
অরিত্র হোসেন
ধপাস!
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দেখি আমার ল্যাপটপ মেঝেতে পড়ে গেছে। কোলের উপর রাখা ছিল, শেক্সপিয়ারের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নিয়ে একটা পেপার লিখছিলাম। চোখ ঘুমে নিবু নিবু করছিল, তবে কখন যে তলিয়ে গেলাম তা সঠিক বলতে পারবো না। ঘড়িতে বাজছে ভোর ৪:৩০। বিছানা থেকে উঠার জন্য মনের সঙ্গে মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধস্তি হল; ফলাফল: মন জয়ী! বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। বড়জোর এক ঘণ্টাও ঘুম হয়নি। আজকাল ঘুম নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও চোখের পাতা এক করতে পারি না। প্রায়ই দিন ভোরবেলা কেটে যাবার পর ঘুম আসে, তবে দুই-তিন ঘণ্টার পর আবারও উঠে যেতে হয়। কি জ্বালা! মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে উঠতেই হবে, নাহলে ফ্লাইট মিস করতে পারি।
কনফারেন্স শেষ, এবার বাড়ি ফিরতে হবে।
বাংলাদেশের প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কনফারেন্স নিয়ে বেশ গবেষণা চলে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ অভিমত প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। এক দল বিশ্বাস করে কনফারেন্স হল বিদেশে ঘুরতে যাওয়া এক বাহানা, কাজের কাজ কিছুই হয় না বরং ফ্রিতে কয়েকদিন ফুর্তিতে নাচানাচি করা। আরেক দল বিশ্বাস করে কনফারেন্সে না গেলে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। বড় বড় বিদেশি সমাজকর্মী, নামীদামী ডোনারদের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে, উঠা-বসার সুযোগ না করলে কিভাবে বেঁচে থাকবে এই অধিকার আদায়ের লড়ায়ে? যে যাই বলুক না কেন, অবশ্যই যেতেই হবে। তৃতীয় দলের কোন মাথাব্যথা নেই বাকি দুইদল কি বিশ্বাস করে। যাওয়ার জন্য মন আনচান করে, আবার না যাওয়ার জন্যও নৈতিকতা বাধা দেয় না। মনের উপর অনেকটা নির্ভরশীল, যদি যাওয়ার জন্য তাগিদ দেয় তাহলেই সবিনয়ে মাথা নাড়ে।
আমি মূলত কৌতূহলের বশে কনফারেন্সে এসেছি।
সাত বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি, আর একবারও কোনভাবেই কনফারেন্সে যাইনি শুনলে মানুষজন অবাক হয়ে চেয়ে থাকতো। দেশে যাওয়ার পর হয়তো সেই মানুষগুলো হয়তো বাহবা দিবে না, তবে অ্যাক্টিভিস্ট বলে আমায় গ্রহণ করবে। ছোট্ট একটা জনগোষ্ঠী কিন্তু ঝামেলা ঢের। এ ওকে দেখতে পারে না, এ ওর কাজ নিয়ে বকাবাজি করে। বেশিরভাগ যারা কাজ করে না, তারা যারা কাজ করে তাদেরকে টপকিয়ে নাম-খ্যাতি টুকিয়ে অন্যান্য মানুষের চোখের হিরে হয়ে ঝলমল করে। তবে তা শুধু আমাদের দেশেই ঘটছে তা নয়, এ হল যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক অন্যান্য প্রচলন।
অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে আমি দুই ভাগে ভাগ করি, এক – ২০১৬ এর পূর্বে এবং দুই – ২০১৬ এর পরে। দুই ভাগেই আমার অভিজ্ঞতা আছে, যদিও প্রথম ভাগে আমার অবস্থান ততটা পরিপক্ব ছিল না, তবুও দেখেছি ক্ষমতার উত্থানপতন, এবং পাঁচমিশালি কার্যক্রমের বলিহারি। ২০১৬ এ জুলহাজ ভাই এবং তনয়ের হত্যাকাণ্ড পুরো মুভমেন্টকে নড়বড়ে করে দেয়, আর সেই অবস্থান থেকে আমরা এখনও উঠে দাঁড়াতে পারছি না। যতই ঝড় বইয়ে যাক না কেন অতিরিক্ত নাক সিটকানো স্বভাব আর আমার কথাই ঠিক মনোভাব থেকে কাটিয়ে উঠছে তো নাই বরং নতুনদেরকে পদে পদে এক বিভ্রান্তিকর ও অরাজনৈতিক ভাবে মুভমেন্টে যুক্ত করে নিজেদের মানসম্মান ও স্ট্যাটাস টিকিয়ে রাখার কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অতীত থেকে যদি নাই কিছু শিখি তাহলে পরিবর্তন আসবে কি করে?
শূন্য স্থানগুলো পূরণ হচ্ছে না, যারা সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে নিজেদের বাঁচাতে পলায়ন করেছে তাদেরকে কোনভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে না, তবে তাদের দায়িত্বগুলো আঙুল তুলে দেখানো হচ্ছে না। কাজ করবার মানুষজন নেই, তার উপর নানারকম কথা শুনতে হয়। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। আমার দম বন্ধ লাগে। আমার মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে। শুধু আমারই কি দায়িত্ব?
কনফারেন্সে এসে কোন সুবিধা করতে পারলাম না; কি আজব রীতিনীতি এদের! আমার কোন ইন্টারন্যাশনাল ফেইসভ্যালু নেই, তাই বলে আমার সঙ্গে কথা বলতেও আগ্রহ বোধ করবে না? সব আছে নিজেদের ধান্দায়, কে কোন সাদা বিদেশি ডোনারকে পটিয়ে গাদা গাদা টাকা তহবিলে জমা করতে পারবে আর যাইহোক আমার দ্বারা ওসব হচ্ছে না, হবেও না। আর সাদাগুলোও আছে! খুঁজে খুঁজে তাদেরকে সঙ্গেই খাতির করছে যাদের গতানুগতিক এনজিও মার্কা প্রজেক্টের পুঁঠি পাঠের সুর কানে যাচ্ছে। প্রথম এক দুই দিন নিজ থেকে যেয়ে পরিচয় হবার চেষ্টা করলাম, পাত্তা পেলাম না!
তবে বলবো না কনফারেন্সে কিছুই হয় না জমকালো কথাবার্তা ছাড়া। এশিয়াতে ভালো ভালো কাজ হচ্ছে সেইসব দেশে যেখানে এলজিবিটি সংগঠনগুলো লেগে থেকে কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদেরই গলার আওয়াজ বেশি শুনা যায়। প্যানেলে হউক, আর সেশন হউক সবকিছুতেই একধরণের এক সিঁড়ি উঁচু, এক সিঁড়ি নিচু মতবাদ অনুভব করেছি। বাংলাদেশের কথা এলেই, ওই এক কথা – কেউই নেই, কই কিছুই তো করা যাচ্ছে না। সরকার দিন দিন আরও পাঁজি হচ্ছে, নাই কোন নিরাপত্তা, কেইবা চায় পাঁঠার বলি হতে! আমিও মুখ খানিকটা ভেটকি মাছের মতো, দীর্ঘ নিঃশ্বাস আয়োজন করে ফেলে হতাশা প্রকাশ করেছি। ভাগ্যিস ডোনারগুলো আমার কাছে আসেনি, নাহলে কিভাবে প্রজেক্ট ছাড়া তাদেরকে তুষ্ট করতাম? ভেবেছিলাম কনফারেন্সে আমাদের ক্রাইসিস কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবো, কিন্তু সবসময় আশা পূরণ হয়? নিজেদের ক্রাইসিস নিজেদের মাথা ব্যথা হয়েই থাকা উত্তম। আর ওসব কনফারেন্স বড় সাহেবদের কঠিন কঠিন থিউরি কপচানোর থিয়েটার শো হিসেবেই বেশি মানানসই।
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ল্যাপটপ তুলে নিলাম। পর্যবেক্ষণ শেষে হালকা করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এক কোণার অল্প অংশ ভেঙ্গে গিয়েছে। কপাল আমার! বিছানায় ল্যাপটপ রেখে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। সাউথ কোরিয়ার সিউল শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। দূরের পাহাড়গুলো ফাঁকফাঁকরে লুকায়িত সূর্যের আলো বিশাল অট্টালিকাগুলোকে ভেদ করে প্রাণবন্ত করে তুলবে এই কংক্রিটের শহরকে।
খালি হাতে এসেছি, খালি হাতে ফিরছি।
তাই শাস্ত্রে আছে, অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকাইয়া যায়।