
তুমিল
লেখার শুরুতেই বলে নেয়া ভালো যে, এই বিষয়ে আমার অবস্থান নিরপেক্ষ। কেও যদি নিজে থেকে বের হয়ে আসতে চায় তাকে আমি সাধুবাদ দিব, কেও যদি নাও চায় তার সিদ্ধান্তকেও আমি সম্মান জানাবো। Coming out, হল আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা কোন প্রতিযোগিতা নয়। অন্য কেও যদি নিজেকে প্রকাশ করে তার মানে এই নয় যে আপনাকেও একই রাস্তায় হাঁটতে হবে। আমাদের একেকজনের জীবনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা একেক রকম। তাই অন্য কেউ করলে আপনাকেও করতে হবে এই চাপ অনুভব করার কোন কারণ নেই। ইদানিং youtube এর সুবাদে এই বিষয়টা আমাদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের একটি ট্রেন্ড আমাদের দেশে ঠিক কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। মূলত আলোচনা এবং আমার ব্যক্তি জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি Coming Out বিষয়টার ভালো এবং খারাপ দিক গুলোতে আলোকপাত করবো এবং নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাদের কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে আমার মতামত তুলে ধরব।
ভালো দিকঃ
১) Living freely and honestly: আপনি যদি আপনাকে মেনে নিতে পারেন তাহলে কে আপনাকে মানল, কে মানল না এই ব্যাপারগুলো আপনাকে আর যন্ত্রণা দিবে না। নিজেকে নিজে ভালবাসতে পারলে অন্যের কাছে ভালবাসা না পাওয়ার কষ্ট অনেকাংশে কমে যায়। তাই আমার মনে হয় নিজের কাছে Come out সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর আপনি যদি একবার নিজে থেকে বের হয়ে আসতে পারেন তখন আর ধরা পড়বার চিন্তা বা ভীতি কাজ করবে না।
২) Strong bond with Friends and Family: আপনি যদি আপনার সবথেকে বড় সত্য আপনার কাছের মানুষদের কাছে প্রকাশ করেন তাহলে আপনাদের বন্ধন আরো দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আপনার সত্যিকারের বন্ধু এবং পরিবার আপনাকে কখনই বিপদের মাঝে একা ফেলে চলে যাবে না বরঞ্চ চেষ্টা করবে আপনাকে আগলে রাখতে।
আমার বোন এবং কাজিনরা আমাকে এখন মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে জীবন নিয়ে কি চিন্তা করছি? কাউকে ভালোবাসি কি না? দেশের বাহিরে কবে যাব? বাবা মাকে কিভাবে জানাবো? আর কখনো কোন বিষয়ে মন খারাপ হলে আর কিছু না হোক জড়িয়ে ধরে কান্না করার জন্য ওরা আছে।
৩) Make a new family: রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে পরিবার হয় এবং একে অন্যের বিপদে আপদে জান দিয়ে দিতে পারে এমন পরিবার মনে হয় আমাদের কমিউনিটি বাহিরে খুব একটা দেখা যায় না। অনেক সময় আমাদের অনেক চালচলন এবং বাচনভঙ্গির জন্য একা বড় হতে হয়। বন্ধু খুব একটা থাকে না। কিন্তু আমরা যখন একসাথে থাকি আমাদের মত শক্তিশালী আর কোন পরিবার নেই। LGBTQ+ পরিবার খুবই ইউনিক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ।
৪) low stress/No Stress: দিনের পর দিন নিজের জীবনের সব থেকে বড় সত্য সব থেকে কাছের মানুষদের কাছে গোপন রাখাটা যে কতো টা মানসিক যন্ত্রনার তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। আপনার আইডেন্টিটি গোপন রাখলে অনেক ক্ষেত্রে কাজে, পড়াশোনায় এবং মানসিক বিকাশে ব্যঘাত ঘটে। কিন্তু কিছু কাছের মানুষের কাছে যদি আপনি come out করেন এবং তারা আপনাকে মেনে নেয় আপনার জীবন তখন অনেক দিক থেকেই সহজ হয়ে যাবে। অ্যাংসাইটি, স্ট্রেস থাকবে না। কাজে কর্মে, পড়াশোনায় মন বসবে।
৫) Being a Role Model: আপনার come out করার ক্ষেত্রে এটা কখনই মুখ্য হওয়া উচিৎ না, কিন্তু এটা অবশ্যই একটা ভালো দিক। আপনি আপনার বেরিয়ে আসার গল্প জানিয়ে অনেকের মাঝেই আশার সঞ্চার করতে পারেন। আপনার কি কি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সেখান থেকে কি শিখেছেন, এসব আইডিয়া অন্যের ক্ষেত্রে coming outএ অনেক সাহায্য করতে পারে।
খারাপ দিকঃ
১) The opposite of pride is shame: আমরা আমাদের কমিউনিটিতে প্রাইড শব্দটা অনেক ব্যবহার করি। কিন্তু এর বিপরীত শব্দ হল শেম। অনেক সময় কাছের মানুষের কাছে সত্য প্রকাশে হিতে বিপরীত হতে পারে। কাছে না টেনে আপনাকে উলটো লজ্জা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
২) No family/No financial support: এটা আমাদের এখানে একটা কমন বিষয়। আপনি যদি আপনার পরিবারের সাথে থাকেন এবং তাদের টাকায় চলেন। তাহলে তারা আপনাকে গৃহবন্দী করে রাখতে পারে। আপনার সাথে সকল সম্পর্ক শেষ করে দিতে পারে কিংবা আপনাকে কোন রকম আর্থিক সাহায্য নাও করতে পারে। এমতাবস্থায় আপনার ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পরতে পারে।
৩) Physical and mental torture: একে তো না মেনে নেওয়ার কষ্ট তার উপরে যদি শুরু হয় শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন! আমাদের মধ্যে অনেককেই হতে হয়েছে এমন নির্যাতন এর শিকার। সাইক্রিয়াটিস্ট থেকে শুরু করে হুজুর ওঝা ডেকে করতে শুরু করতে পারে আপনার যৌনতা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।
৪) Harassment and Discrimination: অনেক সময় এমন হয়েছে যে আপনি বিশ্বাস করে একজন বন্ধুকে আপনার সত্য বললেন। সে আপনার বিশ্বাস ভেঙ্গে পুরো এলাকা/স্কুল/কলেজ/ভার্সিটি বলে বেরালো। এরপরে দেখা যাবে উঠতে বসতে সব জায়গায় আপনাকে অপমানিত হতে হচ্ছে এমন একটা বিষয়ের জন্য যার উপরে আপনার কোন হাত নেই।
আমি যখন ভার্সিটিতে দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ি, আবাসিক ক্যাম্পাসে কোন ওয়াইফাই লাইন নেই। কম্পিউটার ল্যাবে বসে ফেসবুকে ফেইক আইডি চালাতে গিয়ে হঠাত এক ক্লাসমেট এর কাছে ধরা খেয়ে যাই। প্রতিদিন রাতে খেয়ে আমরা হাঁটতে বের হতাম। ঐদিন আমাকে সে বলল, “তুমি যদি আমার সাথে না হাঁট আমি খুশি হব। আমার আশেপাশে গে থাকলে গা ঘিনঘিন করে। আমার সাথে কথা আর বললে পুরো ক্যাম্পাসে বলে দিব”। অবশ্য এমনিতেই সে বলে দিয়েছে। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে আমাকে।
৫) Spying on you: আপনার পরিবার যদি এ ব্যাপারে জানে এবং মেনে না নেয়, তাহলে আপনার জীবনে কোন প্রাইভেসি থাকবে না। কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন সব কিছুর কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনার ফোন, ফেসবুক সব কিছু তদারকি করবে। রাতে বাহিরে থাকা বারণ হয়ে যাবে। বেশি রাত করে বাহিরে থাকা যাবে না। আসল কথা আপনার কোন জীবন থাকবে না।
Come out করার ক্ষেত্রে করণীয়ঃ
আমাদের সব সময় মাথায় রাখতে হবে এটা ইউরোপ/আমেরিকা না। পশ্চিমা দেশেও এই ব্যাপার এখনো অনেক সেনসিটিভ আর আমরা তো নিম্ন আয়ের দেশ। এখানে সেক্স ওয়ার্ড এখনো ট্যাবু। স্যানিটারি প্যাড এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে হয়। কনডম কেনার সময় আশেপাশে দশবার দেখে ফিসফিস করে চাইতে হয়। তাই এরকম একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত হোয়াইট বয়দের ভিডিও দেখে না নেওয়াই ভালো। কারণ বাহিরের আর্থ সামাজিক অবস্থা আমাদের থেকে ভিন্ন। এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেই। এক বিদেশী বন্ধুর সাথে “pose” সিরিজ নিয়ে কথা বলার সময় আমি বলেছিলাম, কোন মুভি বা সিরিজে, আমাদের (LGBTQ) মত ক্যারেক্টার এর থেকে আমাদের যারা মেনে নেয় তাদের আমার সবসময় বেশি ভালো লাগে। উত্তরে সে বলল, এটা ওখানে ধরেই নেওয়া হয়, তুমি যদি শিক্ষিত হও তাহলে তোমাকে এই ব্যাপারটা মেনে নিতেই হবে। আমাদের এখানে সম্পূর্ণ উলটো। এখানে ধরেই নেওয়া হয় যে মেনে নিবে না। তারপরেও অনেক মানুষ আছে যারা আমাদের আপন করে নেয়। তাই আশা হারাবার কিছু নেই। Coming out এর সময় আমরা নিচের কয়েকটা পয়েন্ট আমরা ফলো করতে পারি।
১) Be sure about how you feel about your sexuality: আপনার বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে কোন চাপ অনুভব করার কিছু নেই। কিন্তু আপনি কি আদতে আপনার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে আপনার পরিবার বা নন-গে কারো সাথে কথা বলতে কমফোর্টেবল কিনা সেটা জানা প্রয়োজন। আপনার মনে দ্বিধা থাকলে কমিউনিটির লোকদের সাথে কথা বলতে পারেন। নিজের মনের কথা অন্যের সাথে বললে মন হালকা হয়। আপনি যদি আপনার ব্যাপারে কমফোর্টেবল না থাকেন তাহলে আরও সময় নিন।
২) Pick someone understanding and comfortable: আপনি যার সাথে আপনার কথা বলতে চাচ্ছেন তার সাথে যদি আপনি কমফোর্টেবল না হন তাহলে কথা ঠিক মত বলতে পারবেন না। আমি যখন আমার বোন-এর সাথে আমার সব শেয়ার করি তখন ও পড়ে ক্লাস ৫-এ আর আমি ক্লাস ১০-এ। যেহেতু ও আমার সাথেই বড় হয়েছে আমাকে আমার মত করে মেনে নেওয়া ওর জন্য কঠিন কিছু ছিল না। এখন আমার ছোট আর সমবয়সী সব কাজিনই আমার ব্যাপারে জানে।
৩) Be a good human first: “গুড হিউম্যান” এর সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম হলেও মূল বিষয় কিন্তু এক। আমাদের কাছের মানুষ যখন জানবে যে আমি কারো ক্ষতি করি না, আমার ব্যবহার ভালো, বিপদে মানুষের পাশে দাড়াই, আমার প্রতিবেশি সবাই আমাকে পছন্দ করে, আমার খারাপ কোন রেকর্ড নেই তখন আমাদের মেনে নেওয়া তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। আমার ভার্সিটি লাইফ এর সব বন্ধুরা এবং শিক্ষকরা জানতে পারে যে আমি গে, একটু চমকিত হলেও আমাকে তারা সবাই মেনে নেয়। যারা নিতে পারেনি তারা আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কেও নয়।
৪) Take one little step at a time: আপনি একজনের কাছে বহিঃপ্রকাশ করলেন এবং সে আপনাকে মেনে নিল দেখে পাড়া জুড়ে মাইকিং করার কিছু নেই। গ্রহণযোগ্যতা একদিনে তৈরি হয় না। একজন মেনে নিয়েছে, খুবই ভালো। পরবর্তীতে কাউকে বলার আগে নতুন করে সব ভাবুন। সবাই সব খবর একভাবে নিতে পারে না। আমার কিছু বন্ধু আমার কথা শুনে জড়িয়ে ধরেছে। আবার কিছু বন্ধু বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমি কি বলছি।
৫) Promote love: আপনি যার সাথেই কথা বলুন না কেন চেষ্টা করুন ভালোবাসাকে আগে রাখার। আমি আগেও বলেছি আমাদের সমাজে সেক্স হল ট্যাবু। তাই শব্দচয়নে আপনাকে সতর্ক হতে হবে। আমার এক প্রয়াত বড় ভাই সমকাম এর জায়গায় সমপ্রেম বলতেন। যেখানে সেক্স ট্যাবু, সেখানে যদি আগেই কাম থাকে তাহলে বাঙালির হজমে সমস্যা হতে পারে।
৬) Be financially stable: আপনি আপনার মনের কথা বললেন এবং তারা আপনাকে মেনে নিল না। আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিল। এখন যদি আপনার একটা ভালো চাকরি বা সাপোর্ট না থাকে আপনার জন্য টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। নিজের পায়ে দাড়িয়ে Come out করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
৭) Be prepared for negative outcome: আপনি ভেবেছেন মেনে নিবে কিন্তু নেয়নি। এমনটা হলে ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই। আমাদের সব সিদ্ধান্ত সবসময় সফল হয় না। জীবনে হ্যা না থাকবেই তাই বললে ভেঙ্গে পরলে হবে না। সব ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওার মানসিকতা রাখতে হবে।
সত্যি কথা কি, আমারও ইচ্ছা করে বাবা-মাকে বলতে। আমার এখন ২৫ বছর বয়স। ভালো একটা চাকরি করছি। বাসা থেকে মাঝে মাঝেই বিয়ের কথা বলে। তখন খুব বলতে ইচ্ছে হয়, “একটা ছেলে দেখ না!”। কিন্তু কঠিন বাস্তবতায় অনেক কিছু বলা হয় না। আশে পাশে, বন্ধু বান্ধব, অফিস কলিগ, বোন-কাজিন সবাই জানে। তাও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাবা মাকে বলতে। তাদেরও জানা উচিৎ আমাদের জীবনের কত কষ্ট। কিন্তু অপেক্ষা সঠিক সময়ের। তাদের টাকার হয়তো আমার দরকার নেই। কিন্তু কারণে অকারণে জালানোর জন্য হলেও বাবা-মা পাশে থাকা দরকার। নিতান্তই আমার ব্যাক্তিগত মতামত। কিন্তু যাই করুন না কেন ভেবেচিন্তে করুন।