ফলঙ্গ

লেখকঃ অরিত্র হোসেন

(১)

ত্রিনিদ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার দৃষ্টি হাতের তালুর দিকে। আঁকাবাঁকা অসংখ্য রেখা। একটা বড়, একটা ছোট। একটা বাঁকা, একটা সোজা। একটা গাঢ়, একটা মলিন। ত্রিনিদ কপাল কুঁচকে ফেলল। আচ্ছা, গাঢ়র বিপরীত শব্দ কি মলিন? সঠিক জানা নেই তার। ত্রিনিদ মাথা তুলল। বিরাট এক হল ঘরের মতো জায়গা মাত্র দু’টি প্রাণী বসে আছে। একজন ত্রিনিদ নিজে, আরেকটা হল একটি বিড়াল। হালকা খয়েরী রঙের বিড়াল। পেটের দিকটা ফোলানো। নিশ্চয় এটি মেয়ে বিড়াল। পেটে বাচ্চা আছে। বিড়ালটা দৃপ্ত পায়ে হেঁটে খাবারের র‍্যাক ঘেঁষে বসলো। বসার ধরণ আলিশান। বিড়ালদের মধ্যে রাজরানী ভাবসাব সবসময় দেখা যায়। ত্রিনিদ আবার কপাল কুঁচকে ফেলল। সে কেন বিড়াল নিয়ে চিন্তা করছে? বিড়াল তার অন্যতম অপছন্দের একটি প্রাণী। দেখলেই মনের মধ্যে একধরণের ঘৃণা জন্মে। কতো আদরে, কতো যত্নে এককালে তার বিড়ালটিকে সে পেলেছিল! আর সে কিনা পালিয়ে যে গেলো, আর ফিরে আসলো না। ত্রিনিদ দীর্ঘনিঃশ্বাস আটকাতে আটকাতে উঠে পড়লো। উঠার সাথে সাথেই ঘরে ঢুকল ত্রিনিদের ফুপি রেহেনা। ত্রিনিদকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে ফিসফিস করে বললেন, এই ছোকরা দাড়িয়ে আছিস কেন?

ত্রিনিদ হাই তুলতে তুলতে বলল, আধা-ঘন্টা যাবৎ এখানে বসে আছি ফুপি। তোমরা ওই ঘরে কি যে পরামর্শ করতে ঢুকেছ তা আমার জানা নেই। এভাবে আমাকে বসিয়ে রাখার কোন মানে আছে?

রেহেনা দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে বললেন, অনেক অনেক অনেক কথা হয়েছে। শোন, ওরা একটু পর ঘর থেকে বের হবে। তারপর এখানে এসে তোর সাথে কথা বলবে।

ত্রিনিদ বলল, কেন?

রেহেনা আবারও দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে নিচু গলায় বললেন, তোর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল। শুন, খবর্দার বাবার সাথে তর্কাতর্কি করবি না। তিনি যা বলবেন শুনবি আর চুপচাপ মেনে নিবি।

ত্রিনিদ বলল, ও… ! এই নিয়ে আলোচনায় বসেছিলা! বাবা! তোমরা পারও! আমি বা কি একজন মানুষ! তার আবার বিয়ে নিয়ে আলোচনা সভা! হায়রে!

রেহেনা শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বললেন, আজকে তর্কাতর্কি করিস না। এমনেতে বাবার শরীরটা ভালো না, তার উপর তোর বিয়ের চাপ।

ত্রিনিদ ভুরূ কুঁচকে বলল, চাপ? কোথা থেকে চাপ আসছে?

রেহেনা মাথা কাপড় দিতে দিতে বললেন, কই থেকে আসবে মানে কি? নাতির বিয়ের চাপ আপনাআপনি আসে। ফাউ ফাউ কেউ চাপ দিবে?

ত্রিনিদ বলল, তুমি অনেক ফালতু কথা বলো।

রেহেনা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ফুপির সামনে বলেছিস ভালো কথা। কিন্তু, বাবার সামনে খারাপ, ফালতু, বাজে এধরণের শব্দ উচ্চারণ করবিনা। বাবাশুনলে ক্ষেপে যাবেন।

ত্রিনিদ বিছানায় বসল। রেহেনা এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি করে খাটের নিচ থেকে একটা মোড়া বের করলো। শাড়ি ঠিক করে পরিপাটি হয়ে মোড়ায় আরাম করে বসলো। ব্লাউজের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে এক খিলি পান বের করে সাথে সাথে মুখে পুরে নিলো। ত্রিনিদ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। হাতের কাছেই পানের বাটা থাকা সত্ত্বেও পান বানিয়ে ব্লাউজে রাখার যৌক্তিকতা সে খুঁজে পাচ্ছে না। ত্রিনিদ কর্কশকণ্ঠে বলল, তুমি কি কানাডায় এইগুলো করেছ?

রেহেনা পান চিবুতে চিবুতে বললেন, আরে না। তখন তো এক বাক্স পান নিয়ে ঘুরতাম। যখনই ইচ্ছা তখনই মুখে পুরে দিতাম।

-তাহলে আজকে এরকম করলে কেন? তোমার সামনেই তো পানের বাটা ছিল।

রেহানা মোড়া থেকে উঠে পানের পিক বাইরে ফেলিয়ে বসে বললেন, অভ্যাস। অভ্যাস।

-তোমার ঘাম পানে যায় নি?

রেহেনা বিরক্ত গলায় বললেন, বেটা মানুষ এতো কথা বলবি না। আল্লাহ আল্লাহ কর। আজকেই তোর বিয়ের কথা ফাইনাল হয়ে যাবে। পরশুর মধ্যে সব কাজ শেষ।

ত্রিনিদ কিছু একটা বলার আগেই ঘরের দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে মানুষজন ঢুকতে লাগলো। 

প্রথমে একসাথে ঢুকলেন ত্রিনিদের বড় চাচা-চাচী। তাদের পিছন পিছন ঢুকল ত্রিনিদের বাবা আশফাক রহমান। রেহেনা ব্যস্ত ভঙ্গিতে চেয়ার টানাটানি শুরু করেছে। পাটি পাতালেন, দু-চারটা মোড়াও নিয়ে আসলেন। তাকে সহয়তা করছে ত্রিনিদের বড় চাচী রাশেদা। ত্রিনিদের দিকে তাকিয়ে তার বাবা আশকাফ রহমান তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, তোর মাথা কি নষ্ট? হাফপ্যান্ট পরে আছিস কেন? বদলে আয়! দৌড় দে এক্ষনি!

ত্রিনিদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, পারবোনা।

আশফাক রহমান চোখ বড় বড় করে তাকালেন। ত্রিনিদ চোখ নামিয়ে পা নাচাতে লাগলো। ত্রিনিদের মা পারভীন ঘরে ঢুকলেন একটা পাখা নিয়ে। শাড়ি ঠিক করতে করতে ত্রিনিদের পাশে বসলেন। ত্রিনিদ নরম গলায় বলল, তোমাকে শাড়িতে তো বেশ মানায়।

পারভীন রহমান ফিসফিস করে বললেন, মানালে হবেটা কি আমার? যতবার শ্বশুরবাড়ি আসি ততবার কোন না কোন কাহিনি হবেই।আজকে শাড়িপরা নিয়ে তোর বাবার কাছে বকা খেয়েছি। কি গরম। বাপরে বাপ! এরমধ্যে শাড়ি পড়ে আছি। আরও গরম লাগছে।

ফিসফিসিয়ে কথা বলতে দেখে আশফাক সাহেব কড়া কণ্ঠে বললেন, মা-ছেলের জন্মের গপ্পো আজকেই শেষ করবা নাকি? অ্যায় পারভিন! তোমার ছেলেকে প্যান্ট চেঞ্জ করতে বোলো।

ত্রিনিদ পা নাচাতে নাচাতে বলল, যাবো না!

আশফাক রহমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, কে বলবে এই ছেলের বয়স ২৮! এখনো বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করে।

পারভীন রহমান বললেন, সারাক্ষণ ওর খুঁত না ধরলে তোমার চলে না?

পারভিন রহমানের কথা অগ্রাহ্য করে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে নিচু গলায় বললেন, বাবা এদিকে আসছেন।

ত্রিনিদ নড়েচড়ে বসলো। পারভীন রহমান মাথায় আয়োজন করে ঘোমটা দিলেন। ত্রিনিদের বড় চাচা-চাচী নিজেদের মধ্যে কানাকানি করেই যাচ্ছেন। রেহেনা হাতের ইশারায় বিড়ালটিকে তাড়িয়ে দিলো। বিড়াল ধীরে ধীরে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলো। আশফাক রহমান তার বাবা মাহাবুবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। তার পিছন পিছন ঢুকল ত্রিনিদের চাচাতো দুই ভাই মামুন-রিফাত আর চাচাতো এক বোন অনি।

মাহাবুবুর রহমানের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলের নাম মিজান রহমান। তার ঘরে দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছোট ছেলে অর্থাৎ আশফাক রহমানের ঘরে একটাই ছেলে। আর রেহেনা সবার ছোট। তার ঘরে তিন ছেলে, দুই মেয়ে।

অন্য ভাইবোনদের মতো আশফাক রহমান গ্রামের বাড়িতে তেমন একটা আসেন না। কিন্তু এবার গ্রামে আসতে হল আপন চাচাতো ভাইয়ের ছেলে মাশুকের বিয়ে উপলক্ষ্যে। পারভীন, ত্রিনিদ গ্রামের বাড়ি আসতে পছন্দ করে না। শৌচাগারসহ নানা ধরণের সমস্যার কথা বলে পার পেয়ে যায়। তাই তিনি নিজ অর্থায়নে মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে দুই ঘরের একটি পাকা বাড়ি করেছেন। আপন সীমানায় আছেন কিন্তু বাড়ি ভিন্ন।

ত্রিনিদ স্বভাবে খুব শান্তশিষ্ট। প্রয়োজন ছাড়া কারোর সাথেই কথা বলে না। তারমানে এই নয়, সে কম কথা বলে! সে তার পরিবারের সদস্যদের সবসময় এড়িয়ে চলে। তার সব কথা চলে বন্ধুদের সাথে, বিশেষ মানুষদের সাথে। নিজের এমন অদ্ভুত স্বভাব কবে থেকে লালন করছে সে নিজেই জানে না। তার কথা ‘বাবা-মা, চাচা-চাচী এদের সাথে কি নিয়ে বলবো?’ অবশ্য রেহেনা ফুপির সাথে বেশ খাতির আছে ত্রিনিদের। সারক্ষণ কুটকুট করে কিছু না কিছু আলাপ করতেই থাকে। ত্রিনিদের কাছে রেহেনা ফুপির স্বভাব-চরিত্র খুবই চমকপ্রদ। প্যাঁচ ছাড়া মানুষ। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকে।

ত্রিনিদ বয়স ২৮ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ২২-২৩ বছরের যুবক বলে চালানো যায়। পড়ালেখা শেষ করে চাকরি-বাকরি না করার কারণে মুখের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়নি। পিটানো শরীর, তামাটে বর্ণের ত্রিনিদ একজন তাগড়া জোয়ান পুরুষ। অফিসের জন্য দৌড়াদৌড়ি কাকে বলে, কত প্রকার কি কি – সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই। খায়-দায়, ঘুমায়। টিভি দেখে, আড্ডা দেয়। শুয়ে বসে ঝামেলামুক্ত জীবন কাটাতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু পেটের দায় মিটানোর তাগিদে সবাই তো আর ত্রিনিদের মতো সময় কাটাতে পারে না।

পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার পিছনে শক্ত একটা কারণ আছে। ত্রিনিদ তার নিজের আসল সত্ত্বাকে অনেকদিন পর্যন্ত নিজেই গ্রহণ করতে পারেনি। তার কাছে ‘সমকাম’ একটি অসুস্থতা ছাড়া কিছুই ছিল না। দিনের পর দিন মানুষের সাথে মিশতে মিশতে, কথা বলতে বলতে সমকাম ও নিজের যৌনতা সম্পর্কে সে স্পষ্ট ধারণা পেতে থাকে।নিজের যৌনতা নিয়ে ত্রিনিদের এখন কোন সমস্যা হয় না কিন্তু বহুদিন আগে তৈরি করা দূরত্ব কেন জানি কমে আসে না।

ত্রিনিদ মাথা নিচু করে আছে। মাহবুবুর সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বাকি সব মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে মাহাবুবুর রহমানের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তার লাঠি দিয়ে মেঝেতে আঘাত করে বললেন, ত্রিনিদ!

ত্রিনিদ মাথা তুলে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, বলুন শুনছি।

মাহবুবুর রহমানের বয়স ৮৫। তার হাঁটাচলা-কথাবার্তা দেখলে মনে হবে না তার এতো বয়স হয়েছে। তিনি কাশতে কাশতে বললেন, তোমার বাবা একটা গাধা।

আশফাক বললেন, বাবা?

মাহবুবুর সাহেব বললেন, কি হয়েছে? গাধা বললাম দেখে সন্মানে লাগসে? আহারে!

আশফাক বললেন, আরে তা না…

-তুই গাধাই! ছেলের নাম যখন ত্রিনিদ রাখা হইসে তখনই বুঝছি এই ছেলে শনি ডেকে নিয়ে আসবে।

ত্রিনিদ হাত কচলাতে লাগলো। মাহবুবুর রহমান কড়াকণ্ঠে বললেন, তোমার নামে যা শুনেছি সেটা কি সত্য?

পারভীন রহমান ঘোমটা ঠিক করতে করতে বললেন, আরে ওসব বাজে কথা…

-দেখো বউমা, আমি কথা বলছি ত্রিনিদের সাথে। তোমার সাথে না।

পারভীন রহমান মাথা নিচু করলেন। ত্রিনিদ বলল, দাদাভাই আপনি আসল কথাটা বলুন।

মাহাবুবুর রহমান কাশতে কাশতে কফ আনলেন মুখে। তারপর সেই অবস্থাতে বললেন, আমি তো…

ত্রিনিদ মুখ কুঁচকে বলল, আপনি দয়া করে মুখ ধুয়ে আসুন।

রেহেনা উঠে পিকদানি এনে বাবার মুখের সামনে ধরলেন। তিনি আয়োজন করে কফ ফেললেন। আবারো কাশতে কাশতে কফ ফেলালেন। ত্রিনিদের সহ্য হল না। সে কপাল কুঁচকে তার মা’কে বলল, মা আমি উঠে যাই?

পারভীন রহমান বিড়বিড় করে বললেন, তোর বাবার সাথে আমার সংসার যদি ভাঙতে চাস তাহলে উঠতে পারিস।

ত্রিনিদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

মাহবুবুর রহমানের কফ ফেলানো পর্ব শেষ। তিনি রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, আমি সব ঘটনাই শুনেছি। সবই শুনেছি। মামুন আমাকে সবই বলেছে। আমাদের পরিবারে এই মামুনই একমাত্র যোগ্য নাতি হতে পেরেছে। যেমন রূপে, তেমন কর্মে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কতো ভালো বেতনের চাকরী করে জানিস? আর বউটা যে পেয়েছে। মাশাল্লাহ! আমার মিজানের ভাগ্য ভালো। দুটা ছেলেই জাতের হয়েছে।

আশফাক সাহেব মুখ নিচু করে ফেললেন। ত্রিনিদ অপরাধী চোখে বাবার দিকে তাকাল। তার বাবা লজ্জায় মাথায় নিচু হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাতে আছেন।

-ছি ছি ছি। শেষ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের নাতির সাথে? নাতনীর সাথে হলেও ঠিক ছিল। এইসব কি যে শুনলাম। ছি ছি ছি। লজ্জা শরম বেঁচে খেয়েছে তোর বেটা, আশফাক! তোর বেটা আমাদের পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিল।

মিজান রহমান নড়েচড়ে বসে বলল, বাবা! মামুন যদি না ধরত তাহলে আমরা অনেক বড় অপমানের শিকার হতাম। সেদিনই সে কপ করে দুজনকে ধরেছে। ভাগ্যিস মাশুককের বিয়েটা ঠিকঠাক মতো হয়ে গিয়েছে। এখন এই তারছেড়া ছেলেটার একটা বন্দোবস্ত করো। আর বেশি জানাজানি হলে কিন্তু…

মাহবুবুর সাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ঠিক বলেছিস। কি যুগে আইলাম রে! কিসব শুনতে হচ্ছে! হায়! পোলা আর পোলা? এই শুনার আগে মরলাম না ক্যান!

ত্রিনিদের বড় চাচী রাশেদা আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে মুচকি মুচকি হাসছেন। ব্যাপারটা আশফাক রহমানের চোখে খুব ভালোভাবেই ধরা পড়লো।

মাহবুবুর সাহেব বললেন, কি রে আশফাক? তোর বেটা না বলে কতো শিক্ষিত? নবেল বই পড়ে এই অবস্থা? ভালো জায়গায় পড়ে এই শিক্ষা পাইছে? এতো না পড়ালেখা পড়ালেখা করে চিল্লাইতি! আর শহরে বাস করে বাবুসাহেব ভেল ধরে না কতো আধুনিক কথা বলতি? শেষ পর্যন্ত বেশি আধুনিক হতে গিয়ে ছেলের এই অবস্থা করেছিস?

আশফাক রহমান ম্লান গলায় বললেন, বাবা এতে আমার কি দোষ…

-তোকে কে কইসিলো মাশুকরে তোর বাড়িতে রাখতে? আর ছেলের স্বভাব আগে টের পাস নাই? আর মাশুক ছেলেটা গ্রামের, কিছুই বুঝে না। তোর পোলাই তো ওর মাথা খাইছে।

ত্রিনিদ বলল, আমি কারোর মাথা খাইনি। আর মাশুক আমাদের বাসায় মাত্র ১বছর ছিল।

মাহবুবুর রহমান দাঁত কিড়মিড় করে বলল, তাতেই তো কাম সারসো।

ত্রিনিদ কিছু বলতে গেলেই পারভীন রহমান ত্রিনিদের হাত ধরে চোখের ইশারায় মানা করলেন।

মাহবুবুর রহমান বললেন, আমাদের গ্রামে বহুত ভালা মাইয়া আছে। সমস্যা নেই। বিয়াও ঠিক করসি। শুনবা কার লগে? শুনবা?

মিজান বললেন, বলেন বাবা।

-মামুনের বউয়ের আপন চাচত বইনের সাথে। ভালা করসি না?

ত্রিনিদ এদিক-ওদিক চেয়ে বলল, কি? আমার বিয়ে ঠিক করাও হয়ে গিয়েছে?

-হ। হইসে। পরশু বিয়া। কবুল-কবুল বিয়া শেষ। ঝামেলাও শেষ।

ত্রিনিদ শক্ত কণ্ঠে বলল, আমি বিয়ে করবো না।

মাহবুবুর রহমান বললেন, বিয়া তো করন লাগবো। যা করসস সেটার মাফ হিসাবে বিয়া করবি। কেমন?

ত্রিনিদ উঠে দাড়িয়ে বলল, আমি বিয়ে করবো না। আমার পক্ষে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করা সম্ভব না।

কথা শেষ হতেই আশফাক সাহেব মোড়া থেকে উঠে সজোরে ত্রিনিদের ডান গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ত্রিনিদ চোখ বড় বড় করে বলল, বাবা! তুমি আমাকে চড় মারলে?

আশফাক সাহেব এবার আরেকটা চড় মারলেন। এবার বামগালে।

ত্রিনিদের চোখে পানি চলে আসলো। সে ভেবেছিল তার বাবা-মা তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারে কিন্তু আজ এমন হল কেন?

আশফাক সাহেব রাগে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললেন, বাবা যা বলেছেন তাই হবে। তোর বিয়ে পরশু। ফাইনাল!

ত্রিনিদ তার মা পারভীন রহমানের দিকে তাকাল। তার মা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ লুকিয়ে রেখেছেন। ত্রিনিদ গটগট করে বেড়িয়ে গেলো। চিৎকার করে করে বলতে লাগলো, আমি বিয়ে করবো না! আমি বিয়ে করবো না!

মাহবুবুর রহমান চোখের ইশারায় মামুনকে ত্রিনিদের পিছন পিছন যেতে বললেন। টেবিলে রাখা তালাচাবি নিয়ে মামুন দ্রুত গতিতে ঘর থেকে বের হল।

ত্রিনিদ ঘরে এসে শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। ত্রিনিদ তার বাবার তৈরি করা পাকা ঘরে থাকছে। শহুরে বাড়ির মতো ঘর। টাইলস করা মেঝ, হার্ডবোর্ডের সিলিং। পাখাটা বেশ ভালোই জোরে ঘুরে। থাই গ্লাসের জানালা ঠাস করে বন্ধ করে দিল ত্রিনিদ। বন্ধ করার সময় সে দেখল মামুন আসছে তার ঘরের দিকে। দরজার কাছে দৃপ্ত পায়ে গিয়ে খুব ধীরে ছিটকানি আটকে দিলো ত্রিনিদ। বাইরে লক ধরে টানাটানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দরজায় কান পেতে ত্রিনিদ শুনতে চেষ্টা করলো।

তালা দেওয়া হচ্ছে!

ত্রিনিদ দরজা থাপড়ানো শুরু করলো। জোরে জোরে। তালা দেওয়া শেষ। ত্রিনিদ দৌড়ে গিয়ে জানালা খুলে চিৎকার করে বলল, দরজা খুল। তালা কেন মারা হয়েছে?

কেউ জবাব দিচ্ছে না।

ত্রিনিদ মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। এসব কি হচ্ছে তার সাথে? কেন এসেছিল এখানে? কি দরকার ছিল মাশুকের বিয়ের দু’দিন আগে ওর ঘর যাওয়া? কেন? কেন মাশুকের প্রেমে পাগল হয়ে এমন উন্মাদের মতো আচরণ করতে হবে তাকে? চুমু খাওয়াটা কি অন্যায়ের ছিল? বিয়ের আগে একটু আপন করে পাওয়ার আশায় গিয়েছিল সে। নিজের মাশুক তো আর আগের মতো আপন থাকবে না। তাই শেষ বারের মতোও ত্রিনিদ তাকে ঠিকমতো পেতে পারলো না?

ত্রিনিদ এতোসব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রার মতো হচ্ছে। মন খারাপ হলে তার ঘুম পায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা মেসেজ লিখে সে। লিখতে লিখতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। গভীর ঘুম।

শো শো শব্দ। পাখা চলছে দ্রুত গতিতে। চারদিক সুনসান। পোকার শব্দ। মাঝেমধ্যে কুকুরও ডাকছে। ত্রিনিদ চোখ মেলল। হাতে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। সাইলেন্ট করা কিন্তু ভাইব্রেট করছে। ঘুম ঘুম চোখে স্ক্রিন দেখার চেষ্টা করছে। দেখতে পাচ্ছে না। খুব ঘুম পাচ্ছে। দরজায় হঠাৎ শব্দ। কে? কেউ কি দরজা খুলছে? ত্রিনিদ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো। স্যান্ডেল পরতে পরতে লাইট জ্বালাল। দরজার লক ঘুরিয়ে একজন ঢুকল। ত্রিনিদ তাকিয়ে দেখে মাশুক। ত্রিনিদের আত্মা  উড়ে গেলো এমন অবস্থা। মাশুককে দেখলে তার জগত উল্টে যায়। মাশুককে জড়িয়ে ধরল ত্রিনিদ। মাশুক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, এসব করার সময় নেই। তাড়াতাড়ি এখানে থেকে চলে যাও।

-কই যাবো?

-ঢাকা চলে যাও। রাত বেশি হয়নি। মাত্র ৭টা বাজে। গাড়ি পাবে।

ত্রিনিদ মাশুকের হাত ধরে বলল, অনেকদিন হল তোমাকে কাছে পাই না।

মাশুক ম্লানগলায় বলল, ব্যাগ গুছাও।

ত্রিনিদ রাগ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। হাতের কাছে যা পেলো তা ব্যাগে ভরে বাইরে বেরিয়ে আসলো।

খুব সাবধানে দরজা আটকাল মাশুক। ত্রিনিদ রাগান্বিতস্বরে বলল, তুমি চাবি পেলে কিভাবে?

-রেহেনা ফুপি আমাকে খবর দিয়েছেন। তিনি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। সবাই মেয়ের বাড়িতে গিয়েছে। বিয়ে সম্পর্কিত কি যেন কথাবার্তা বলতে । তুমি দেরি করো না।

ত্রিনিদ ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলো। মাশুক কোমলকণ্ঠে বলল, ত্রিনিদ।

ত্রিনিদ থামল। পিছনে তাকিয়ে বলল, কি?

মাশুক দৃপ্ত পায়ে হেঁটে ত্রিনিদের কাছে এলো। ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল, ভালো থেকো।

ত্রিনিদ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,  আমাদের আর সম্পর্ক থাকবে না?

মাশুক ম্লান গলায় বলল, সম্ভব না। আমি আর চাচ্ছি না যে…

ত্রিনিদ ভারী গলায় বলল, মাশুক চল পালিয়ে যাই। চল!

মাশুক চোখ হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেক দেরি হয়েছে। আমাদের ভ্যাগের রেখা আমাদের পক্ষে ছিল না।

ত্রিনিদ মুখ সরিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। চোখে পানি জমছে। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে নিলো। তা দিয়ে পথ দেখতে দেখতে এগুচ্ছে ত্রিনিদ।

আঁকাবাঁকা পথ। কিন্তু নির্দিষ্ট রেখায় অবস্থিত।

দুটি রেখা পথটিকে আটকে রেখেছে।

রেখার বিস্তৃতি অনেকদূর।

হয়তো মহাকাল পর্যন্ত।

হাতের রেখা, কপালের রেখা, কতো রকমের রেখা রয়েছে। কিন্তু কোন রেখাই ত্রিনিদ আর মাশুককে জুড়ে দিতে পারলো না।

ফলঙ্গের দোষ, ফলঙ্গের ব্যর্থতা।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.