরায় ঢুকে গিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদও করতে পারছি না। কেন? যদি আমায় চিনে ফেলে? আমি যদি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই?

ক্ষমতাহীন এই কুড়ি বয়সের তরুণ কিছুই করতে পারছে না।

করুণ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তোলন করবে কে? আমরা কি অধিকার আদায়ের কাজ থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হয়ে গেলাম? জানের ভয়ে আরও কয়েক বছর পিছিয়ে গেলাম? কতদিন দমিয়ে রাখতে পারবে তারা? ধারালো অস্ত্র দিয়ে কলমকে ধ্বংস করা, এটাই কি তাদের উদ্দেশ্য? লেখকের শির কেটে ধর্মকে উদ্ধার করা? ধর্ম কবে থেকে সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করলো? না ধর্মের দোহায় দিয়ে আত্মতৃপ্তিতা ভোগ করা?

ভাগ্যের কেরামতির কারণে আজ বেহাল দশা, আমাদের। এই সমাজের। এই রাষ্ট্রের। এই মানবগোষ্ঠীর।

রচনার সময়কালঃ জুন, ২০১৬

লেখাটির ইংরেজি অনুবাদঃ https://www.youthkiawaaz.com/2016/06/being-queer-in-bangladesh/

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.